সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩

শব্দব্রাউজ ৮৩৪ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-834, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮৩৪ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-834, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮৩৪ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়া মেন রোড কলকাতা । ১৬। ৫। ২৩। সকাল সাতটা ।



শব্দসূত্র: অবাক পৃথিবীর কাছে



অবাক পৃথিবীর কাছে

আমার অক্ষর

কতদিন ধ্বংস থেকে

বাঁচবে?



অবাক সময় আমায় যোগায়

শব্দ

অবাক থেকে বাকপ্রতিমার

খেলা নাচায়!



শব্দের পর শব্দ দিয়ে

গড়ি ভাঙি

ভাঙি গড়ি ।


রবিবার, ২৮ মে, ২০২৩

শব্দব্রাউজ ৮৩৩ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-833, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮৩৩ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-833, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮৩৩ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়া মেন রোড কলকাতা । ১৫। ৫। ২৩। সকাল সাতটা ।



শব্দসূত্র: হাজারো শব্দের ভীড়ে



হাজারো শব্দের ভীড়ে

আমি কোনদিন

দিশেহারা হয়নি ।

বরং শিকার করি

নিহিত শব্দসম্ভার।



হাজারো শব্দের ভীড়ে

সারাদিন সারারাত

প্রাণপ্রতিষ্ঠা করি

কবিতার ।


অন্য কোন মন্ত্র লাগে না ।

শনিবার, ২৭ মে, ২০২৩

শব্দব্রাউজ ৮৩২ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-832, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮৩২ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-832, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮৩২ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ১৪। ৫। ২৩।



শব্দসূত্র : ঠিকঠাক শব্দ এলে



ঠিকঠাক শব্দের সঙ্গে

অবাক বন্ধুত্ব

কফি হাউসের কোলাহলে

মুছে যায় না।



কালো কফি খেতে খেতে

সে শব্দ আরও জোরালো হয়ে যায় ....



ঠিকঠাক শব্দ হলে

বিমূর্ত কি সুন্দর

মূর্ত হয়ে ওঠে!


শুক্রবার, ২৬ মে, ২০২৩

শব্দব্রাউজ ৮৩১ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-831, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮৩১ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-831, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮৩১ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়া মেন রোড কলকাতা । ১৩। ৫। ২৩। সকাল আটটা ।



শব্দসূত্র: ঝরো ঝরো বৃষ্টির অপেক্ষায়



ঝরো ঝরো বৃষ্টি

এখন

স্বপ্নে ধেয়ে আসে ।



টিনের চালের জল শব্দ

গ্রীষ্মের চাতক মন

ছুঁয়ে থাকে ।



বৃষ্টি শব্দ এখন সবচেয়ে প্রিয় ....



আটপৌরে- ১৪৫|| পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জির আটপৌরে কবিতা, Atpoure 145, by Pankaj Kumar Chatterjee

 আটপৌরে- ১৪৫|| পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জির আটপৌরে কবিতা, Atpoure 145, by Pankaj Kumar Chatterjee 






আটপৌরে কবিতা-১৪৫

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০২৩

শব্দব্রাউজ ৮৩০ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-830, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮৩০ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-830, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮৩০ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়া মেন রোড কলকাতা । ১২। ৫। ২৩। সময় সকাল ৬টা ৫০মিনিট ।



শব্দসূত্র: শান্তি, শান্তি



বাস্তবতার ক্ষতস্থানে

যে ভোর লাগায় প্রলেপ

তাকে নাম দিই

শান্তি ।



নিশ্চিন্ত সুখ কাঁধে হাত রাখলে

যে স্বাদ

তাকে অনায়াসে বলে দিই

শান্তি ।


আটপৌরে- ১৪৪|| পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জির আটপৌরে কবিতা, Atpoure 144, by Pankaj Kumar Chatterjee

 আটপৌরে- ১৪৪|| পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জির আটপৌরে কবিতা, Atpoure 144, by Pankaj Kumar Chatterjee 






আটপৌরে কবিতা-১৪৪


বন্ধু


কিছু পাওয়ার জন্য

হা-হুতাশ

আমি সমুদ্র পরস্পরকে বুঝি

আটপৌরে ৫৪৬|| সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 546 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৫৪৬|| সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 546 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৫৪৬

ব্রীজমোহন


ইনিংস। মেরামতের। রসদ। 


ব্রজবাসী 


ওভার শেষে সামান্য রাখাল।

বুধবার, ২৪ মে, ২০২৩

কিছু বই কিছু কথা - ৩১২ । নীলাঞ্জন কুমার হৃদি- জোছনার জল। মালা চক্রবর্তী,Hridi Jochonar Raat

 কিছু বই কিছু কথা - ৩১২ । নীলাঞ্জন কুমার





হৃদি- জোছনার জল। মালা চক্রবর্তী । বই টার্মিনাস,  বারাসাত,  কলকাতা- ১২৫। মূল্য ১৭৫ টাকা ।



একজন তরুণী কবি যখন তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করে,  তখন তাতে আবেগী প্রধানত আবেগের পাল্লা বেশি থাকে , প্রেমের দিকে জোর দেন বেশি , আর অহেতুক প্রচুর কথা বলার প্রবণতা লক্ষ্যণীয় । কবি মালা চক্রবর্তীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হৃদি - জোছনার জল ' এ এই তিনটি প্রভাব দারুন ভাবে স্পষ্ট । তাঁর কবিতাতে তাই উঠে আসে ' কেউ জানবে না,  শুধু আমরা জানব/  আমরা একসাথে কি ভীষণ ভিজছি ....' ( ' কোনও একদিন ') , ' নোনা জলে আজ সে বিস্তৃত/  কামাতুর সাগর তার সর্বাঙ্গ ছুঁয়েছে ।' ( ' পাহাড় নদীর রূপকথা '), 'সুনীল সমুদ্দুর , শোন/  তোমার মতো প্রেমিক পেলে/  কোন নারী না নীরা হতে চায়! ' ( ' সুনীল সমুদ্দুর ' ) ইত্যাদি ইত্যাদি ।
               যা হোক ' হৃদি-  জোছনার জল ' তে কবি তাঁর  নিজের প্রেমাতুর আবেগ উজাড় করার চেষ্টা করছেন । কিন্তু তার মধ্যে কিছু পংক্তির সন্ধান পাই যা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে : ' বর্ষার ফলার মতো রোদ্দুর নেমে এসেছিল পশ্চিমের আকাশ থেকে? ' ( বিসর্জনের বিকেল '), ' রাতারাতি ভিজে চলে,  ভেসে যায় জেব্রা ক্রসিং- / তবুও পদচিহ্ন মোছে না/  থামে না ম্যান্ডোলিন । ' ( 'থামে না ম্যান্ডোলিন ') , তাকে চন্দ্রকলা বলে রায় দাও তুমি/  প্রকাশ্য এজালাসে ।' ( ' চন্দ্রকলা')।
          কবি মালা চক্রবর্তীর এখনও নেশা কবিতা । তা যখন সাধনাতে পর্যবসিত হবে তা প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠবে । কবি নিজেকে শব্দ শ্রমিক ভাবতে পছন্দ করেন,  তা ভালো কিন্তু উত্তরণের প্রয়োজন আছে । ভবিষ্যতে আশা করব তাঁর প্রকৃত সাধনার ফসলের জন্য । সমীর দেবনাথের প্রচ্ছদ মন ভরায় ।

আটপৌরে- ১৪৩|| পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জির আটপৌরে কবিতা, Atpoure 143, by Pankaj Kumar Chatterjee

 আটপৌরে- ১৪৩|| পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জির আটপৌরে কবিতা, Atpoure 143, by Pankaj Kumar Chatterjee 






আটপৌরে কবিতা-১৪৩


চেনা


মানুষ চিনতে বাতেলা

নয়

কাজের খতিয়ান বিচার করো

আটপৌরে ৫৪৫|| সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 545 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৫৪৫|| সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 545 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৫৪৫

মধুযাম


বসন্তগান। ব্যাকুল।আম্রকাননে।


কুলায়ভরা


সখীনীড়ে সকল হৃদয় গান।

শব্দব্রাউজ ৮২৯ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-829, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮২৯ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-829, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮২৯ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়া মেন রোড কলকাতা । ১১।৫। ২৩। সময় সকাল ৬ টা ৫০ মিনিটে ।



শব্দসূত্র: অসহ্য আগুন দিন



আগুন দিনে

সকালে ভৈরবী তান

বিস্বাদ।


অগ্নিবীণা বাজানো থামাই ।


হয়ে উঠি

চাতকের মত

বৃষ্টি পিয়াসী ।



সব স্বপ্ন কেমন উধাও!


মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০২৩

আটপৌরে- ১৪২|| পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জির আটপৌরে কবিতা, Atpoure 142, by Pankaj Kumar Chatterjee

 আটপৌরে- ১৪২|| পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জির আটপৌরে কবিতা, Atpoure 142, by Pankaj Kumar Chatterjee 






আটপৌরে কবিতা-১৪২


দিব্যজ্ঞান


ফালি করতে থাকো

সরু

হলেও পাবে দুই পাশ

আটপৌরে ৫৪৪|| সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 544 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৫৪৪|| সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 544 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৫৪৪

বৈশাখী


অশোভন। মন্তব্যের। শেষাঙ্ক।


সহকার


অম্লমধুর দিনে কালবৈশাখী সহচর।

শব্দব্রাউজ ৮২৮ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-828, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮২৮ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-828, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮২৮ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়া মেন রোড কলকাতা । ১০। ৫।২৩। সময় ৮টা ।


শব্দসূত্র: হায় দিন যায়




হায় দিন যায়

নিষ্ফল জীবনের

সঙ্গে!



হায় দিন যায়

সব অন্ধকার সামনে

রেখে !


দিন যায় হাওয়ায়

মিশে

আমার সঙ্গে ছলনা করে ।

রবিবার, ২১ মে, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৩৬ ।। সন্তোষ কুমার কর্মকার ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudeb Das

হে আমার স্বদেশ- ৩৬

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত  বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ  মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম  পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে  বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার  সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের  অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

(৩৬)

 'বাঁহী' প্ৰকাশ করার আয়োজন শুরু হল। কিন্তু একটা পত্রিকা বের করা সাধারণ কাজ নয়। তারমধ্যে এখন আবার সঙ্গে সুপরামর্শদাতা এবং টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করা মাজিউ নেই, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সাহায্য করার হেম গোঁসাই নেই। বের করতে হলে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় পত্রিকাটা বের করতে হবে। কষ্ট হবে। খুবই কষ্ট হবে। কষ্ট হলেও 'বাঁহী' বের করতে হবে। এখন 'বাঁহী' বের করাটা তার কাছে, তার লেখক জীবনের জন্য একটি বড়ো প্রত্যাহ্বান। লক্ষ্মীনাথ মনে মনে কঠোর সংকল্প গ্রহণ করল।

একটা সাহিত্য পত্রিকার জন্য প্রথম কাজটা হল লেখক- কবি- প্রবন্ধকারের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেখা দেবার জন্য অনুরোধ করতে হবে। তারা লেখবে, লেখার পরে সম্পাদককে পাঠাবে, লেখা পাওয়ার পরে সেগুলির সম্পাদনা… পর্যায়ক্রম পরিক্রমা গুলি সময় সাপেক্ষ। লক্ষ্মীনাথের হাতে এত সময় নেই। সে সকাল, বিকেল, গভীর রাত পর্যন্ত লিখতে লাগল। কবিতা,প্রবন্ধ,রম্য রচনা ইত্যাদি নিজের লেখা। লেখাগুলি আলাদা আলাদা নামে লিখবে। এই কাগজটাও বত্রিশ পৃষ্ঠার হবে। হরিনাথকে পাঠিয়ে ঘরের কাছে থাকা 'সালকিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস' এর মালিককে ডেকে আনল। লক্ষ্মীনাথ কেবল কাঠের ব্যবসায়ী নয় বা ঠাকুর বাড়ির জামাই নয়। হাওড়া কোর্টের সম্মানীয় ম্যাজিস্ট্রেট। ইতিমধ্যে বহু জটিল মামলার রায় দিয়ে সুনাম অর্জন করেছে। অসমিয়া হয়েও সে এখন হাওড়ার বাঙালি সমাজে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। তাই সালকিয়া প্রেসের মালিক দায়িত্ব সহকারে ‘বাঁহী’র মুদ্রণের কাজ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল।

 এই সময় রোহিণী এবং যতীন্দ্রনাথ কলকাতার কলেজে পড়তে থাকা অসমিয়া ছাত্রদের কাছ থেকে প্রবন্ধ সংগ্রহ করে লরেলসে এল। লক্ষ্মীনাথের হাতে সেসব তুলে দিয়ে রোহিণী বলল,' স্যার আপনি তিন মাসের মধ্যে আঠারোটা প্রবন্ধ চেয়েছিলেন। এখানে তেইশটা প্রবন্ধ আছে।'

 'তেইশটা প্রবন্ধ!'

 'আপনি নিজে কাগজ বের করবেন শুনে আমাদের ছাত্ররা এতটাই উৎসাহিত হয়ে পড়েছে যে অনেকেই লেখা দিয়েছে। আরও দুই চার জন দেবে।তাঁরা লিখছে।'

 'বড়ো আনন্দের কথা। আপ্লুত হয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল, 'তবে তোমরা দেখছি বড়ো দুষ্টু ছেলে। আমি সেদিন তর্জন গর্জন করে তোমাদের প্রস্তাবটা উড়িয়ে দিলাম, এখন তোমরা আমাকে ভালো ফাঁদে ফেলেছ।'

 মুচকি হেসে যতীন্দ্রনাথ বলল' আমাদের দিকে হাতির দাঁত একবার বের হলে আর ভেতরে ঢোকে না, তবে আপনাদের কলকাতার হাতির দাঁত কী ধরনের, সেটা বলতে পারছি না।'

 'কলকাতার হাতির দাঁত তোমাদের দিকের মতোই। কিন্তু আমি যে 'বাঁহী'র প্রথম সংখ্যার জন্য লেখার তালিকা ঠিক করে ফেলেছি। এদিকে আমাকে আবার পরশুদিন ঝাড়চোগড়া যেতে হবে। আচ্ছা প্রবন্ধ গুলি রেখে যাও। দেখা যাক কী করা যায়।

 স্বনাম খ্যাত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সম্পাদনায় প্রকাশ পেতে চলা'বাঁহী'তে লেখা বের হবে, রোহিণী এবং যতীন্দ্রনাথ মনে আশা নিয়ে চলে গেল। লক্ষ্মীনাথ যুবক মনের আশা আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারে। তবে এখন আর উপায় নেই। তাছাড়া 'বাঁহী'র প্রথম বছরের প্রথম সংখ্যা‐ লেখাগুলি ভালো হতে হবে। নতুন লেখকের লেখাগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে সময় লাগবে। তাই লক্ষ্মীনাথ রোহিণী যতীন্দ্রনাথ দিয়ে যাওয়া লেখাগুলি দেখল যদিও সেগুলি থেকে কোনো প্রবন্ধ নির্বাচন করল না। রাত দুটো পর্যন্ত নিজের লেখাগুলি সম্পাদন করে চূড়ান্ত রূপ দিল। পরের দিন সকালে ঝাড়চোগড়ায় চলে যাওয়ার সময় চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা লেখার ফাইলটা 'সালকিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস' এ  দিয়ে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠল।

 ঝাড়চোগড়া যাওয়াটা হল ব্যবসায়িক কারণ।ব্যবসা হল লক্ষ্মীনাথের জীবিকা।জীবিকার উপায় ঠিক না রাখলে পত্নী,তিনটি কন্যার সঙ্গে নিজের বেঁচে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।আরও একটি বড়ো প্রশ্ন।এই প্রশ্নটির সমাধান না থাকলে কীভাবে সাহিত্য চর্চা করবে?এদিকে স্বদেশ-স্বজাতির জন্য নিজের চেতনা-বোধ কর্মশক্তি বিনিয়োগ করলেও বিনিময়ে বৈষয়িক লাভ কিছুই পায় না।স্বদেশের অবস্থা এতই শোচনীয় যে স্বজাতির কেউ সাহিত্যিকের জীবিকার সংস্থান দেয় না।তাই সাহিত্যের মাধ্যমে দেশ-জাতির জন্য যতই যা করুক না কেন,সেটা হল ত্যাগ।চিন্তা-চেতনা উজার করে দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করা।এই নেশা,দেশ-জাতিকে ভালো্বাসার নেশা।ভালোবাসার স্বর্গীয় নেশাটাই অন্তরে সৃষ্টি করে এক দেবসুলভ প্রেরণা।তারজন্যই ঝাড়চোগড়া গিয়ে ব্যবসায়িক কাজটা করতে গিয়েও লক্ষ্মীনাথ অনবরত ‘বাঁহী’র কথা ভাবল।

 আর বারো দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরে সালকিয়া প্রেছ থেকে ‘নহি জ্ঞানেন সদৃশংপবিত্রমিহ বিদ্যতে’মন্ত্রের সাহায্য নিয়ে ১৮৩১ শকের আঘোন মাহে (১৯০৯ সনের নভেম্বর মাস )ডিমাই আকারে মাসিক কাগজে ‘বাঁহী’বের হল। 

 ‘বাঁহী’র প্রচ্ছদ পরিকল্পনা লক্ষীনাথ বেজবরুয়ার প্রচ্ছদটা হল নদীর তীরে একটা গাছের নিচে একজন নারী বসে বাঁশী বাজাচ্ছে।গাছটার ডালে বসে আছে একটা দীর্ঘ পুচ্ছধারী ময়ূর।প্রকাশক হল,লক্ষ্মীনাথের ভাই হরিনাথ বেজবরুয়া।প্রকাশকের ঠিকানা হল –আসাম-বেঙ্গল স্টোর্স,২ নং লালবাজার স্ট্রীট,কলকাতা।মূল্য-বছরে এক টাকা আট আনা।প্রচ্ছদের পরে পত্রিকাটি একটি কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে।পত্রিকাটির নাম প্রতিপন্ন করা কবিতাটি হল,

‘ত্রিভুবন মাঝে যত বস্তু মধুময় 

সে সবের সারবস্তু করে এক জায়গায় ,

পূরণ করলি উদর তোর বাঁহী অমিয়া; 

প্রেমকে মাগিছে কণা পূর্ণ করি হিয়া।...’

 আর বিষয় সূচি হল –রসাল গল্প ‘জগরা মণ্ডলের প্রেমাভিনয়’,বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ‘রেডিয়ামের কথা’, ‘আনন্দরাম বরুয়ার জীবন চরিত’,কৃপাবর বরুয়ার ছয়টি কবিতা,এবং প্রবন্ধ ‘অসমিয়া ভাষা সম্পর্কে দুই একটি কথা’।প্রথম সংখ্যার বাঁশিতে সম্পাদকীয় লিখল না যদিও শেষের প্রবন্ধটিতে লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া জাতিকে উদ্দেশ করে অনুপ্রেরণামূলক একটি বাণী প্রকাশ করল,

 ‘...আমাদের অসমিয়া বন্ধুদের একটা কথা কঠিনভাবেই বলছি যে আপনারা মূল্যবান বলে জানবেন যে –অসমিয়া ভাষার উন্নতি ,অসমিয়া সাহিত্যের উন্নতি অসমের উন্নতির প্রথম সোপান।আমরা একান্তমনে পরিশ্রম করে তার উন্নতির অর্থে লেগে পড়লে নিশ্চয় আমাদের যত্ন ফল ফলাবেই।আমাদের শরীর থেকে মিথ্যা অসম্মান গিয়ে তার জায়গায় প্রকৃত আত্মসম্মান এলে আমরা এভাবে মুজরা লেগে থাকতে পারি না। এসব  পাবার প্রধান উপায় জ্ঞান উপার্জন, বিদ‍্যা উপার্জন এবং মাতৃভাষার উন্নতি সাধন। স্বদেশ এবং স্বজাতির উন্নতি এবং মঙ্গল মন্দিরের সিংহ দুয়ার হল মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষার সেবক হয়ে প্রগাঢ় ভক্তি ভরে তার কুশলের অর্থে নিজের এই নশ্বর দেহের সমস্ত ক্ষমতা সমর্পণ করে আমরা আমাদের কর্তব্য কর্ম করে গেলে নিশ্চয় অচিরে মঙ্গল রূপ উন্নতির কীরিটি অসম মাতৃর  মাথায় শোভা পাবে।

 ২নং লালবাজার আসাম বেঙ্গল স্টোর্স থেকে প্রকাশিত 'বাঁহী' হাতে নিয়ে কলকাতায় পড়তে আসা অসমিয়া ছাত্রদের সেকি আনন্দ বর্ণনা করা যায় না। লক্ষ্মীনাথ ছাত্রদের জমা দেওয়া কোনো প্রবন্ধই প্রথম সংখ্যায় প্রকাশ করেনি। তার জন্য ছাত্রদের মনে কোনো ক্ষোভ নেই। অবশ্যই দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে সেগুলোর মধ্যে বেছে নিয়ে প্রবন্ধ গুলি 'বাঁহী'তে প্রকাশিত হতে লাগল। তারপর ছাত্রদের অনুরোধে আগে ইংরেজি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হওয়া 'বাঁহী' অসমিয়া মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রকাশিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

 গতকাল রাতে এক প্রহর পর্যন্ত লেখার কাজ করল। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল। আজ রবিবার। অত্যন্ত জরুরী কিছু না থাকলে লক্ষ্মীনাথ রবিবার ব্যবসার কোনো কাজ করে না। ধীরে ধীরে ঘুম থেকে উঠে সাহেবদের মতো বাসিমুখে এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট জ্বালায়। আজ চা খেয়ে সিগারেট অগ্নিসংযোগ করে রাতের পোশাকেই ঢাকাই চপ্পল জোড়া পরে  বাইরের ফুলবাগানে বেরিয়ে এল। বাগানের প্রতিটি গাছ ,নতুন করে লাগানো প্রতিটি চারার সে নিজের হাতে যত্ন নেয়। বুড়ো মালি হরি বাগানের দেখাশুনা করে যদিও কোন গাছ কোথায় লাগাবে, কোন গাছের গোড়ায় সার দেবে, কোন গাছের কলম দিয়ে নতুন করে লাগাতে হবে, লক্ষ্মীনাথ শৈশব নির্দেশ দেয়। সিগারেট হাতে নিয়ে ছোটো ছোটো করে টান দেয় এবং অদ্ভুত মমতায় গাছের চারা গুলি, গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। আজও তাই করছিল। একটি কাশ্মীরি গোলাপ গাছকে হেলে পড়তে দেখল। একটা কামি খোঁজ করে এনে হাতের সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে ধরে হেলে পড়া গাছটাকে নিজেই দাঁড় করিয়ে দিল।

 এমনিতেও নিজের পরিকল্পনা অনুসারে 'বাঁহী' প্রকাশ করতে পেরে এবং'বাঁহী'কে ছাত্র তথা শিক্ষিত অসমিয়া জনগণ সাদরে বরণ করে নেওয়ায়'উষা' থেকে পাওয়া অপমানের জন্য অস্থির হওয়া লক্ষ্মীনাথ মানসিকভাবে শান্ত হয়ে পড়েছে। ব্যবসা চালানোর অতিরিক্ত  নিয়মিতভাবে 'বাঁহী'র প্রকাশ করার জন্য দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অথচ তার জন্য খুব একটা ক্লান্তি অনুভব করে না। উল্টে অন্তরের গভীরতা থেকে একটি শক্তি পায়। হেম গোঁসাইয়ের বক্তব্য অনুসারে, সত্যিই তার জীবন আগের চেয়ে গতিশীল হয়েছে। তার হাত দিয়ে প্রকাশিত লেখাগুলি আগের চেয়ে পরিণত হয়ে উঠছে মনে হয়।

রবিবারের দিনটা লক্ষ্মীনাথ বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে কাটায়। পয়তাল্লিশ বছর অতিক্রম করা মধ্য বয়স্ক উঁচু মজবুত স্বাস্থ্যের অধিকারী লক্ষ্মীনাথ এমনিতেই ছোটোদের মতো করে তিন মেয়ের সঙ্গে  খেলাধুলা করে। বিচ্ছেদের দিকে নিজের ঘোড়া গাড়ি নিয়ে সবাইকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। গাড়িতে লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞা একসঙ্গে বসে, অরুণা বসে মায়ের বাঁ পাশে, রত্না বসে বাবার ডান পাশে এবং ছোটো দীপিকা বসে মা অথবা বাবার কোলে। কলকাতার রাজপথ দিয়ে ঘোড়ার খুরের খটখট শব্দ তুলে গাড়ি এগিয়ে যায়। গাড়িতে বসে উৎফুল্লিত রত্না এবং দীপিকা পথের দুপাশের দোকানপাট অট্টালিকা দেখে এটা ওটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। কন্যাদের প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো প্রজ্ঞার এত ধৈর্য থাকে না। অথচ বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে লক্ষীনাথ ওদের কৌতূহল ভরা প্রতিটি প্রশ্নের মনোযোগ সহকারে উত্তর দেয়। লক্ষ্মীনাথের নির্দেশ অনুসারে কোচোয়ান কোনোদিন গাড়ি নিয়ে যায় ইডেন গার্ডেনের দিকে, কোনোদিন গঙ্গার পারে, কোনোদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে, কোনোদিন জোড়াসাঁকোতে অথবা অন্য কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে…।

 আজও সেভাবে প্রত্যেকেই বের হওয়ার কথা। কিন্তু প্রজ্ঞার শারীরিক অসুবিধা হওয়ার জন্য বের হল না। এদিকে ক্লাবে গিয়ে বিলিয়ার্ডস খেলা নেই, ক্লাবে যেতে ইচ্ছা করল না। বাইরের বাগানে উত্তর দিকে কোমল ঘাসের মধ্যে তিন মেয়ে এবং কাজের ছেলে ফটিক দৌড়াদৌড়ি করছে। গোধূলি নেমে আসার সঙ্গে অন্য দিনের মতো সামনের গেট খুলে যতীন্দ্রনাথ ভেতরে চলে এল। তাকে দেখে অরুণা- রত্না খুব খুশি হল। তার মানে অরুণা- রত্না বুঝতে পারল, আজও বাবা নিশ্চয়ই যতীন্দ্রনাথকে নিয়ে শুরু করবে অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাকে নিয়ে ফুর্তি করবে। তার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথ বলল,' ও বাবা যদু, এসো–।'

 লক্ষ্মীনাথ তারপরে যতীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ব্যবহারের জন্য রাখা ঘরে গিয়ে বসল।

 যতীন্দ্রনাথ দুয়ারার  জন্ম ১৮৯২ সনের ৪ মার্চ। সেও শিব সাগরের। ১৯০৯ সনে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। ইতিমধ্যে গুয়াহাটিতে কটন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কলেজটি  ভালোভাবেই চলছে। অসমে কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষার্থে যতীন্দ্রনাথ  কলকাতা এল। এখন সে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের বি এ ক্লাসের ছাত্র। স্কুলের ছাত্র অবস্থায় যতীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে শুরু করে। সে ব্যক্তি লক্ষ্মীনাথের ভক্ত এবং সাহিত্যিক লক্ষ্মীনাথের একজন অনুরাগী পাঠক।

 কলকাতা আসার পরই যতীন্দ্রনাথ লক্ষ্মীনাথের বাড়ি খুঁজে বের করে। উনিশ-কুড়ি বছরের শান্ত এবং ভাবুক প্রকৃতির সুদর্শন যুবক যতীন্দ্রনাথকে লক্ষ্মীনাথ ভালোবেসে ফেলে।'বাঁহী' সম্পাদনার কিছু কিছু কাজ যতীন্দ্রনাথ করে দেওয়ার ফলে দুজনের সম্পর্ক আন্তরিক হয়ে পড়ে। বয়সের এত পার্থক্য যদিও লক্ষ্মীনাথ যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে সমবয়সী বন্ধুর মতো আচরণ করে। জ্ঞান বুদ্ধির সঙ্গে রস-বোধ থাকা আধুনিক মনের অধিকারী লক্ষ্মীনাথের প্রতি যতীন্দ্রনাথও নিবিড় এক আকর্ষণ অনুভব করে। প্রায় প্রতিদিন গোধূলি বেলা লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে সাহিত্য ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে। আলোচনা করতে গিয়ে কখন যে রাত সাড়ে আটটা নটা বেজে যায় জানতেও পারে না। সঙ্গে চলে প্রজ্ঞা পরিবেশন করা চা-জল খাবার আহার। কোনো কোনো দিন রাতের আহার খেয়ে যতীন্দ্রনাথ মেসে ফিরে যায়। এভাবে জ্ঞানদাভিরামের মতোই যতীন্দ্রনাথও লক্ষ্মীনাথের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে পড়ে।

 ' তারপরে, এবারের 'বাঁহী'তে প্রকাশিত লেখাগুলি পড়ে তোমাদের মেসের যুবকদের কীরকম লেগেছে?'

 যতীন্দ্রনাথ বলল' ভালোই পেয়েছে। তবে কাল আমাদের মেসে প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত' অসমিয়া ভাষার সম্পর্কে দু একটি কথা' প্রবন্ধটির শেষের দিকে আপনি যে' স্বদেশ এবং স্বজাতির উন্নতি এবং মঙ্গল মন্দিরের সিংহ দুয়ার  হল মাতৃভাষা' বলে একটা বাক্য লিখেছিলেন সেটা নিয়ে পুনরায় আলোচনা হল। কথাটা মন্ত্রের মতো হয়ে পড়েছে। আমাদের ছাত্ররা কথাটা উচ্চারণ করে জাতীয়তা বোধে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে।'

 ' দ্বিতীয় সংখ্যার'বাঁহী'তে যে উষার সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে' আত্মকথা'য় লিখেছিলাম–?'

 ' কোন কথাটা কাকাবাবু?'

 ' এই যে‐।' বলেই টেবিলের বাঁ পাশে রাখা দ্বিতীয় সংখ্যা'বাঁহী'ৰ পাতা উল্টে লক্ষ্মীনাথ পড়তে লাগল,' কাগজে অনেক কর্তব্যের ভেতরে গ্রাহক-পাঠক' সৃজন' করা ও উচিত। কাগজ সেই কাজে অক্ষমতা দেখিয়ে, দোষের পাহাড়টা শুধু নিরুপায় গ্রাহকের ওপরে'হুঃ' বলে ফেলে দেওয়াটা মস্তিষ্কের সাহায্য বিবর্জিত বীরত্ব হতে পারে; কিন্তু ধর্মবুদ্ধির কাজ যে নয় সেটা আমরা নির্ভয়ে বলতে পারি।'

 ' মোক্ষম। আপনি মোক্ষম আঘাত হেনেছেন। তবে তার প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ পেয়েছে। আপনার লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পরেই পদ্ম বরুয়া'উষা'য় ' পুরোনো কথায় নতুন রং' বলে একটি প্রবন্ধের দ্বারা আপনাকে সাবধান করে দিয়েছে।’

 'ক্রোধ প্রকাশ করেছে। এভাবে রাগ দেখালে তো হবে না। কথাগুলি যুক্তির সাহায্যে প্রতিপন্ন করতে হবে। আর এখানেই শেষ নয়। অপকর্মের জন্য পদ্ম বরুয়াকে আর ও কিছু পেতে হবে। আচ্ছা, এখন তোমার কথা বল। তুমি কবি। কবিতা লেখায় তোমার মন। আমিও কবিতা লিখি। লিখি মানে লেখার চেষ্টা করি। তবে সেগুলি কবিতা হয়ে উঠে না বলে মনে হয়। ভালো কবিতা লিখতে হলে কী কী গুণ দরকার বলতো?'

 ‘ইস কাকাবাবু আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন।আমি আপনাকে কবিতা লেখার জন্য কী কী গুণের দরকার সেকথা বুঝিয়ে বলতে পারব?’

 ' তুমি যে 'বাঁহী'র এই বছরের প্রথম সংখ্যায় ' মাঝি' বলে কবিতাটি লিখেছিলে, সেটা আমি লেখা কবিতা থেকেও ভালো হয়েছে। আসলে, তুমি একটা বিষয়ে ভালোভাবে বুঝে নিয়ে নিজের চেতনায় উপলব্ধি করে কবিতা লেখ। আমি এত ভাবনা-চিন্তা করে কবিতা লিখিনা, লিখতে পারিনা।'

 কিছুক্ষণ চিন্তা করে যতীন্দ্রনাথ বলল,' গত বুধবার আমাদের ইংরেজির সুধীন বোস স্যার ক্লাসে রোমান্টিক কবিদের কথা বুঝিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, অনুভবের আন্তরিকতা, ভাবের সৌকুমাৰ্য, প্রকাশভঙ্গির মাধুর্য এবং ছন্দের সাবলীল গতি কবিতা হৃদয়সংবাদি হয়ে ওঠে।'

 'বাহ! সুন্দর! সুন্দর কথা বলেছেন বোস স্যার। তুমিও বোস স্যারের ভাব গম্ভীর কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছ। এটাই প্রমাণ করে, তুমি কথাগুলি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছ। বড়ো সুখী হলাম। তোমার মধ্যে আমি অসমিয়া সাহিত্যের একজন প্রতিভাবান কবিকে খুঁজে পেয়েছি। তুমি লেখ, কবিতা লেখ।'

 এমন সময় রেকাবিতে মালপোয়া, মিষ্টি সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে কাজের মেয়েটি ভেতরে প্রবেশ করল। যতীন্দ্রনাথের দিকে খাওয়ার জিনিসের রেকাবিটা এগিয়ে দিয়ে খেতে বলে সে বেরিয়ে গেল।

 যতীন্দ্রনাথ খেতে শুরু করেছে মাত্র, তখনই লক্ষ্মীনাথ শিখিয়ে দেওয়া মতে কাজের ছেলে ফটিক চুপিচুপি ঘরের ভেতরে এসে তাদের সামনের টেবিলের নিচে ঢুকে গেল। তারপর মশার মতো গুনগুন শব্দ করে ফটিক যতীন্দ্রনাথের পায়ে চিমটি কাটল।

 চমকে উঠে যতীন্দ্রনাথ বলল,' কাকাবাবু আমাকে কিছু একটা কামড়েছে।'

কিছুক্ষণ পরে ফটিক আবার চিমটি কাটতেই যতীন্দ্রনাথ খাওয়ার জিনিস ফেলে লাফিয়ে উঠল। ঘরের ভেতর থেকে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে ফোঁপাতে লাগল।

 যেন কিছুই জানে না এরকম একটা ভাবে লক্ষ্মীনাথ' কী হয়েছে যদু বাবা, তোমাকে কিসে কামড়াল' বলে যতীন্দ্রনাথকে সান্তনা দিতে লাগল। কিন্তু যতীন্দ্রনাথ এতই ভয় পেয়েছে যে সে আর শান্ত হচ্ছে না। লক্ষ্মীনাথ তাকে ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে এল। গ্লাসে এক পেগ মদ ঢেলে দিয়ে যতীন্দ্রনাথকে  খেতে দিয়ে বলল,' তুমি আসলে ভয় পেয়েছ। খাও, এটা খেয়ে নাও। তাহলেই তোমার মনের ভয় নাই হয়ে যাবে।'

 কিন্তু মদ খাওয়ার পরে যতীন্দ্রনাথ আরও বেশি উত্তেজিত  হয়ে পড়ল। ভয় উত্তেজনায় অস্থির যতীন্দ্রনাথ কে শান্ত করার জন্য লক্ষ্মীনাথ তারপরে এক ঘটি জল এনে তার মাথায় ঢেলে দিল। দৃশ্যটা দেখে অরুণা, রত্না ,প্রজ্ঞা ফটিকের সেকি হাসি! তারপরে প্রত্যেকের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথও হাসতে লাগল।

 ভাই হরিনাথকে ম্যানেজার বানিয়ে ব্যবসার উন্নতি হল না। নিজে কাজ না করে সে কর্মচারীর ওপরে বেশি নির্ভর করে। তার জন্য লক্ষ্মীনাথ তাকে গালিগালাজ করে। তবু হরিনাথের চরিত্রের সংশোধন হল না। এদিকে লেখালেখি এবং 'বাঁহী'প্রকাশের কাজকর্মের জন্য তাকে হরিনাথের ওপর নির্ভর করতেই হয়। তাই ব্যবসায় যতটুকু আয় হওয়ার কথা সেটা হচ্ছে না।

 আয় হচ্ছে না যদিও লক্ষ্মীনাথের সাংসারিক খরচ কমেনি। আয়া, রাঁধুনি কোচো য়ান ,মালিকে বেতন দিতে হয়। অরুণা এবং রত্নাকে খরচ বহুল সেন্ট এজেন্স স্কুলে ভর্তি করিয়েছে । ওদের সাজ- পোশাক, বইপত্রের খরচ ছাড়াও প্রাইভেট টিউটরের বেতন দিতে হয়। অরুণা যাতে পিয়ানো শিখতে পারে তার জন্য ব্রিটিশ শিক্ষয়িত্রী  মিসেস ব্রাউনকে নিযুক্ত করেছে।

 এমনিতেও লক্ষ্মীনাথের খরচের হাত লম্বা। উপার্জনের পরিমাণ চিন্তা করে সে খরচ করতে পারে না, করতে জানেও না। অন্যদিকে কিছুদিন ধরে দেশ ভ্রমণের শখটাও বেড়েছে। আর্থিক অবস্থা এত সুবিধাজনক নয় যদিও মে মাসের কলকাতার গরমে অতিষ্ঠ হয়ে লক্ষ্মীনাথ পুরী যাত্রা করল। এই যাত্রা একা নয়। প্রজ্ঞা এবং মেয়ে তিনটি কে সঙ্গে নিয়ে। তাদের সঙ্গে ইতিমধ্যে ভোলানাথ আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তক নেওয়া পুত্র ভুবনও সঙ্গী হল।

 পুরী বলতেই অসমিয়াদের মনে ভেসে উঠে পুণ্যতীর্থ জগন্নাথ ধাম মন্দিরের বৈকুণ্ঠ ধাম। লক্ষ্মীনাথের মনেও সেই ভাব রয়েছে। কিন্তু মন্দিরের চেয়ে তাকে বেশি আকর্ষণ করে সাগর। দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল বঙ্গোপসাগর। তার জন্যই পুরীতে এসে ১৫০ টাকায় বন্দোবস্ত করা ' অনাথ কটেজ'এ সবাইকে নিয়ে উঠেই লক্ষ্মীনাথ সাগর পারে চলে এল। অনন্ত পর্যন্ত প্রসারিত সফেন সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে এতটাই আহ্লাদিত হয়ে পড়ল যে তখনই জলে নেমে পড়ল। উত্তাল সাগরে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে পরম তৃপ্তি লাভ করল।

 খবর পেয়ে লক্ষ্মীনাথের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা পান্ডার বংশধর ভুটু পান্ডা ' অনাথ কটেজ'এ এল। ভুটু পান্ডা অসমিয়াতে কথা বলল। অসাম থেকে সুদূর উড়িষ্যায় অবস্থিত জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডার মুখে অসমিয়া ভাষা শুনে লক্ষ্মীনাথের খুব ভালো লাগল। ভুটু পান্ডার সঙ্গে মন্দিরের বিষয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল। তিনিই মন্দির দর্শন করিয়ে বিকেলের দিকে' মহাপ্রসাদ' পাঠিয়ে দিলেন।

 দুদিন পরে ভুটু পান্ডা মন্দির থেকে পুনরায়' মহাপ্রসাদ' আনার সঙ্গে পনেরোজন ব্রাহ্মণ ডেকে আনলেন। ব্রাহ্মণভোজন করালে নাকি চৌদ্দ পুরুষের পুণ্য হয়। শুধু ভোজন করানোই নয়, ভোজনের পরে ব্রাহ্মণদের দক্ষিণাও দিতে হবে। পনেরো জন ব্রাহ্মণের সঙ্গে পরিবার এবং ভুবনের সঙ্গে  বসে লক্ষ্মীনাথ' মহাপ্রসাদ' ভোজন করল। লক্ষ্মীনাথ এবং ভুবনকে তার জন্য আট টাকা এবং পাঁচ টাকা দক্ষিণা দিতে হল। তারপর তারা পান্ডা দেওয়া 'ঘোটা' পান করল। কম মাত্রায় পান করেও কাঢ়া ' ঘোটার' নেশায় দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। লক্ষ্মীনাথের অবস্থা দেখে বিরক্তি- ক্রোধে প্রজ্ঞা 'এত বয়স হল তথাপি মানুষটার কাণ্ডজ্ঞান হল না! তীর্থ করতে এসে কী সব ছাইপাশ গিলছ!' বলে বকাবকি করল। লক্ষ্মীনাথের খারাপ লাগল। অনুতপ্ত সুরে বলল,' ভেরি সরি, পরী এসব আর খাব না।'

 পরের দিন সকালে জেগে উঠার পরেও লক্ষ্মীনাথ মাথা তুলতে পারল না। জোর করে উঠে সাগরে স্নান করার পরে কিছুটা সুস্থ বোধ করল। সেদিনই বিকেল ছটার ট্রেনে কটক থেকে হাওড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।

 বাড়িতে এসেও লক্ষ্মীনাথের শরীর ভালো হল না। পুনরায় জ্বর এল। পরিবারের ডাক্তার সত‍্যব্রত মিত্রকে ডেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে ঔষধ খাওয়ার দুদিন পরে সুস্থ হল। তখনই খবর পেলেন গোলাঘাটে মা ঠানেশ্বরী বিছানায় শয্যাশায়ী। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে লক্ষ্মীনাথ অস্থির হয়ে পড়ল। অফিসে গিয়ে গত কয়েকদিনের কাজকর্ম দেখে আগামী ১৪-১৫  দিনে কী কী করতে হবে, হরিনাথ এবং কেরানি সুধন্য বসাককে শিখিয়ে পরিয়ে দিয়ে লক্ষ্মীনাথ গোলাঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হল ।

 দীননাথ বেজবরুয়া মহাশয়ের কনিষ্ঠা পত্নী ঠানেশ্বরী হল কবি অনন্ত কন্দলির কুলের সন্তান। ঠানেশ্বরীর পিতা ছিলেন তনু বরপূজারী। লক্ষ্মীনাথের শৈশবে মাতা ঠানেশ্বরীর  খুব একটা ভূমিকা ছিল না। কারণ তখন একদল ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের ছিল ভরা সংসার। ঘর সংসারের দায়- দায়িত্ব পালন করে লক্ষ্মীনাথের জন্য ঠানেশ্বরী সময় দিতে পারত না। তা বলে লক্ষ্মীনাথ যে স্নেহ ভালোবাসা পায়নি তা নয়। জন্মের পরেই বড়মা( দীননাথের প্রথমা পত্নী) তাকে দেখাশোনা করেছিল। বড়ো মায়ের সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করত, ঘুমোত। তার জন্য ঠানেশ্বরীর কোনো দুঃখ ছিল না। শিবসাগর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসার পরে লক্ষ্মীনাথ মায়ের স্নেহ ভালোবাসা উপলব্ধি করল। নিজে যখন পিতা হল, প্রজ্ঞার মধ্যে যখন নারীর মাতৃত্বের রূপ প্রত্যক্ষ করল, তখন মায়ের প্রতি স্নেহের আকর্ষণটা আরও নিবিড় হয়ে উঠল। দুই বছর আগে বড়ো বৌদি এবং শ্রীনাথ দাদার সঙ্গে পুরী, গয়া আদি তীর্থস্থান দর্শন করে ঠানেশ্বরী  কলকাতায় এসেছিলেন। তখন লক্ষ্মীনাথ মাকে কিছুদিনের জন্য এখানে থাকতে বলেছিল। কিন্তু ঠানেশ্বরী কলকাতায় থাকলেন না। সঙ্গে রেখে সেবা-যত্ন করার সুযোগ না পেলেও লক্ষীনাথ মায়ের কাছে প্রায়ই টাকা পাঠাত।

 দুদিন পরে গুয়াহাটি, গুয়াহাটি থেকে রেলে ফরকাটিং, ফর কাটিং স্টেশন থেকে গরুর গাড়িতে বিকেল তিনটের সময় গোলাঘাটে শ্রীনাথ দাদার বাড়িতে এসে দেখল, ঠানেশ্বরী শয্যাশায়ী। অসুখ-বিসুখে শুকিয়ে দুর্বল হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। মুখটা কালো হয়ে গেছে। চোখ দুটো বসে গেছে। সাদা চুলগুলি বিবর্ণ-ধূসর। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে লক্ষ্মীনাথ ডাকল,' মা–।'

 ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকিয়ে ঠানেশ্বরী লক্ষ্মীনাথকে চিনতে পারল। শুকনো ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠল। ক্ষীন কন্ঠে বলল,' লখী, কলকাতা– কলকাতা থেকে এলি–।'

 'হ্যাঁ মা।'

 'বৌমা, নাতনি তিনজন?'

 লক্ষ্মীনাথ নিজেকে আর সামলাতে পারল না। দুই চোখ জলে ভরে উঠল। কোনোমতে বলল,' ওরা ভালোই আছে।'

 এটা ঠানেশ্বরীর অন্তিম অবস্থা। দাদা শ্রীনাথ মায়ের চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করেনি। কিন্তু ডাক্তার- বৈদ্য আশা ছেড়ে দিয়েছে। লক্ষ্মীনাথ অসহায় বোধ করল। জন্মদাতৃর অন্তিম অবস্থায় তাঁর কিছুই করার নেই।

 বুকে গভীর বেদনা নিয়ে লক্ষ্মীনাথ গোলাঘাটে থাকতে লাগল। লক্ষ্মীনাথের সম্মানার্থে ই.এ.সি বেনুধর রাজখোয়া গোলাঘাট ক্লাবে চা- পানের আয়োজন করল। সেখানে লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষার ওপরে দীর্ঘ বক্তৃতা দিল। উপস্থিত শ্রোতা মন্ডলী উচ্চ প্রশংসা করে লক্ষ্মীনাথকে অভিনন্দন জানাল। পরের দিন গোলাঘাট বেজবরুয়া হাইস্কুলে' শিক্ষা' শীর্ষক বিষয়ে অন্য একটি বক্তৃতা দিল।

 গোলাঘাটে থাকা সাত দিন হয়ে গেল। দাদা ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত এবং সরল মনের মানুষ হল শ্রীনাথ। তিনি বর্তমানে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব আদরের ভাই লক্ষ্মীনাথের ব্যস্ততার কথা জানেন। শ্রীনাথ বলল,' এইরকম অবস্থায় মাকে রেখে যাওয়াটা তোর পক্ষে কত কঠিন তা আমি বুঝতে পারছি লখী। তবে এখন মায়ের অন্তিম ক্ষণটির জন্য কেবল অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এদিকে তোর তো আর চাকরি নয়। কলকাতায় হরিনাথকে রেখে এসেছিলি। মায়ের এই অবস্থা শুনে সেও চলে এসেছে। তাই তোর ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে। তুই কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হ। এখানে যাই হোক না কেন, আমরা সামলে নেব।'

 অবশেষে লক্ষ্মীনাথ মৃত্যু শয্যায় শায়িত ঠানেশ্বরীর কাছে এল। নিথর হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে অবরুদ্ধ কন্ঠে বলল,' মা ছোড়দাদা আমাকে কলকাতায় যেতে বলেছে, যাব কি?'

 ঠানেশ্বরী আকুল নয়নে লক্ষ্মীনাথের  দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে ধীরে ধীরে শীর্ণ  ডান হাতটা তোলার চেষ্টা করল। সেটা না পেরে শুকনো কন্ঠে বলল,'যা, আয় গিয়ে–।'

 লক্ষ্মীনাথের এরকম মনে হল যেন নাড়ির বন্ধন ছিড়ে গেল। শয্যাগত ঠানেশ্বরীর পা দুটি স্পর্শ করে প্রণাম জানিয়ে নিস্তেজ পদক্ষেপে বেরিয়ে এল।

 সেপ্টেম্বর ১৯ তারিখ(১৯১০ সন)। দুপুর ১ টার সময় গুয়াহাটি পাওয়ার পরে অনেক ব্যক্তি লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে দেখা করতে এল। তাদের মধ্যে দেবেন ফুকন, অধ্যাপক পিসি রায়, ইএসি যোগেন্দ্র বরা, রাধানাথ ফুকন এবং হেমচন্দ্র গোস্বামী। তাঁদের ক্লাবে গিয়ে সত্যনাথ বরা এবং রায় বাহাদুর ভুবন চন্দ্র দাসের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু লক্ষ্মীনাথ কারও সঙ্গেই সেভাবে কথা বলল না। কেবল হেমচন্দ্র গোস্বামীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করল। সেদিন সুযোগ পেল না। পরের দিন গুয়াহাটি ঘাট থেকে বিদায় জানাতে এসে হেমচন্দ্র 'বাঁহী'র প্রসঙ্গ তুলে প্রশংসামূলক কথা কিছু বলে লক্ষ্মীনাথকে অভিনন্দন জানাল। তখন ক্ষোভ প্রকাশ করে লক্ষ্মীনাথ বলল–' গোঁসাই তোমার প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু 'উষা'র সম্পাদকের কাছ থেকে যে অপমান পেলাম, সেটা এখনও ভুলতে পারিনি।'

 'আমি তোমার অপমানের কারণটা বুঝতে পারছি,বেজ। কিন্তু তখন পদ্মবরুয়ার কোনো উপায় ছিল না।'

 'তা বলে সতীর্থ একজনের লেখক সত্তায় আঘাত দিয়ে ইংরেজের এই ধরনের নির্লজ্জ দাসত্ব!'

 লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বরে উষ্মার আভাস পেয়ে হেমচন্দ্র তার হাত ধরল।

 'উষা' বের হওয়ার আগে পদ্ম বরুয়া কলকাতায় আমার বাড়িতে গিয়ে আমার সঙ্গে পরামর্শ করেছিল। রাজরোষে পড়ার পরে গর্ডন স্যার যখন আমার 'এংলো ইন্ডিয়ান' উঠিয়ে নেবার পরামর্শ দিল, তখন পদ্ম বরুয়া আমাকে কথাটা জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না। ইংরেজের প্রতি দাসত্ব মানুষটাকে এত নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল!'

' প্লিজ বেজ, তুমি শান্ত হও।' কাতর কন্ঠে হেমচন্দ্র বলল,' আমি পুনরায় বলছি, তখন পদ্ম বরুয়ার উপায় ছিল না? তবে দুর্ভাগ্যজনক এই ঘটনাটির জন্যই তোমার মানস কন্যা 'বাঁহী' জন্ম নিয়েছে। আর আমার মনে হয় এখন 'উষা'র চেয়ে 'বাঁহী' উন্নতমানের অসমিয়া সাহিত্য পত্রিকা।'

 লক্ষ্মীনাথের মনটা কিছুটা শান্ত হল। কিন্তু সকালবেলা সাড়ে দশটায় গুয়াহাটি জাহাজ ঘাট থেকে যখন বিদায় নিল,ভাঁটির দিকে যাত্রা— নিজের টেবিলে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথের মনটা পুনরায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। অসম থেকে বিদায় নিয়ে এভাবে কলকাতায় যাত্রা করার সময় প্রতিবার লক্ষ্মীনাথের মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে তার অন্তরে অনুভূত হওয়া এইবারের বেদনাটি আলাদা। অন্যান্যবার মনের মধ্যে থাকে শুধু মাতৃভূমি থেকে বিদায় নেওয়ার বেদনা। এবার সেই বেদনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাতৃ বিয়োগের আশঙ্কা। না এরপরে অসমে এসে সে আর মমতাময়ী মায়ের কায়িক অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না, শুনতে পাবে না স্নেহ  মাখানো মায়ের কোমল কণ্ঠস্বর।তাঁর অন্তরের গভীরতা থেকে মন খারাপের ভাব উঠে এল। মানসপটে ভেসে উঠল শৈশবকালে অনুষ্ঠিত উপনয়নের সেই দৃশ্যটি।

 শিবসাগরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ত্রিলোচন শর্মা ছিলেন লক্ষ্মীনাথের উপনয়নের আয়োজনের প্রধান দ্রষ্টা। উপনয়নের অন্তিম অনুষ্ঠানে টাক মাথা কিশোর ব্রহ্মচারী লক্ষ্মীনাথের হাতে পলাশ গাছের ডালের একটি দন্ড, কমন্ডুল আর কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে মাতৃ ঠানেশ্বরীর সামনে উপস্থিত হয়ে ' ভবতি মাতর ভিক্ষাং দেহি' বলে ভিক্ষা চেয়েছিল। তাকে ঘিরে থাকা মহিলারা তখন ' যেওনা বৈরাগী হয়ে–' বলে করুণ রসাত্মক গান গাইছিল। লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে মাতৃ ঠানেশ্বরীর দুই চোখ ছল ছলে হয়ে উঠেছিল এবং তিনি রিহার আঁচলে চোখ মুছে ছিলেন। মায়ের সেই রূপটির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথেরও দুই  চোখ থেকে জলের ধারা নেমে এসেছিল।

 অশ্রু প্লাবিত চোখে লক্ষ্মীনাথ তারপরে নদীর দক্ষিণ পাড়ে দৃষ্টি প্রসারিত করল। ভাটার যাত্রা যদিও জাহাজটা এখন এত দ্রুত যাচ্ছেনা। তীরের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে সবুজ ধান, ধানকে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মলায়া বাতাস, পশ্চিমে ঢলে পড়া শারদীয় সূর্যের কোমল কিরণ আকাশটাকে বর্ণিল  করে তুলেছে। সেদিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনাথ দেখল, এক ঝাঁক সাদা বক সারি  পেতে পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে উড়ে যাচ্ছে, এভাবে দল বেঁধে উড়ে গিয়ে দূরের কোনো পাহাড় অথবা জঙ্গলে রাতের জন্য বিশ্রাম নেবে।… এই হল জন্মভূমি। জন্মভূমির এই রূপটির সঙ্গে লক্ষ্মীনাথ পরিচিত। তবু চেয়ে রয়েছে, চেয়েই রয়েছে, এত করে দেখেও তার আগ্রহ মিটছে না। লক্ষ্মীনাথ ইতিমধ্যে বিহার, উড়িষ্যা ,উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের অনেক জায়গায় বেড়িয়েছে, উত্তর পশ্চিম ভারতের বোম্বাই গিয়েছে, দার্জিলিং, সিমলা, শ্রীনগর, ভূস্বর্গ কাশ্মীর, রাওয়ালপিন্ডি লাহোর  দেখেছে। এইসব জায়গা অসমের চেয়ে উন্নত কিছু কিছু জায়গা ঐতিহাসিক কীর্তি চিহ্নে ঐশ্বর্য মণ্ডিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতিশয় মনোরম। তবু জন্মভূমি অসমের কথাটা আলাদা। সমস্ত জায়গা থেকে অসম আলাদা। অসমের সঙ্গে আপন বোধটা ব্যঞ্জনাময় এক অনুভূতিতে আনন্দময়। নয়ন ভরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লক্ষ্মীনাথের মনে এক অদ্ভুত ভাবের দোলা লাগল। তারপরে তার সমগ্র সত্তায় এক কম্পনের সৃষ্টি হল। সঙ্গে সঙ্গে ঐশ্বর্যময় এক বিভূতিতে জন্মভূমি অপরূপ এক রূপ ধারন করল। তারপরে লক্ষ্মীনাথ নিজের অজান্তে গুণগুণ করে উঠল–

'অ' মোর আপোনার দেশ,

অ'মোর চিকুণি দেশ,

এনেখন শুয়ালা ,

এনেখন সুফলা,

এনেখন মরমর দেশ।

অ'মোর সুরীয়া মাত।

অসমর সুয়দী মাত।।

পৃথিবীর কতো

বিচারি জনমটো 

নোপোয়া করিলেও পাত।।

অ'মোর ওপজা ঠাই।

অ'মোর অসমী আই।।

চাই লওঁ তোমার

মুখখনি একবার

হেঁপাহ পলোয়া নাই।।'

(হে আমার জন্মভূমি,সুজলা সুফলা,শস্য শ্যামলা দেশ।সারা পৃ্থিবী খুঁজেও তোমার মতো একটি দেশ পাওয়া যাবে না।তোমাকে দেখে দেখে আমার আর আশ মিটে না।)


 

সোমবার, ১৫ মে, ২০২৩

শব্দব্রাউজ ৮২৭।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-827, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮২৭।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-827, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮২৭ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ৯। ৫। ২৩। সময় সকাল ৯টা ।



শব্দসূত্র: শব্দবাঁধন আপনি জড়ায়



শব্দবাঁধন

জড়িয়ে রাখে

মিষ্টি যন্ত্রণায় ।



আপনি আসে

জড়িয়ে রই

মুক্তি কে চায় ?



জড়ায় জড়ায়

আশ্চর্য

বিপুলা পৃথিবীর

সব রহস্য ।


ছুঁয়ে থাকি

শব্দ জব্দ হতে দেয় না ।

শব্দব্রাউজ ৮২৬ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-826, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮২৬ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-826, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮২৬ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ৮।৫। ২৩। সময় সকাল ৭টা ৪০মিনিট ।



শব্দসূত্র: হৃদয় মাঝে রাখব



শব্দ বাক্য গঠন

হৃদয় মাঝে রাখলে

কে অসুখী? 



অবিরাম প্রিয় দিন

সামনে এসে দাঁড়ায়

সৃজনে ।



আমি তার জন্য

শিতলপাটি বিছাই

খেতে দিই প্রিয় খাবার ।



বুঝে ফেলি সে

আজীবন হৃদয় জুড়ে

থাকতে চায় ।

শব্দব্রাউজ ৮২৫ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-825, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ ৮২৫ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-825, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৮২৫ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ৭। ৫। ২৩। সময় সকাল ১০টা ১০মিনিট ।



শব্দসূত্র: দাও যাপন, শব্দের সঙ্গে



দাও, দাও আমায়

শব্দযাপন

ম্যাজিক হয়ে ছুটে আসুক

প্রকৃত শব্দশৃঙ্খল

শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ।



দাও, দুরন্ত ইচ্ছে

যাকে নিয়ে যেন

ছুটি ছুটি হাজার বছর

সকলের মনে ।


আটপৌরে ৫৪৩|| সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 543 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৫৪৩|| সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 543 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৫৪৩

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...