প্রকৃতির ভুল
হোমেন বরগোহাঞি, Homen Borgohain
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল একটা বড় অর্থপূর্ণ কথা বলে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন– 'সোনালি কুয়াশা দেখতে যতই ভালো হোক না কেন আমি কিন্তু সূর্যের পরিষ্কার আলোই ভালোবাসি।'
সোনালি কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা নিসর্গের রূপ দেখতে সুন্দর হলেও সেটা তার আসল রূপ নয়। একমাত্র পরিষ্কার সূর্যালোকেই সমস্ত জিনিসের প্রকৃত এবং অবিকৃত রূপটি দেখা যায়। ঠিক সেভাবে তীব্র হৃদয়াবেগে জীবনের অনেক কথাকেই আমাদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুললেও একমাত্র যুক্তির নির্মল আলোতেই আমরা সেইসবের আসল রূপটা দেখতে পাই।
জীবনে আবেগের নিশ্চয় স্থান রয়েছে। জীবন কখনও যুক্তি সর্বস্ব হতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতিতে যেভাবে শীত–গ্রীষ্ম, রোদ-বৃষ্টি, অন্ধকার-আলো ইত্যাদি সমস্ত জিনিসেরই নিজের নিজের স্থান এবং সময় আছে, ঠিক সেভাবে মানব জীবনেও আবেগ এবং যুক্তির আলাদা আলাদা ভূমিকা রয়েছে। রবি শংকরের সেতার বাজানোর সময় বা সূর্যাস্তের গরিমাময় সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় আমরা নিশ্চয় আমাদের অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য যুক্তির আশ্রয় নিই না। আমরা সেইসব মুহূর্তে জীবনের পরম রহস্যের কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করি। কিন্তু প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটন করা কাজে যুক্তিই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। ভালো খারাপ কর্তব্য অকর্তব্য এবং উচিত-অনুচিত বিচারের সময়ও যুক্তির দ্বারা চালিত হওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।
কিন্তু যে সময়ে যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়, সেই সময় মানুষ আবেগের মাদকতা পরিহার করে চলতে অসুবিধা অনুভব করে। যুক্তিবাদের প্রবল প্রবক্তা বার্টান্ড রাসেলের জীবনে একাধিক উদাহরণ রয়েছে– যে সমস্ত কথা তিনি নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে রেখে গেছেন।' ম্যারেজ এন্ড মরেলস ' নামে সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে রাসেল যুক্তি সহকারে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেছিলেন নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা দেওয়া ঈর্ষা আসলে আদিম সংস্কার বা মানসিক বিকৃতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। সভ্য মানুষ ঈর্ষার বিষাক্ত প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে থাকার চেষ্টা করা উচিত। অন্যভাবে বলতে গেলে রাসেলের মতে যে কোনো নারী বা পুরুষ একই সময়ে একাধিক নারী বা পুরুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রাখতে পারে; এর জন্য কেউ কারও প্রতি ঈর্ষা অনুভব করা উচিত নয়। সেই রাসেল নিজে কিন্তু একবার করলেন কি– যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন করে তিনি জেলে থাকার সময় তার নবতমা যুবতী প্রেমিকা প্রতিদিন তাকে দেখতে এসে মাঝখানে মাত্র দুই দিন না আসার জন্য রাসেলের মনে সন্দেহ হতে লাগল যে যুবতটি নিশ্চয় অন্য কারও প্রেমে পড়েছে। ঈর্ষায় উন্মত্ত হয়ে রাসেল একই সঙ্গে চৌদ্দটি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন!
আবেগের পথ ছেড়ে যুক্তির পথ বেছে নেওয়া কত কঠিন সে কথা এই একটি মাত্র উদাহরণ থেকেই বুঝতে পারা যায়। অন্যদিকে ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টি আবেগের তীব্র মদিরার দ্বারা আরও বেশি সহজে উত্তেজিত হয়। তার ফলে আমরা দেখতে পাই– মানবজাতির ইতিহাস প্রধানত অন্তহীন রক্তাক্ত সংঘর্ষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং গণহত্যার ইতিহাস। আবেগের হাতে যুক্তি বারবার পরাজিত হয়েছে। বিস্তর অধ্যয়ন করে আর্থার কোয়েষ্টলার সেই জন্য এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে মানুষের এই আবেগ- প্রবণতা তথা হিংসা প্রবণতার মূল কারণ হল জৈবিক। প্রকৃতির ভুল বা অক্ষমতার জন্য মানুষের মস্তিষ্কের গঠনেই এরকম একটি বড় ত্রুটি থেকে গেছে যে লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের পরেও মানুষ এখনও হিংস্র আদিম আবেগের দাসত্বের বন্ধন ছিঁড়ে যুক্তিবাদী মুক্ত মানুষ হতে পারেনি। অন্যভাবে বলতে গেলে সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্ষীণ রঙ্গিণ প্রলেপের নিচে মানুষ এখনও আদিম পশু হয়ে রয়েছে ।
কিন্তু পরাজয়ের জন্য মানুষের জন্ম হয়নি। প্রকৃতির ভুল সংশোধন করে মানুষ একদিন নিজেকে নিখুঁত করে সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে। সে দিনই সমস্ত মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হবে।
( আর্থার কোয়েষ্টলার মানুষের মস্তিষ্কের গঠন সম্পর্কে যে তত্ত্ব তুলে ধরেছেন সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া পাঠকদের তাঁর 'Janus' গ্রন্থটি পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করছি)
----
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন