শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১১ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi তৃতীয় অধ্যায়, একাদশ অংশ

 পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১১


পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   


মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  

Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

তৃতীয় অধ্যায়, একাদশ অংশ 



(১১)

 আজ রাস পূর্ণিমা।

 সকাল থেকে প্রতিটি কর্মীই ব্যস্ত। আজ আমাদের স্বপ্নের পর্যটক নিবাসটি বাস্তব রূপ লাভ করবে। গত তিন চার দিন ধরে আমাদের ব্যস্ততার আর শেষ নেই। নবজিৎ বৈশ্য, কীচক ,টিংকু, জেপি প্রত্যেকেই চাকরি থেকে তিন দিনের জন্য ছুটি নিয়েছে। পর্যটক নিবাসীর চারপাশে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রতিটি পরিবেশ কর্মী নিজের নিজের দায়িত্বে কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে চলেছে। আমি স্থায়ীভাবে কাজ করা প্রত্যেককেই নতুন কাপড় উপহার দিয়েছি। সৌম্যদা পাঠানো জনজাতীয় মানুষ দুটিকে, নব কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা দুজন ব্যক্তিকে এবং নৈমিত্তিক কাজ করা অন্য চারজন ব্যক্তিকে। আজকের অনুষ্ঠানে তারা নতুন কাপড় পরে এসেছে। অনামিকা, জ্যোতিমালা, কাকিমা প্রত্যেকেই সুন্দর পরিষ্কার পোশাক পরে পরিচ্ছন্ন হয়ে সকাল থেকে পরিবেশটাকে সুন্দর করে তুলেছে। অচ্যুত পরিচালনার সমস্ত দিক সামলাচ্ছে। অতীতকে পুলক এবং রাতুল সাহায্য করছে। পুলকের বন্ধু এপেটাইজারের মালিক পাঠানো রাঁধুনী দুইজন আরও দক্ষ। ওরা দুজনেই নিষ্ঠাবান প্রকৃতি কর্মীর মতোই পরিবেশ পটু। কোথাও এক ফোঁটা নোংরা দেখতে পেলে কোনো একজন নয়, অন্যের কাঁধে থাকা গামছা দিয়ে হলেও মুছে দিচ্ছে। জানিনা,এই পটুতা কতদিন অব্যাহত থাকবে।

 অচ্যুত পুলক এবং রাতুল কফি রঙের জামা এবং কালো রঙের প্যান্ট পরেছে। শার্টের আস্তিনে লাগানো আছে কালো রঙের পটি।বাকি তিনজন ছেলে এবং দুটি মেয়ে ঘরের ভেতরে থাকা পর্যটকদের শুশ্রূষা করবে। ওদের পোশাকের রং নীল। কাপড়ের নির্বাচন অচ্যুত পুলকদের।সব বিষয়ে আমি হস্তক্ষেপ করতে চাইনি। দেখি না ওরা কাজটাকে কীভাবে সামলে নেয়। তবে আমি লক্ষ্য করলাম, ওদেরকে দু-চারটি কথা বলার প্রয়োজন আছে।

 গতরাতে আমরা প্রত্যেকেই পর্যটক নিবাসের কাজ শেষ হওয়া উপলক্ষে এক ভোজ সভায় মিলিত হয়েছিলাম। নতুন করে নিযুক্ত হওয়া রাঁধুনি ভরত এবং নরেন আমাদের আপ্যায়িত করেছিল। আমি সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলাম তোমাদের স্থানীয় খাদ্য সম্ভারের উপরে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের এখানে আসা পর্যটক বিদেশি খাদ্য সম্ভারের স্বাদ নিতে আসে না, আসে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে। সকালের আহারে পুরী দেবার চেয়ে কোমল চাল এবং দই দিয়ে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করবে। সঙ্গে নারকেলের নাড়ু। চায়ের সঙ্গে কলা পাতায় করে পিঠা। কুলি পিঠার ভেতরে চিনি নারকেলের গুড়ি দিলে আমি তোমাদের সামনে লাউসের অভিজ্ঞতার কথা বললাম। অচ্যুতকে বললাম তুমি আমাদের স্থানীয় খাদ্য সম্ভারের তালিকা প্রস্তুত করবে এবং প্রতিটি গ্রাহকের সামনে সেটাই দেবে। কাসার থালা এবং বাটি দেখেছ, তারমধ্যে পুরী পরিবেশন করলে কেমন দেখাবে । জল খাবার জন্য পেতলের গ্লাস এবং ছোটো ছোটো ঘটি ব্যবহার করলে আমাদের আভিজাত্য কমবে না, বরং বাড়বে। স্থানীয় খাদ্য পরিবেশন এবং একান্তই আমরা ব্যবহার করা সাজ সরঞ্জাম আমাদেরকে পুরোনো কালের বলবেনা , নিজের পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ না করা জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে হবে। খাদ্য পরিবেশনের সময় ছেলেদের আটহাতি ধুতি এবং জামা ব্যবহার করতে বলবে এবং তাদের জন্য সেরকম কাপড়ের ব্যবস্থা করবে।

 পর্যটক নিবাসে কাজ করা প্রতিটি কর্মীকেই মনে রাখতে হবে তারা প্রকৃতি কর্মী, তারা পর্যটন কর্মী ।তাদের প্রত্যেকেরই থাকতে হবে কর্ম তৎপরতা এবং সেবার মনোভাব ।কেউ যদি না পারে সে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেবে অথবা তাকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

  মনে রাখবে তোমরা এক এক জন ব্যবসায়ী ।তোমাদের কর্ম পদ্ধতি ব্যবসার অনিষ্ট করলে তোমাদের নিজেদেরই তার ফল ভোগ করতে হবে।

 সফল ব্যবসায়ী বিপিন ডেকার উপরে আমার ভরসা আছে। তিনি পর্যটক নিবাসের প্রকল্পটিকে অন্তর থেকে গ্রহণ করেছেন। তারা প্রত্যেকেই পরিচালনার দিকটি দেখবে, কিন্তু পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ‌।বিজ্ঞাপন দিলে সাধারণ পর্যটক ভিড় করলে পরিবেশের উপরে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অবশ্য সমস্ত পর্যটককে দশ মিনিটের জন্য প্রকৃতি পর্যটনের উপরে সাধারণ প্রশিক্ষণ একটা দেওয়া যেতে পারে। সঙ্গে তাদের হাতে একটা ছোটো পুস্তিকাও তুলে দেওয়া যেতে পারে, যেখানে প্রকৃতি পর্যটনের উপরে সম্যক আভাস উল্লেখ থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কথা কাজগুলি এগিয়ে যাবে। অভিজ্ঞতা এবং অনুশীলন আমাদের অনেক কথা শেখাবে। সৌম্যদা এবং শৈলেশ চৌধুরী ভরসার যোগ্য। তারা প্রতিমুহূর্তে আমাদের সঙ্গে আছে। তাদের উপরে দায়িত্ব দিলে আমাদের নিবাসে পর্যটকের কোনো অভাব হবে না।

  উৎসবমুখর দিনটিতে আমি ঋণাত্মক দিকসমূহের উপরে আলোকপাত করতে চাইনি।সৌম্যদা পৃথক পৃথকভাবে প্রকৃতি কর্মীদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যথাসম্ভব শলা পরামর্শ দিচ্ছে।কোথায় কী তৈরি করলে দেখতে ভালো লাগবে– বিপিন ডেকা ও দেখিয়ে গেছে। আমি জানি এইসব এই মুহূর্তের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তথাপি প্রতিজন প্রকৃতি কর্মীর নিজস্ব ইচ্ছা অভিলাস আছে। তাতে বাধা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আমরা কেউ অনুভব করছি না।

   বিপিন ডেকা প্রতিটি টেপে জল ভালো করে বইছে কিনা পরীক্ষা করার জন্য জলের টেপগুলি খুলে দেখছে। জিজ্ঞাসা করছে জলাধারে পর্যাপ্ত জল উঠিয়ে রাখা হয়েছে কিনা। জেপি প্রতিটি পর্যটক নিবাসী দরজার সামনে ধুপ কাঠি জ্বালিয়ে দিয়েছে। সুনন্দ পড়ে থাকা কলাপাতার টুকরো একটা উঠিয়ে নিয়ে পাশের নোংরা ফেলার জায়গায় ফেলে দিয়েছে। রাতুল পাইপ দিয়ে চারপাশে জল ছিটাচ্ছে।নবজিৎ সন্ধ্যার কার্যসূচী সফল করার জন্য ব্যস্ত। সে অভিনেতা মৃদুল ভুইয়া এবং অভিনেত্রী প্রস্তুতি পরাশরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করায় ব্যস্ত। তারা দুজনেই সময় মত না এলে অসুবিধা হবে। তারা দুজনেই নবজিতকে আশ্বাস দিয়েছে তারা নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট আগেই পৌঁছে যাবে।দুজনকেই মনে করিয়ে দিয়েছে শরাইঘাটে প্রতিদিন যানজট হয়। সঙ্গে এটাও বলেছে নলবাড়ির হরি মন্দিরের রাস মহোৎসব উদ্বোধন করার সময় পর্যটক নিবাসের দ্বার উন্মোচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।নবজিতের মতে তার মধ্যে কোনো ধর্মীয় কারণ নেই,হরি মন্দিরের মাধ্যমে প্রচলিত হওয়ার জন্য সামাজিক পরম্পরা রক্ষা করাই একমাত্র কারণ। তারা দুজনেই নবজিতকে উল্টে অনুরোধ জানিয়েছে তোমরা সময়ে শুরু করবে। তোমাদের ওখান থেকে গিয়ে আমাদের প্রথম দর্শনীর জন্য প্রস্তুত হতে হবে।যেতে হবে টিহুতে। নবজিৎ নির্দিষ্ট সময় পাঁচটা দশ মিনিটে আরম্ভ হবে বলে পূর্ণ আশ্বাস দিয়ে তাদের আমন্ত্রণ নিশ্চিত হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেছে।

  প্রকৃতি কর্মী অধর এবং শ্বাহ আলম কাছের অগ্নিশালা গ্রামে গিয়ে আতশবাজি কিনে এনেছে। অগ্নিশালা গ্রামে ব্রিটিশ শাসন কাল থেকেই পরম্পরাগত ভাবে উন্নত মানদন্ডের আতশবাজি নির্মাণ করে। দুই প্রকৃতি কর্মী আতশবাজি কিনে এনেছে বলে জানতে পেরে সৌম্যদা দুজনকেই ডেকে আনল। সৌম্যদা দুজনকেই তোমরা আতশবাজি এনেছ নাকি বলে জিজ্ঞেস করায় দুজনেই এনেছে বলে জানাল। তখন সৌম্যদা বললেন— তোমরা জান না,তাই তোমাদের ভুল হয়েছে বলতে পারিনা। তোমরা জেনে রাখ আতশবাজি প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এতে ব্যবহার করা রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ দূষিত করে।। আতশবাজির উজ্জ্বল আলো এবং শব্দ বন্যপ্রাণীদের আতঙ্কিত ভীতিগ্রস্ত করে তুলে। তোমরা কল্পনা কর তো এখানে জ্বালানো আতশবাজি কত আলো এবং শব্দের সৃষ্টি করবে। আশেপাশের অরণ্যে থাকা জীবজন্তুগুলি সেই আলো দেখতে পাবে। এবং শব্দ শুনতে পাবে। ওরা তখন ভয়ে এখান থেকে দূরে চলে যাবে। প্রকৃতি কর্মী হিসেবে তোমরা নিশ্চয়ই এরকম ভুল করবে না।

অধর এবং শ্বাহ আলমের মনে সৌম্যদার মন্তব্য গভীর প্রভাব বিস্তার করল।ওরা দুজন আতশবাজি এনেছে বলে জানতে পেরে যে কয়েকজন তরুণ প্রকৃতিকর্মী আনন্দ পেয়েছিল তাদের অধর এবং শ্বাহ আলম ফটকা এবং আতশবাজির অপকারিতার বিষয়ে সৌম্যদা বলা কথাগুলি জানানোয় ওরা জিজ্ঞেস করল তাহলে এখন কী হবে ? তখন অধর এবং শ্বাহ আলম বলল, আজকের কথা তো আলাদা, জীবনে আর কখনও ফটকা আতশবাজি জ্বালানো হবে না।অন্যেরা জ্বালাতে চাইলে তাদের বাধা দেব।

 পর্যটক নিবাসকে কেন্দ্র করে ঘটতে থাকা বিভিন্ন কার্যাবলী চেতন অথবা অবচেতনভাবে আমার চোখের সামনে পার হয়ে যাচ্ছে। আগামীকাল থেকে আমি অতি সন্তর্পনে পর্যটক নিবাসের বিভিন্ন কার্যাবলী থেকে সরে আসছি। যে গাছের নিচে চেয়ার পেতে আমরা পর্যটক নিবাস নির্মাণের সম্পূর্ণ কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করেছিলাম, সেখানে এখন সুন্দর ফুলের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। লাল রংয়ের নার্জি ফুলের গাছগুলি দ্রুত বেড়ে চলেছে এবং দুই একটি ফুলের কলি প্রস্ফুটিত হয়েছে ।আমি বাগানের কাছে এটা চেয়ার পেতে বসে একা প্রকৃতি কর্মীদের কাজকর্ম গুলি নিরীক্ষণ করছি। সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। দিনের বেলা স্থানীয় এয়োরা নাম প্রসঙ্গ করার কথা। সুনন্দের মা এবং কাকিমা নাম প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছে। তাদের দলটি প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র হাতে নিয়ে ইতিমধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছে। দলটি হলঘরের ভেতরে প্রসঙ্গের বিধিব্যবস্থা করছে। তাদের চা জল খাবার দেবার জন্য অনামিকা জ্যোতি মালা জুলিয়েট ব্যস্ত। ভরত এবং নরেন ব্যস্ত নাম প্রসঙ্গে অন্তত আয়োতি এবং উপস্থিত লোকের জন্য খিচুড়ি প্রস্তুত করায়। সৌম্যদা একদল ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের প্রতি ঘর মানুষের বাগান বস্তিতে রোপণ করা গাছের চারাগুলি কীভাবে যত্ন নিচ্ছে দেখতে গিয়েছেন। কেউ প্রয়োজন অনুসারে যদি গাছের চারায় বেড়া দিয়ে ঘেরাও করেনি,তাদের সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে গেছে।আগাছা উৎপাদিত করার জন্য খুন্তি খুরপি সঙ্গে নিয়েছে। সৌম্যদার সঙ্গে যাওয়া প্রকৃতি কর্মীদের উৎসাহের অন্ত নেই।সৌম্যদা ওদের সামনে দেখতে পাওয়া পাখিগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতি সংরক্ষণের দুই-চারটি জ্ঞাতব্য কথা বলে চলেছেন।প্রতিঘর মানুষ গাছের চারা সংরক্ষণে আন্তরিকতার সঙ্গে যত্ন করতে দেখে তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

  সৌম্যদা এসে আমার সামনের খোলা জায়গাটায় বসেছেন।বসে থাকা প্রকৃতি কর্মীদের সামনে দাঁড়িয়ে সৌম্যদা তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে চলেছেন।সৌম্যদার কাছে একটি পুঁটলি।পুঁটলিতে কী আছে আমি জানি না।সৌ্ম্যদা প্রকৃ্তি কর্মীদের জিজ্ঞেস করছে---তোমাদের মধ্যে কে কে গাছের চারা রোপণ কর এভবগ দেখাশোনা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃ্তি সংরক্ষণে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছ?তাঁদের নামগুলি তোমাদের মাঝখান থেকেই বল।এমনিতেই বলে দিও না।একজন প্রকৃ্তি কর্মীকে সৌম্যদা নামগুলি লিখে যেতে বলল।

 উঠে দাঁড়িয়ে একজন বলল—নয়ন।

 নয়নের কথা আমার মনে পড়ল।নীতি নির্ধারক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকার সময় সে আমাকে একজন মানুষের গাছ কাটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।

অন্য একজন বল—অবিনাশ।

 ঠিকই বলেছে প্রকৃতি কর্মীটি।অবিনাশ একটা ভামকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে।প্রায় পঞ্চাশজন প্রকৃ্তি কর্মী দল থেকে এরকম দশজন প্রকৃ্তি কর্মীকে নির্বাচন করে বের করা হল।সৌম্যদা বলায় ছেলেটি বিশেষভাবে পারদর্শী প্রকৃ্তি কর্মীদের নামগুলি পুনরায় আওড়ে গেল।

 --তোমাদের কারও কোনো ওজর আপত্তি আছে।

 নাই বলে প্রকৃ্তি কর্মীরা সামগ্রিকভাবে হাততালি দিয়ে সমর্থন জানাল।

 সৌ্ম্যদা একজন প্রকৃ্তি কর্মীকে তার কাছে থাকা পুঁটলিটা খোলার জন্য বলল।পুঁটলিটা খোলার পরে সবাই দেখতে পেল তাতে কয়েকটি স্পোর্টিং গেঞ্জি রয়েছে।সৌ্ম্যদা তারই একটা হাতে নিয়ে সবাইকে দেখাল।সাদা রঙের গেঞ্জিটার সামনের ভাগে একটা দহিকতরার (এক ধরনের মিষ্ট কণ্ঠের পাখি)ছবি।আর পেছন দিকে টাইপ করে লেখা আছে দহিকতরা।শব্দটির নিচে একটা আঁচ।আঁচটার নিচে হাতের অক্ষরে লেখা আছে –দশের হিতে কাজ ত্যাগের সঙ্গে কর।সৌ্ম্যদা বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করা প্রকৃ্তি কর্মীদের এক একটা স্পোর্টিং গেঞ্জি উপহার দিল।

 — এটা তোমাদের করা ভালো কাজের বিপরীতে দেওয়া সম্মান। এই সম্মান তোমরা ধরে রাখতে চেষ্টা করবে। যারা এই সম্মান আজ লাভ করনি, কাল লাভ করার জন্য তোমরাও চেষ্টা করবে। নিশ্চয় পারবে। এই স্পোর্টিং যেখানে সেখানে পরে যাবে না। সম্মানজনক স্থানে পরবে।

 সৌম্যদা দুজন প্রকৃতি কর্মীর মাধ্যমে সুনন্দ, নবজিৎ বৈশ্য, পুলক, রাতুল, কীচক ,অচ্যৃত , অনামিকাদের ডেকে এনে দশ জনকে সম্মানজনক স্পোর্টিং প্রদান করল।

 গাছের নিচের চেয়ারটাতে একা বসে অবচেতনভাবে আমি এই দৃশ্যগুলি দেখতে পাচ্ছি।আমি দেখতে পাচ্ছি অনামিকা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। অনামিকার বেশভূষা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে পড়লাম। আশ্চর্য নয়, বলা যেতে পারে আপ্লুত হয়েছি। সে দহিকতরা স্পোর্টিং পরার সঙ্গে সৈনিকরা ব্যবহার করা একটা সবুজ প্যান্ট এবং সৈনিক ব্যবহার করা একজোড়া কাপড়ের জুতো পরে এসেছে। উপস্থিত প্রত্যেকেই একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং স্যালুট প্রদর্শন করে অভিবাদন জানালাম। সবার সামনেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তার দুচোখ থেকে উষ্ণ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পরে সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে মুখটা ঢেকে ধরল। আমি জানতে পারলাম না সে জ্যোতিষ ব্যবহার করা পোশাক পরিধান করে এভাবে জ্যোতিষকে স্মরণ করছে, না জ্যোতিষের আদর্শ সামনে রেখে নতুন জীবনটা আরম্ভ করবে বলে স্থির করেছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা প্রত্যেকেই পুনরায় নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

 কিছুটা লাজুক ভাবে অনামিকা এসে আমার পাশে বসলো এবং সে হঠাৎ নিজেকে বদলে ফেলল।

 —ইস। আপনি একা বসে আছেন। আপনাকে লক্ষ্য করছি আপনি গত দুদিন থেকে আমাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আপনি দূরত্ব বজায় রাখছেন। আপনি চা খেয়েছেন?

অনামিকা একসঙ্গে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নগুলির কোনটির উত্তর দেব আমি ঠিক করতে পারছি না।

 — খাইনি।

 আমি চা খাই নি বলে সাধারণভাবে বলে রাখলাম। সে আমাকে কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে তাকে সামরিক বাহিনীতে কাজ করা কোনো মহিলা অফিসারের মতো দেখাচ্ছে। আমি জানিনা, অসমের অন্য কোনো গ্রামে হলে অনামিকা এভাবে এগিয়ে আসতে পারতেন কিনা। কিন্তু বর কুরিহা গ্রামটি সত্যিই আদর্শগত ভাবে ব্যতিক্রম। কার ও প্রতি কুনজর দেবার জন্য এখানে প্রত্যেকেরই যেন সময়ের অভাব। অনামিকা এক কাপ চা এবং একটা নিমকি নিয়ে ফিরে এলেন। আমি তার হাত থেকে শুধুমাত্র এক কাপ চা নিলাম।

 — নিমকি খাবেন না?

 — না খাই না।

 —কেন?

 — ইচ্ছা নেই।

 অনামিকা গুমোট ভাবে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

 — আপনার দেখছি আজকাল কোনো কিছুতেই ইচ্ছা নেই।

 অনামিকা কোনোরকম ভুল বলছে না। সত্যি। শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুতেই আমার ইচ্ছা নাই হয়ে গেছে।

 আমি ভাবতে শুরু করেছি আমার ইচ্ছার কোনো অংশ পূরণ হল মানে আমার করার কাজ শেষ হয়ে গেল। কখন ও আবার ভাবি মনের মধ্যে কল্পনার সৌধ না তৈরি করে আমি কীভাবে বেঁচে থাকব। গ্রামটি অরণ্য হয়ে উঠতে আর ও পাঁচ বছর সময় লাগবে।

 — কী হল, কিছুই বলছেন না দেখছি?

 — অনেক প্রশ্নের উত্তর না থাকার মতো অনামিকা, আমার হাতে তোমার তোমার প্রশ্নেরও উত্তর নেই।

 আমি নিজের কাছ থেকে অথবা আইনের কাছ থেকে পালাতে চাইলে প্রশ্নের উত্তর না থাকার অজুহাত দেখাই অথবা এভাবে সিদ্ধান্ত নিই। আমার মনের মধ্যে মাঝেমধ্যে উঁকি দেওয়া নিরাশা এবং হতাশায় অন্যের উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢালা অনুচিত। সমস্ত কিছু অনির্ণেয় বলে ভাবলেও, কাজের ফলাফল আছে বলেই আমি অনির্ণেয়তাকে ধ্যান করে হাত গুটিয়ে বসে থাকি না।আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চেষ্টা করলাম।

  --না অনামিকা।আমি মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসি। আমি ভাবি পৃ্থিবীতে আমার চেয়ে আমার অন্য কোনো ভালো সঙ্গী থাকতে পারে না।আমি আমার সঙ্গে থাকলে জানই তো ,আমার জন্য বাস্তব পৃ্থিবীটা পরিবর্তিত হয়ে যায়।কখনও নিজের সঙ্গে সময় কাটিয়ে দেখ।

 উদয়নদা, আমি ক্ষণিকের জন্য ভাবি না আমার পৃথিবীটাতে শুধু আমি বসবাস করছি। আমার পৃথিবীটা বহুমাত্রিক। সেখানে সবাই থাকে। আমার সম্পর্কিতরা, বন্ধুবান্ধবরা, পরিচিত অপরিচিত অনেকেই। সেই পৃথিবীতে থাকে প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃতিক বিচিত্র সম্পদ এবং ঘটনা রাজি। জীবন চক্রের বাস্তব পরিঘটনা।।এই সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে আমি শুধু আমার সঙ্গে জীবন কাটাতে অনিচ্ছুক।

 অনামিকা আমাকে আমার পৃথিবী থেকে বের করে আনল। তার মানে আমার জন্য দুটি পৃথিবী,একটিতে আমি একা থাকি অন্যটিতে আমি এবং আমার সঙ্গে থাকে অনেকেই। যান্ত্রিকতা এবং প্রাকৃতিকতার মধ্যে বিচরণ করে আমার মনের মধ্যে দুই চিন্তার ধ্বংসাবশেষ আমি গড়তে চাইছি নাকি? আমি নিজেকে লুকানোর জন্য চেষ্টা করলাম।

 আয়োতিরা নাম প্রসঙ্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে কি অনামিকা? ও দাঁড়াও, সৌম্যদা এবং তার সঙ্গে যাবার ছেলেমেয়েগুলোর দলটি খাওয়া দাওয়ার দিকে তুমি একটু লক্ষ্য রাখবে।

—আয়োতির দলটি নাম প্রসঙ্গ ইতিমধ্যে আরম্ভ করেছে। আপনি বোধহয় সেদিকে খেয়াল করেননি। প্রকৃতি কর্মী ছেলেমেয়েদের জন্য বেলের শরবত এবং ওদের জন্য প্রত্যেকের সঙ্গে খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে।।

 অনামিকা বলার পরে আয়োতিদের করতালি তালের শব্দ এবং বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি এসে আমার কানে লাগল। নিজের পৃথিবীতে যে এরকমই। নিজেকে সম্পূর্ণ নিজের সঙ্গে ব্যস্ত করে রাখে।

—-আমি আসছি। আমার একটু কাজ আছে। আপনার কাজ একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া বলে কেন ভাবছেন? বহির্মুখী একজন মানুষ হঠাৎ অন্তর্মুখী হয়ে যাবেন না।এবার বৈশাখে দেখবেন গাছের চারাগুলি দ্রুত বেড়ে চলেছে।নতুন নতুন পাতা বের হবে।ওরা একফুট উঁচু হবে।গাছের চারাগুলির আগে মনগুলি বেঁধে নিলে আমরাও ওদের মতো উঁচু হয়ে যেতে থাকব।

তাজ্জব ব্যাপার।আমি হতচকিত হয়ে পড়লাম।অনামিকা আমার নিজস্ব পৃ্থিবীটা খান খান করতে চেষ্টা করছে।অরণ্য গ্রাম এবং পর্যটক নিবাসের কাজ করার পর থেকে মা আমার সঙ্গ ত্যাগ করেছে।

আমি চেয়ার থেকে উঠে এসে আয়োতিদের নাম-পর্ব শুনতে লাগলাম।সুর দিয়ে গাওয়া তাঁদের সঙ্গী্তের কথাগুলি একেবারে অব্যর্থ ।এটি পুনরায় এরকম পৃ্থিবী যেখানকার সমস্ত বাসিন্দা কর্মবিমুখ হতে ইচ্ছুক।আর আমার এরকম মনে হয় তাঁরা যেন সামূহিকভাবে আত্মহত্যা করার জন্য অপেক্ষা করছে।

এতদিন মনে না আসা চিন্তাগুলি আজ হঠাৎ আমার মনে কেন আসতে লাগল।বাপুটি কোনোভাবে জানতে পারলে সে এসে বলবে—আমি বলেছিলাম না,আপনাকে ভূতে পাবে।এখন আপনাকে ঝাঁড়ফুক করতে হবে।

পুরোহিত শর্মা এসে আমার পাশে বসল।

--আপনার পাশে এসে বসাটাই এখন ভাগ্যের কথা।

এবার পুনরায় আমার পাশে এসে বসল ভাগ্য।সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত।আজ আমার সেরকম ব্যস্ততা নেই।সময় পার করার জন্য আমি পুরোহিত শর্মাকে ঘিরে ধরলাম।

--ভাগ্য মানে পুন্য।ভাগ্য মানে ঈশ্বরের সুমতি।ভাগ্য মানে মন চাওয়া সফল।শর্মাবাবু ভাগ্য মানে কি?

পুরোহিত শর্মা আমার কাছ থেকে এই ধরনের প্রশ্ন আশা করেন নি।

--ভাগ্য মানে কী হবে?আমরা যা চাই তা পাওয়া তো।না পেলে দুর্ভাগ্য।আমরা বলি সেটা কপালেই লেখা থাকে।

--আমার কপাল আপনি পড়তে পারবেন শর্মাবাবু?

--কেউ কারও কপাল পড়তে পারে না।সেইজন্য হয়তো আমরা ভাগ্য এবং দুর্ভাগ্যকে শ্লেটে আঁকতে পারি না।পারলে বলতে পারতাম আগামীকাল আপনার জীবনে কী হতে চলেছে।

শর্মার মন্তব্য শুনে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলাম সৌ্ম্যদা ছেলেমেয়েদের দলটিকে নিয়ে ভাত খাবার ঘরে এসেছে।তিনি সোজাসুজি আমাদের কাছে এলেন এবং প্রকৃ্তি কর্মীদের ভাত খাবার ঘরে যেতে বললেন।আমি তার দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলাম।পুরোহিত শর্মার সঙ্গে অদৃষ্টকে নিয়ে আর বেশি কথা বলা হল না।

--তুমিও আমাদের সঙ্গে যেতে পারতে।গাছের চারাগুলি সুন্দরভাবে গড়ে উঠছে।গ্রামের প্রায় প্রতিঘর মানুষই গাছের চারাগুলিকে খুব সুন্দরভাবে যত্ন করছে।গোয়ালঘরের গরু এবং চারাগাছটির মধ্যে তারা কোনো পার্থক্য করছে না।দুই তিন বছরের মধ্যেই গ্রামটা পুরো সবুজ হয়ে উঠবে।

সবুজ হতে চলা গাছের চারাগুলির কাছ থেকে ফিরে এসে সৌ্ম্যদা পুরো মানুষটা সবুজ হয়ে পড়েছে বলে আমার মনে হল।আমরা অনেকক্ষণ ধরে সবুজ হতেঁ চলা অরণ্য গ্রামটি সম্পর্কে কথা বললাম।অনামিকা এসে কিছুক্ষণ আমাদের কাছে বসল।সে আমার মনোভাব বুঝতে পারল না।এক ঘণ্টা আগের মানুষ একজন একঘন্টা পরে কীভাবে বিশেষভাবে বদলে যেতে পারে,হয়তো তার চিন্তা এবং বোধের ধারণার বাইরে ছিল। তবে আমি সেকথা জানি। একজন মানুষ চিন্তা জগত থেকে বাহনের পিস্টনের মতো বাইরে-ভেতরে করতে থাকে।সেই পিস্টনের মসৃণতা নির্ভর করে চিন্তার তৈলাক্ততার ওপরে।

দিনটা আমার কাছে বিচ্ছুরিত চিন্তা এবং কল্পনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হল।

অনামিকা হয়তো আমাকে জানতে বা বুঝতে এসেছিল,হয়তো সে ভেবেছে আমি নিজেই একটা রহস্য।

মাথার ওপরে ধীরে ধীরে উঠে এসেছে বিশাল আকৃ্তির চাঁদ।দশদিক রূপোলি জ্যোৎস্নায় ভরপুর।শীতল বাতাস এবং রাশি রাশি শিশিরের কণা অনন্য পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।অভিনেতা মৃদুল ভূঞা এবং প্রস্তুতি পরাশর ফিতা কেটে আমাদের স্বপ্নের পর্যটক নিবাসকে বাস্তবে উপস্থাপন করল।আগামীকাল থেকে তারা আমাদের অতিথি হবে।।উলুধ্বনি এবং হাততালির মধ্যে ফিতার বাইরে থাকা প্রকৃ্তি কর্মিরা পর্যটনক্ষে্ত্রে প্রবেশ করছে।অস্বচ্ছ আলোতে ঝি্লমিল করে উঠছে পর্যটন মণ্ডল।তারা এক এক করে প্রতিটি ঝুপড়িতে প্রবেশ করছে।মন্তব্য দিতে গিয়ে বলছে অনন্য।গ্রন্থাগারটিতে ঢুকে তারা অতিশয় আপ্লুত।প্রকৃ্তি কর্মীর জন্য,পর্যটকদের জন্য গ্রন্থাগার ,তারা ভারতবর্ষের কোনো পর্যটন ক্ষেত্রে নাকি এই ধরনের সাত্তিক প্রচেষ্টা দেখতে পায় নি।বিভিন্ন জন প্রকৃ্তিকর্মী,এমনকি ভরত এবং নরেনও তাদের সঙ্গে সেলফি উঠছে।পর্‍্যটকের মন্তব্য খাতায় তাঁরা আবেগের সঙ্গে লিখেছে –পরম করুণাময় পর্যটক নিবাসটিকে সুদৃষ্টি প্রদান করুক।

সৌম্যদাকে সঙ্গে পেয়ে দুই অভিনেতা এবং অভিনেত্রী আন্তরিকতার সঙ্গে বার্তালাপ করছে।গণ্ডারের খড়গের হিসেব বহির্ভূত এবং বেসরকারি বিশৃঙ্খল সম্পর্কে সৌ্ম্যদা নেওয়া ভূমিকার প্রশংসা করছে।সমস্ত ধরনের সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছে।এগুলিই সামাজিক দায়বদ্ধতার ধনাত্মক দিক।

পরম্পরাগত আতিথ্যে অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা করার পর্ব চলছে।

আজকের দিনটিতে আমি আমাকে সমস্ত ব্যস্ততা থেকে সরিয়ে রেখেছি।তাই বহুদিনের মাথায় আমি আজ সম্পূর্ণ চাঁদটিকে নিজস্ব আকাঙ্খায় প্রত্যক্ষ করার সুবিধা লাভ করেছি।আমি একপা দুপা করে পাখিদের পাড়া পড়োশির দিকে এগিয়ে গেলাম।চোখের আড়ালে সমৃদ্ধ সারি সারি গাছের চারার মধ্য দিয়ে আমার সঙ্গে চাঁদ ও হাঁটতে লাগল।পাখিদের পাড়া প্রতিবেশীর মৃত শিশু গাছটির হেলানো জায়গাটিতে বসে আমি সামনের শিমূল গাছ দুটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছি।চাঁদের আলোতে শিমূল দুটির ছায়া কেঁপে কেঁপে জলাশয়ের জলে নৃ্ত্য করছে। নিবারণের জন্য অকালে হারানো শিমূল গাছটির কথা আমার খুব মনে পড়ে গেল।সেই গাছটিতেই বকের সংসার পাতার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা করছিল।জলাশয় থেকে ভেসে আসা একটা ঠান্ডা বাতাস আমাকে ক্ষণিকের জন্য নাড়া দিয়ে গেল।আমি দেখতে পাওয়া শিমূল গাছদুটির উঁচু শিমূল গাছটাতে কয়েকটি বকের ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।ওরা চাঁদকে ঢেকে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।পাখিদের পাড়াপড়োশীর আবাসীদের দেখতে পেয়ে আমি আত্মহারা হয়ে পড়লাম।দিনটির সমস্ত ঋণাত্মক চিন্তাকে মুছে ফেলার জন্য আমি সম্ভবত এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

প্রাকৃ্তিক চেয়ারটিতে বসে থাকা থেকে আমি দেখতে পেলাম কেউ একজন আমার দিকে এগিয়ে আসছে।আমার খোঁজে এসে অনামিকা পাখিদের পাড়া পড়োশিতে পৌছে গেল নাকি?


শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আমার বিরহ বর্ষা ।। সঞ্জয় ব্যানার্জী ।। কবিতা, Sanjay Banerjee

আমার বিরহ বর্ষা

সঞ্জয় ব্যানার্জী



রিমঝিম বৃষ্টির ধারা ঝরছে

আমি বসে আছি জানালার পাশে

মন আমার ভারাক্রান্ত নাগপাশে। 


আমার বিরহ বর্ষা তুমি এলে

সব আনন্দ আমার কেড়ে নিলে

আমার বান্ধবী তুমি মনমরা

রিমঝিম শ্রাবণ বেলা।


তুমি এলে আমার আঁখির অশ্রু নিয়ে

কাটে নাকো বেলা তোমার রিমঝিম শব্দ শুনে

আমার প্রেমিকা জানালার পাশে বসে--

আমারই পথ চেয়ে।


রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১০ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi তৃতীয় অধ্যায়, দশম অংশ

 পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১০


পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   


মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  

Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

তৃতীয় অধ্যায়, দশম অংশ 



(দশ)

 সৌম্যদা টেন্ট পাততে চাওয়া শিবিরটা ব্যস্ততার জন্য আমরা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। আমি সৌম্যদাকে বললাম—সৌম্যদা আমাদের কাজগুলি সুষম গতিতে এগিয়ে চলেছে। এখন টেন্ট শিবিরে ব্যস্ত হলে দৈনন্দিন কাজগুলিতে অসুবিধা হবে। টেন্ট শিবিরটা আমরা এখন অনুষ্ঠিত না করে পিছিয়ে দিলে ভালো হবে। নলবাড়িতে রাসমহোৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় শিবিরের আয়োজন করলে অংশগ্রহণকারীরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান দর্শন করার সুযোগ এবং সুবিধা লাভ করবে। তখনই অনুষ্ঠিত করা ভালো হবে নাকি? সৌম্যদা আমার সঙ্গে একমত হলেন। আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম আমাদের পর্যটক নিবাস মুক্ত করার পরের দিন আমরা আমাদের টেন্ট শিবির উন্মোচন করব। আমরা পর্যটক নিবাস তৈরি করার কাজের খবর লাভ করে রাস কমিটি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাঁরা আমন্ত্রণ করা থিয়েটারের বিশিষ্ট অভিনেতা অভিনেত্রীদের জন্য থাকার অসুবিধা। নলবাড়ির হোটেলগুলি চাহিদা পূরণ করতে পারবেনা। আমরা বলেছি রাস পূর্ণিমার দিনেই যেহেতু আমরা উদ্বোধন করার কথা ভাবছি, আপনারাই প্রথম গ্রাহক হতে পারেন।

 এই সমস্ত কথার সঙ্গে আমি সৌম্যদাকে আমাদের কাজেরও অগ্রগতির সম্পূর্ণ আভাস দিলাম। জানালাম ঝুপড়িগুলি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। আপনার পাঠানো মানুষ দুটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজগুলি সম্পন্ন করেছে। মানুষ দুটি কর্মঠ। কারেন্ট এবং জলের সরঞ্জাম গুলি আনা হয়েছে। রান্নাঘর এবং কাজ করা মানুষ থাকার জন্য ব্যবহার করা ঘর গুলির মেঝে পাকা করা কাজ সম্পূর্ণ হবে।

 সৌম্যদা গাছের চারা রোপণ করার কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্রতিটি বাড়ির মানুষ তাদের বাড়ির পরিসরে গাছের চারা রোপণ করার অনুমতি দিয়েছে। দু একজন প্রথমে দিচ্ছিল না, পরে আমাদের স্বার্থহীন মনোভাবের কথা জানতে পেরে আমাদের নিমন্ত্রণ জানাল। দুই একটি বাড়ির লোকেরা গাছের চারা রোপন করতে যাওয়ার পরে গামছা দিয়ে সম্বর্ধনা জানাল। আমি অত্যন্ত আপ্লুত হয়ে সৌম্যদাকে জানালাম।

 —ভালো কাজ করলে, ভালো ফলাফল পাবে। মনে পড়ায় বলে রাখি, তোমাদের মধ্যে যিনি পর্যটক গৃহ সমূহ পরিচালনা করবেন তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন আছে। তিনি যদি প্রকৃতি পর্যটনের ক্ষেত্র সমূহ দেখেননি, তাহলে তাকে দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এক কথায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

 —সৌম্যদা। একজন নয়, তিনজনের মতো পাঠাতে হবে। তখন তারা একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারবে। একজনকে পাঠালে অনুষ্ঠানে তাঁর মাতব্বরি বেড়ে যাবার আশঙ্কা আছে।

 —উদয়,তুমি ঠিকই বলেছ। তিনজনকেই পাঠিয়ে দাও। আমি শৈলেশদাকে বলে রেখেছি। আজ পুনরায় মনে করিয়ে দেব। এখনই পাঠিয়ে দিলে নিবাসটা আরম্ভ করার সময় তুমি ওদের দায়িত্ব দিতে পারবে। ওরা যদি নিবাস নির্মাণের কোনো দায়িত্বে আছে তিনজনকেই আজ তার থেকে মুক্ত করে দাও।

 —আমি সম্পাদককে নীতিনির্ধারক কমিটি একটি সভা আহ্বান করার জন্য অনুরোধ করব। তাতেই তাদের তিনজনকে নির্বাচন করা হবে এবং অভয়াপুরির শৈলেশদার আস্থানায় প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হবে।

 সৌম্যদার সঙ্গে কথা অনুসারে সকালবেলা আমি সুনন্দের বাড়িতে উপস্থিত হলাম।সুনন্দ পনেরো দিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়িতে আছে।আমি সুনন্দকে নীতি নির্ধারক কমিটিটার বৈঠক আহ্বান করার জন্য অনুরোধ জানালাম।আমরা কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে।সুনন্দ জিজ্ঞেস করল –আগামীকাল? আমি বললাম—যত তাড়াতাড়ি পারা যায়!সুনন্দ আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি অনামিকাকে জানিয়েছি নাকি?আমি বললাম জানাই নি,তুমি জানিয়ে দিও।আমার মনে হয় অনামিকা কাজের তদারকি করার জন্য দশটার সময় সেখানে যাওয়া উচিত।আমি তাকে বলেছিলাম সে কাজগুলিকে গুরুত্ব দেয় নি।সম্পাদক গুরুত্ব না দিলে কীভাবে হবে!সেইজন্য ভাবছি সে ওখানে যাবে।তুমিও যাবে।আলোচনার মাধ্যমে কাজগুলিকে এগিয়ে নিতে হবে।তিনটি ছেলে নির্বাচন করে পরিচালনার প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে হবে।রাঁধুনি দুজনের কথাও এখন চিন্তা করতে হবে।আমাদের মধ্যে কোনো প্রকৃ্তি কর্মীর রন্ধন দক্ষতা বা রন্ধন প্রকরণে জড়িত হওয়ার ইচ্ছা থাকলে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে নিতে পারব।আমাদের পর্যটক নিবাসের দ্বার উন্মোচন করার মুহূর্ত থেকে আমাদের সুদক্ষ পরিচালক,রন্ধন কর্মী এবং সহায়কারীর প্রয়োজন হবে।তাঁদের প্রত্যেককেই পরিবেশ কর্মী হতে হবে,তাঁদের ব্যবহারে থাকতে হবে অতিথি পরায়ণতা।

 সুনন্দের বাড়ি থেকে আমি বিদায় নিয়ে সোজাসুজি নির্মাণ স্থলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম।বাঁধ থেকে নেমেই দেখতে পেলাম কিছুটা সামনে দিয়ে অনামিকা যাচ্ছে।অনামিকার হাতে একটি ব্যাগ।জানি না ব্যাগে কী আছে।অনামিকা সোজাসুজি কাজের লোকদের থাকার জন্য তৈরি বাড়িটার দিকে যাচ্ছে।সে সেখানে ব্যাগটা রেখে ইতিমধ্যে নির্মাণ সমাপ্ত হওয়া ঝুপড়ি দুটোতে ঢুকেছে।ঝুপড়ি দুটোর বিদ্যুৎ এবং জল জোগানোর সাজসরঞ্জাম গুলি লাগানো হয়েছে।আজ ব্যবহৃত বাঁশে পোকা না ধরার জন্য ঔষধ ছিটিয়ে দেবে আর তারপরে বার্নিশ করবে।এই কাজটুকু করলে ঝুপড়ি দুটিতে বিছানা পাতা এবং অন্যান্য সামগ্রী ঢোকানো যাবে।বাকি দুটি ঝুপড়ির বিদ্যুৎ জল পরিবহনের সরঞ্জামগুলি লাগানোর কাজ বাকি রয়েছে।আগামী দুদিনে সেই কাজটুকুও সমাপ্ত করতে হবে।আগামী দশ দিনের মধ্যে স্বপ্নের পর্যটন নিবাসটি বাস্তব রূপ লাভ করবে।

 আমাকে আসতে দেখে অনামিকা এগিয়ে এল।আমি গাছের নিচে পেতে রাখা একটা চেয়ারে বসলাম,সেও এসে পাশের চেয়ারটাতে বসল।

 --কোথাও গিয়েছিলেন?রুমে দেখতে পেলাম না যে!

 তোমার কী প্রয়োজন—ভেবেছিলাম এভাবে বলব।সকাল সকাল ওকে অপদস্থ করতে ইচ্ছা হল না।

 --সম্পাদকের ঘরে গিয়েছিলাম।

 --আমি কোনো সম্পাদক নই নাকি?না কি সম্পাদিকার ঘরে যান না?

 --সম্পাদিকা নিজের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করছে।সম্পাদক করছে না বলে তার ঘরে যেতে হল।আমাদের দুজন সম্পাদক বলে খারাপ হয়েছে।তবে তোমরা দুজন মিলিত হয়েছ কি?ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কী ভাবছ?

 --আপনাদের এইজন সম্পাদকও এসেছে দাঁড়ান।মুখোমুখি কথাগুলি খোলশা করে নেওয়া ভালো হবে।

 কিছুক্ষণ পরে সুনন্দ এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করল।

 --সুনন্দ, তুমি অনামিকার সঙ্গে কথাগুলি আলোচনা করেছ কি?দুজনে মিলে কথাগুলি আলোচনা করে মিলে-মিশে এগোবে।আমি আজ আছি,কাল নেই।নভেম্বরের শেষে আমার ছুটি শেষ।আমি চলে যাব।তোমাদেরই সবাইকে পরিচালনা করতে হবে।তোমাদের মধ্যে বিপিন ডেকা মানুষটি ভালো।তার উপরে নির্ভর করতে পার।

 --আপনি যে আমাদের মাঝখান থেকে চলে যাবেন,সেটা তো ভাবতেও খারাপ লাগে।

 --উপায় নেই।একেই বলে চাকরি।চাকুরীজীবীরা অতি বেশি সময়ের দাস।যাই হোকনা কেন তোমরা সংগঠনের নামে থাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তোমাদের সভাপতি সম্পাদকের সইয়ের দ্বারা টাকা উঠানোর মতো ব্যবস্থা করে নেবে।কমিটি গঠন হওয়ার আগেই অ্যাকাউন্টটা খোলা হয়েছিল বলে আমার নামেই করা হয়েছিল।পঞ্জীয়নের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন।ব্যাঙ্ক অফিসার হিসেবে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আমার সুবিধাও ছিল।এখন যেহেতু পঞ্জীয়ন হয়ে গেছে প্রত্যেককেই নিয়মের মধ্য দিয়ে এগোনো ভালো।তোমরা দুজন আগামীকাল গিয়ে কাজটা এগিয়ে রাখবে।সঙ্গে নীতি নির্ধারক কমিটির একটি বৈঠকও আগামীকাল অনুষ্ঠিত কর।সেখানে আমাদের আগামীকাল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।বিশেষ করে তিনটি ছেলেকে পর্যটক নিবাস পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য অভয়াপুরীর আস্থানায় পাঠাতে হবে।নিবাস দেখা-শোনার জন্য ব্যবস্থা করা রাঁধুনি এবং সহায়কদের বিষয়েও আলোচনা করতে হবে।নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করতে হবে।সে কথাও আলোচনা করতে হবে।ভবিষ্যৎ কার্যপন্থা কীরকম হবে আলোচনা করার জন্য পর্যটকনিবাস সমিতিটাও তৎকালে গঠন করতে হবে।দ্রুততার সঙ্গে করার মতো কয়েকটি কাজ আছে।

 আমি সুনন্দর দিকে কথাটা বলতে থাকার মধ্যে অনামিকা উঠে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।

 --কোথায় যাচ্ছ।আমার কথায় গুরুত্ব দিচ্ছ না নাকি।

 --এভাবে কেন বলছ উদয় দা।আপনি এরকমম ভাবলে খারাপ লাগে।আমি ব্যাগটা আনতে যাচ্ছি।

 --যাও।যাও।

 কাজ করা লোকদের জন্য তৈরি হওয়া বাড়িটার জন্য অনামিকা ব্যাগটা নিয়ে এল।ব্যাগের ভেতর থেকে সে একটা ফ্লাস্ক,একটা টিফিন এবং তিনটি ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া গ্লাস বের করল।

 --অনামিকা বৌ্দি কী এনেছ?

 --সকালের জলখাবার।

 --বাঃ সুন্দর।এতক্ষণ বলনি কেন।দাও তাড়াতাড়ি দাও।আমিও বাড়িতে কিছু না খেয়েই চলে এসেছি।আসলে আমার মন বলছিল তুমি আমাদের জন্য বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসবে।

 সুনন্দ এভাবে বললেও আমি বুঝতে পারছি অনামিকা এভাবে সকালের জলখাবার আনার কারণ কি।আমি যে ওকে বলেছিলাম তোমরা আমি এক কাপ চা খেয়েছি কিনা তাও জিজ্ঞেস কর না।আবেগিক মুহূর্তে আমার মুখ থেকে বের না হওয়া কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল এবং এটা তারই ফল।

 --কেন এনেছ এসব।প্রয়োজন ছিল না।

 --সত্যিই প্রয়োজন ছিল না নাকি?তাহলে রেখে দিচ্ছি।

 --বৌ্দি যা করার কর,মাত্র আমার অংশটুকু দিয়ে দাও।

 সুনন্দ অনামিকাকে খ্যাপানোর উদ্দেশ্যে বলল।

 ওকে এভাবে বললেও আমারও অবশ্য ক্ষুধা পেয়েছিল।হরিণের দোকানে সবসময় আসা যাওয়া হয় না।কখনও মেগী সিদ্ধ করে খেয়ে নিই।প্রায়ই খাওয়া হয় না।এভাবেই সারা দিন পার হয়ে যায়।জিজ্ঞেস করার মতো কেউ নেই।অনামিকা নিয়ে আসা কলাপাতায় দেওয়া পিঠা এবং লাল চা সহ আমাদের সকালের জলপান সুকলমে সম্পন্ন হয়ে গেল।

 পর্যটক নিবাস পরিচালনা করার প্রশিক্ষণের জন্য আমরা কাকে কাকে পাঠালে ভালো হবে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করা উচিত।সঙ্গে দুজন রাঁধুনী।যদি আমাদের প্রকৃ্তি কর্মীদের মধ্যে কোনো ভালো রাঁধুনী থাকে ,সেরকম দুজনকে পাঠানো ঠিক হবে।

 --তিনজন পরিচালক নির্বাচনের জন্য আমরা একটা কাজ করি চলুন।তিনজনেই একটা একটা করে কাগজ নিয়ে তাতে তিনটা করে নাম প্রস্তাব করি।তিনজনের মধ্যে যে তিনজন বেশি প্রাধান্য লাভ করবে তাদের নির্বাচিত করা হোক।হবে তো?

 অনামিকার প্রস্তাবটা খারাপ মনে হল না।আমরা তিনজনেই তিনটা কাগজ হাতে নিলাম।কিন্তু একটা কলম ছিল বলে অনামিকাকে প্রথম নামটা লিখতে বললাম।তারপরে সুনন্দ এবং সবার শেষে আমি তিনজনের নাম লিখলাম।অনামিকাকে বললাম এখন তুমি কাগজ তিনটাতে থাকা নামগুলি ডেকে দাও।আমাদের তিনজনকেই অবাক করে দিয়ে আমরা তিনজনেই একই নাম তিনটা লিখলাম—অচ্যুত,পুলক আর রাতুল।আগামীকাল আনুষ্ঠানিকভাবে তিনজনের নামটা প্রস্তাব করবে এবং পরের দিন তিনজনকেই অভয়াপুরী যাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলবে।সকালের বহাগী নামের রেলটিতে ওরা তিনজন বঙ্গাইগাওঁ যাবে।

 স্টেশন থেকে অভয়াপুরীতে অনেক ছোটো গাড়ি চলাচল করে।তাঁরা তাতেই অভয়াপুরী যেতে পারবে।আমি সৌ্ম্যদার মাধ্যমে সমস্ত যোগাড়-যন্তর করে রাখব,কোনো সমস্যা হবে না।

 নীতিনির্ধারক কমিটির সভাটা আগামীকাল সন্ধ্যা চারটায় এখানেই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল।

 সেই অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ের আগে তিনটার সময় অনামিকা এসে হাজির।হাতে একটা ব্যাগ।সারাদিনের কাজ কর্মের খতিয়ান নিয়ে আমি ঠান্ডা বাতাস পাওয়ার জন্য গাছের নিচে চেয়ার পেতে বসেছিলাম।নিজের অজান্তে আমি তন্দ্রালস হয়ে পড়েছিলাম।সামনে অনামিকাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম।

 --চমকে উঠলে যে,উদয়দা,কোনো দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন নাকি?

 যে অনামিকা আমি সামনে থাকলে কয়েকহাত দূরে চুপ করে থাকত, তুমি সম্বোধন করার পর থেকে দেখছি আজকাল ঝাঁঝালো সুরে কথা বলে। একই কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আপন বলে ভেবেই বলেছে। অনামিকা চেয়ারে বসে ব্যাগ থেকে দুটো টিফিন বের করল। তারপরে নিন বলে একটা থালা আমার দিকে এগিয়ে দিল।

 — কী করছেন?

 — আগে ধরুন ।তারপর জিজ্ঞেস করবেন কী করছি।

 যন্ত্রের মতো আমি থালাটা হাতে নিলাম। অনামিকা টিফিন দুটির একটি খুলে দেওয়ায় জুহা চালের গন্ধ ভেসে এল।

 — আমি দিনের বেলা ভাত খাই না।

 —জানি, রাতেও খান না। খেতে না পেলে কোথা থেকে খাবেন?

 মাঝেমধ্যে আমি ধর্ম সংকটে পড়ি। কখনও ছোটো ছোটো কথায় কখনও বড়ো বিষয় নিয়ে। অনামিকা টিফিন বক্স থেকে ভাত এবং ভাজা বের করে আমি ধরে থাকা থালার উপরে ঢেলে দিয়ে টিফিন বক্সটা বন্ধ করে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল তারপরে অন্য টিফিন বক্সটা খুলে তার মধ্যে থাকা তরকারির সঙ্গে থাকা টিফিনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।

 — এখন আমি উঠলাম, তারা কি কাজ করছে দেখে আসি। আমি থাকলে আপনি খেতে লজ্জা পাবেন। আপনাকে তো জানি। ব্যাগের ভেতরে জলের বোতল আছে। বের করার কষ্টটুকু করে নেবেন।

 অনামিকা সোজাসুজি কাজ করতে থাকা লোকগুলির দিকে এগিয়ে গেল। সত্যি অনামিকা পাশে থাকলে আমার ভাত খাওয়া হত না। আর এখনও ভাতগুলি একান্ত বাধ্য হয়েই খেতে হচ্ছে। মাগুর মাছ আর ভেদাইলতা আলুর ঝোল। সবুজ ঝোলের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা আলুর টুকরো গুলির সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে কেন যে ইচ্ছা হল। তিন টুকরো বড়ো বড়ো মাগুর মাছ। আজকের দিনটাতে আমার জন্য রীতিমতো অভিজাত খাদ্য। অনামিকা আসার আগে আমি কোনো মতে ভাতটা খেয়ে নিলাম।

 — বোতলটা দাও।

 — আমি জল ঢেলে দিলে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। হাতটা ধুয়ে নিন।

পরিবেশটা আমার কেমন যেন ভালো লাগল না। তথাপি আমি অনামিকার সঙ্গে সহযোগিতা করলাম। জলের বোতলটা আবার তার হাতে ফিরিয়ে দিলাম। অনামিকা বাসনপত্র গুলি গুছিয়ে নিয়ে ব্যাগে ভরে পুনরায় আমার কাছে বসল। খাবার কেমন হয়েছে সেও আমাকে জিজ্ঞাসা করল না, আমিও কিছু বললাম না।

 — উদয় দা, চলে গেলে আমরা চালাতে পারব কি? তার চেয়ে আপনি বরং এখানেই থেকে যান।

 — চাকরি ছেড়ে দেব নাকি?

 — ছেড়ে দিন।

 এত তাৎক্ষণিকভাবে অনামিকা বলেছিল যে বেচারার প্রতি আমার করুণা জন্মাল। প্রায় লক্ষ টাকার একটা চাকরি ছেড়ে দেওয়া কি মুখের কথা । তথাপি অনামিকাকে জানতে এবং বুঝতে আমার ইচ্ছা হল।

 — আমাকে কে খাওয়াবে?

 — আমি।

 — কোথা থেকে?

 — পর্যটক নিবাস থেকে। আমার পেনশন থেকে।

 কাকাবাবুর বৌমা সত্যিই এখনও ছোট্ট মেয়েটির মতোই রয়েছে। সংসারে প্রবেশ করেছিল মাত্র। বুঝে ওঠার আগেই সমস্ত কিছু কেমন যেন গন্ডগোল হয়ে গেল। আমি আর তার সঙ্গে কথা বাড়াতে চাইলাম না। আমি ভাবলাম এখন থেকে আমাকে সংযত হতে হবে। আমি চুপ করে রইলাম।

 — কী হল উদয় দা। ভয় পেলেন। আমি জানি আপনার মতো সরল মনের মানুষ পর্যটক নিবাস চালাতে পারবে না। ব্যাবসা এভাবে হয় না। আপনি যা যা বলেন সবাই বিশ্বাস করে। বুদ্ধি করে খরচ করতে জানে না।

 আমি চুপ করে রইলাম। অনামিকা আমাকে বুঝতে চাইছে বলে মনে হল।

 আপনি এতটা কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন অথচ একজন মানুষকেও কোনোদিন কোনো শক্ত কথা বলেন নি।

  — সেরকম ভাবে বলার প্রয়োজন হয়নি। ছোটো ছোটো কথাগুলি উপেক্ষা না করলে সংগঠন করবেন কীভাবে। সেই জন্য আমি সংগঠন করব আর তোমরা ব্যবসা। পর্যটক নিবাসের কমিটিটাতে আমি থাকব না, অরণ্য গ্রামের কমিটিতে থাকব। অরণ্য গ্রাম আমার স্বপ্ন।

 --আর পর্যটক নিবাস আপনার কাছে বাস্তব ।আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। নিবাসটা বন্ধ হয়ে গেলে?

 —তোমাদের যতটুকু দরকার আমি করে দিয়েছি, এখন যা করবে তোমরা।

 — আপনার টাকা পয়সা গুলি বিফলে যাবে নাকি?

 — আমি বললাম— অনেক প্রশ্নের উত্তর না থাকার মতো এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর আমার হাতে নেই।

 —-আপনার হাতে উত্তর আছে আপনি সেটাই স্বীকার করতে চান না।

  অনামিকা আর আমি তর্কের সুরে কিছু সমস্যার সমাধান আলোচনা করছিলাম। তখনই পুলক এবং রাতুল এল। সুনন্দ এবং বিপিন ডেকা এল। চারটার সময় আমাদের সভা আরম্ভ হল। নীতি নির্ধারক কমিটির সভা। আমরা আলোচনা করা অনুসারে অচ্যুত পুলক এবং রাতুলকে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত শুনে তিনজনই খুব আনন্দ পেল।। ওরা দশ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যাবে সমস্ত ব্যবস্থা সৌম্যদা করে রেখেছে বলে সকাল বেলা আমাকে ফোন করে জানিয়েছে। রান্নার কথা উঠায় পুলক বলল তার বন্ধুও মায়াপুরে যে অ্যাপেটাইজার নামে রেস্টুরেন্ট আছে সেও নাকি দুজন রাঁধুনি দিতে পারবে। দুজনেই ভালো রাধুনী। আমি বললাম তাদের সঙ্গে চুক্তিপত্র করে নিতে হবে। অন্যথা মাঝ রাস্তায় চট করে চলে গেলে সমস্যায় পড়বে। অবশ্যই ওরা যখন কাজ করতে শুরু করবে তাদের দুজন থেকে তোমাদের কেউ কেউ রন্ধন রন্ধন প্রকরণের বিষয়ে শিখে নিতে হবে। তাহলেই রান্নার সমস্যার সমাধান হবে। স্থানীয় প্রকৃতি কর্মী না পাওয়া গেলে তোমরা ক্ষতিকর ভাবে দুজনকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতে হবে।নীতি নির্ধারণ কমিটির সভায় আগামী রবিবার প্রকৃতি পর্যটন অর্থাৎ পর্যটক নিবাস এবং অরণ্য গ্রাম পরিচালনা করার জন্য দুটি কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির কোনো প্রকৃতি কর্মী যদি প্রকৃতি নিবাসে কাজ করতে চায় তাকে প্রাধান্য দেওয়াটা জরুরী বিবেচনা করতে হবে। সেই জন্য দুটি কমিটি গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। আজ বুধবার। আগামী রবিবার পর্যন্ত পারা যাবে কি? আমি নবজিৎ বৈশ্যকে জিজ্ঞেস করলাম। নবযুগের মতে না পারার কোনো কারণ নেই।

 আমরা সবার কাজ প্রায় শেষ করেছি। সেই সময় দেখতে পেলাম একদল ছেলে আমাদের দিকে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। দলটির সবচেয়ে বড় ছেলেটির বয়স চৌদ্দ বছরের মতো হবে। তার পেছন পেছন বিভিন্ন বয়সের একদল ছেলে। সে দৌড়ে এসে আমাদের বলতে শুরু করল যে সেখানে একজন মানুষ একটা গাছ কাটতে শুরু করেছে। আমরা বাধা দেওয়ায় আমাদের মারার জন্য তেড়ে এসেছিল। তার বাড়ির গাছ সে কাটবে কিনা কাটবে সেটা নাকি তার নিজস্ব ব্যাপার।

  আমি নবজিৎকে বললাম দুটো গাছের চারা নিয়ে সঙ্গে চল।গাছের চারা দুটি নিয়ে আমরা ছেলেদের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম। আমরা গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মানুষটা গাছটা কেটে প্রায় ফেলে দেবার উপক্রম করেছিল। আমরা যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম গাছটা তিনি কি প্রয়োজনে এই সন্ধ্যা বেলা কাটতে শুরু করেছেন তখন তিনি বললেন এমনিতে থাকার চেয়ে কেটে ফেলব ভাবছি। আমি নবম শ্রেণির ছেলেটিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম তুমি এখন কাকুকে বুঝিয়ে দাও আমাদের কেন গাছ কাটা উচিত নয়।ছেলেটিকে আমরা কেউ কিছু শিখিয়ে দিইনি। সে একনাগারে একটা গাছের উপকারিতা সম্পর্কে বলে গেল। গাছ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অম্লজান যোগায়।গাছ আমাদের ছায়া দান করে। ফলমূল দান করে আমাদের এখানকার মতো নদী তীরের অঞ্চলগুলিতে গাছ ভূমির ক্ষয় রোধ করে। গাছের শুকনো ডাল আমাদের কাছে ইন্ধন। কিন্তু সম্পূর্ণ গাছ একটা কেটে ফেললে আমাদের পরিবেশের উপরে তার খারাপ প্রভাব পড়বে। কথাটা বলে প্রথমেই ছেলেটি গাছ কাটা মানুষটার দিকে এবং পরে আমার দিকে তাকাল। ছেলেটির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই জোরে হাতে তালি দিয়ে উঠলাম।ছোটো ছেলেদের দলটি চেঁচিয়ে উঠল। এটা ভেবে ভালো লাগলো যে আমাদের অজ্ঞাতসারে বরকুরিহা গ্রামে আমাদের পাখিদের পাড়া প্রতিবেশীতে বয়স নির্বিশেষে প্রকৃতি আন্দোলন জেগে উঠেছে।

  —দাদা এই ছোটো ছেলেটি বুঝতে পেরেছে গাছের উপকারিতা এবং আপনি অপ্রয়োজনে একটা গাছকে হত্যা করেছেন৷

  মানুষটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। তিনি কী করবেন না করবেন বুঝতে পারছেন না। মানুষটাকে সহজ করে দেবার জন্য আমি বললাম এখন যা হবার হয়ে গেছে। যা হয়ে গেছে তাকে তো আর ফেরানো যাবে না। আপনি গাছটার কাছে একটা গাছের চারা লাগিয়ে দিন। আর ছেলেটি—কী কি নাম তোমার ভাই– নয়ন— এখন নয়ন তুমি অন্য গাছের চারাটা একটু দূরে লাগিয়ে দাও । মানুষটা একটা শব্দ ও উচ্চারণ না করে হাতে থাকা দা নিয়ে গর্ত খুঁড়তে লাগল। দুজনে দুটি চারা রোপণ করার পরে মানুষটাকে চারা দুটি প্রতিপালন করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে নমস্কার করলাম।

 আসার সময় নয়নকে জড়িয়ে ধরে সুন্দর কাজের জন্য তাকে প্রশংসা করলাম এবং ছোটো ছোটো ছেলের দলকে বললাম— তোমরা আসবে , আমরা একসঙ্গে চারাগাছ লাগাব। ছেলেদের মধ্যে অরণ্য সংরক্ষণের মনোভাব জেগে ওঠা কার্যকে আমরা আমাদের সফলতা বলে বিবেচনা করছি।

 পরের দিন আমরা এরকম অন্য একটি সমস্যার সম্মুখীন হলাম। আমাদেরই একজন প্রকৃতি কর্মী, নাম অবিনাশ। নলবাড়ি মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র। সকালবেলায় সে এসে আমি থাকা পর্যটন নিবাসের ঘরে উপস্থিত হল। জোরে সাইকেল চালিয়ে আসার জন্য তার কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। সে এসেই আমাকে বলল ওদের গ্রামের কয়েকজন ছেলে রাতে জাল পেতে একটা ভাম ধরেছে। সেটা নাকি আজ মেরে ভোজ খাবে। তাই আমাকে যেতে হবে। আমি নবজিৎকে ফোন করলাম। নবজিৎ তখনও বিছানায়।নব জিৎ কে বললাম কিছু মনে কর না এটা সময়ের দাবি। আমি ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিয়ে নবজিতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।দশ মিনিটের মধ্যে নবজিৎ এসে উপস্থিত হল।ঘটনাস্থলে আমাকে এবং নবজিৎকে দেখতে পেয়ে ভাম ধরা ছেলেরা অবাক। নবজিৎ বলল প্রায় প্রত্যেকই তার ছাত্র। ওদের মধ্যে কোনো একজন জালে বন্দি হয়ে থাকা জন্তুটাকে মারার জন্য খোঁচাতে শুরু করেছে, কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করছে। আমাদের দেখে ওরা পিছিয়ে এল। নবজিত বলল— তোরা পাগল হয়েছিস? এই অবুঝ জন্তুটার ওপর এত অমানুষিক অত্যাচার করছিস কেন? তোরা হয়তো জানিস না, অরণ্য আইন অনুসারে তোরা শাস্তির যোগ্য। ছেলেরা নিশ্চুপ।ছেলেদের একজন অভিভাবক দৌড়ে এসে নবজিৎকে জিজ্ঞেস করল কে আপনি? আপনি কে?

 নবজিৎ রুখে দাঁড়িয়ে বলল— আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করার আপনি কে? এই জন্তুটা ধরতে আপনি ছেলেদের সাহায্য করেছেন নাকি?জালটা কি আপনার ?

 ছেলেরা দেখল ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াচ্ছে। স্যার না রেগে যান।রেগে গেলে কি অবস্থা হতে পারে সেটা তারা বিদ্যালয়ে দেখতে পেয়েছে।

 — স্যার!স্যার! আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা না জেনেই—

 —কী ভুল হয়েছে তোদের? বন্য জন্তু,ইনি কি তার মালিক নাকি?

 অভিভাবকটি পুনরায় বেপরোয়া ভাব ভঙ্গিমায় উচ্চবাচ্য করতে লাগল। অভিভাবকের স্ত্রী দৌড়ে এসে মানুষটাকে হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল— ইনি আমাদের বাপুর স্যার, আপনি কেন এভাবে বলছেন। দেখি,আপনি এখান থেকে চলে আসুন।

 মানুষটার তখন চেতনা ফিরে এল। তিনি ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে পড়লেন।

  সেই সুযোগে আমি ছেলেদের বললাম— তোমাদের কেউ জন্তুটাকে চিনতে পেরেছ কি?

 —-স্যার ভাম।

  উপস্থিত ছেলের দলের মধ্যে একজন বলল।

 — তুমি ঠিকই বলেছ। এটাকে অসমিয়াতে তাড়ি খাওয়া ভাম বলা হয় । ইংরেজিতে এশিয়ান পাল্ম সিভেট। বৈজ্ঞানিক নাম পারাডকচারচ হারমাফ্রডাইটাচ। এই জন্তুটা এখন দুষ্প্রাপ্য জন্তুর সারিতে পড়ে। তোমাদের জন্তুটিকে ছেড়ে দিতে হবে। মাংসের জন্য হত্যা করার ফলে অসাম থেকে ভাম বিলুপ্ত হওয়ার অবস্থা হয়েছে। তোমরা এত ভালো ছেলে, বন্য জন্তু গুলিকে তোমাদের ভালোবাসা উচিত।এদের বাসস্থান বৃদ্ধি করার জন্য গাছ রোপণ করতে হবে। দেখতো প্রাণ রক্ষার জন্য কীভাবে সে সজল নয়নে তোমাদের দিকে তাকাচ্ছে। ভামটার এই অবস্থা দেখে তোমাদের মধ্যে কার কার খারাপ লাগছে হাত ওঠাও। একজন ছাড়া প্রত্যেকেই হাত উঠাল। যে ছেলেটি হাত উঠায়নি তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কেন হাত উঠায় নি। তার মতে পৃথিবীর সমস্ত কিছুই মানুষের ভোগের জন্য।ভামটা নিজের ভোগের জন্য ইঁদুর খায়।আমি তাকে বললাম তুমি কেন ভাবছ যে নিজে খাওয়াটাই ভোগ। সে ইঁদুর খায়, সেটা তার খাদ্য। ভাম নিজের ভোগের জন্য তোমার খাদ্য খায় না। তুমি তার গতিবিধির লক্ষ্য করে, তাকে সংরক্ষণ করে ও ভোগ করতে পার। পাখ-পাখালি, জীবজন্তু গুলি মরে না গেলে তুমি তোমার সন্তানরা কী নিয়ে ভোগ করবে। ছেলেটি নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম, তোমরা এসো, আমরা একসঙ্গে পাখ-পাখালি জীবজন্তু ইত্যাদির সংরক্ষণের জন্য কাজ করব। তারপর দেখবে হত্যা করার চেয়ে জীবন দান করায় বেশি ভোগ করা যায়। দশের হিতের জন্য ত্যাগের সঙ্গে কাজ কর। এখন তোমরা একে ছেড়ে দাও। দেবে তো?

 প্রতিবাদ করা ছেলেটিই প্রথম বলল– হ্যাঁ স্যার দেব।

 ওরা ভামটাকে ছেড়ে দেবার যতই চেষ্টা করছে, সে ততই জালটাতে আরও জড়িয়ে পড়ছে। জালটার এক মাথায় ধরে তুলে দিয়ে আমি একটু কষ্ট করে ভামটাকে ছাড়িয়ে আনলাম। ভামটা তীব্র বেগে দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

 এই ঘটনা থেকে আমরা কয়েকটি শিক্ষা গ্রহণ করলাম। প্রথমে আমাদের স্থানীয়ভাবে কয়েকটি সজাগতা শিবিরের আয়োজন করতে হবে। আমরা একটি ফোন নাম্বার সবাইকে দিতে হবে যাতে এই ধরনের ঘটনার বিষয়ে কেউ কোনো খবর পেলেই আমাদের প্রকৃতি কর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেবে।

 মাছ মারা জালে ফেঁসে যাওয়া সাপের উদ্ধার, খাঁচায় বন্দি করে রাখা পাখিকে মুক্ত করে দেওয়া এই ধরনের কয়েকটি কাজ আমাদের প্রকৃতি কর্মীরা শুরু করেছে। সাপের বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করা নবজিৎ বর্মন কর্মীদের সাহায্য করছে। ফোন পেলেই নবজিৎ দৌড়ে আসে। নতুন নতুন কর্মগাঁথুনির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে অরণ্য গ্রাম এবং পর্যটন নিবাসের কাজ।

 আজ রবিবার। আজ পর্যটক নিবাস এবং অরণ্য গ্রাম পরিচালনা করার জন্য দুটি কমিটি গঠন করার কথা। সময় দেওয়া হয়েছে এগারোটার সময়। নয়টা থেকে প্রকৃতি কর্মীরা ইতিমধ্যে রোপণ করা প্রতিটি গাছের চারার দেখাশোনা করবে। গোড়ায় গজিয়ে ওঠা জঙ্গল পরিষ্কার করবে। বেড়াগুলি মেরামত করবে। কোথাও কোনো চারা যদি মরে যায় তাহলে সেই জায়গায় নতুন চারা লাগাবে। এগারোটার সময় প্রত্যেকেই মিলিত হবে সাংগঠনিক ভিত্তি সবল করার জন্য। অচ্যুত ,পুলক এবং রাতুল ইতিমধ্যে অভয়া পুরীতে গিয়ে শৈলেশদার অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। আমি তাদের নিয়মিত খবরাখবর করছি।

 সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তির তৎপরতায় পর্যটক নিবাস উদ্বোধন করার জন্য প্রায় প্রস্তুত হয়ে উঠেছে।


শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কবিতা। । আর জি কর ।। কাশীনাথ সাহা, #RGKAR

কবিতা। । আর জি কর 

কাশীনাথ সাহা 



প্রতিবাদ আজ পথে প্রান্তরে

লক্ষ কণ্ঠে একই স্বর 

অভয়ার বিচার চেয়ে 

গর্জে ওঠে আর জি কর। 


কে কোন দল কোন সে ঝান্ডা 

ভুলে রাজপথে মিলিত স্বর 

অলি গলি রাজপথ জুড়ে 

প্রবল প্লাবন আর জি কর। 


রক্তস্রোতে দামামা বাজে

জনপ্লাবনে ছেড়েছি ঘর

বুকের পাঁজরে অস্ত্র বানিয়ে

যুদ্ধে নেমেছে আর জি কর। 


শাসক যখন চক্রান্তে 

আড়াল করে বংশধর 

তখনই তো প্রতিরোধে স্থির

বিচার চাইছে আর জি কর। 


শিরদাঁড়াহীন স্তাবক তুমি 

তোমার নেই কণ্ঠস্বর

তোমাকে ছাড়াই উজ্জীবিত 

লক্ষ কণ্ঠে আর জি কর। 


আমরা যাঁরা নেহাত শুধুই

গনতান্ত্রিক দিন প্রহর

পথে প্রান্তরে আমারও আজ

বিচার চাই আর জি কর।


শাসক যতোই নির্দেশ বলে

থামিয়ে দেয় বাহির ঘর

প্রতিবাদ ততোই সোচ্চার হয়ে 

কাঁপন ছড়ায় আর জি কর। 


দেউলিয়া এই সমাজেই আজ

বরাভয় হয়ে পরস্পর 

হাতে হাত রেখে মশাল জ্বালিয়ে 

প্রতিবাদে স্থির আর জি কর। 


জনতা যখন প্লাবন হয়

সমুদ্র স্রোতে প্রবল স্বর

রাজদন্ড খড়কুটো হয়

বুঝিয়ে দিচ্ছে আর জি কর।


এই প্রতিবাদ অবিশ্রান্ত 

চলবেই রাত্রি তিন প্রহর

কে থামাবে এই সংগ্রাম 

লক্ষ কণ্ঠের আর জি কর।

রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৯ ।। পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

 পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৯


পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   


মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  

Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

তৃতীয় অধ্যায়, নবম অংশ 



(নয়)

 গাছের চারা রোপনের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটক নিবাসের কাজও পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। গাছের চারা রোপনের কাজ প্রতি রবিবার এবং সরকারি বন্ধের দিনে করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকতা করা সদস্যদের সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ।

 আমি এবং নবজিৎ কংক্রিটের কাজ গুলি কিভাবে করেছে নির্দিষ্ট কংক্রিটের দোকানে দেখতে গেলাম। আমাদের দেওয়া মাঠ অনুসারে কাজ করা ছেলেটি খুটিগুলি ঢালাই করে রেখেছে। প্রতিটি ঝুপড়ির জন্য আমাদের কুড়িটা করে প্রায় একশোটা এই ধরনের খুঁটির প্রয়োজন হবে। কংক্রিটের দোকানির নাম সুমন্ত। যুবক ছেলে। শীর্ণকায়, মুখভর্তি দাড়ি। পরনে প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া একটা জিন্স প্যান্ট, বর্ণহীন একটা স্পোর্টিং। কথার মধ্যে তিনি দাড়ি চুলকাতে থাকেন এবং পুনরুক্তি করে বলতে থাকেন হয়ে যাবে। হয়ে যাবে।

 আমি সুমন্তকে বললাম–তুমি হয়ে যাবে, হয়ে যাবে বলছ কিন্তু তুমি দেখছি মাত্র চল্লিশটা খুটি ঢালাই করেছ।

 — দাদা, এইগুলি ব্যবহার করেই আগে বাড়িটা তৈরি করে নিন। আপনাদের দুটো ঘর তৈরি করতে করতে আমার আর ও দশটা ঘরের কাজ হয়ে যাবে।

 –কী বলছ হে। তোমার এতটাই আত্মবিশ্বাস?

 — দাদা। আপনাদের বীম ঢালাই করা কাজ আমি আগামীকাল ওখানে গিয়ে আরম্ভ করব। এই কয়েকটির ফরমা খুলতে পারা হওয়া পর্যন্ত বীমগুলি তৈরি হয়ে যাবে। খুঁটিগুলি সুন্দর করে কিছুটা পুঁতে তার উপরে বীম গুলি দাঁড় করিয়ে দেব। খুঁটির খাজে বীমগুলি সুন্দরভাবে খাপে খাপে বসে যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছি। বাড়িটার মূল বাঁশের খুঁটিগুলি পুঁতে সেগুলি মশলা দিয়ে ঢালাই করা পর্যন্ত, আমার ষাঠটা খুঁটি রেডি হয়ে যাবে। আপনাদের এই দুটি ঘরের কাঠি কামির কাজ শেষ করতে আমার মতে আরও একমাস লাগবে।

 – তারমানে তুমি দুটো করে বাড়ি তৈরি করার কথা বলছ?

 — আপনি ভাবছেন চারটি একসঙ্গে করব। এরকম করা ঠিক হবে না। দুটো দুটো করলে কাজটা ভালো হবে এবং কাজেরও আয় হবে।

 আমি সুমন্তের কথায় একমত হলাম এবং তাকে স্বাধীনভাবে তার মতে কাজ করার সুবিধা দিলাম।

 পুলক পর্যটক নিবাসের জায়গায় অস্থায়ীভাবে একটা বাড়ি তৈরি করেছে। একটা চাপাকল বসিয়েছে। নদী থেকে মোটর দিয়ে জল তোলার জন্য সুবিধা আছে যদিও কারেন্টের কাজটুকু আর ও পনেরো দিনের মতো সময় লাগবে। বাঁধ থেকে কারেন্ট আনার জন্য তিনটি খুঁটির প্রয়োজন হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের হাতে বর্তমানে অতিরিক্ত খুঁটি নেই। দুই একদিনের মধ্যে এসে যাবার কথা। খুঁটি এলে প্রথমেই নাকি আমাদের এখানেই দেবে। নবজিৎ তার সম্পর্কীয় একজন মানুষের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছে। দুই ঘর মানুষের মাটির উপর দিয়ে কারেন্টের খুঁটি যাবে। তাদের কাছ থেকে আপত্তি বিহীন প্রমাণপত্র নিতে হবে। তারা মাটির সীমানা দিয়ে বিদ্যুতের তার টানলে কোনো আপত্তি নাই বলে লিখিতভাবে দিয়ে দিল। সীমা দিয়ে তার টানার ফলে তারা এক পয়সাও খরচ না করে বিদ্যুতের সুবিধা লাভ করবে।

 ঝুপড়ি তৈরি করার জন্য ভালুকা বাঁশ স্থানীয়ভাবে কেনার সুবিধা হয়েছে। বাঁধের তীরের কয়েক ঘর মানুষের পর্যাপ্ত পরিমাণে ভলুকা বাঁশ আছে। তবে তারা সুযোগ বুঝে দেড়শো টাকার বাঁশের দাম একশো সত্তর টাকা চাইছে । তথাপি বাঁশগুলি ভালো। পরিপুষ্ট এবং সোজা। পুলক এবং রাতুল বাঁশগুলি কিনে এনে স্তূপীকৃত করে রেখেছে। আমি পুলককে তার মধ্যে কতগুলি বাঁশ আছে জিজ্ঞেস করায় সে বলেছে–আশিটা। আমি পুলককে বললাম আরও লাগবে। সে তখন বলল যে আপাতত এই বাঁশগুলি দিয়েই কাজ চলে যাবে। শুধু জাতি বাঁশই লাগবে। আমি আসলে মনে মনে বাঁশের হিসেবই করে রেখেছিলাম, জাতি এবং ভলুকা বাঁশের কথা ভুলে গিয়েছিলাম।

 – জাতি বাঁশ কবে আনবে?

 – কাটা হয়েছে। আনিয়ে নিলেই হবে। আজ সন্ধেবেলা এসে যাবার কথা। ট্রাক্টরটা কোথাও ভাড়া খাটতে গেছে। সেখান থেকে ফিরে এলেই বাঁশগুলি নিয়ে আসার কথা। আমি ফোন করেছিলাম।

 আমরা দুজনেই কথা বলার সময় চিন্তু নামের নবম শ্রেণিতে পড়া একটি ছেলে কাঁধে করে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে আমাদের দিকে আসছে। আমি উপলকে জিজ্ঞেস করলাম– ছেলেটি স্কুলে পড়ে? সে এখনও স্কুলের ইউনিফর্ম পরে রয়েছে । ওকে এখানকার কাজে কেন লাগিয়েছ? পড়াশুনা করা ছাত্রের এখানে কোনো পরিশ্রমের কাজ নেই। ওরা গাছের চারা বহন করলে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু চেয়ার বহন করতে পারবে না। পুলক, এখন থেকে ব্যাপারগুলিতে সাবধান হবে।

 আমি লক্ষ্য করলাম আমার কথা শুনে পুলকের গৌর বর্ণ মুখটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

 সে বলল– খারাপ পাবেন না উদয়দা। ভবিষ্যতে আর এই ভুল হবে না।

 আমি একটা কথায় লেগে থাকলাম না। থাকার প্রশ্নই উঠে না। আমি পুলককে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম– সৌম্যদা পাঠানো দুজন মানুষ আজ এসে যাওয়ার কথা ছিল। তাদের কোনো খবর পেয়েছ কি?

 – জানতে পারিনি।

 – মানুষ দুটির মোবাইল নাম্বার সৌম্যদা নবজিতকে দিয়েছে। তুমি খবর নাও, না হলে ওরা গিয়ে নলবাড়ি পৌছাবে এবং অনর্থক হয়রানি হবে।

 পুলক নবজিতকে ফোন করার জন্য একটু দূরে সরে গেল। চিন্তু আনা প্লাস্টিকের চেয়ার একটাতে বসে নিয়ে আমি শরীরটা ছেড়ে দিলাম।

 সময় নিজস্ব হিসেব এবং গতিতে এগিয়ে চলেছে। সুমন্ত খুটির উপরে বীমগুলি সংস্থাপিত করেছে। সে সেইটুকু কাজ করার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে কিছু বেশি সময় নিল। বীমগুলি খুঁটির উপরে বসানোর জন্য তাকে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছিল। তার কাজটুকু শেষ হওয়া পর্যন্ত সৌম্যদা পাঠানো দুটি মানুষ দুদিন অপেক্ষা করল। কাজ শুরু করার পরের দিনই একটা ভালো খেলা দেখিয়ে দিল।

 নবজিত এসে আমাকে বলল যে সৌম্যদার পাঠানো মানুষ দুটির নাকি একটু পানীয় দরকার। সে পানীয় না হলে নাকি কোনো কাজ করতে পারে না। গত দুদিন তারা এখানে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে জোগাড় করতে না পেরে আজ সকাল বেলা আমাকে জানিয়েছে। ওরা দুজন এভাবে অনুনয় বিনয় করছে যে সেই পানীয় গলাধ:করণ করতে না পারলে ওরা কাজই করতে পারবে না।

 – তারা জনজাতীয় মানুষ। বাড়িতেই মদ তৈরি করে। কাজে যাবার সময় এক ঢোক গিলে যায়। তাই সম্ভব হলে তুমি একটু জোগাড় করে দিয়ে যাও।

 মদের বিষয়ে নবজিতও একেবারে অভিজ্ঞতাহীন। একজনের মাধ্যমে তাদেরকে একটা লং প্যান্ট আনিয়ে দিল।

 — লং প্যান্ট?

 লংপ্যান্ট কী আমি বুঝতে না পেরে নবজিতকে আশ্চর্য হওয়ার ধরনে জিজ্ঞেস করলাম।

 – উদয়দা। আমিও এদের ভাষা শুনে আশ্চর্য।ওরা ফুল মদের বোতলকে লং প্যান্ট, হাফ মদের বোতলকে হাফপ্যান্ট এবং কোয়ার্টার আকৃতির মদের বোতলকে আন্ডারপ্যান্ট বলে ইশারার সাহায্যে বোঝায়। চৌরাস্তার পান দোকানটাতে গিয়ে হাফ বা আন্ডার বললে দোকানদার ঠিকই বুঝে যায়।

 তখন নবজিত লংপ্যান্ট একটা কিনে এনে দুজনের দিকে উপহার হিসেবে এগিয়ে দিল। বোতলের লালমদ পাওয়ার পর ওদের দুজনকে আর পায় কে। কাজকে মাঝপথে ঠেকিয়ে রাখল। বোতলটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুজনে বসা থেকে উঠল না এবং শেষ পর্যন্ত জায়গাতেই ঘাড় মটকা খেয়ে এক দিনের চেয়েও বেশি শুয়ে থাকল। নবজিতের ভয় হল, মানুষ দুটি মরে যায় যদি। সেরকম কোনো অঘটন ঘটল না। আগের দিন দুপুরবেলা খেতে বসা মানুষ দুটি পরেরদিন সন্ধ্যা বেলা জেগে উঠে নবজিতের পা খামচে ধরে দুঃখ প্রকাশ করল এবং কোনমতেই সৌম্যদাকে না জানানোর জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগল। নবজিত জানাবে না বলায় দুজনেই কিছুটা আশ্বস্ত হল। ঘটনাটা অবশ্য আমাদের জন্য লাভ দায়ক হল। ছোটোখাটো মানুষ দুটি এভাবে কাজ করতে পারে বলে না দেখলে বিশ্বাস করে যেত না। তাদের কাজে শৃঙ্খলা এবং নিপুণতা আছে। অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তারা কাজে যথেষ্ট তৎপরতা দেখাল।

 প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কাজ করতে থাকা মানুষ দুটির দিকে তাকিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে থাকি– ভাবি, কাজগুলি শেষ করে কখন গোটানো যাবে! বীমের উপরে বাঁশ বাধা ঝুপড়ি দুটোর দিকে তাকাতে তাকাতে আমি মনে মনে পূর্ণাঙ্গ পর্যটক নিবাসের রূপ দেখতে পাই। হাজিরা কাজ করা কামলা দুটি সাধারণভাবে সীমার বেড়া দিয়ে পাশেই বিজলী বাঁশের গোছাগুলি রোপণ করছে। আজ এতদিন ধরে লক্ষ্য করছি কাজ করা এই মানুষ দুটিও নিজের বাড়ির কাজ করার মতো সারাদিন কাজ করে থাকে। সাধারণত দেখতে পাওয়া কামলার মতো সাদা বিড়িতে এদেরকে মজে থাকতে দেখা যায় না। মানুষ দুটিকে এটা করুন, ওটা করুন বলে পেছনে লেগে থাকতে হয় না, সেটাই আমাদের কাছে সুখের কথা। এরকম মানুষ আজকাল পাওয়া কঠিন। তার মধ্যেই তিন টাকা দামের চাল পাওয়া মানুষগুলি সিংহাসনে বসল, কামচোর হল।

 দ্রুত গজিয়ে উঠা বিজলী বাঁশের সীমার ভেতরে চারটি ঝুপড়ি। একটা বেশ বড়োসড়ো রান্নাঘর। রান্নাঘরের সামনে একশো জন বসতে পারার মতো একটি হল ঘর। দশ জন মানুষ একসঙ্গে বসতে পারা ছোটো খাটো একটি গ্রন্থাগার। আমার স্বপ্নের আয়তন ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল। এই চারটি ঝুপড়ি থেকে অনতি দূরে আরও চারটি ঝুপড়ির জন্য সুন্দর করে জায়গা ছেড়ে রাখা আছে। মোটামুটি আটটা পর্যটক নিবাস হলে ব্যাবসা হিসেবে লাভজনক হওয়াটা নিশ্চিত। ততটুকু করতেই হবে। কাজ আরম্ভ করার এক মাস হয়েছে। আজ সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন। আমরা আশা করছি রাস পূর্ণিমার দিনটিতে এই পর্যটক নিবাস উদ্বোধন করতে পারব । আমি দেখতে পাচ্ছি রুপোর কাসির আকৃতির চাঁদটা ধীরে ধীরে দিগন্ত ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমাদের গালে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে রুপালি আলোক বিন্যাস।এয়োতিরা মঙ্গলসূচক জোকার দেবার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আমরা সামগ্রিকভাবে প্রবেশ করব আমাদের স্বপ্নের গৃহে।

 সুনন্দকে এই দিকে আসতে দেখে আমার দিবা স্বপ্ন কোন মুলুকে পালিয়ে গেল। এত কল্পনা ভালো নয়। আমি নিজের মনেই বললাম।

 গত দুদিন আমি সুনন্দের খবর নিতে পারিনি। কাজের ব্যস্ততা। কখন সকাল হয় আর কখন রাত হয় আমি বুঝতেই পারি না।

 — সুনন্দ এসো। এসো। আমি তোমার খবর নিতে পারিনি।

 সুনন্দ এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল।

 — কী বলছেন উদয়দা, আমার হে আপনার খবর করা উচিত। কিছুটা সুস্থ হয়েছি যদিও ডান হাতটা একটু ভারী জিনিস হলেই তুলতে অসুবিধা হয়।

 – মনে হয় একজন ফিজিওথেরাপিস্টের সঙ্গে তোমার আলোচনা করা উচিত।

 – আমি বাড়িতে ফেরার সময় হাসপাতালেই দু একটি এক্সারসাইজ দেখিয়ে দিয়েছে। সেই দুটো ধীরে ধীরে করছি।

 সেই অভ্যাস নিয়মমাফিক করে যাও, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।

 আমি সুনন্দকে সান্ত্বনা দেবার সুরে বললাম। তারপরে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম— জ্যোৎস্না কেমন আছে? তাকেও একটু সাবধানে চলাফেরা করতে বলবে। চাপা কলের পারে এবং বাথরুমে যাবার সময় সাবধান হতে বলবে।

 অতি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির মতো আমি বলা কথাটা শুনে সুনন্দ সম্মতি সূচকভাবে মাথা নাড়ল। আমি সুনন্দকে’ দহিকতরার’ কাজকর্ম গুলি কীভাবে চলছে তার আভাস দিতে লাগলাম।

 — সংবিধানের কাজ শেষ হয়েছে। আজ নবজিত ডিটিপি করে এনে তোমার ওখানে যাবে। তোমাদের দুজনের সেখানে কী কী প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় আছে ভালোভাবে পড়ে দেখবে। তেলিয়া কথাগুলি একেবারে বাদ দেবে। সংবিধানের কাজটা দ্রুত শেষ করে পঞ্জীয়নের কাজ আরম্ভ করতে হবে। দ্রুত পঞ্জীয়ন করে নিতে পারলে ভালো।

 সুনন্দ সায় দিয়ে বলল– ঝুপড়ি গুলির কাজও অনেকটা এগিয়েছে ।

 – হলেও আরও একমাস লাগবে।

 – লাগবে ।লাগবে। ছোটো ছোটো কাজগুলিতে বড়ো কাজের চেয়ে বেশি সময় লাগে।

 সুনন্দ আমাকে কিছুক্ষণ সঙ্গ দিয়ে চলে গেল। যেভাবে দিনকে সম্বোধন করে সন্ধ্যেবেলা বিদায় মাগে।

 অন্যান্য দিনের মতো কাজ দেখার জন্য আসতে সন্ধ্যাবেলা আমার কিছু দেরি হল। বহুদিন পরে দিনের বেলায় একটু ঘুমোলাম। বিছানায় লম্বা হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে যেতেই ঘুমে চোখ বুজে এল। আমি এসে দেখতে পেলাম অনামিকা এসে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে।সৌম্যদা পাঠানো মানুষ দুটি অনামিকার সঙ্গে কথা বলছে। আমি তার কাছাকাছি যেতেই মানুষ দুটি তার সঙ্গে কথা বলছেই। আমি তার কাছে পৌঁছাতে অনামিকা বলল— এদের এখানে কাজ করতে ভালো লেগেছে নাকি। কথাবার্তা শুনে খুব খুশি হয়েছে।

 — কথা সেটা নয়। সন্ধ্যায় নবজিত দু'জনকেই হিসেবের পানীয় যোগান দিয়ে চলেছে, এইজন্যই তাদের এত ফুর্তি।

 — অন্যান্য দিন তাড়াতাড়ি চলে আস। আজ দেরি হল যে?

 অনামিকা আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করায় আমি বলতে চাইছিলাম আমার ব্যক্তিগত কথাগুলিতে তোমার কী প্রয়োজন। কিন্তু এই কয়েকদিন আমার ব্যক্তিগত বলে কোনো কথা নেই।প্রতিমুহূর্তে জনগণের কাজেই মনোনিবেশ করছি ।তাই অনামিকাকে সামাজিকভাবেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

 — অনেকদিন পরে দিনের বেলা ঘুমোলাম। তার আগে আমি সুনন্দ এবং নবজিৎ পঞ্জীয়নের কাগজপত্র গুলিঠিকঠাক করে নবজিতের হাতে তুলে দিলাম। পঞ্জীয়নের জন্য কাজগুলি সে অন্য একজনকে সঁপে দেবে। সময়ের অভাবে নবজিতকে কাজগুলি বিভিন্ন জনের মাধ্যমে করাতে হচ্ছে। খরচ পড়ছে যদিও এখন পর্যন্ত কোনো রকম চিন্তা না করেই কাজগুলি হয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ সংযোগও ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। বিদ্যুতের সংযোগ নবজিৎ এভাবে অন্যের মাধ্যমে করেছে। সঠিকভাবেই কাজগুলি সম্পন্ন হয়ে চলেছে। তুমি দেখতেই পাচ্ছ।

 —আপনার উদ্যোগে হওয়া কাজ, কেন হবে না।

 আমি বুঝতে পারলাম না অনামিকা আমাকে টিটকারি মেরে কথাগুলি বলল নাকি প্রশংসা সূচক মন্তব্য করল। কাজ দেখতে আসা অনামিকা এভাবে বলে কাজের তদারক করতে গেল। আমাদের পুরোনো কামলা দুজনের সঙ্গে এবং চারজন শ্রমিক রান্না ঘরের কাজ শেষ করেই হল ঘরটার কাজ করতে শুরু করেছে। আর দু দিনের মধ্যেই ঘরের কাজ শেষ হয়ে যাবে। মাপ দিয়ে আনা দরজার বেড়াগুলি দেবার জন্য কাজ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে।গাঠিগুলি ঝুলিয়ে দিয়ে গেলেই হল ।হলঘরটার কাজ শেষ হলে শ্রমিক থাকা ঘরটার কাজ করতে হবে। সেই ঘরটার কাজ শেষ হলে নিচটা পাকা করার কাজ করতে পারা যাবে ।পাকা মিস্ত্রিকে বলে রাখা আছে। পাড়া এটা পেতে তার উপরে বালি সিমেন্টের মসলা লাগিয়ে বেঞ্চ এটা পাকা করে দেবে। চারটি ঝুপড়ির মধ্যে পাতার জন্য দাড়ি পাতা মানুষ চারজন গত তিনদিন ধরে কাজ করছে। তাদের এখনও তমাল তোলার শেষ হয়নি।

 স্থানীয় দুজন কাজ করা মানুষের সঙ্গে যোগ দিয়ে সৌম্যদা পাঠানো দুজন মানুষ চারটা ঝুপড়ি ঘরের দুটো ঝুপড়ির কাজ প্রায়শেষ করে ফেলেছে। সবুজ টিনগুলি পরিপাটি করে সাজিয়ে ইতিমধ্যে লাগানো হয়েছে। শুধু দেখার জন্য সুন্দর করতে গিয়ে কিছু জালি লাগানোর কাজ এবং বারান্দায় বাঁশের তৈরি নকশাটা বাকি। সুমন্ত বাকি ঝুপড়ি দুটির পাকা খুঁটি পুঁতে বীমগুলি উঠিয়ে রেখেছে।আজ ভুলুকা বাঁশের খুটিগুলি মসলা দিয়ে পুঁতে ফেলার কথা। দুর্গাপূজার পরিবেশ হলেও গরম রয়েছে। দূর দিগন্তে সাদা মেঘ শরতের আকাশে ভিড় করেছে।

  অনামিকা কাজের পর্যবেক্ষণ করে পুনরায় ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল— আমাদের বাড়িতে যাননি দেখছি উদয় দা।

 —কাজ নেই যে,সেই জন্য যাওয়া হয়নি।।

 — এভাবে বলছেন যে। কোনো কারনে খারাপ পেয়েছেন নাকি?

 —পেয়েছি তো। কাজ আরম্ভ হওয়ার এতদিন হয়ে গেল তোমাদের কারও খবরই নেই। সম্পাদক হয়ে বাড়িতে বসে আছ?

 —আপনি কোনো কাজ দেননি।

 — কাজ আমি তোমাকে দেব না তুমি আমাকে দেবে? আমি উপদেষ্টা।

 — হবে। বুঝতে পেরেছি।

 — কী বুঝেছ?

 নিজের অজান্তে কীভাবে অনামিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আপনি থেকে তুমি হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আমার প্রশ্নের উত্তর অনামিকা দিল না।পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে সে স্যান্ডেলের সামনের দিকটা চুলকাচ্ছে। তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে চারপাশে তাকাচ্ছে। হয়তো সে এই সময় কেউ এলে রক্ষা পাবে। দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে রয়েছে। সামনে কাজ করা মানুষ কয়েকজন নিজের নিজের ভাগের কাজগুলি এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

 —-আমি যাই উদয় দা।

 — যাও।

 —আর কোনোদিন আসব না ।

 — তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি সেরকম করবে না। আমি বড়ো আশা নিয়ে কাজগুলি এগিয়ে নিয়ে চলেছি।বাড়ির মানুষ বলে ভাবা মানুষগুলি এত নিঃসঙ্গভাবে ছেড়ে দিলে কি ভালো লাগে। তোমার কথা আমি বলছি না। কাকাবাবু কাকিমা একবারও কি আমার খবর নিয়েছে। জ্যোতিমালা খবর নিয়েছে?উদয়দা একা আছে, চল একবার গিয়ে এক কাপ চা খেতেই বলি, সুনন্দ অসুস্থ না হলে সে আমার সঙ্গে থাকতো। নবজিৎ বেচারা স্কুলে যাওয়ার আগে একবার স্কুল থেকে এসে একবার খবর নেয়।পুলক রাতুল বাঁশ থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যন্ত সবাইকে সামলাচ্ছে। অশ্রুত নিজের ব্যবসা আমার কথায় বাদ দিয়ে এখন বাজারে গিয়েছে।। সে লাইট জলের সাত সরঞ্জাম কিনবে। দূরত্বে আছে বলে জেপি ছটফট করছে। সে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা একবার হলেও ফোন করে খবর নেয়। আর তোমরা?

 — আপনি আমাকে দোষারোপ করবেন না। আমাদের মাঝখানের সম্পর্ক আপনি সম্বোধনের জন্য নিতান্তই দূরত্বে ছিল।

 —জুলিয়েটরা এখনো এতটা আপন হয়নি, কিন্তু জ্যোতি মালা?

  তার কথা আমি জানিনা উদয়দা।আজ থেকে দেখবেন আমি কাজ করি না করি।

 আমরা কথা বলার সময় বিপিন দেখা স্কুলের ছাত্র কয়েকজনকে নিয়ে এসেছে। ওরা আগে আমাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে আসেনি।।

 —- ওদের স্কুলের অবসর প্রাপ্ত একজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। স্কুল ছুটি দিয়েছে। তাই ওদেরকে ধরে নিয়ে এসেছি। গাছের চারা গুলিতে জল দেবার জন্য। আশার পথে রাস্তায় ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছি— ওরা গাছপালা ভালোবাসে কিনা। ভালোবাসি বলায় বললাম চল আমার সঙ্গে। ভালোবাসি না বললে কান মুলে দিতাম। এখন ছেলেরা, যা বালতি নিয়ে নে এবং নদীর থেকে জল তুলে এনে গাছের গোড়ায় দে।

 —দাদা ওদেরকে নদী থেকে জল আনতে হবে না। মোটরের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।সুইচ দিলে জল এখন হাতের কাছে।

 —ও আমি শুনেছি দাঁড়াও, তুমি নাকি থানেও কানেকশন করে দিয়েছ ।জল তোলার জন্য একটা মোটরও না কি দিয়েছ।

 —সেসব সাধারণ কথা।নয় কি? দাঁড়ান দাদা আমি ওদের সুইচটা দেখিয়ে দিয়ে আসি।

 আমি শুনতে পেলাম বিপিন ডেকা অনামিকাকে জিজ্ঞেস করছে— কেমন আছ?

সে চট করে জবাব দিল— কাজে সাহায্য না করার জন্য উদয়দার কাছ থেকে এইমাত্র বকুনি খেয়েছি।

 তারপর দুজনে একই কথা বলল আমি শুনতে পেলাম না। ছেলেরা মোটরের জল পেয়ে খুব খুশি হল। প্রথমে ওরা নিজের নিজের হাত পা ধুতে লাগল এবং একে অপরের গায়ে জল ছিটোতে লাগল।

 —এরকম করলে আমি কিন্তু মোটরটা বন্ধ করে দেব।

 আমার ধমকে ছেলেরা শান্ত হল এবং মোটরের জল দিয়ে বালতিগুলি ভর্তি করতে লাগল। গত কয়েকদিন এক ফোঁটাও বৃষ্টির জল পড়েনি। গাছের চারা গুলির জলের বড়ো প্রয়োজন।বিপিন ডেকার সজাগতা প্রশংসনীয়। জলের পাইপ গুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারা গাছের চারাগুলি প্রয়োজনের বেশি অতিরিক্ত জল পাচ্ছে। যেই মটরের সুইচ অন করে সেই চারা গুলির গায়ে এক পাক জল ছিটিয়ে দেয়।

  আমি পুনরায় বিপিন ডেকা এবং অনামিকার কাছে ফিরে এলাম। দুজনেই দুটি চেয়ারে বসে আড্ডা জমিয়েছে। আমি এসে তাদের কাছে বসায় বিপিন ডেকা জিজ্ঞেস করল— নিজের রোপণ করা চারা গুলিতে জল দেবার দায়িত্ব হয়ে যে চারা রোপন করেছে তার ছিল নাকি?

 —ছিল সেই অনুসারে তারা জল যে দেয়নি তা নয়। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হয়নি।, জল একটু বেশি পেলে ভালো। আপনি ছেলেদের ধরে এনে ভালো করেছেন, লাগে যদি আদর নেশা লাগুক। এই কাজটুকু শেষ হলে বিদ্যালয় সমূহ পর্যায়ক্রমে গাছের চারা রোপন করার কাজ আরম্ভ করা যাবে। তখন ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি করে জড়িয়ে পড়বে।

 বিপিন ডেকা আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কাজ কতটা এগিয়েছে তার হিসেব নিল। আমি ‘দহিকতরা’ নামের আমাদের সংগঠনটি পঞ্জীয়ন হওয়ার কথা বললাম। সংগঠনের নামে প্যান কার্ড এসে গেছে। নলবাড়ির স্টেট ব্যাংকে একটা একাউন্ট খোলা হয়েছে। বাকি কাজগুলি চোখের সামনের কাজ, সবাই দেখছে।

 —তুমি কাজগুলি একেবারে পদ্ধতিগত ভাবেই এগিয়ে নিয়ে চলেছ। তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করি, খারাপ পেয়ো না।

 — হ্যাঁ বলুন। আমার অভিধানে খারাপ পাওয়া নামে কোনো শব্দ নেই।

 আমার দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলতে শুরু করলেন— সমস্ত খরচ তুমি নিজের পকেট থেকে করেছ?

 কেউ আমাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা অথবা সাহস করেনি। বিপিন ডেকা প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করায় আমি অপ্রস্তুত হইনি। বরং আমি ভেবেছিলাম কোনো না কোনো জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি আমাকে প্রশ্নটা করবেই।

 —হ্যাঁ।

 তিনি অবাক হওয়ার মতো আমার দিকে তাকালেন। তার চাহনিতে হয়তো আর ও অনেক প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল। সম্ভাব্য প্রশ্ন সমূহ আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছি কেননা আমাকে যেকোনো সময়ে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। যেমন– এটা তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় অথচ তুমি নিজের পয়সা কেন এত খরচ করলে? আমার সন্দেহ সত্যি প্রমাণ করে বিপিন ডেকা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন— তুমি খারাপ পেয়ো না, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, জিজ্ঞেস করতে চাইছি।

 – হ্যাঁ দাদা। জিজ্ঞেস করুন।

 — এই মাটি সম্পত্তি তোমার ব্যক্তিগত নয় অথচ তুমি অনেক টাকা পয়সা এতে খরচ করছ?

 আমি বিপিন ডেকাকে আমার উদ্দেশ্যের কথা বলতে জ্যোতি পুনরায় সুদীপ্ত এবং একতারার বাড়ির কথা মনে পড়ল। ওদের সবই আছে অথচ সঙ্গী নেই। আমার কিছুই নেই ,এমনকি সঙ্গীও। আমি কীভাবে বলি আমি আমার টাকা খরচ করে একটি গ্রামের সঙ্গ কিনতে চাইছি। বিনিময়ে আপনাদের দিতে চাইছি অফুরন্ত সবুজ। সবুজ অবিহনে সুদীপ্ত এবং একতারার মতো আপনারাও একদিন সঙ্গীহীন হয়ে পড়বেন।

 — আমাকে একেবারে খারাপ পেয়ো না, আমি হয়তো তোমাকে জিজ্ঞেস না করার প্রশ্ন কিছু জিজ্ঞেস করে ফেললাম।

 আমার ভাবুক হয়ে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বিপিন ডেকা বলল। অনামিকা মৌন হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে হয়তো আমার উত্তরের অপেক্ষা করছে। সেও হয়তো জানতে চাইছে এই সমস্ত নির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমার কী অভিসন্ধি জড়িত হয়ে রয়েছে।

 আমি অনিচ্ছাসত্বেও বিপিন ডেকাকে আমার জীবনের একাকীত্বের কথা বলতে বাধ্য হলাম।

 – দাদা। শৈশবেই আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। আমি মায়ের কাল্পনিক একটি মুখের দিকে তাকিয়ে আজ পর্যন্ত জীবন অতিবাহিত করছি। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা একবার নয় দুবার বিয়ে করেছে। জীবনে আমার কেউ নেই, কেউ নেই। বিয়ে-সাদি করা হল না, আমাকে সংসার করার কথা বলার মতো জীবনে কোনো একজন আত্মীয় অথবা বন্ধু পেলাম না। হয়তো আমার বিয়ে করার বয়স পার হয়ে গেছে। দাদা ,আমি আজ একজন উচ্চ স্তরের ব্যাংক অফিসার। বেতন ভালো, হাতে টাকা পয়সাও আছে। আমি পড়াশোনা করা বিদ্যালয়টিতে যে সমস্ত অনাথ ছেলে এখনও পড়াশোনা করছে তাদেরকে আমি আর্থিক সাহায্য করি। আমি নিজেও একজন অনাথ। আজ আছি কাল মরে ও যেতে পারি। সৌম্যদার সান্নিধ্যে এসে আমি প্রকৃতির সাহচর্য লাভ করেছি। জীবনে প্রকৃতিই আমার একমাত্র সঙ্গী। বকের সংসার দেখতে এসে এই গ্রামটিকে সবুজ হতে দিয়ে একটি অরণ্য গ্রাম গড়ার ধারণা আমার মনে এল। নদীর তীরে বসে থেকে আমি কল্পনা করলাম এখানে একটা পর্যটক নিবাস গড়ে তুললে আমার মতো সঙ্গীবিহীন প্রত্যেকেই দুদিন প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটিয়ে যেতে পারবে এবং আমার প্রিয় গ্রামবাসীদের তরুণদের জন্য আমার জীবনের উপার্জনে কিছু একটা করে রেখে যেতে পারব।দাদা, এখানে আসার আগে আমার জীবনের কোনো অর্থ ছিল না। রাতের পরে রাত আমার মায়ের কাল্পনিক মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। আমার ঘুম হতো না। আজ আমার সব আছে। আপনি আছেন ,অনামিকা আছে, সুনন্দ আছে, কাকাবাবু আছে ,গ্রামবাসী আছে, সবাই আছে। অনেকদিন পরে আপনার কথা শুনে আমি আমার মায়ের কাল্পনিক মুখটা দেখতে পাচ্ছি। মা আমাকে বলেছেন তোর সমস্ত উপার্জন সমাজের হিতের কাজে ব্যবহার করবি। সেই জন্যই আজ আমাদের সংগঠনের নাম’দহিকতরা’-দশের হিতের কাজ ত্যাগের সঙ্গে করা।

 নিজের অজান্তে আমার দু চোখ দিয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমি ফোঁপাতে লাগলাম। বিপিন ডেকা এবং অনামিকার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। অনামিকা আমার কাছ থেকে উঠে গেল। বিপিন ডেকা আমাকে সজোরে জড়িয়ে ধরল।

—আপনি শপথ করুন দাদা, আমার কথাগুলি কাউকে বলবেন না— অরণ্য গ্রাম এবং পর্যটক নিবাসের কাজটা সম্পূর্ণ করে আমি এখান থেকে চলে যাব। এখানে থাকলে আমি আমার মায়ের প্রতি অন্যায় করব। আমার মা আমাকে নিয়তির হাতে নিঃসঙ্গ হয়ে জীবন কাটানোর জন্য ছেড়ে গেছেন, আমি সেভাবেই থাকব।

 বিপিন ডেকা তখনও আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন।

 অনামিকা এক বোতল জল এনে আমার সামনে তুলে ধরেছে। আমি জলের বোতল নিয়ে বসে থাকা জায়গা থেকে উঠে গিয়ে মুখে জল ছিটিয়ে দিলাম। ঠান্ডা জলের ছিটে লেগে আমার চোখ মুখ কুঁচকে এল। নিজেকে সুস্থির করে আমি পুনরায় এসে চেয়ারটাতে বসলাম।বিপিন ডেকা এবং অনামিকা হয়তো কী বলবে ভাবতেই পারছিনা। আমার আচরণের জন্য আমি লজ্জিত বোধ করলাম।

 — কিছু না দাদা। না বলা কথা বলে আমি আপনাদের দুজনকে কষ্ট দিলাম। তার জন্য আমি দুঃখিত। খুবই দুঃখিত।

 — উদয়দা।

 আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম। অচ্যুত ডাকছে।

 – বল।

 – কারেন্ট এবং জলের সমস্ত সরঞ্জাম পেয়েছি। আমার পরিচিত একটা অটো ভ্যান সন্ধ্যাবেলা আসবে। তার দুটো ভাড়া আছে। সে সেই দুটো ভাড়া মেরে বাড়িতে ফেরার পথে একসঙ্গে নিয়ে আসবে। আমি এখনই লাগবে বলে তাকে জোর করলাম না। তবে দাদা,আমি সন্ধ্যাবেলা থাকব না। আমাদের সম্পর্কিত একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আমাকে শ্মশান যাত্রী হতে হবে। সেখান থেকে ফিরে এসে সারাদিনের হিসেব-নিকাশ করতে পারব।

 – কোনো ব্যাপার না, যখন সময় পাবে আসবে। শুধুমাত্র ছেলেটিকে বলে দেবে সে যেন সামগ্রী গুলি এখানে রেখে যায়। বাঁধের উপর দিয়ে আনতে অসুবিধা হলে আমার বাড়িতেই রেখে দিতে পারবে। তুমি তাকে বলতে ভুলে যেও না।

 বিপিন ডেকা এবং অনামিকা তখনও কে জানে হয়তো আমাকে সহজ ভাবে নিতে পারেনি। দুজনকেই স্বাভাবিক করার মানসিকতা নিয়ে আমি বললাম–অচ্যুত আমার দৈনন্দিন হিসাব নিকাশগুলি করে। সন্ধ্যাবেলা সে এসে কে কি খরচ করেছে? সমস্ত ভাউচার সংগ্রহ করে হিসেবের খাতায় প্রতিটি টাকার হিসাব লেখে। এত সিনসিয়ার ছেলে আজকের দিনে পাওয়া অসম্ভব।

 দুজনেই মৌন। আমার কিছু ভুল হয়েছে বলে মনে হল। উপায়হীন হয়ে দুজনকে উপেক্ষা করার জন্য বললাম— আসুন, তারা কী কাজ করেছে দেখি।

 তাদের উত্তরের জন্য আমি অপেক্ষা করলাম না এবং সোজাসুজি বাড়ির কাজ করতে থাকা শ্রমিক কয়েকজনের দিকে এগিয়ে গেলাম।

মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০২৪

গণতন্ত্র ।। কাশীনাথ সাহা ।। We want justice.

কবিতা

 গণতন্ত্র 

কাশীনাথ সাহা 



অনেক কথা বলবো ভাবি, সব কথা কি বলতে পারি 

মাথার উপর বসে আছেন গণতান্ত্রিক ক্ষমতাধারী!

প্রজাতন্ত্র বলে আমরা দু'হাতে যতোই ঝান্ডা তুলি

কিন্তু তবুও তেমনই নাচি তিনি যেমন বাজান তালি!

তিনি বললেন মিছিলে হাঁটো, বলতে পারি হাঁটবো কেন?

আসলে সবাই ক্রীতদাস, মানো কিংবা নাই বা মানো।

তিনি বললেন রবিবারের মধ্যে দোষীর ফাঁসি চাই।

কিন্তু তাঁকে কে বোঝাবে, তাই তো দেখি নাটক-টাই।

নির্যাতিতার ফাঁসি চাই, তাঁর কণ্ঠে যেই শুনি

বিস্ময়ে থমকে গেলেও, হাত তুলে দি দুই খানি!

সারে জাঁহাসে নজরুলের, সেদিনও ছিলাম চুপ করে 

ভুল খানি তার শুধরে দিয়ে কে যেতে চায় শ্রীঘরে?

এস এস সি বন্ধ কেন, ডি এ কেন পাচ্ছি না

এসব প্রশ্ন তোলা মানেই, আবারও নরক যন্ত্রণা! 

তারচেয়ে তো ভালোই আছি, গনতন্ত্রের গাইছি গান

শিরদাঁড়াহীন মহামানব, সব মঞ্চে -ই পাচ্ছি স্থান!

রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৪

প্রভাতী শুভেচ্ছার পদ্য সায়ন্তনী || কাশীনাথ সাহা, Kashinath Saha

 প্রভাতী শুভেচ্ছার পদ্য

সায়ন্তনী  ||  কাশীনাথ সাহা 



তোমাকে দেখেছি আমি সিন্ধু নদী তীরে 

ছুঁয়েছি তোমার হাত অদৃশ্য বন্দরে।

সূর্য জাগার ক্ষণে পল্লবীত তোমার গান

ক্লান্তিহীন নাবিকের উজানে শুনেছি আহ্বান।

জলরঙ ক্যানভাসে ছুঁয়ে থাকে তোমার হৃদয় 

ধরেছি বিশ্বস্ত হাত, কক্ষনো ছিল না সংশয়!

শালবনের আড়ালে থেকেও তোমার অনুচ্চ ধ্বনি 

অগণন কবিতার স্রোতেও তুমি ভিন্ন সায়ন্তনী!

শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৪

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudeb Das

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





চার

বেঞ্জামিনের আত্মশিক্ষার শুরু

 স্কুল ছাড়ার পরে প্রায় দুই বছর বেঞ্জামিন তাঁর পিতার ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

  বেশিরভাগ দুঃখী ছেলে-মেয়ে স্কুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি হওয়া বলে মনে করে। কিন্তু বেঞ্জামিনের ক্ষেত্রে হল ঠিক উল্টোটা। স্কুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হল তার আত্মশিক্ষার সাধনা— যা অব্যাহত ভাবে চলতে থাকল তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজে লিখে গেছেন—’শৈশব থেকেই বই পড়তে আমি খুব ভালোবাসতাম। হাতে কিছু টাকা এলে আমি সেই টাকা অন্য কোনো কাজে খরচ না করে কেবল বই কিনতাম। বুনিয়ানের Pilgrims Progress নামের বইটি পড়ে খুশি হয়ে আমি তার অন্য বই গুলোও কিনেছিলাম। সেই বইগুলি ছিল আমার বইয়ের প্রথম সংগ্রহ। পরে সেই বইগুলি বিক্রি করে সেখান থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে আমি আর বার্টনের ইতিহাস রচনার সংকলন গুলি কিনেছিলাম।বইগুলির আকার ছোটো ছিল এবং দামও বেশি ছিল না।আমার বাবার ছোটো গ্রন্থাগারটিতে থাকা বইগুলির বেশিরভাগ ছিল ধর্ম সম্পর্কে বাদানুবাদের বই। বই গুলির বেশিরভাগই আমি পড়েছিলাম যদিও মনে এই বলে একটা আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল যে সময় আমার জ্ঞানের তৃষ্ণা ছিল অতি প্রবল, সেই সময়ে সেইরকম তৃষ্ণা পূরণ করার জন্য বই পড়তে পেলে আমার নিশ্চয় বেশি উপকার হত ।আমি যেহেতু ধর্মযাজক হওয়ার সংকল্প বাদ দিয়েছিলাম সেই জন্য ধর্ম সম্পর্কিত বই পড়া থেকে আমার বিশেষ কোনো লাভ হল না। বাবার গ্রন্থাগারে প্লুটার্কের Lives বইটা ছিল। সেটা আমি উল্টেপাল্টে পড়েছিলাম আমি এখনও ভাবি যে সেই বইটি পড়ার পেছনে যে সময়টুকু খরচ করেছিলাম তা সম্পূর্ণ সার্থক হয়েছিল।গ্রন্থাগারটিতে ডিফোর Essays on Projects এবং ডক্টর মেথারের Essays to do Good নামের অন্য দুটি বই ছিল। আমার জীবনে ভবিষ্যতে ঘটতে চলা কয়েকটি প্রধান ঘটনার ওপরে সেই বই দুটির প্রভাব পড়েছে বলে আমার মনে হয়।’

 পিতার ছোটো গ্রন্থাগারটির বইপত্র পড়ে শেষ করার পরে অন্যান্য জায়গায় বইয়ের খোঁজ করতে লাগলাম। পিতা প্রথমে তাকে ধর্মযাজক করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু বইয়ের প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে তিনি অবশেষে প্রিন্টার তথা মুদ্রক করার জন্য ঠিক করলেন।আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে একটি নতুন সভ্যতার শুরু করা ইংরেজদের মধ্যে সেই সময়ে ছাপাশালা একটি অতি জনপ্রিয় ব্যাবসা ছিল। জোসিয়া ফ্রাঙ্কলিনের অন্য একজন ছেলে জেমস ইংল্যান্ডের মুদ্রণ বিদ্যা শিখে স্বদেশে ফিরে এসে বোস্টনে একটি ছাপাশালা আরম্ভ করেছিলেন এবং সেখান থেকেই তিনি একটি খবরের কাগজ বের করেছিলেন। পিতার নির্দেশ অনুসারে বেঞ্জামিন শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিলেন। তখন তার বয়স মাত্র বারো বছর।

  জেমসের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল যে একুশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাদার ছাপাশালায় শিক্ষানবিশ হয়ে থাকবেন এবং সেই সময় তিনি বেতনের পরিবর্তে কেবল দৈনিক হাজিরা পাবেন। সে যে কাজে হাত দেয় সেই কাজটির সমস্ত কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝে নিয়ে তাকে নিখুঁতভাবে করাটা ছিল তার স্বভাব। ছাপাখানার কাজও তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে শিখতে লাগলেন। অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে তিনি সেই কাজে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠলেন।

 কিন্তু ছাপাখানার কাজে যোগ দিয়ে তিনি বইয়ের কথা ভুলে যাননি।বরং বই খোঁজার কাজ আগের চেয়ে সহজ হয়ে উঠল, কারণ বই ব্যাবসায়ীর সঙ্গে ছাপা শালার ওতপ্রোত সম্পর্ক। ছাপাশালার কাজের মধ্য দিয়েই বইয়ের দোকানে কাজ করা একজন কর্মচারীর সঙ্গে বেঞ্জমিনের পরিচয় হল। কিন্তু যেহেতু দোকানে বিক্রির জন্য রাখা বই দিনের বেলা বের করে দেওয়া যায় না, সেই জন্য বেঞ্জামিন সন্ধ্যাবেলা বই দোকান থেকে ধার করে আনে এবং রাতে ঘুমের ক্ষতি করে হলেও বইটি পড়ে শেষ করে। সকালবেলা সে বইটি ফিরিয়ে দেয়। বইটি যাতে কোনো ভাবে নষ্ট না হয় বা ধুলোবালি লেগে নোংরা না হয় সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি থাকে।

 যে মানুষ নিজেকে সাহায্য করে তাকে ভাগ্যও সাহায্য করে। ম্যাথিউ আদমস নামের একজন স্থানীয় ব্যাবসায়ী প্রায়ই বেঞ্জামিনের ছাপাখানায় আসতেন। তাঁর নিজস্ব একটি গ্রন্থাগার ছিল। বইয়ের প্রতি বেঞ্জামিনের গভীর অনুরাগ দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন এবং নিজের গ্রন্থাগারের দরজা তিনি বেঞ্জামিনের জন্য মুক্ত করে দিলেন। ম্যাথিউ আদমসের গ্রন্থাগারটা ছিল যথেষ্ট বড়ো। বেঞ্জামিন এবার মনের আশ মিটিয়ে বই পড়তে লাগলেন।

 কিন্তু কেবল বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেই বেঞ্জামিন সন্তুষ্ট ছিলেন না । উৎকৃষ্ট গদ্য রচনা করার ক্ষমতা অর্জন করাটা ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই কঠোর সাধনায় ব্ৰতী হয়েছিলেন। 

 বেঞ্জামিন গদ্যের সাধনায় ব্রতী হওয়ার পেছনে তাঁর জীবনের একটি ছোটো কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল।

 বেঞ্জামিনের জন কলিন্স নামের একজন বন্ধু ছিল। বেঞ্জামিনের মতো তিনিও বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। দুই বন্ধুর মধ্যে প্রায়ই নানা বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হত। একদিন তর্কের বিষয় হল নারী শিক্ষা।কলিন্সের মতে নারী শিক্ষা লাভের উপযুক্ত নয়, কারণ শিক্ষা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিভা প্রকৃতি তাদের দেয়নি। বেঞ্জামিনের মত হল ঠিক তার উল্টো। বেঞ্জামিনের যুক্তি বেশি সবল ছিল যদিও তর্কে তিনি হেরে গেলেন, কারণ ভাষার ওপরে কলিন্সের দখল ছিল অনেক শক্তিশালী। কেবল বাক নৈপুণ্যের জোরে তিনি বেঞ্জামিনকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে দিলেন।

 কিন্তু বেঞ্জামিন এই পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারলেন না কারণ তার যুক্তি যে বেশি সবল ছিল সে কথা তিনি নিজেও ভালো করে জানতেন। তর্কযুদ্ধের পরে অনেকদিন তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। সেই সময় বেঞ্জামিন একদিন তাঁর যুক্তিগুলি পরিষ্কার করে লিখে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিলেন। বন্ধুটিও তার উত্তর লিখিতভাবে দিলেন। এভাবে বেশ কয়েকটি চিঠির আদান-প্রদান হল, অর্থাৎ তর্কযুদ্ধটা এবার মৌখিকভাবে না হয়ে চিঠির মাধ্যমে হল। এই সময় বেঞ্জামিন কলিন্সকে লেখা একটি চিঠি বেঞ্জামিনের পিতার হাতে পড়ল। তিনি চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে সেই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য বেঞ্জামিনকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ছেলেকে বললেন–’ তোমার বানান শুদ্ধ। যতি চিহ্নও ঠিক জায়গায় দিতে শিখেছ। এই বিষয়ে তুমি তোমার বন্ধুর চেয়ে এগিয়ে রয়েছ। কিন্তু তোমার ভাষা সরল নয়। কথাগুলি পাঠকের সহজ বুদ্ধিতে বুঝতে পারার মতো তাকে রসালো করে তুলতে তুমি পারনি। এই বিষয়ে উন্নতি করার জন্য তোমাকে আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে।’

 পিতার কথায় বেঞ্জামিন সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলেন, কারণ পিতা তার কথার সমর্থনে বেঞ্জামিনের লেখা থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরলেন। বেঞ্জামিন তখনই সংকল্প করলেন যে ভাষার ওপরে দখল বাড়ানোর জন্য আরও ভালো গদ্য লেখার কায়দাটা আয়ত্ত করার জন্য সে চেষ্টার কোনো রকম ত্রুটি করবে না।

 সেই সময়ে তিনি একটি বইয়ের দোকানে’ স্পেকটেটর’(Spectator) নামের একটি ইংরেজি পত্রিকার একটি বাঁধানো খন্ড দেখতে পেলেন। তিনি এর আগে পত্রিকাটি কখন ও দেখেননি বা তার নামও শোনেন নি। পত্রিকাটি কিনে এনে তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়তে লাগলেন। পত্রিকাটির গদ্যরীতি তাকে এতটাই মুগ্ধ করল যে সম্ভব হলে তিনি নিজেও সেই গদ্যরীতির অনুকরণ করতে এবং সেই রীতিতে গদ্য লিখতে মনস্থ করলেন।

 পত্রিকাটি পড়ার সময় বেঞ্জামিন একটি কথা জানতেন না তিনি পড়ে মুগ্ধ হওয়া পত্রিকাটি আসলে ছিল ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ পত্রিকার একটি। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন জোসেফ এডিসন (১৬৭২-১৭১৯)একজন বিরাট প্রতিভাশালী গদ্য-লেখক এবং প্রবন্ধকার হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অন্য একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি ডঃসেমুয়েল জনসন বলেছিলেন—‘ইংরেজি ভাষায় উৎকৃ্ষ্ট গদ্য রচনার কৌশল যারা আয়ত্ত করতে চায় তাঁরা দিন রাত জোসেফ এডিসনের রচনাবলী অধ্যয়ন করায় মনোনিবেশ করতে হবে।’স্পেকটেটরের বেশিরভাগ লেখক ছিলেন জোসেফ এডিসন।এডিসনের গদ্য বিষয়ে ডঃজনসন কী বলেছিলেন সেকথা না জেনে বেঞ্জামিন তাঁর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করেছিলেন।

 বেঞ্জামিন নিজে লিখে রেখে গেছেন—‘স্পেকটেটরের গদ্য রচনার কৌশল আয়ত্ত করার জন্য আমি পত্রিকাটার প্রবন্ধগুলি পড়ে প্রত্যেকটি বাক্যের ভাবার্থ গুলি লিখে রাখলাম।কয়েকদিন পার হয়ে যাবার পরে আমি বইটা না দেখে সেই স্পেকটেটরের মূল প্রবন্ধটির সঙ্গে আমার নিজের লেখাটা মিলিয়ে দেখলাম। যে সমস্ত ভুল ভ্রান্তি আমার চোখে পড়ল সেগুলি পুনরায় শুদ্ধ করলাম। কখনও আমি ইতিমধ্যে লিখে রাখা ভাবার্থ গুলি মিশ্রিত করে ফেলে কয়েক সপ্তাহ পড়ে পুনরায় সেগুলি পরিপাটি করে সাজিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম। এরকম করার উদ্দেশ্য ছিল ভাব গুলি পরিচ্ছন্নভাবে সাজানোর জন্য নিজেকে শেখানো। মূল প্রবন্ধের সঙ্গে আমি নিজের লেখা গুলি মিলিয়ে দেখে দ্বিতীয়বার চোখে পড়া ভুল ভ্রান্তি গুলি শুদ্ধ করলাম। এভাবে অভ্যাস করার সময় আমার মনে হল যে কিছু কথা মূল প্রবন্ধের চেয়ে আমি বেশি ভালো করে লিখতে পারব। একজন ভালো গদ্য লেখক হওয়াটা ছিল আমার জীবনের একটি প্রধান আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারব বলে এখন আমার মনে আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। এভাবে গদ্যরচনার অনুশীলন করার জন্য এবং পড়ার জন্য আমি কেবল রাতের বেলায় সময় পেতাম। কাজ থেকে ফিরে এসে বা সকালে কাজ আরম্ভ করার আগেই আমি রাতের মধ্যে লেখা এবং পড়া দুটো কাজই করতাম। আমার পিতার আকাঙ্ক্ষা অনুসারে আমি রবিবার গির্জায় না গিয়ে তার পরিবর্তে ছাপা শালায় যেতাম —যাতে ছাপাশলায় কোনো মানুষ না থাকা অবস্থায় আমি সেখানে শান্তিতে লেখাপড়া করতে পারি।’( বেঞ্জামিন লেখা মূল কথাটা এখানে সরল এবং সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে)।

 অতি সাধারণ অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় উন্নতি করে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তার সমসাময়িক পৃথিবীর একজন অতি মহৎ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে পরিগণিত হয়েছিলেন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজে স্বীকার করে গিয়েছেন তার এই উন্নতির মূলে ছিল ভালো গদ্য লেখার দক্ষতা— যা তিনি অত্যন্ত কষ্ট করে আয়ত্ত করেছিলেন। মনের ভাব সরল এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করার ওপরে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি লিখে রেখে গেছেন—’ গদ্য রচনা আমার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে এবং এটা আমার উন্নতির একটি প্রধান কৌশলে পরিণত হয়েছিল।’

 





 

প্রভাতী শুভেচ্ছার পদ্য ।। ভোরের আলো || জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

 প্রভাতী শুভেচ্ছার পদ্য

ভোরের আলো  ||  জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়



পাখির ডাকে ঘুম ভাঙানোর ভোর
ঘুমিয়ে আছে স্মৃতির পাতায় তোর।
মনকে বলি,দীর্ঘতর নিদ্রাবিহীন রাত
ব্যর্থতারা হাসে তাদের নিকষকালো দাঁত।
রাত গভীরে  ইট ও বালির বাহক,বাইক
বিকট আওয়াজ বাজছে যেন মাইক
রাতের বেলা ব্যর্থতারা হেসোভূতের মুখ
ভোরের আলোয় ভাবনা তোমার,সুখ।

বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৪

তোমার জন্য স্বাধীনতা // কাশীনাথ সাহা // কবিতা // Kashinath Saha

স্বাধীনতা দিবসে


তোমার জন্য স্বাধীনতা 

কাশীনাথ সাহা 



স্বাধীনতা তোমার জন্য দু'চোখ জুড়ে স্বপ্ন দেখি

তোমার জন্য স্বাধীনতা ভালবাসা সাজিয়ে রাখি।

ইচ্ছে হয় তোমার জন্য দু'হাত তুলে আকাশ ছুঁতে 

আসবে বলে তোমার জন্য আসন পিঁড়ি রাখি পেতে।

তোমার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছিলাম আঁজলা ভরে

তোমার জন্য অরন্ধন গণসংগীত ঘরে ঘরে। 

বোনের ছেঁড়া শরীর নিয়ে মাতলো ওরা উর্দিধারী

স্বাধীনতা তোমার জন্য আমরা সব সইতে পারি।

দিতে পারি প্রিয় নারী,পিতার দেহ,মায়ের চিতা

তোমার জন্য দিতে পারি শুদ্ধশীল এই মগ্নতা। 

স্বাধীনতা তোমার জন্য বুকের পাঁজর খুলে খুলে 

ছুঁড়তে পারি অগ্নিশিখায়,আগুন হয়ে জ্বলবো বলে।

দিতে পারি নদী শহর,সোঁদা মাটি সোনালী ধান

বুকের ভিতর জমিয়ে রাখা কৈশোরের হারনো গান।

তোমার জন্য অশ্রু হাসি, পুজোর গন্ধ, প্রতিবেশী 

সবকিছুই ছুঁড়ে ফেলে দহন মন্ত্র ভালোবাসি।

ভালোবাসি নিঃস্ব হতে, উজাড় হতে,ধ্বংস হতে

এক সহস্র জীবন ছুঁড়ে একটুকরো চিতায় শুতে।

স্বাধীনতা তোমার জন্য মায়ের অশ্রু আজও ঝরে

তোমার জন্য শহীদ জননী একাকী কাঁদে অন্ধকারে।

তোমার জন্য দগ্ধ হৃদয় এখনো আছে জ্যোতির্ময়

অবলীলায় তুচ্ছ করি তোমার জন্য মৃত্যুভয়।

তোমার জন্য নদীর চর সুবিস্তৃত গহীন বন

স্বাধীনতা তোমার জন্য লক্ষ জীবন সমর্পণ।

মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

শান্ত হও ।। বাংলাদেশ সুমন ঘোষ

 শান্ত হও বাংলাদেশ

সুমন ঘোষ 


শান্ত হও বাংলাদেশ

নিজের ভূগোল ইতিহাস ভুলো না

মনে হতেই পারে তোমার 

বলতেই পারো, দূর হটো তুমি, আমরা হাসি না

তাই বলে কি আগুন জ্বালাবে 

আগুনে যে পোড়া পোড়া গন্ধ 

তার অসহ্য যন্ত্রণা!


না হেসো আর কোনদিন 

তাই বলে কাঁদবে মানুষ 

বরং গম্ভীর হও দেশের কথা ভাবো।


হাসি না মানে কান্না নয় 

বাংলাদেশ মানে শস্য শ্যামলা 

সে দেশে কিনি ফসল ফলে 

সব ছেড়ে আগুনে যা মিললো 

সেটা নয় কি ছোলা-কলা!


শান্ত হও বাংলাদেশ

নিজের ভূগোল ইতিহাস ভুলো না

যে ছেলেটি আজ রাজপথে 

কাল সে হবে বাবা 

ইতিহাস পড়তে গিয়ে প্রশ্নের যত থাবা 

উত্তর দেবে কী?

চোখের দেখা যত কথা বলবে অজানা 

ছেলের কাছে ধরা পড়া!

চোখের জলেও ফেনা


শান্ত হও বাংলাদেশ

নিজের ভূগোল ইতিহাস ভুলো না

বীরত্ব রচনা করো, বীরদের ভুলো না

অন্ধত্ব এক জিনিস, এক চোখ মানে কানা।

শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪

দুটি কবিতা ।। তীর্থঙ্কর সুমিত ।। Tirthankar Sumit

 দুটি কবিতা 

তীর্থঙ্কর সুমিত







(১)

আরও একটা দিন


মুছে যাওয়া দিনগুলো
এখন আয়নার কথা বলে
এক পা, দু পা - প্রতি পায়ে পায়ে
ইতিহাস জড়িয়ে থাকে
কথা পাল্টানো মুহূর্তে...
"তুমি" নামে একটা ছায়া
আজ অতীতের দরজায় কড়া নাড়ে
ব্যর্থ পরিহাসের কথনে

অসমাপ্ত চিঠি আমার বালিশের নিচে
চোখের জলের...

আরও একটা দিন।।


(২)

বাকি গল্প


অসময়গুলো এখন বড় খাপছাড়া
সময়ের তাগিদে লিখে রাখা যত চিঠি
এখন আমার বইয়ের টেবিলজুড়ে
নানা আছিলায় আমার কালো কালির "পেন" টা
এখন ভাঙ্গনের গল্প লেখে
নদীর কাছে দাঁড়িয়ে যে বিশ্বাসের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম
আজ ভগ্নাংশের হিসাবে অতীত বলার দাবী রেখেছে
মুহূর্তে কত কিছু বদলে যায়
ঘড়ির ব্যাটারিটাও এখন স্থগিদ

আর আমি...

এসো এক কাপ চা খেতে খেতে বাকি গল্পটা বলি।।


Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...