শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৪৪ সন্তোষ কুমার কর্মকার মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev DasHe Amar Swadesh

 হে আমার স্বদেশ- ৪৪

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das







  লেখক পরিচিতি--এ সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।


   আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।


(৪৪)

সম্বলপুরে আসা দু'বছর হল। বার্ড কোম্পানি উড়িষ্যা এবং বিহার সরকার থেকে নেওয়া জঙ্গলগুলির পরিদর্শনের সঙ্গে জঙ্গলের কাঠ কেটে শ্লিপার তৈরির কাজের দায়িত্ব  অর্পণ করেছিল লক্ষ্মীনাথের ওপরে। নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার জন্য লক্ষ্মীনাথ কোম্পানির কর্মকর্তাদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলেন। অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও তাদের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্ক গড়ে উঠল। তারা সম্বলপুরে এলে লক্ষীনাথের বাড়িতে অতিথি হয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে লাগলেন। তাই পরিশ্রম হলেও কোম্পানির কাজ করে লক্ষ্মীনাথের ভালো লাগে।তাছাড়া কোম্পানি থেকে বেতনাদি,বাড়ি-ঘর,চাকর-বাকর এবং টাঙার খরচ পাওয়ায়  এখন তার আর্থিক অবস্থাও ভালো।

  মেয়ে অরুণা কলকাতার ডায়োসেশন কলেজে বিএ পড়ছে। রত্না এবং দীপিকা ও সেই শিক্ষানুষ্ঠানের ছাত্রী। পড়াশোনায় ওদের অগ্রগতি সন্তোষজনক।। পড়াশোনা ছাড়া ওরা সংগীতের চর্চা করছে। তাই কলকাতায় ছেড়ে আসার সময় মেয়েদের লেখাপড়ায় অসুবিধা হতে পারে ভেবে যে একটা দুশ্চিন্তা ছিল সেখান থেকে লক্ষ্মীনাথ মুক্ত হতে পেরেছেন।

 কলকাতা ছেড়ে সম্বলপুরে আসার সময় সবচেয়ে বেশি করে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন ‘বাঁহী’র সম্পাদনা এবং প্রকাশনাকে নিয়ে। লক্ষ্মীনাথ ভেবেছিলেন সম্বলপুরে থেকে ‘বাঁহী’র প্রকাশের সমস্ত কাজ করাটা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তার জন্য সম্পাদনার দায়িত্বটা নিজের হাতে রেখে লক্ষ্মীনাথ ‘বাঁহী’র প্রকাশনা এবং পরিবেশনের দায়িত্বটা কলকাতার ৪৫ নম্বর হ্যারিসন রোডে থাকা অমিয় কুমার দাস,  ধীরেন্দ্রনাথ আগরওয়ালা, রাজেন্দ্রনাথ বরুয়া ইত্যাদি জনকয়েক উদ্যোগী ছাত্রের হাতে অর্পণ করেছিলেন।সেটা সুবিধাজনক হল না দেখে এক বছর পরে যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা করে ‘বাঁহী’র পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন  ডিব্রুগড়ে থাকা বন্ধু চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা কে। চন্দ্রকুমারের সম্পাদনায় ‘বাঁহী’প্রকাশের পর থেকে সেই চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারলেন।

এদিকে গত দুটো বছরের মধ্যে লক্ষ্মীনাথ কয়েকজন আত্মীয়কে হারালেন। সময়ের প্রবাহের সঙ্গে এরকম ঘটনা ঘটবেই। তথাপি নিজের আত্মীয়কে হারানোটা বেদনা দায়ক। শিবসাগর থেকে জয় দাদার মৃত্যুর সংবাদ (১৮১৮ সনের ১৬ আগস্ট)এল। তারপর একই বছরে ৬ ডিসেম্বর গোলাঘাটে লক্ষীনাথের সবচেয়ে আদরের শ্রীনাথ দাদা মৃত্যুবরণ করলেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা তারপরের দিন সদ্য মৃত শ্রীনাথ দাদার পত্নী এবং পুত্র  অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন।

 কলকাতার বাইশ নম্বর রোজমেরির বাড়িটা (লরেলস)লক্ষ্মীনাথের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। লরেলসে থাকার বছরগুলিতে লক্ষ্মীনাথের সাহিত্য সৃষ্টির ধারা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে ছিল। সেখানে থেকেই তিনি ‘বাঁহী’ সম্পাদনা করে বের করেছিলেন। সেই বাড়িটিতে প্রতিদিন বিকেলে যতীন্দ্রনাথ,জ্ঞানদাভিরা্‌ম এবং কলকাতায় পড়তে আসা অসমিয়া ছাত্রদের সঙ্গে অসম, অসমিয়া জাতি, অসমিয়া সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হতেন। কিন্তু সম্বলপুরে স্থায়ীভাবে থাকার পর থেকে ২২ নম্বর রোজমেরির লরেলসের বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণ করাটা লক্ষ্মীনাথের পক্ষে অসুবিধা জনক হয়ে পড়ল। তার জন্য তিনি বাড়িটা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং চব্বিশ হাজার টাকায় বিক্রির জন্য রামনাথ সাহা থেকে ১০১ টাকা অগ্রিম বায়না নিলেন। কিন্তু রেজিস্টার করে ক্রেতাকে দখলস্বত্ব দেননি। পরে মূল্য বেড়ে যেতে দেখে সেই বায়নার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে ১৯১৮ সালের ৫ জুলাই একত্রিশ হাজার টাকায় লরেলস একজন মারোয়ারির কাছে বিক্রি করলেন।

লরেলস বিক্রি করার পরে সম্বলপুর থেকে কলকাতায় এসে প্রজ্ঞা এবং  তিন মেয়ে জোড়াসাঁকো অথবা বালিগঞ্জে ভায়রা আশুতোষ চৌধুরীর বাড়িতে থাকে। এদিকে বার্ড কোম্পানির কাজে অথবা অন্যান্য কারণে লক্ষ্মীনাথকে প্রায়ই কলকাতা আসতে হয়। তিনি থাকেন হাওড়ায় ভোলানাথ বরুয়ার বাড়িতে অথবা ঠাকুর বাড়িতে।এদিকে নতুন  পরিবেশে নিজের গতিশীল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নগরের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি এবং সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে প্রায়ই মৃগয়ায় যাওয়ার ফলে এবং সামাজিক কার্যসূচিগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য গত দুই বছরে লক্ষ্মীনাথ নিজেকে সম্বলপুরের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন। সম্বলপুরে অনুষ্ঠিত সরকারি অথবা স্থানীয় উড়িয়া সমাজের সভা-সমিতি থেকে তাকে আমন্ত্রণ করতে লাগল। এভাবে প্রবাস যদিও কলকাতা যেভাবে তার জন্য নিজের বাসভূমির মতো হয়ে পড়েছিল, সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক দিকে এতটা সমৃদ্ধ না হলেও সম্বলপুরও তার কাছে মনোরম বাসস্থান হয়ে উঠল।সম্বলপুরের জনজীবন থেকেও লক্ষ্মীনাথ জীবনের রস খুঁজে পেলেন। 

 তাই কলকাতা ছাড়ার দুঃখ ভুলে সমস্ত কিছুর সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে এখন লক্ষ্মীনাথ সম্বলপুরে স্থিতিশীল, সুখী। কিন্তু সেদিন রাতের আহার খেয়ে ঘুমোতে যাবার সময় প্রজ্ঞা বলল অরুণা বড়ো হয়েছে, তাকে বিয়ে দিতে হবে। পরের দিন সকালবেলা অরুণার দিকে তাকিয়ে তিনি মেয়েকে নতুন এক রূপে দেখতে পেলেন।হ্যাঁ রূপ যৌবনে অরুণা সত্যি দেখছি বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে । সুপাত্র খুঁজে তার বিয়ে দেওয়াটা পিতা মাতার কর্তব্য । এই চিন্তাটা লক্ষ্মীনাথ কে কিছু পরিমাণে অস্থির করে তুলল।

  বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া অরুণার বয়স কুড়ি বছর। শিক্ষিতা, চেহারা আকর্ষণীয় ,কথাবার্তা শান্ত, বুদ্ধিমতী অরুণাকে বিয়ে দেবার পরে সে পতিগৃহে চলে যাবে কথাটা ভাবতেই লক্ষ্মীনাথ কীরকম হয়ে পড়েন। অরুণা বাড়িতে থাকবে না, অরুণাবিহীন বাড়ির দৃশ্য মনে পড়তেই তার চোখ দুটি সজল হয়ে উঠে।

প্রজ্ঞা স্বামীর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারেন । তিনিও অরুণার মা ।কন্যাকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের বের করে দেওয়াটা মায়ের জন্য কম বেদনাদায়ক নয়। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে প্রজ্ঞা ধীরে ধীরে বলল, কন্যা সন্তান যখন, তাকে তো চিরকালের জন্য মায়ের ঘরে রাখা যাবে না।রাখাটা সংসারের নিয়ম নয় ।তাই পাত্ৰস্থ  করে তাকে সাংসারিক জীবনে এগিয়ে দিতে হবে।

  অবশেষে লক্ষ্মীনাথ সুযোগ্য পাত্রের সন্ধানের জন্য আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে লাগলেন ।কিন্তু অরুণার সঙ্গে মানিয়ে নেবার মতো সুদর্শন উচ্চ শিক্ষিত সংস্কৃতিবান এবং অভিজাত বংশের অসমিয়া কোনো ছেলের সন্ধান পেলেন না। এই ক্ষেত্রে আর ও একটি অসুবিধা হল লক্ষ্মীনাথের ব্রাহ্ম কন্যাকে বিয়ে করা নিয়ে। তিনি নিজে মহাপুরুষীয় বৈষ্ণব ধর্ম অনুসরণ করে নাম সংকীর্তন জপ-তপ করলেও অসমে থাকা তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতরা তাকে ব্রাহ্ম বলেই মনে করেন ।তাদের ধারণা ব্ৰাহ্ম  এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই।এখন ও তারা পুরোনো সংস্কার অতিক্রম করতে পারেনি। এই সমস্ত ভেবে লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া পাত্রের সঙ্গে অৰুণার বিয়ে দেওয়ার কথাটা বাদই দিলেন। তারপরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজনের সামনে কথাটা উত্থাপন করলেন। কিন্তু ঠাকুরবাড়িতে থাকা  সদস্যদের মধ্যে আগের সেই  পারিবারিক বাঁধনটা  আর নেই।ভায়রা ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরীও কোর্ট কাছারি মামলা মোকদ্দমা ছাড়া সাাংসারিক কথায় উদাসীন। এমনিতেই একদিন প্রজ্ঞা এবং দীপিকার সঙ্গে নিয়ে ছাড়ার থেকে রেলের সম্বলপুরে যাবার সময় বৰোদা থেকে আসা সুপ্রকাশ কর নামে একজন প্ৰৌঢ়ের সঙ্গে পরিচয় হল। আগে থেকে পরিচয় থাকা সুপ্রকাশ  করের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পরে যোগ্য পাত্রের কোনো সন্ধান আছে কিনা লক্ষ্মীনাথ জানতে চাইলেন।

সুপ্রকাশ কর বললেন একজন উপযুক্ত পাত্র আছে। কিন্তু তিনি চাকরি করেন  বরোদার রাজার রাজসভায়। বরোদা মুম্বাই থেকে আরও কয়েক ঘন্টার রেল ভ্ৰমণ। অরুণাকে বিয়ে দিয়ে এতদূর পাঠাতে হবে ভাবতেই লক্ষ্মীনাথের পিতার মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রজ্ঞা বাস্তববোধ সম্পন্ন মহিলা। ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রজ্ঞা বললেন দূর কোনো সমস্যা নয়। জাতি ,ভাষা ও বাধা নয় ।পাত্র শিক্ষিত স্বাস্থ্যবান এবং সাংস্কৃতিক চেতনায় উদার হতে হবে। সেটা হলে পাত্রের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে ।তখন সুপ্রকাশ কর জানালেন পাত্রের পিতা-মাতার বিষয়ে তিনি বিশেষ কিছু জানেন না। কিন্তু পাত্রের ভগ্নিপতি একজন কলকাতার বালিগঞ্জে থাকেন।

পাত্রের নাম কী, বরোদার রাজার রাজসভায় কী ধরনের পদে অধিষ্ঠিত জানতে চাইলে সুপ্রকাশ কর জানালেন পাত্রের নাম সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় ,বরোদা রাজ্যের সেন্সাস কমিশনার।

সত্যব্রত  নামটা শুনেই লক্ষ্মীনাথের পরিচিত বলে মনে হল। এদিকে প্রজ্ঞা ও ভাবী জামাতার প্রতি কৌতুহলী হয়ে পড়লেন। কিন্তু উড়িষ্যার এই ঝাড়চোগোড়া বা সম্বলপুর থেকে বরোদায় থাকা সত্যব্ৰত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবেন এটা নিয়ে চিন্তিত হতে দেখে প্রজ্ঞা বলল,' তুমি বাপু মেয়ের বাবা। প্রস্তাব নিয়ে তোমাকে পাত্রের অভিভাবকদের কাছে যেতে হবে।'

' অরুণা কি আমার কোনো দিকে খুঁত থাকা মেয়ে যে বাবা হয়ে আমি পাত্রের অভিভাবকের কাছে ছুটে যাব?' উষ্মা প্রকাশ করে লক্ষ্মীনাথ বললেন, তাছাড়া আমাদের পারিবারিক প্রথা হল কন্যা বিবাহযোগ্যা হলে পাত্রের তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে।

‘আসাম দেশের নিয়ম তো  আর এদেশে চলবে না।মেয়ের বাবা হিসেবে তোমাকে নম্র হতেই হবে।’

‘ তা কীভাবে কতটুকু নম্র হব তুমি বল।’

‘ বরোদাতে গিয়ে পাত্রের সঙ্গে দেখা করে তুমি সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দাও। আর সঙ্গে যদি অরুণাকে নিয়ে যাও তাহলে আরও ভালো হবে।’

‘আমি বাবা যখন আমার যাওয়াটা তবু ঠিকই আছে। তা বলে অরুণাকে সঙ্গে নিয়ে যাব, এসব কী বলছ বুঝতে পারছি না।’

‘ওগো বিয়ের পর মেয়ে যাতে সুখী হতে পারে তার জন্য বাবা মায়েরা এইটুকু করেই থাকেন। আর তুমি দেখবে, একবার দেখার পর সত্যব্রত আমাদের অরুণাকে পছন্দ না করে থাকতে পারবে না।

‘ তথাপি—?’

‘ আহা, তুমি যে সত্যব্রতকে দেখানোর জন্যই অরুণাকে নিয়ে যাচ্ছ সেটা বলবে না।অরুণাকে নিয়ে বোম্বাই বরোদা বেড়াতে গিয়েছ। তাছাড়া অরুণা শিক্ষিত মেয়ে যার সঙ্গে ঘর-সংসার করবে তাকে আর পছন্দ হয় কিনা সেটাও তো আমাদের দেখতে হবে নাকি

 প্রজ্ঞা এত কিছু বলার পরেও লক্ষীনাথ অরুণাকে  সঙ্গে নিয়ে বরোদায় যাবার উৎসাহ পেল না । এরকম মনে হল যে এভাবে যাওয়াটা ঠিক  হবে না।এদিকে উচ্চশিক্ষিত বরোদা রাজ্যে রাজবিষয়া সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়কে হারাতেও চাইছেন না। অবশেষে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অরুণার দিকে তাকিয়ে লক্ষীনাথ জিজ্ঞেস করল ‘কী মা অরুণা সত্যি তুই আমার সঙ্গে বরোদাা যাবি?’

লজ্জিতভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি শেষে অরুণা বলল—‘হ্যাঁ যাব।’

 অবশেষে লক্ষ্মীনাথ এবং অরুণা ঝাড়চোগোড়ার থেকে বরোদায় যাত্রা করল। উনিশ সেপ্টেম্বর (১৯২০ সন) সকাল আটটার সময় মুম্বাই ভিক্টোরিয়ার টার্মিনালে পৌছাল। সেখান থেকে বরোদায় যাবার সকাল সাতটা  কুড়ি মিনিটের ট্রেনটা পেল না। আট টাকার বিনিময়ে দুজনে হোটেল মেট্রোপলিতে আহার করে রাত পো্নে নটার সময় কাথিহার এক্সপ্রেসে উঠলেন।পরের দিন সকাল আটটার সময় বরোদা পৌঁছালেন। তারা যে আসবেন টেলিগ্রাম করে প্রকাশ করকে জানিয়েছিলেন। সেই অনুসারে সুপ্রকাশ স্টেশন থেকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাবার জন্য মানুষ পাঠিয়ে দিলেন। লক্ষীনাথ এবং অরুণা দ্রুত তাদের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। আদর-অর্ভ্যথনায় সুপ্রকাশ আন্তরিক। অরুণাকে নিয়ে লক্ষীনাথের থাকা খাওয়ার অসুবিধা হল না। সুপ্রকাশ সেদিন বিকেলে সত্যব্রত মুখার্জীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করলেন।

বিকেলে সত্যব্রত সুপ্রকাশ করের বাড়িতে এল। উঁচু লম্বা গৌরবর্ণ সাজ পোশাকে সাহেব সত্যব্রতকে দেখেই লক্ষীনাথের ভালো লেগে গেল। এদিকে সত্যব্রত যেভাবে অরুণার দিকে তাকাচ্ছে তাতে সে অরুণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে বলে মনে হল। অরুণার চোখে মুখে মুগ্ধ ভাব ফুটে উঠল। চা জল খাবার খাবার পরে অরুণা গান গাইল। উপস্থিত প্রত্যেকেই অরুণার সললিত কন্ঠের প্রশংসা করল।। গানের আসর শেষ হওয়ার পরে সবাই সুপ্রকাশ আয়োজন করা রাতের আহার খেতে বসল। আহার খেতে শুরু করে  সত্যব্রত অরুণাকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করল।

সত্যব্রতের এই সরলতা এবং স্পষ্টবাদিতা লক্ষীনাথের ভালো লাগল। পরের দিন সুপ্রকাশের সঙ্গে সত্যব্রত দেওয়া গাড়ি করে বরোদার জাদুঘর দেখল। সত্যব্রত নিজের বাংলোয় লক্ষ্মীনাথ অরুণা এবং সুপ্রকাশকে দুপুরের খাবার খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালেন। কয়েক ধরনের সুস্বাদু ব্যঞ্জনে ভোজনের পরে সত্যব্রত অরুনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য লক্ষ্মীনাথের অনুমতি চাইলেন। লক্ষ্মীনাথ আধুনিক মনের মানুষ।তিনিও সানন্দে অনুমতি দেওয়ায় অরুণা সত্যব্রত বাইরে বেরিয়ে একে অপরের কাছে মনের কথা ব্যক্ত করল। তারপর দুজনেই একসঙ্গে এসে যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছার কথা জানাল তখন লক্ষ্মীনাথের পিতৃ হৃদয় আনন্দে ভরে উঠল। দুই হাতে দুজনকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আবেগ ভরা ভারী কন্ঠে বললেন— ‘তোমরা আমাকে ধন্য করলে, আমি খুব খুশি হয়েছি।’

 এদিকে সিদ্ধান্ত হলেও ‘পাকা কথা’ বলে একটা আনুষ্ঠানিকতা থাকে। তার জন্য পরের দিন সকালে আয়োজন করা হল।বরোদায় সত্যব্রতের পিতা-মাতা অথবা   আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই।সত্যব্রতের অভিভাবক হলেন বরোদার চিফ জাস্টিসের মিসেস টায়াবজী।। মিসেস টাায়াবজী দুটো গিনির আংটি পরিয়ে অরুণাকে আশীর্বাদ করলেন।। রাতে ঘুমোতে এসে লক্ষ্মীনাথের প্রজ্ঞার কথা মনে পড়ল। তিনি চিঠি লিখতে বসলেন। 

'পরি,

… আমি সত্যব্রতকে দুটো গিনির আংটি দিয়ে আশীর্বাদ করেছি। সেও গিনির আংটি দিয়ে অরুণাকে আশীর্বাদ করেছে। ছেলে আমার মনের মতো হয়েছে। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি সত্যব্রত তোমারও মনের মতো হবে। যেমন বিদ্বান তেমনই সচ্চরিত্র। সত্যব্রত এখানকার সকলের প্রিয় পাত্র। আমি যেমন সব বিষয়ে সরলতা ভালোবাসি সেও অবিকল আমার মতো। ভগবান আমাদের কৃপা করলেন, তাই আমাদের মনের মতো জামাই দিলেন।

… আগামী সোমবার বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা জানাবার জন্য সত্যব্রত স্টেট ডিনারের মতো পার্টি দেবে। শুক্রবার চলে যাবার দিন ঠিক কিন্তু সত্যব্রত ছাড়ল না । এখানকার প্রত্যেকেই অরুণাকে বিখ্যাত বিউটি বলছে । সত্যব্রতেরও একই ওপিনিয়ন। সে একটি বহুমূল্য রত্ন পেয়েছে বলে অহংকারে উৎফুল্ল হয়ে বেড়াচ্ছে । আর একটা আমোদজনক কথা শোনো, সত্যব্রত মিলিটারি গোঁফ রেখেছিল। তোমার মেয়ের এক কথায় গোঁফ কামিয়ে ফেলেছে।….

ইতি তোমার লক্ষ্মীনাথ।  

বরোদা থেকে সম্বলপুরে আসার পরেই অরুণার বিয়ের প্রস্তুতি আরম্ভ হল। বিয়ের পাকা কথা হওয়ার দিনই বর কনের আশীর্বাদ হয়েছে। সেদিনই বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিয়ের তারিখ হল ১৭ নভেম্বর (১৯২০) সন। তাই বেশি দিন নেই ।

এদিকে এই প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান হতে চলেছে। সম্বলপুরে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যদিও এখানে লক্ষীনাথ-প্রজ্ঞার আপন আত্মীয়-স্বজন নেই। এর মধ্যে আবার মেয়ের বিয়ে বলে কথা। বিয়ের জন্য শুধু অর্থবল থাকলেই হয় না লোকবলের ও প্রয়োজন।এ সমস্ত নিয়ে কথা বলতে  যেতেই প্রজ্ঞা পরামর্শ দিল যে বিয়েটা কলকাতার জোড়াসাঁকোতে হতে হবে।বিষয়টা নিয়ে টেলিফোনে ব্যারিস্টার ভায়রা আশুতোষ চৌধুরী এবং প্রজ্ঞার দিদি প্রতিভা দেবীর সঙ্গে কথা বলার পর একই অভিমত পাওয়া গেল।। জোড়াসাঁকোর  থেকে ঋতেন্দ্রনাথেরও একই মত।এভাবে আত্মীয়-স্বজনের উপদেশ-পরামর্শ শুনে লক্ষ্মীনাথও ভাবলেন,জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে অরুণার বিয়ে দিলে সুবিধা হবে এবং অভিজাতভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে।

বার্ড কোম্পানির কর্মকর্তা মিঃকার্ক পেট্রিককে অরুণার বিয়ের কথা বলতেই লক্ষীনাথের জন্য পনেরো দিনের ছুটি মঞ্জর করা হল। বিয়ের কাপড়চোপড় অলংকার কেনার জন্য অরুণাকে নিয়ে কিছুদিন আগে থেকেই জোড়াসাঁকোর  ঠাকুরবাড়িতে থাকতে লাগলেন। রত্না এবং দীপিকাকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ নভেম্বরের পাঁচ তারিখ কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সম্বলপুর থেকে যাওয়া ট্রেনে করেই ভাবী জামাই  সত্যব্রত মুখার্জি বরোদা থেকে এসেছিল।ঝাড়চোগোড়াায় তাকে দেখতে পেয়েই লক্ষ্মীনাথ আনন্দিত হলেন। সত্যব্রত তাড়াতাড়ি ভাবী শশুর মশাইকে তার কামরায় আসার জন্য বলল। লক্ষ্মীনাথ রত্না দীপিকাকে মহিলাদের কামরায় তুলে দিয়ে ভাবী শ্বশুর জামাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে হাওড়ায় এসে উপস্থিত হলেন।

হাওড়ার ডবসন রোডের বাড়িতে ভোলানাথ থাকেন। লক্ষ্মীনাথও এভাবে আসার কথা ভোলানাথ জানে। তার জন্যই দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ভোলানাথ ড্রাইভারের সঙ্গে নিজের ট্যাক্সিটা স্টেশনে পাঠিয়ে দিলেন। তার স্বাস্থ্যটা ভালো নয় বলে শুনে সবাইকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথকে দেখতে এলেন।। সত্যি ভোলানাথ সুস্থ নয়। আগের চেয়ে রোগা হয়ে গেছেন। লক্ষ্মীনাথ ভোলানাথের সঙ্গে সত্যব্রতের পরিচয় করিয়ে দিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পরে চা-জল খাবার খেয়ে সত্যব্রত বালিগঞ্জে থাকা তার বোনের বাড়িতে চলে গেল। রত্না দীপিকাকে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ জোড়াসাঁকোয় ফিরে এলেন।

  জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে।আত্মীয়-স্বজনের আগমনে ঐতিহ্যমন্ডিত ঠাকুরবাড়ি প্রাণ পেয়ে উঠল।সুগৃহিনী প্রজ্ঞা নতুন বউদের সঙ্গে নিয়ে অরুণার বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে আরম্ভ করলেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কীভাবে পালন করা হবে, বরযাত্রীদের কীভাবে আপ্যায়ন করা হবে, কোথায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে, বিয়ের পুরোহিত সমস্ত ঠিক করা হল। তথাপি বিয়ে বলে কথা। তার মধ্যে আবার মেয়ের বিয়ে। হাজারটা নিয়ম, সেই সমস্ত নিয়ম পালনের জন্য হাজারটা কাজ করতে হয়। তবে লক্ষ্মীনাথ সৌভাগ্যবান যে আত্মীয়দের জন্য সে সমস্ত করতে হল না। তিনি নিমন্ত্রণের দায়িত্ব নিলেন। সুদীর্ঘ আঠাশ  বছর কলকাতায় ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন ছাড়া বন্ধুবান্ধব, ব্যবসায়িক সহযোগী কম নয়। নিমন্ত্রণ করতে যাওয়ার সময় এক সময়ে কলকাতার এক নম্বর কাঠের ব্যবসায়ী কালী কৃষ্ণ প্রামাণিকের ছেলে উদার হৃদয় মন্মথ প্রামাণিক নিজের ট্যাক্সিটা দিলেন। সেটা নিয়ে লক্ষ্মীনাথ নিমন্ত্রণ পর্ব শেষ করলেন।

  ১৫ নভেম্বর গায়ে হলুদ। স্নান করানোর পরে অরুণা কনে সাজার জন্য তৈরি হল। অরুণা বিয়ের দুদিন পরেই মা-বাবাকে ছেড়ে, দুই বোনকে ছেড়ে চলে যাবে। বিয়ের পরদিন থেকে অরুণা আর তাদের সঙ্গে থাকবে না। এটাই নিয়ম। এটাই সমস্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়। লক্ষ্মীনাথও সেটা জানে। তথাপি কী এক যন্ত্রণা,কী এক অবুঝ  আবেগ লক্ষ্মীনাথের বুকটাকে ভারী করে তুলল।

 সব সময় সবাইকে আনন্দ দান করা লক্ষ্মীনাথকে  হঠাৎ চুপ করে যেতে দেখে প্রজ্ঞা তার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। তিনি স্বামীকে ভেতরের ঘরে ডেকে আনলেন।শান্ত করুণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললেন— ‘তুমি তো আমার থেকে জ্ঞানী। তোমার প্রজ্ঞাবোধ আমার থেকে অনেক ওপরে। বিয়ের আগের দিন তুমি এরকম করলে আমার কী হবে? আমি কীভাবে মেয়ের বিদায় সহ্য করব বল।’

‘পরি, আমি—আমি বুঝি—।’ লক্ষীনাথের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে পড়ল, অরুণা শ্বশুর বাড়ি যাবেই, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনটা মেনে নিতে পারছে না। ও চলে গেলে আমার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যাবে।’

  ‘সুরভি তো তোমার মাথার মনি ছিল।’ প্রজ্ঞার কণ্ঠস্বর ভারী, ‘তুমি কি কখনও ভেবেছিলে সুরভি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে?’

‘পরি—না, দয়া করে ওর কথা ওভাবে বল না।’

‘ওভাবে বলছি না। সুরভি অকালে সংসারের মায়া ত্যাগ করে  চলে যাওয়াটাকেও যে তুমি সহ্য করেছ, সেটাই তোমাকে বোঝাতে চাইছি। কিন্তু অরুণার এই যাওয়াটা তেমন নয়। তাছাড়া তুমি তো সাহিত্যিক, কবি। তোমার মন উদার। উদার মন দিয়ে তুমি অনেক কিছু অনায়াসে গ্রহণ করতে পার। স্নেহের বন্ধন অতিক্রম করে তুমি কেন ভাবতে পারছ না যে সত্যব্রতকে বিয়ে করে আমাদের অরুণা জীবনের পরিপূর্ণতার দিকে এগোচ্ছে।

 অশ্রুসজল লক্ষ্মীনাথ অপলক নয়নে পত্নী প্রজ্ঞার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার এরকম মনে হল যেন প্রজ্ঞার আলোকে প্রজ্ঞা সত্যিই সুন্দর। তারপরে প্রজ্ঞা যখন তার কোমল উষ্ণ ডান হাতটা লক্ষ্মীনাথের বা হাতে আলগোছে রাখল তখন লক্ষ্মীনাথের দেহ মনে অদ্ভুত এক অনুরণন খেলে গেল।আর তখন তার মধ্যে তিনি অনুভব করলেন সবাই চলে গেলেও প্রজ্ঞা তাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।

 লক্ষীনাথের ইচ্ছা অনুসরণ করে বরোদার রাজ্যরত্ন সত্যব্রত মুখার্জির সঙ্গে অরুণার বিবাহ সম্পন্ন হল। লক্ষ্মীনাথ নিজে কন্যা সম্প্রদান করলেন।। সম্প্রদানের পরে তার দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগল।

  পরের দিন বাসি বিয়ের পরে অরুণা সত্যব্রতের সঙ্গে বালিগঞ্জে চলে গেল। এই বিদায়টাও লক্ষীনাথের কাছে হৃদয়বিদারক। তিনি সহ্য করতে পারলেন না। বাড়িতে থাকতে পারলেন না।বিয়ে দিয়ে বের করে দেওয়া মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে এখনই যেতে নেই  বলে প্রজ্ঞা এবং আত্মীয়-স্বজনরা বোঝানো সত্ত্বেও লক্ষ্মীনাথ একটা টেক্সি করে জোড়াসাঁকো থেকে বালিগঞ্জে এলেন।

বিয়ে করে কনে নিয়ে বাড়িতে আসার এক ঘন্টা পার না হতেই শ্বশুরের আগমন। লক্ষ্মীনাথকে দেখে সত্যব্রতের বাড়ির প্রত্যেকেই আশ্চর্য হল কিন্তু সন্তানের স্নেহ মমতায় বিবশ লক্ষ্মীনাথের মনে বুদ্ধি জ্ঞান কাজ করছে না। তিনি সত্যব্রতকে ডেকে পাঠালেন। সত্যব্রত এলে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আবেগজড়িত কন্ঠে বললেন—বাবা জীবন সত্য এভাবে এসেছি বলে কিছু মনে কর না। অরুণা মাকে নিয়ে তোমরা চলে আসার পর আমি আর থাকতে পারলাম না। সবাই নিষেধ করা সত্ত্বেও চলে এলাম।

 ‘ঠিক আছে এসে ভালোই করেছেন। আপনি থাকুন, এখানেই থাকুন।’

 ‘না, বাবাজীবন আমি থাকব না। এখন এটাই তো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের বাবার প্রথম বছর থাকতে নেই। লক্ষ্মীনাথ বললেন মানে কথাটা হল অরুণা মা তোমাদের বাড়িতে নতুন। তুমি ছাড়া এখানে সবাই ওর অপরিচিত। ওদের সঙ্গে ওর অসুবিধা, থাকা খাওয়ার ব্যাপারে ওর—।’

 ‘একি বলছেন, বাবা!’ লক্ষ্মীনাথকে শেষ করতে না দিয়ে ব্যস্ত ভাবে সত্যব্রত বলে উঠল ,আমার সঙ্গে অরুণার বইয়ে দিয়ে আপনি তো আমাকে ধন্য করেছেন। অরুণাকে পেয়ে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান। কোনো কিছুতে ওর অসুবিধা হবে, এটা কি আমার সহ্য হবে? না বাবা, আপনি ওকে নিয়ে একটুও চিন্তা করবেন না।’

 ‘না বলছিলাম কি, খাওয়া দাওয়াতে ওর কিছু বাছ বিচার আছে। কাতর কণ্ঠে লক্ষ্মীনাথ বললেন, ‘খাবার টেবিলে বসে এটা খাব না ওটা খাব না বলে। ওর মা ওর পছন্দ মতো খাবার রান্না করে খাওয়ায়। তুমি যদি নিজে ওর খাওয়ার ব্যাপারটা একটু নজর দাও।’

  ‘নিশ্চয় দেব। সত্যব্রত বলল, ‘তাছাড়া বরোদা যাওয়ার পর অরুণাই তো রান্নাঘর সামলাবে। ওখানে আমার একজন ভালো খানসামা আছে। আমি খানসামাটিকে অরুণার পছন্দ অনুসারে রান্না করতে বলব।’

  তারপরেও যেন লক্ষ্মীনাথের কথা শেষ হয় না। অরুণার ভালোলাগা খারাপ লাগার কথাগুলি বলে কী কী করতে হবে সেইসবও সত্যব্রতকে বলতে ইচ্ছা হল কিন্তু রাত হয়ে গেছে। এদিকে বাইরে ড্রাইভার ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছে।।অবশেষে অন্দরমহলে ঢুকে  হাসিমুখে কথা বলতে থাকা অরুনাকে দেখে লক্ষ্মীনাথের বুকের যন্ত্রণা কমল। তারপরে অরুণাকে  বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে তিনি তার মাথা পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন—‘মা ভালো থাকিস। সবাইকে আপন করে নিয়ে সুখী হোস বলে  প্রাণ ভরে আশীর্বাদ জানিয়ে অশ্রু সজল চোখে বিদায় নিলেন। 

*'ছায়া ! ।। মিষ্টিবৃষ্টি ।। কবিথা

 *'ছায়া !'* 

মিষ্টিবৃষ্টি ।



.. দেওয়াল বেয়ে লাফিয়ে ওঠে ছায়া !


-- দীর্ঘ হাতে দীর্ঘ দশটা আঙুল ..

দশ আঙুলে দীর্ঘতর নখ,

বাঁকা নখর --


ছায়া ।


-- ভয় পাচ্ছো ?

যদিই ধরে কায়া !


শরীরী নয়,

কেবল আলোর মায়া ..

কেবল দেয়াল, কেবল আলোর খেয়াল !


.. আমি ওকে পোষ মানাতে জানি --

চুপ্ সে যাবে, এইটুক্কুস্ খানি,

জাদুর ছড়ি, ঠিক্ যখন বারোটা !


.. বাজ্ তে দাও! বাজুক্ না, বারোটা ?

              

ছায়াকে হারাতে জানে যে ।। পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জি ।। কবিতা

ছায়াকে হারাতে জানে যে

পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জি 

 


দেখেছি সূর্যের ছায়া

চাঁদের আর পৃথিবীরও

 

নক্ষত্রের ছায়া দেখিনি

 

মহাকাশে ভিড়ের মাঝে

যারা আলো হয়ে উঠতে জানে

তারা সুন্দরের পূজারী

ধ্রুবতারার মতো

ধ্রুব



কবিতা ।। আমাদের মৃত্যুর সঠিক সংজ্ঞা নেই ।। হাবিবুর রহমান

কবিতা

আমাদের মৃত্যুর সঠিক সংজ্ঞা নেই

হাবিবুর রহমান 



আমাদের মৃত্যুর সঠিক সংজ্ঞা নেই 

চারদিকে আগুনের হালকা চলছে

কখনোই নিভবে না এই আগুন 

আগুনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আমাদের ছায়া,

আঙুল থেকে আঙুল খসে পড়ছে,তাই 

তানপুরা থেকে কোনো শব্দ উঠছে না।

আটপৌরে ৬৩৬ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 636 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৬৩৬ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 636 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৬৩৬

অবকাঠামো 


নির্ভর। নিরাপদ। নিরালায়। 


বাসনাদি 


গরলায়েক কবন্ধে জিরাফ শিকার।

শব্দব্রাউজ- ৯৪৯ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-949, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ- ৯৪৯ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-949, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৯৪৯ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ৩০। ৯।২৩। সকাল ১০ টা


শব্দসূত্র : চোখে চোখ রেখে


চোখে চোখ রেখে
যা বলতে যাওয়া
চোখের জাদু কি বলতে দেয়!


প্রতি ইন্দ্রিয়ের ভেতর
তখন ঘুর্ণি,
তারা ব্রহ্মান্ডে মিশে যায় ।

চোখের স্নিগ্ধতা
              ঔদ্ধত্য
আমায় নাশ করে

আনন্দে নিঃস্ব হই ।

কাহিনি ও চিত্রনাট্যের গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠান

কাহিনি ও চিত্রনাট্যের গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠান 



নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা ।। কলকাতার সূর্য সেন স্ট্রিটে ডাঃ কৃষ্ণপদ ঘোষ  মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ভবনের ত্রিতলে ডাঃ বি সি রায়  মেমোরিয়াল সোসাইটির উদ্যোগে সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ স্মৃতি মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল পুরস্কার বিতরণ ও কবিতা পাঠ ও  সর্বোপরি  কবি সাংবাদিক মহিবুর রহমানের কাহিনি ও চিত্রনাট্যের গ্রন্থ ' শুধু তোমারই জন্যে ' র প্রকাশ অনুষ্ঠান । অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও নজরুল গবেষক মজিদ মাহমুদ । সম্মানীয় অতিথি ছিলেন সৈয়দ হাসমত জালাল। অনুষ্ঠানে মজিদ মাহমুদ , কবি আবদুস শুকুর খান ও কফি হাউসের চারপাশে পত্রিকার সম্পাদক মৃণাল কান্তি সাহাকে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হয় । 

             কবিতাপাঠ ও বক্তব্যে অংশ নেন নৃপেন চক্রবর্তী,  কেশবরন্ঞ্জন, অমলেন্দু বিশ্বাস, প্রিয়াঙ্কা নিয়োগী,শঙ্কর তালুকদার, তাজিমুর রহমান, নীলাঞ্জন কুমার প্রমুখ।

শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

শব্দব্রাউজ- ৯৪৮ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-948, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ- ৯৪৮ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-948, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৯৪৮ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ২৯। ৯। ২৩। সকাল- ৮টা ১৫মিনিট ।



শব্দসূত্র: মায়ের গায়ের গন্ধ




মায়ের গায়ের গন্ধ চিনতে

সব কৌশল

কে যেন দিয়ে দেয় ।



সে নির্যাস মৃগনাভির

নয়

তার থেকেও বেশি

উল্লাস আনে ।


মায়ের গায়ের গন্ধ

আজীবন অনুভবে

ছুঁয়ে থাকে ছুঁয়ে থাকে।



আটপৌরে ৬৩৫ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 635 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৬৩৫ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 635 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৬৩৫

কৌরবঅথবা 


পুতুলের। ডিউটি। পুরুত্বের। 


গবাক্ষ 


আলাদা মিছিল কথা কুরুকুলের।

বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

অবশেষে ।। সুব্রত সোম ।। কবিতা, Poem

 অবশেষে

সুব্রত সোম



ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টায় গুটি কেটে বেরিয়ে এল যে প্রথম অঙ্কুর তাকে জল দাও এই প্রত্যয়টুকু নিয়ে অবশেষে সকালে ঘুম ভাঙলো। ব্যস্ততাও জল শুকিয়ে নেয়। আচ্ছাদন ফেলে রেখে শুরু হয় ঘর সংসার সংঘ পরিবার। আমাদের প্রলোভনগুলো কাঁটা পেরোনো সেই পুরোনো শহর ক্যানভাস। যেখানে সম্মোহন ও উদ্দীপনার অভাব হয়না তবুও এক একটা সন্ধ্যার চালচিত্রও বদলে দেয় সময়ের গতিপথ। জলেকাদায় মিশে যায় অপ্রতিষ্ঠান ভাবনা। এখান থেকেই আবার শুরু হতে পারে পটচিত্র যাত্রাকাহিনী কিংবা নগর সমীকরণ যা মানুষ ছড়িয়ে রেখেছে বিশ্বাসে অকৃপণ ভালবাসায়, সঙ্গোপনে।

শব্দব্রাউজ- ৯৪৭ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-947, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ- ৯৪৭ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-947, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৯৪৭ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ২৮। ৯। ২৩। সকাল- ৭টা ।



শব্দসূত্র: আগামীকালের জন্য



আগামীকালকে

আজ ধরতে গিয়ে

হাস্যকর হই ।



আগামীকালের বাস্তব

আজ ধরতে ধরতে

দিন গড়ায় ।



কিছুতেই বুঝতে চাই না

আগামীকালের জন্য

আগামীকালই অপেক্ষা করে আছে ।


আটপৌরে ৬৩৪ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 634 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৬৩৪ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 634 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৬৩৪

ফিনকি 


উচ্ছ্বাস। আবেগ। উঠলো। 


একটুখানিক 


অন্যরকম কিছু জনস্রোতে ভাসিয়ে।

বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১ পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস, Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi

 পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ১

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি   

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  

Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi




তৃতীয় অধ্যায়, দ্বিতীয় অংশ ।। পাখিদের পাড়া- পড়শী

***/..

আমরা ভারতীয় পর্যটকদের পকেটের দিকে তাকিয়ে হাঁটা মানুষ। ডলারের তুলনায় টাকার মানদণ্ডের দুর্বলতা আমাদের  কাছে সত্যিই পরিতাপের। ১৯৪৭ সনে এক টাকা এক ডলারের সমান ছিল। আজ এক ডলারের মান প্রায় ৬৭ টাকা। ৪৭ সনের মতো টাকার মান ডলারের সমান হলে ভারতীয়রা অনায়াসে পর্যটক হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত। লাউসে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আমার মনে প্রথমে ডলারের কথাই এল। হলেও যাব বলে ভাবছি যখন খরচের অংক বেশি করে না করাই ভালো— আমি ভাবলাম।

আমার দেশ আমাকে পৃথিবীর যে কোনো দেশে যাবার অনুমতি পত্র অথবা পারপত্র দিয়েছে।

পারপত্র বের করতে যথেষ্ট পয়সা খরচ করতে হয় এবং অনেক সময় লাগে— বিভিন্ন জন বলা কথার ওপর নির্ভর করে আমারও সেরকম ধারণা ছিল। তবে কথাটা শুদ্ধ নয়। আমি অনলাইনে আবেদন করলাম। প্রয়োজনীয় টাকাও ইব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান করলাম। তারা আমাকে অনলাইনযোগে নির্দিষ্ট দিন তারিখ জানাল। নির্দিষ্ট দিনে আমি গুয়াহাটি পারপত্র কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে আমার তথ্য সমূহ পারপত্র কার্যালয়ে প্রদান করতে হবে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেৰ কাছ থেকে আপত্তিহীনতার প্রমাণপত্র। আমার ব্যাংকের শাখার পরিচালকের থেকে আমি আপত্তিহীনতার প্রমাণপত্র সংগ্রহ করলাম। চাকরি করা ব্যক্তির জন্য এটাই গুরুত্বপূর্ণ নথি। সঙ্গে লাগবে বিভাগীয়ভাবে প্রদান করা পরিচয়পত্রটি। তাছাড়া ভোটার তালিকা, জন্মের প্রমাণপত্র, স্থায়ী নিবাসীর প্রমাণপত্র যাকে আমরা পিআরসি বলি, এই সমস্ত কিছু নিয়ে আমি গুয়াহাটি পারপত্ৰ কার্যালয়ে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হলাম। নির্দিষ্ট সময় মানে অতি নিৰ্দিষ্ট। আমার অনলাইন আবেদনের বিপরীতে তারা আমাকে দেওয়া তথ্য সমূহে সময় ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। সেই নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে নিরাপত্তারক্ষী আবেদনকারীকে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না।

পারপত্র কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে একটা অন্যরকম পরিবেশের সম্মুখীন হলাম। অসমের কোনো কার্যালয়ে না দেখা পরিবেশ। একের পর এক টেবিল অতিক্রম করে গিয়ে তৃতীয় টেবিলটিতে আমার দুটি হাতের ছাপ এবং আলাদা আলাদা প্রত্যেকটি আঙ্গুলের ছাপ নিল। সঙ্গে ক্যামেরা দিয়ে আমার আলোক ছবি গ্রহণ করল। নথিপত্র গুলি ফটোকপি করে আমার মূল নথি গুলি ফিরিয়ে দেওয়ায় আমি জিজ্ঞেস করলাম—আমার হয়ে গেছে নাকি?

— হ্যাঁ। হয়ে গেছে।

আমার সামনে থাকা হৃষ্টপুষ্ট কর্ম তৎপর মেয়েটি বলল।

— পারপত্রটি কবে কীভাবে পাব?

— আপনি আপনার ঠিকানায় ডাকে পেয়ে যাবেন।

আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটির কথামতোই এক সপ্তাহ পার হতে না হতেই আমি আমার পারপত্রটা লাভ করলাম। পারপত্রের সাদা পৃষ্ঠাগুলি উল্টে উল্টে ভাবলাম— কবে এখানে কোনো দেশের ভিসার মোহর লাগাতে পারব!

সম্ভবত সেই মুহূর্তটি এসে আমার সামনে উপস্থিত হল।

লাউসে ভিসার জন্য অনলাইন আবেদন করা যায়। আমি সেই সুবিধা গ্রহণ করলাম। তিনটি কাজের দিনে তারা ভিসার কাজ করে দেয়। ভিসার জন্য আমাকে টাকার হিসেবে এগারো  হাজার ছশো আটানব্বই টাকা পঁচাশি পয়সা দিতে হল। টাকা জমা দেবার পরে কাজ এগুলো এবং আমি লাউস সরকারের কাছ থেকে তাদের দেশে প্রবেশ করার অনুমতিপত্র লাভ করলাম।

এখন আমার সামনে উত্থাপিত প্রশ্নটা হল লাউসের রাজধানী ভিয়েনটিয়েনে কীভাবে যাওয়া যায় । অর্থাৎ কোন পরিবহন ব্যবস্থায়। তার জন্য আমাকে দুটি কথায় মনোযোগ দিতে হল। প্রথম কথা হল কোন পরিবহন ব্যবস্থায় কম খরচে যাওয়া যেতে পারে। আর দ্বিতীয় কথাটা হল সময়। অবশ্য এটা ওটার পরিপূরক। সময় কম লাগলে খরচের মাত্রাও কম হতে দেখা যায়। আমি কলকাতা থেকে ভিয়েনটিয়েনে যাবার সুবিধার বিষয়ে অনুসন্ধান করলাম । তিনটি বিমান পরিবহন সংস্থা কলকাতা থেকে ভিয়েনটিয়েনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। সেগুলি হল চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স, বিমান বাংলাদেশ এবং এয়ার ইন্ডিয়া।

চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের বিমান কলকাতা থেকে কুনমিঙ এবং কুনমিঙ থেকে ভিয়েনটিয়েনে উড়ে যায়। একইভাবে ফেরার পথ আছে ভিয়েনটিয়েন থেকে নানিং, নানিং থেকে কুনমিঙ এবং কুনমিঙ হয়ে কলকাতা। কলকাতা থেকে কুনমিঙে সময় লাগে দুই ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট কুনমিঙ  থেকে ভিয়েনটিয়েনে মাত্র ত্ৰিশ মিনিট। অথচ গোটা যাত্রা পথে সময় লাগে বারো ঘন্টা ত্রিশ মিনিট। কারণ হল সকালবেলা পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কুনমিঙ পৌছান আকাশযানটা কুনমিঙ ছাড়ে বিকেল দুটোয়। ফিরে আসতে সময় লাগে তেরো ঘণ্টা পাঁচ মিনিট। বিমানের টিকেটের জন্য খরচ পড়ে ছশো সাত দশমিক নয় এক ডলার অর্থাৎ চল্লিশ  হাজার তিনশো উনচল্লিশ টাকা একুশ পয়সা। বিমানটা কলকাতা থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ব্যাংককে যায়। ব্যাংকক থেকে ভিয়েনটিয়েনে যাবার জন্য তারা থাই এয়ারওয়েজের বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেয়। যাবার সময় বিমান পরিবহন ব্যবস্থা সময় নেয় বাইশ ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিট। অবশ্য ফিরে আসার সময় যথেষ্ট কম সময় লাগে। মাত্র সাত ঘন্টা চল্লিশ  মিনিট।

খরচের দিক দিয়ে এয়ার ইন্ডিয়াৰ বিমানের রেট অনেকটা বেশি।সাতষট্টি দশমিক শূন্য পাঁচ ডলার। অর্থাৎ একান্ন হাজার একশ আঠাশ টাকা ষোলো পয়সা। তার কারণ আছে। কেননা বিমানটা কলকাতা থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে ব্যাংকক এবং ব্যাংকক থেকে ভিয়েনটিয়েনে যায়। সময় লাগে উনিশ ঘন্টা। এভাবে ফিরে আসে ভিয়েনটিয়েন থেকে ব্যাংকক, ব্যাংকক থেকে দিল্লি এবং দিল্লি থেকে কলকাতা আসে। সময় লাগে কুড়ি ঘন্টা পঁয়ত্ৰিশ মিনিট।

সমস্ত ভেবে শুনে আমি চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের বিমানে ভিয়েনটিয়েনে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।কুনমিঙ এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে হওয়ার সময়টুকুতে চাইনিজ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন মানুষের চাল চলন দেখেই সময় কাটাব এবং বই পড়ব।কুনমিঙেৰ সঙ্গে পরাধীন অসমের ভালো যোগাযোগ ছিল। যোরহাটের ররৈয়া বিমানবন্দর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুনমিঙে নিয়মিত যুদ্ধবিমান এবং মাল বহনকারী বিমান চলাচল করত। সেই স্মৃতি স্মরণ করার জন্য কোনো বিমানবন্দরের অপেক্ষা গৃহ নিশ্চয় উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

ভিয়েনটিয়েনে আসা যাওয়া টিকিটের ব্যবস্থা ও হয়ে গেল। তেরো আগস্ট যাত্রা আরম্ভ হবে এবং আঠারো আগস্ট যাত্রার সমাপ্তি ঘটবে। তেৰো  থেকে আঠারো  আগস্ট পর্যন্ত সরকারি বন্ধ। তাই ষোল থেকে আঠাৰো  আগস্ট পর্যন্ত ছুটি নিতে হল। সমস্ত জোগাড় করে এখন যাত্রার দিনটির জন্য আমি অধীর ভাবে অপেক্ষা করছি। বিদেশের মাটিতে পা রাখার সুযোগ লাভ— এই কথাটাই আমাকে আহ্লাদিত করে রেখেছে।

বারো আগস্টের রাতের রাজধানী এক্সপ্রেস উঠে আমি তিনসুকিয়া থেকে গুয়াহাটি পৌছালাম। রেলস্টেশন থেকে সোজাসুজি গোপীনাথ বরদলৈ আন্তরাষ্ট্রীয় বিমানবন্দর। দশটার ইন্ডিগো বিমানে কলকাতা যাত্রার জন্য বিমানের টিকেট, লাওসের টিকেট কাটার দিন একসঙ্গে কেটে রেখেছিলাম। কলকাতা পৌঁছাতে এক ঘন্টার চেয়ে একটু বেশি সময় লাগল। এই এক ঘণ্টা সময় আমি প্রায় ঘুমিয়ে কাটালাম। রাতে ঘুম হয়নি বলে আমার সুন্দর ঘুম হল। বিমানটা টেক অফ করার সময় চাকার ঘর্ষণে আমি জেগে গেলাম।

কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল আমার বন্ধু সুদীপ্ত সে আমার সহপাঠী ছিল সেও ব্যাংকে চাকরি করে যদিও তার আর আমার ব্যাংকের শিরোনাম পৃথক। কলকাতায় যাব বলে তাকে জানানোয় সে বলল যে সেদিন যেহেতু তারও বন্ধ তাই দুপুরের আহার একসঙ্গে করতে চায়। সুদীর্ঘ  দিনের বিরতিতে আমার সঙ্গে তার দেখা হবে। মনের মধ্যে ভালো এবং খারাপের মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। তার পরিবার-পরিজন আছে। তার বউ আমি কেন বিয়ে করিনি বলে জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেব সেটা আমি আগেই ঠিক করে রেখেছি। না হলে কখন ও কখন ও বড়ো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।

বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার মুখেই সুদীপ্ত আমার জন্য দাঁড়িয়েছিল। সে আমাকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে দিল। আমি তার কাছে দৌড়ে যাবার মত করে গিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা মাটিতে রেখে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। এক মুহূর্তের মধ্যে আমি পড়াশোনা করা বিদ্যালয়টা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে এবার তার হাত দুটি জড়িয়ে ধরলাম।

পরস্পরের খবরা-খবর সাধারণভাবে বিনিময় করে সে আমার ব্যাগটা নেবার ইচ্ছা জানাল।

— আরে ভাই তুই আমার বন্ধুহে, বন্ধু পাঠিয়ে দেওয়া গাড়ির চালক নয়!

একটার দিকে এগিয়ে দেওয়া হাতটা গুটিয়ে নিয়ে সে নির্দিষ্ট একটি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

— তোর গাড়ি?

আমি সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম। মাথা নেড়ে বলল —হ্যাঁ।

— আরে বাবা খুব সুন্দর গাড়ি নিয়েছিস!

আমি তাকে খ্যাপানোর জন্য বললাম। হাতে থাকা রিমোট কন্ট্রোলে গাড়ির দরজা খুলে নিয়ে আমাকে সামনের আসনে বসতে বলল আরক্ষী আটক করা অতি অবাধ্য অপরাধীর মতো আমি গাড়িতে উঠলাম। আমার বেগটা সেই ডিকিতে ভরিয়ে নিল। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে কলকাতা মহানগর বেশ ভালোই দূর। এঁকেবেঁকে বিভিন্ন পথে এসে সে একটা বিশাল মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং এর সামনে এসে দাঁড়াল। তারপরে ডিকি থেকে আমার ব্যাগটা বের করে হাতে নিয়ে সে লিফটের জন্য এগিয়ে এল।

সুদীপ্তের ফ্লাটের বৈঠকখানাটাও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সুগৃহিনীর হাতের স্পর্শে লাবণ্য মধুর। ঘরে ঢুকে আমি চারপাশে চোখ বোলালাম। শীতল এবং মসৃণ কার্পেটে খালি পায়ে হেঁটে কোনো তারাখচিত  হোটেলের লনে হাঁটছি বলে মনে হল। আমাদের উপস্থিতির কথা জানতে পেরে সুদীপ্তের ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

— নমস্কার বৌদি।

— নমস্কার।

সুদীপ্তের পত্নী সাবলীল অসমিয়ায় জিজ্ঞেস করলেন— আপনি ভালোভাবে এসেছেন? পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

—হ‍্যাঁ, কোনোরকম অসুবিধা হয়নি ।ভালোভাবে পৌঁছে গেছি।

আমি সুদীপ্তের স্ত্রীর মুখ থেকে চোখ না সরিয়ে বললাম। সুদীপ্তও কথাটা নিয়ে মজা করছিল।

— এভাবে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছিস যে?

সুদীপ্তের বন্ধুত্ব সুলভ প্রশ্নটি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সুদীপ্তের পত্নীর সামনে নিয়ন্ত্রণ না হারানোর জন্য আমি বললাম— পত্নী বিষয়ক আমার কোনো ধারণা নেই। মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ধারণা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি।

— তবে এর চেয়ে আর বেশি এগোস না।

— সুদীপ্ত তোর পুরোনো স্বভাবের আর বদল হল না।

এক ধরনের গর্জে উঠার মতো বললাম।

— বাঁদর যত বুড়ো হয় তত গাছের উপরে উঠে। আমরা মানুষরা বাঁদরের জাত, তাই বুড়ো হচ্ছি মানে ততই গাছের—

আমি সুদীপ্তকে আর কথা বলার সুযোগ দিতে চাইলাম না। আমাকে  কথার সুর বদল করার চেষ্টা করতে দেখে, সে তার পত্নীকে  আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

— এই যে আমার স্ত্রী। একতারা সাহা।

— আমি জিজ্ঞেস করলাম একটা তাঁর নাকি একটা তারা। আচ্ছা এত সুন্দর অসমিয়া বলে যে?

সুদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল— কেন বলবে না? গুয়াহাটির মেয়ে যে।

আপনারা বসুন ,আমি চা নিয়ে আসছি।

সুদীপ্তের স্ত্রী একতারা ভেতরে চলে গেল।

— ছেলেমেয়েরা?

— আমাদের দ্বিতীয় শনিবার বন্ধ, ওদের তো আর বন্ধ নেই।

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।

সুদীপ্ত দেখিয়ে দেওয়া অনুসারে আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। বাথরুমটাও বেশ সুন্দর। তারাখচিত হোটেলের বাথরুমের মতো। সুদীপ্তের গাড়ি– বাড়ি দেখে আমি কিন্তু নিজেকে একবারও প্রশ্ন করলাম না— আমি সারা জীবনে কী করলাম? এই প্রশ্নটি কখন ও আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হলে আমি উত্তরটা তৈরি করে রেখেছি— আমি শুরু করেছি মাত্র। এমন একটি কাজ যা দশের উপকার করতে পারে, হিতসাধন করতে পারে।

একতারা এনে দেওয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে আমাদের মধ্যে আরম্ভ হল স্মৃতি রোমন্থন। কোথা থেকে আরম্ভ হয়েছে আমাদের কথা কোথায় শেষ হয় আমরা দুজনে আন্দাজ করতেও পারলাম না। কত কথাই যে আমরা বললাম। সুদীপ্ত তার বিয়ের কথা বলল ।কর্মক্ষেত্রের কথা বলল ।বলল জীবনের বহু উত্থান এবং পতনের বহু অ-কথিত কাহিনি। একতারা আমাদের দুজনের জন্য দুপুরের আহার তৈরি করার সঙ্গে মাঝেমধ্যে এসে দুই পাঁচ মিনিট আমাদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে যায়। মুখে সে কিছুই বলে না, কেবল আমাদের কথা শুনে যায়। একতারার মুখে হাসি আছে দেহের গঠনে আছে লাস্যময় ভঙ্গিমা। সুদীপ্তের কথা আর বলে লাভ নেই, মুখের কোনো লাগাম নেই কখন যে একতরার সামনে কী সব বলে দেবে ভেবে ভয় হয় । ভয় করার কী আছে , আমাকে অপ্রস্তুত অথবা বেকায়দায় ফেলার জন্য সে আগে থেকেই চেষ্টা করে থাকে। কেবল আমি তাকে সুযোগ না দিলেই হল।

সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল— উদয় এখনও সময় পার হয়ে যায় নি তুই বিয়ে টিয়ে করলি না, তবে এখন অন্য কোনো বিশেষ কাজে ব্যস্ত আছিস নাকি?

এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে আমার বেশ কিছু সময় লাগল। আমি এক দিক থেকে আদ্যোপান্ত বলে যেতে লাগলাম। আর একতারা গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শুনতে লাগল। আমি বলতে থাকা বিষয় সম্পর্কে সুদীপ্তের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। সেই জন্য সে অনেক কথা বুঝতে পারছিল না এবং আমাকে পরপর প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। আমি তাকে ছোটো ছোটো কথায় জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাম। অনামিকার জীবনে এসে পড়ার দুর্ভাগ্যের প্রতি সে সহানুভূতি প্রকাশ করেও নিজের চরিত্রকে শোধরাতে না পারা সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করতে ভুলল না — মহিলাটিকে দেখতে কেমন ?

একতারা সুদীপ্তের পিঠে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিল। নারীসুলভ সেই অভিব্যক্তিতে কি লুকিয়ে ছিল জানিনা, হয়তো সুদীপ্তের চরিত্রের কিছু ত্রুটি শুধরানোর ব্যর্থ চেষ্টা । আমি সুদীপ্তকে কোনো উত্তর দিইনি। এই ধরনের প্রশ্ন উত্তর দিতে আমি মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি। সুদীপ্ত জানে বলে এরকম প্রশ্ন আমাকে প্ৰায়ই করে ব্যতিব্যস্ত করে আমোদ লাভ করে। 

আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দুই চারটি কথা আমি সুদীপ্তকে জানালাম।। সে আমাকে শুভেচ্ছা জানালেও যদিও আমি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেবার ব্যাপারটাকে সে মোটেই সম্মতি জানাল না। তার মতে আমি চাকরি করে থাকা অবস্থাতেই সবার সেবা সমাজ সেবামূলক কাজ গুলি চালিয়ে নেওয়া যুক্তিযুক্ত। আমি সুদীপ্তের মনের ভাবকে সম্মান জানালাম এবং অবশেষে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেব না বলে তাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হল।

 তুই যেভাবে নিজের খেয়াল খুশি মতো কাজ করিস তোর কথা বলতে পারি না। তুই হঠাৎ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিবি।তাই তুই আমার কাছে এই ধরনের শপথ খেতে হবে না।

--কোনোমতেই চাকরিটা ছাড়বেন না দাদা।

 একতারার কন্ঠে আবদার এবং  স্নেহ মিশ্রিত সুর।  বহুদিনের পরিচিত কোনো আত্মীয়ের আত্মিক দাবি। অবশেষে আমি পতি পত্নীর কাছে শপথ খেয়ে নিস্তার পেলাম। আমাকে যে মা কালীর নাম উচ্চারণ করে কানে ধরতে হল না, আমি অল্পতেই রক্ষা পেলাম বলে মনে হল।

 দুপুর বেলা একতারা অতি তৃপ্তিদায়ক খাবার রান্না করে আমাদের খাওয়াল। সরষে বাটা দিয়ে রান্না করা ইলিশ মাছ, আলু টমেটো দিয়ে  রান্না চিতল মাছ এবং লঙ্কা দিয়ে  রান্না করা স্থানীয় মুরগির মাংস। জুহা চালের ফুরফুরে গন্ধে ভাত খাওয়া ঘরটা ইতিমধ্যে ভরে উঠেছে।এইসব খাদ্য সম্ভার দিয়ে একবেলা খাওয়া আমার কাছে স্বপ্নেরও  অগোচর।

আমরা ভাত খাবার সময় একতারা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসার জন্য বিদ্যালয় গেল।

-- ছেলেমেয়েদের স্কুল কাছে নাকি?

 আমি সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম।

 না তা নয়। পাঁচ কিলোমিটারের মতো দূরে। গাড়ি নিয়ে যাবে যখন এখনই চলে আসবে।

 সুদীপ্তের পত্নী একতারা রান্নাবান্না করে ছেলে মেয়েকে আনতে স্কুলে গেছে ভাব তেই আমার কেমন ভালো লেগে গেল। সুদীপ্ত প্রতিজন স্বামী আকাঙ্ক্ষা করার মতো কর্মদক্ষ সুপত্নী লাভ করেছে। খাওয়া-দাওয়া হওয়ার পরে সুদীপ্ত আমাকে শোবার জন্য বলল।

 -- রাতের ফ্লাইটে ঘুম নাও হতে পারে। সেজন্য একটু ঘুমিয়ে নে।

-- দিনে ঘুমালে বরং রাতে ঘুম আসবে না

  ফ্লাইটে দেওয়া একটা পেগ খেয়ে নিবি। তবে তুই তো আবার সে স্পর্শ করবি না। যা হওয়ার হবে, একটু রেস্ট নিয়ে নে।

 সুদীপ্তকে একটু অবসর দেওয়ার ইচ্ছায় আমি তাকে সম্মতি জানালাম এবং সে দেখিয়ে দেওয়া অতিথির জন্য ব্যবহৃত ঘরটাতে ঢুকে গেলাম। সুদীপ্ত ঘরে থাকা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটির তাপমান ঠিক করে দিল। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল কততে রাখবে।  আমি বললাম তোর ইচ্ছা। সে হয়তো ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেখেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে সুদীপ্ত অতি ধীরে ধীরে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে গেল। বিছানাতে শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম এসে পড়ল। আমি বিছানার কাছেই থাকা সেদিনের হিন্দু কাগজটা মেলে ধরলাম এবং মূল খবরটাতে চোখ বোলাতে লাগলাম।

সুদীপ্ত আমাকে যখন জাগিয়ে দিল তখন কলকাতা মহানগরকে রাতের অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। আমি মুখ হাত বেসিনের জলে ধুয়ে বৈঠকখানা ঘরে সুদীপ্তের কাছে বসলাম। একতারা ম্যাগি এবং কফি তৈরি করে সাজিয়ে টেবিলে রেখেছে।দুপুরের ভুরি-ভোজের পরে আমার খুব একটা ক্ষুধা ছিল না।আমি কেবল কফি খেলাম।একতারা আমাকে ম্যাখি খাওয়াবার জন্য  খুব চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমি রাজি হলাম না।

 সুদীপ্ত বিবিসির কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছে। মূল শীর্ষক খবরের পরে পরিবেশন করছে আবহাওয়ার খবর।

-- চিনে বৃষ্টি হতে পারে। চিনে হলে লাউসেও হবে।

-- হলে হবে। বৃষ্টি দিলে কী আর এমন বড়ো কথা হল ।

 চিনের বৃষ্টি নিয়ে সুদীপ্ত আমাকে এরকম একটা পাঠ পড়াতে চেষ্টা করল যেন আমি চিনের বৃষ্টিতে ভেসে গিয়ে সাগরে পড়ব। আমি জানি চিনের বৃষ্টির বদনাম রয়েছে। বৃষ্টি হলে দুর্যোগ না হয়ে থাকে না। পাহাড়ি লাউসে সেরকম হওয়ার আশঙ্কা নেই। আমি সুদীপ্তকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম রাত বারোটা ত্রিশের সময় আমার ফ্লাইটের সিডিউল। এগারোটা ত্রিশে আমাকে বিমানবন্দর পৌঁছাতে হবে। আমি আটটার সময় সুদীপ্তকে বললাম-‘আমার সময় হয়েছে, আমি যাই।’

-- ‘পাগল হয়েছিস নাকি তুই? ভেবেছিস আমি প্লেনের সময় জানি না।ঠিক সময় মতো আমি পৌঁছে দেব তুই মিছামিছি এত ব্যস্ত হয়ে পরিস না।’

 সুদীপ্তের কথা শুনে আমি চুপ করে যেতে বাধ্য হলাম, কেননা একতারা সুদীপ্তের চেয়েও বেশি।

  ‘আপনি রাতের খাবার খেয়ে যাবেন।আমি বাজার করে এনেছি।’

 আমি বুঝতেই পারলাম না কোন ফাঁকে একতারা গিয়ে বাজার করে এনেছে ।সুদীপ্ত সত্যিই ভাগ্যবান পুরুষ। ছেলে মেয়েদের স্কুলথেকে আনা, বাজার করে এনে রান্নাবান্না করা ,এই বিদূষী  গৃহিণী সমস্ত কাজ নিজেই সমাপন করে। বেশ শক্তিমান এনার্জেটিক।

 সুদীপ্ত আমাকে এবার তার ব্যক্তিগত রুমে নিয়ে গেল। বাঃ এত সুন্দর! আমার অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ।তারা চিহ্নিত একটি হোটেলের মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সমস্ত সুবিধা সংলগ্ন ।সে ঘরের শীতাতপ যন্ত্রটিকে নির্দিষ্ট ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ফ্যান চালিয়ে দিল। দুটো সুইচ দেওয়ার পরে ঘরটিতে মসৃণ রঙে সমুজ্জল  হয়ে পড়ল। আমি কোনো কল্পনা রাজ্যে বসবাস করা যেন অনুভব করতে লাগলাম।

  —তুই সত্যি মদ খাস না?

–উহু।

আমি সজোরে মাথা নাড়লাম।

 —মদ খাওয়া মানুষের সঙ্গে বসতে তোর আপত্তি আছে নাকি?

 —মোটেও নেই।যদি হে অদরকারী কথাগুলি আবোল-তাবোল ভাবে বকতে শুরু না করিস।

 —তুই কি সমস্ত মদ খাওয়া মানুষকে মদ্যপী বলে ভাবিস নাকি?

  —ভাবি না বলেই তো বসায় আপত্তি নেই বলে বললাম।

  কথা বলতে থাকার মধ্যে সে একটা সেলফ খুলল। সেলফটিতে  বিভিন্ন ধরনের কারুকাৰ্য খচিত  মদের  বোতল। তারই একটা বের করে এনে সে সেলফেই সাজিয়ে ৰাখা বিশেষ জায়গাটিতে রাখল। তারপরে এসে নিচের বড়োসড়ো একটি সেলফ খুলল।আসলে আমি সেলফ বলে ভুল করেছিলাম। সেটি একটি সুন্দর দেখতে ছোট্ট ফ্রিজ। সে ফ্রিজ থেকে জলের বোতল এবং একটি সোডার বোতল বের করে আনল। আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তাকিয়ে থাকলাম। তার বোতল থেকে জল এবং সোডা মেশানোর প্রক্রিয়া দেখতে লাগলাম। মদের গ্লাসটিতে জল ঢালায় সৃষ্টি হওয়া রিমঝিম শব্দ আমাকে বেশ আকর্ষণ করল।

 গ্লাসটিতে আলগোছে জড়িয়ে ধরে সুদীপ্ত সেলফগুলির কাছ থেকে এসে আমার সামনে চেয়ারে বসল। একসঙ্গে পড়াশোনা  এবং চাকরি করা সুদীপ্তের ঐশ্বর্য দেখে আমি কিছুটা বিমুগ্ধ এবং কিছু পরিমাণে হতচকিত হয়ে পড়লাম। সত্যিই জীবন  মানুষকে কীভাবে গড়ে তোলে।মানুষের জীবনটা জলের চেয়েও তরল। যে ধরনের পরিবেশে রাখা যায় জীবনটা তার চেয়েও বেশি সেরকম পরিবেশে নিজেদের গড়ে নেয় ।

  গ্লাসে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে সুদীপ্ত নিজের জীবন-বীক্ষা আরম্ভ করল।

 —উদয়শংকর কী আছে জীবনটাতে ?কী আছে তুইও বলতে পারিস না ।আমিও পারিনা।

 সুদীপ্ত আমার দিকে এভাবে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার মনে হল সে আমার কাছ থেকে উত্তর চাইছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে মৌন হয়ে থাকায় সে পুনরায় বলতে লাগল।

মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবে। পরিবার নিয়ে ছেলেটি চাকরি করে দূরে থাকবে, যেভাবে আমি রয়েছি। কী করব তখন বুড়ো বুড়ি?যান্ত্রিক জীবনের এই পর্যায় আমাদের ইতিমধ্যে সমস্ত আত্মীয় কুটুম্ব থেকে দূরে নিয়ে এসেছে। সুদীপ্ত গ্লাসটাতে একটা দীর্ঘ চুমুক দিল। আমার হাতে উত্তর আছে কিন্তু আমি নিরুত্তর হয়ে রইলাম। সুদীপ্তের চোখে না পড়ার মতো করে আমি মনে মনে হাতের ঘড়িটার দিকে লক্ষ্য করছিলাম যদিও সে দেখতে পেল। তবে সময়ের প্রতি আমার লক্ষ্য করাকে গুরুত্ব দিল না।

-- তুই কিছুই বলছিস না যে?

 কী বলব সুদীপ্ত? আমরা একই পৃথিবীতে বসবাস করলেও আমরা দুজন দুটি  পৃথক পৃথিবীর বাসিন্দা। আমার ধারণার সঙ্গে তোর ধারণা সম্পূর্ণ পৃথক। আমি সঙ্গী চেয়ে প্রকৃতি এবং মানুষের কাছে যাই। আর তুই, আমার বলার দরকার নে্‌ই, তুই নিজেই জানিস তোর স্থান আর স্থিতি তোকে যেভাবে গড়ে তুলেছে তুই সেভাবেই  গড়ে উঠেছিস। তাই দুঃখ প্রকাশ করে লাভ নেই।আর যদি জীবনের কোনো বাঁকে দাঁড়িয়ে তুই নিজের পথের পরিবর্তন করতে চাস, প্রকৃতি আর মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চাস আমার ফোন নাম্বার তোর কাছে আছে। আমাকে ফোন করিস।

 কথার মধ্যে মাঝে মাঝে সুদীপ্ত হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে এবং মাঝেমধ্যে ঐশ্বর্যশালী পৃথিবীর একজন বাসিন্দা হয়ে  উল্লসিত হয়ে পড়ে।সুদীপ্ত গ্লাসে দ্বিতীয় পেগ ঢেলে নেয়নি। আমাকে রেখে এসে নাকি আরও দুটি পেগ নেবে একা একা। হতাশা এবং বর্ণহীন নিঃসঙ্গতাতাকে জড়িয়ে ঘুমানো মানে পুনরায় গতানুগতিক একটি দিনের শুরু।

-- চল একতারা ডাকছে।

 মোবাইল ফোনটার অনুজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে সুদীপ্ত বলল।

 আমি তার এই বাক্যগুলির জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলাম।

 ভাত খাওয়ার টেবিলে বিভিন্ন তরকারি এবং একজন মানুষের জন্য একটা থালা সাজানো ছিল। আমি সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে একা খেতে হবে।সে সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল--এই আর কি ।

 একা ভাতের থালায় বসতে যাওয়া আমার পক্ষে একটু সংকোচের ছিল। এক তারা আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল-‘ইনি আপনাকে রেখে এসে খাবে।’আমি আগেই বুঝতে পেরেছি যদিও একতারার কথায় আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। 

--এত কষ্ট করে এতগুলি--

-- কোথায় আর এত রেঁধেছি।

 একতারা ঢাকনায় দিয়ে রাখা থালাগালি থেকে একের পরে এক ঢাকনা সরাতে লাগল।

  থালাটা সামনে এনে আমি ভাতের থালাটা সাজিয়ে রাখা হাতাটা ভাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। গরম বাসমতি চালের ভাতের গন্ধটা আমার নাকের ভিতরে ঢুকে গেল। মাংস এবং একটু তরকারি ভাতের ওপরে ঢেলে দিলাম। কাজুবাদাম, কিসমিস, মগজ এবং মসলা দিয়ে রান্না পাঁঠার মাংস। গন্ধ এবং স্বাদে মনে হল আমার ক্ষুধা আরও বেড়ে গেছে। শুধু ভাত এবং মাংস নিতে দেখে একতারা পনির, বিন এবং গাজর দিয়ে রান্না করা মিক্সড ভেজ এক হাতা আমার থালার কাছে সাজিয়ে রাখল। অন্য একটি থালা থেকে বেসন গোটা সর্ষে দিয়ে রাঁধা ক্যাপসিকামের বড়া দুটিও  খালার ওপরে রাখল। একতারা পুনরায় কিছু দিতে তৈরি হতেই আমি বললাম-- এত পারব না, দেবেন না।

 ভালো করে খেলে তবে আপনার ঘুম ভালো ঘুম হবে।গিয়েই ফ্লাইটে শুয়ে পড়বেন। অসুবিধা কোথায়?

 একতারার আন্তরিকতাকে বাধা দিতে না পারার জন্য পরিমাণের চেয়েও আমাকে বেশি করে খেতে হল। আমার বাধা না মেনে পুনরায় একহাতা মাংস অবশিষ্ট ভাতের ওপরে জোর করে ঢেলে দিল। ভাতও দিতে চেয়েছিল, হাত দুটি দিয়ে থালাটা ঢেকে ধরে কোনোমতে রক্ষা। নারীর সুলভ আন্তরিকতা একতারা কে আমার সামনে একজন অতিথি পরায়ন সুগৃহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল।স্বামীর বন্ধুকে আপ্যায়ন করায় একতা্তারা কোনো ত্রুটি রাখেনি। এরকম একজন একতারা থাকার পরেও সুদীপ্ত নিঃসঙ্গ।

 একতারা এবং তার পরিচ্ছন্ন ঘর থেকে বিদায় নিতে  হওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাত্র একটা দিন অথচ এরকম মনে হলো যেন বহু দূর অতীত থেকে রক্ষা করে আসা বছর বছর ধরে রাখা  আন্তরিক সম্পর্ক। একতারা বিদায়ের সময় বারবার বলল --আবার আসবেন অনুগ্রহ করে। সম্পর্ক রক্ষা করবেন। ফিরে যাবার সময় পারলে চলে আসবেন।

 ফিরে আসার সময় আসা হবে না। আমি দুপুরবেলা কলকাতা পৌছাব আর এক ঘন্টা পরেই আমার গুয়াহাটির জন্য ফ্লাইট। তার মধ্যে সেদিন ব্যাংক খোলা থাকবে। সুদীপ্ত অসম্ভব ব্যস্ত থাকবে।

  একতারার কথায় মনে হল সম্ভবত সুদীপ্তের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে আসা আমি একমাত্র ব্যক্তি ।তাই মনের আশ মিটিয়ে একতারা নিজেই বাজার করেছে নিজেই রেঁধেছে এবং নিজেই আপ্যায়ন করেছে। মানুষের হৃদয়ে মনিকোঠায় সম্পর্ক রক্ষার জন্য আকাঙ্ক্ষা সঞ্চিত হয়ে থাকে। সেই আকাঙ্ক্ষাকে অবহেলা করলেই আমরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি আর হতাশাগ্রস্ত।

 সুভাষচন্দ্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিদেশ উড়ানের মূল প্রবেশদ্বারে নামিয়ে সুদীপ্ত চলে গেল। যাবার সময় তার দুচোখ জলে ভরে উঠল বলে মনে হল।

 -সময় পেলে আসবি। কোথায় আসবি? তোকে আবার জীবনে দেখতে পাব কিনা?

 -পাবি। কেন পাবি না। তুই তোর বাড়ি দেখালি আমি একদিন তোকে আমার সমাজটা দেখাব।

ফিরে যাওয়া সুদীপ্তের দিকে অনেকক্ষণ আমি নিরন্তর তাকিয়ে রইলাম।। সে যাবার পরে তবেই আমার বিদেশ ভ্রমণের ঔৎসুক্য শুরু হল।

 







শব্দব্রাউজ- ৯৪৬ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-946, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ- ৯৪৬ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-946, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৯৪৬ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ২৭। ৯। ২৩। সকাল সাড়ে সাতটা ।



শব্দসূত্র: পায়ে মুঠো মুঠো সর্ষে




করি ভ্রমণ

পায়ে মুঠো মুঠো সর্ষে

বাক্স প্যাঁটরা মহাকালের

হাতে দিয়ে নিশ্চিন্তে

নিঃস্ব হই ।


করি ভ্রমণ

মনে মনে ব্ল্যাক হোলে

মহাবিস্ফোবণের অপেক্ষায়

ঘুরে যাই কোটি বছর ।


আমি আমার মতোই ভ্রমণ করি ।



আটপৌরে ৬৩৩ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 633 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৬৩৩ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 633 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৬৩৩

ঋতস্য 


 পথ্যা। অনু। ঋগ্বেদ। 


মানব! 


সত্যের পথ অনুসরণ করো।

মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

শব্দব্রাউজ- ৯৪৫ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-945, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ- ৯৪৫ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-945, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৯৪৫ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ২৬। ৯। ২৩। সকাল- ৮-৫০ ।



শব্দসূত্র: ঐক্য বাক্য মাণিক্য



ঐক্যের ভেতর থেকে

ছুটে আসে

অগণিত পরিচয়

ঠিক ভুল বোঝার কৌশল ।


বাক্যের ভেতর দিয়ে

ঐকতান

জমজমাট ।


তখন মাণিক্য ঘেরা দিন

আমার সঙ্গে ।


শিখে গেছি শিখে গেছি

প্রিয় বিদ্যাসাগর ।


আটপৌরে ৬৩২ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 63২ by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৬৩২ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 63২ by Sudip Biswas






আটপৌরে ৬৩২

হবিগঞ্জ 


উৎপাদন। উপাচার্য। অবলম্বন। 


 এমাজউদ্দীন 


শরিয়তের ফাঁদ থেকে পলায়ন।

সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

শব্দব্রাউজ- ৯৪৪ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-944, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ- ৯৪৪ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-944, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৯৪৪ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ২৫। ৯। ২৩



শব্দসূত্র: শব্দপথে ছুটি




এলোমেলো শব্দের

ভেতর দিয়ে

প্রকৃত পথ খুঁজে

ছুটি আর ছুটি।


শব্দপথে ছুটি বলে

বেহিসাবি হাজারো শব্দ

রাস্তার থেকে কুড়োই ।


তাকে নিয়ে ছুটি

প্রকৃত শব্দ শেষ অবধি

আমার সঙ্গে ছুটবে

জেনে গেছি ।


আটপৌরে ৬৩১ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 631 by Sudip Biswas

 আটপৌরে ৬৩১ || সুদীপ বিশ্বাস-এর কবিতা, Atpoure 631 by Sudip Biswas






আটপৌরে ৬৩১

এতিমখানা 


হলাহল। উপাদেয়।দেয়ালা।


শিশুশ্রম 


বুনছে কুঞ্চী মহাসচিব রুহুল।

রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

শব্দব্রাউজ- ৯৪৩ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-943, Nilanjan Kumar

 শব্দব্রাউজ- ৯৪৩ ।। নীলাঞ্জন কুমার || Shabdo browse-943, Nilanjan Kumar




শব্দব্রাউজ- ৯৪৩ ।। নীলাঞ্জন কুমার

বিপাশা আবাসন তেঘরিয়ার মেন রোড কলকাতা । ২৪। ৯। ২৩। সকাল ১১টা ২৫ মিনিট ।



শব্দসূত্র: ভাঙছি । গড়ছি ।



ভুল ভাঙছি

সুখ আনছি ।


গড়ে তুলছি

ঠিক করছি ।


সব পারছি

সব ধরছি ।


করতলে ছুঁয়ে দেখছি

গড়ছি ভাঙছি গড়ছি ।


Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...