অনুবাদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অনুবাদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন-৯ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





নয়

(৯)

বেচারা রিচার্ডের বর্ষপুঞ্জী

(Poor Richards Almanac)


(Poor richards Almanac) বেঞ্জামিন  ফ্রেঙ্কলিন ইতিমধ্যে ফিলাডেলফিয়ার একজন নেতৃস্থানীয় ধনী মানুষ বলে  পরিচিতি লাভ করেছেন।

১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে  ফ্রেঙ্কলিন  তার ছাপা ছাড়া থেকে প্রতিবছর একটি বর্ষপঞ্জী প্রকাশ করতে শুরু করেন। তিনি বর্ষপঞ্জিটার নাম দেন–Poor richards Almanac–অর্থাৎ বেচারা রিচার্ডের বর্ষপঞ্জী। রিচার্জ ছিলেন একটি কাল্পনিক চরিত্র। মানুষটা ছিলেন অতি সৎ, কিন্তু অতি দরিদ্র।স্ত্রীর কাছ থেকে গালিগালাজ খেয়েই  তাঁর দিন কাটে। প্রকাশ ফ্রাঙ্কলিন প্রতিবছর প্রকাশ করা বর্ষপঞ্জিটা ছিল রিচার্ড নামে এই কাল্পনিক মানুষটির স্বীকারোক্তি।। নিজের জীবনের কথা বলার ছলে রিচার্ড নানা বিষয়ে তার মন্তব্য এবং  নীতি উপদেশ দিতেন।  সেই প্রতিটি কথা তিনি লিখেছিলেন তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। বেচারার রিচার্ডের বর্ষপঞ্জি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ফ্রেঙ্কলিনকে  প্রতিবছর বর্ষপঞ্জীটার দশ হাজার কপি প্রকাশ করতে হয়েছিল। সুদীর্ঘ 25 বছর কাল বর্ষপঞ্জীটি প্রকাশ হয়েছিল। এই বর্ষপঞ্জটি একইসঙ্গে তিনটা কাজ করেছে। প্রথমত, এটি আমেরিকার মানুষের স্বভাব চরিত্র উন্নত করা এবং জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করায় সাহায্য করেছে। দ্বিতীয়ত,বর্ষপঞ্জীটি  বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের  চেয়ারটি এবং জনপ্রিয়তা আমেরিকার চারদিকে  ছড়িয়ে দিয়েছিল। তৃতীয়তঃ, বর্ষপঞ্জী থেকে ফ্রেঙ্কলিন এত ধন উপার্জন করলেন যে তিনি সেই সময়ের আমেরিকার প্রথম সারির ধনীদের মধ্যে একজন বলে পরিচিতি লাভ করলেন।

 বেচারা রিচার্ডের  বর্ষপঞ্জীর কিছু যোজনা পাঠান্তরের পরিচিতি নিচে দেওয়া হল–

নিজের নিকটতম  প্রতিবেশীকে ভালোবাসবে, কিন্তু দুটি বাড়ির মধ্যে সীমানাটা ভেঙ্গে ফেল না।

 তোমার নিজের ভাই তোমার বন্ধু না হতে পারে, কিন্তু তোমার বন্ধু সবসময় তোমার ভাই হয়ে থাকবে।

 মানুষ মাত্রই ভুল করে; ক্ষমা করাটা স্বর্গীয় গুণ; কিন্তু একই ভুলকে বারবার করে থাকাটা শয়তানের লক্ষণ।

‘ কর্কশ’ শব্দ প্রয়োগ করে কেউ কারও বন্ধু হতে পারে না। এক গ্যালন ভিনেগারের চেয়ে  এক চামচ মধু দিলে বেশি মাছি ধরা পড়বে।

 যে মানুষ সুখ শান্তিতে বেঁচে থাকতে চায়, তিনি নিজে  সমস্ত কথা মুখ খুলে বলেন জানা সমস্ত কথা মুখ খুলে বলেন না, আর নিজে দেখা সমস্ত কথার উপরে মন্তব্য করেন না।

 একজন সহজ সরল গ্রামের মানুষ যদি উকিলের পাল্লায় পড়ে; তাহলে তার অবস্থা হয় দুটি বিড়ালের মধ্যে পড়া মাছের মতো।

পচা আপেল  একটি টুকরিতে  থাকলে  বাকি  আপেলগুলি  পচতে আরম্ভ করে।

 কোনো  মানুষ এত খারাপ হতে পারেন না যে তিনি অন্যের ভালো গুণগুলিকে শ্রদ্ধা না করে থাকতে পারেন।

 সহজ উদাহরণই হল সর্বোত্তম উপদেশ।

 নিজের বিবেক সব সময় নির্মল করে রাখবে; তাহলে তুমি অন্যকে ভয় করে চলার প্রয়োজন নেই।

যে মানুষ আদেশ পালন করতে পারে না, তিনি অন্যকে আদেশ দিতে পারেন না।

 মিথ্যা কথা আর একটি, সত্যের পা দুটি।

 সমস্ত মানুষকে খুব সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি পর্যবেক্ষণ করবে নিজেকে।

 জীবন দীর্ঘ হলেও সে ভালো জীবন নাও হতে পারে; কিন্তু ভালো জীবন সব সময় দীর্ঘ বলে প্রমাণিত হয়।

জীবন ধারণের জন্য খাবে,? খাবার জন্য জীবন ধারণ করবে না।

  যে মানুষ কারও কাছ থেকে কিছু আশা করে না , তিনিই সুখী এবং ভাগ্যবান মানুষ। তাকে জীবনে কখনও বিরাশ হতে হয় না।

 তুমি সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাও কি? যদি চাও, তাহলে যে কাজ করা উচিত, কেবল সেই কাজই করবে, যে কাজ করে খুশি হও, সেরকম কাজ করবে না।

 যদি দীর্ঘ জীবন লাভ করতে চাও, তাহলে আহারের পরিমাণ পরিমাণ কম করবে।

 পিঁপড়ার চেয়ে ভালো নীতি শিক্ষা অন্য কেউ দিতে পারে না; পিঁপড়া  কিন্তু মুখে  কিছু বলে না।

কষ্ট না করে কেউ কিছু জিনিস লাভ করতে পারে না।

দোকানটা ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে;তখন দোকানটাও তোমাকে সুখে-সন্তোষে রাখবে।

যে মানুষ পরিশ্রম করে না,সে কখনও খ্যাতিমান হতে পারে না।

আগামীকাল কিছু কাজ করার মতো আছে কি?যদি থাকে তাহলে সেই কাজ আজই করে ফেল।

একজন যুবক ব্যবসায়ীর প্রতি উপদেশ

তোমার চাহিদা অনুসারে আমি নিচে কয়েকটি সংকেত দিলাম।আমি নিজে এই কয়েকটি নীতি অনুসরণ করে জীবনে অনেক সুফল পেয়েছি।আমি আশা করি যে তুমিও আমার মতোই সুফল পাবে।

মনে রাখবে যে সময়ই হল ধন।ধরে নাও,তুমি সারাদিন কাজ করে দশ শিলিং রোজগার করতে পার।কিন্তু তুমি মাত্র অর্ধেক দিন কাজ করে দিনটির বাকি সময় শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলে।সেই সময়ে তুমি যেন আমোদ-প্রমোদের জন্য ছয় শিলিং খরচ করলে।তুমি ভাবলে যে তুমি মাত্র ছয় শিলিংই খরচ করেছ।কিন্তু আসলে খরচের তালিকায় তোমাকে আরও পাঁচ শিলিং যোগ দিতে হবে।কারণ দিনের অর্ধেক ভাগ সময় তুমি শুয়ে বসে বা রং তামাসা করে না কাটালে তুমি পাঁচ শিলিং অর্জন করতে পারতে।

 মনে রাখবে যে ধনের নিজের সংখ্যা-বৃদ্ধি করার ক্ষমতা আছে।ধন সন্তানের জন্ম দান করে;ধনের সন্তান নতুন করে সন্তানের জন্ম দান করে।এভাবে ধনের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে।পাঁচ শিলিং ভালোভাবে ব্যাবসায় বিনিয়োগ করতে জানলে তা একদিন ছয় শিলিং হবে।ছয় শিলিং অতি দ্রুত সাত শিলিং তিন পেন্স হবে।এভাবে বাড়তে বাড়তে তা একদিন গিয়ে একশো পাউণ্ড হবে।ব্যাবসায় ভালো হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে লাভও দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করবে।কেউ যদি বাচ্চা দিতে থাকা অবস্থায় একটি শূকরীকে মেরে ফেলে ,তাহলে সে ভবিষ্যতে হাজারটা পুরুষের জন্য শূকরীটির সবগুলি বংশধরকে হত্যা করে।ঠিক সেভাবে কেউ যদি একটি শিলিং নষ্ট করে তিনি আসলে সেই শিলিংটা থেকে হতে পারা শত শত পাউণ্ড নষ্ট করেন।

মনে রাখবে যে, যে মানুষ অন্যের কাছ থেকে ধন ধারে নিয়ে সেই ধার সময়মতো পরিশোধ করেন তিনি আসলে অন্যের ধনের থলেগুলির মালিক হন।যখন মানুষ দেখে একজন মানুষ অন্যের কাছ থেকে ধার নেওয়া সমস্ত টাকা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করে,অর্থাৎ তিনি নিজের শপথ রক্ষা করেন,তখন তাঁর প্রয়োজন হলেই অন্যে তাকে     ধন ধার দিতে সঙ্কোচ করে না।ব্যাবসায়ী মানুষকে এই কথাটা খুব সাহায্য করে।ব্যাবসায় উন্নতি করতে চাওয়া যে কোনো যুবকের জন্য অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতার পরেই সবচেয়ে বড়োগুণ হল আর্থিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা।সেইজন্য কারও কাছ থেকে ধন ধারে নিলে ধার পরিশোধ করা নির্দিষ্ট সম্যের চে্য়ে মাত্র একঘণ্টা সময়ও বেশি সেই ধন নিজের হাতে রাখবে না,কারণ তাহলে তুমি পুনরায় কখনও বন্ধুদের কাছ থেকে ধন ধারে পাওয়ার আশা করতে পারবে না।

তুমি যার কাছ থেকে ধন ধারে নাও তাঁর মনে তোমার সম্বন্ধে সন্দেহ বা অবিশ্বাস জন্মাতে পারা ছোটো ছোটো কথাগুলি সযত্নে পরিহার করে চলতে চেষ্টা করবে।তোমার কারখানায় যদি সকালবেলা পাঁচটার সময় বা রাত নয়টার সময় হাতুড়ির কাজ চলতে থাকে এবং তোমাকে টাকা ধার দেওয়া মানুষটি সেই হাতুড়ির শব্দ শুনতে পায়,তাহলে তিনি তোমার হাতে তার ধনটুকু আরও ছয়মাস বেশিদিনের জন্য ছেড়ে দিতে দ্বিধা করবে না।কিন্তু অন্যদিকে তুমি যে সময়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকা উচিত ছিল সেই সময়ে যদি তিনি তোমাকে তাস খেলায় মত্ত থাকতে বা মদের দোকানে দেখতে পায়,তাহলে ঠিক তার পরদিনই তিনি তোমার কাছ থেকে ধনটুকু ফিরে পাবার দাবি জানাবে।

সবসময় আয় দেখে ব্যয় করবে।তা না করলে নিজের অজান্তেই তুমি একদিন ঋণী হয়ে পড়বে এবং ধারের বোঝা ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকবে।

সেরকম যাতে না হয় তার জন্য তুমি কিছুদিনের জন্য তোমার উপার্জন এবং খরচের হিসেব লিখে রাখার হিসেব করবে।তুমি যদি একটু কষ্ট করে খরচের খুঁটিনাটিগুলি লিখে রাখ,তাহলে খুচরো খরচগুলি কীভাবে একদিন গিয়ে একটা মোটা অঙ্কে পরিণত হয় সেকথা তুমি নিজেই আবিষ্কার করবে।তখন তুমি নিজের জন্য বিশেষ অসুবিধা সৃষ্টি না করে ধন সঞ্চয় করতে শিখবে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে ধনী হওয়ার পথটা বাজারে যাওয়া পথের মতোই সোজা।এটা প্রধানত নির্ভর করে মাত্র দুটি শব্দের ওপরে।অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতা।অর্থাৎ সময় এবং ধন এই দুটির একটিরও অপচয় করবে না;বরং দুটিরই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে।অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতার অবিহনে তুমি কখনও ব্যাবসায়ে সফল হতে পারবে না।অন্যদিকে এই দুটি একত্রিত হলে তুমি ব্যাবসায় সফল না হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।যে মানুষ সৎভাবে পেতে পারা সমস্ত ধন পায় এবং পাওয়া ধনটুকু (অত্যাবশ্যকীয় খরচটা বাদ দিয়ে)সঞ্চয় করে তিনি নিশ্চয় একদিন ধনী মানুষ হবেই হবে।

যে মানুষ ভাবে যে নিজের জোরে তিনি সমস্ত কাজ করিয়ে নিতে পারেন,তাহলে সেরকম মানুষকে এই বলে সন্দেহ করার জন্য জায়গা থাকে যে তিনি প্রত্যেকটা কাজ ধনের জন্য করেন।

কুঠারের একটু একটু আঘাতে একটি বিরাট গাছ গড়িয়ে ফেলতে পারে।

তুমি যত অর্জন কর,তারচেয়ে কম খরচ করার জন্য যদি শেখ,তাহলে নিশ্চয় জানবে যে সমস্ত জিনিসকে সোনায় পরিণত করতে পারা প্রশ-পাথর তুমি পেয়ে গেছ।

তাড়াতাড়ি বিছানায় যাওয়া এবং দ্রুত উঠার অভ্যাস করবে;তখন তুমি স্বাস্থ্যবান,ধনী এবং জ্ঞানী হতে পারবে।

গাড়ির সবচেয়ে খারাপ চাকাটা সবচেয়ে বেশি শব্দ করে।

কৃ্তকার্যতা অনেক মানুষের সর্বনাশ করেছে।

নিজের জ্ঞান গোপন করতে না পারা মানুষের চেয়ে বড়ো মূর্খ অন্য কেউ নেই। 

ছোটো ছোটো দষ-ত্রুটিগুলি সময় মতো শুধরে না নিলে শেষে এটাই গিয়ে বিরাট আকার ধারণ করে।

কাঁচের বাসন,চিনা মাটির বাসন এবং মানুষের খ্যাতি অতি সহজে ভাঙে;সেইসব কখনও সম্পূর্ণভাবে জোড়া লাগে না।

যে নিজেকে সহায় করে,তাকে ঈশ্বরও সহায় করে।

ক্ষুধাই হল সবচেয়ে ভালো তরকারি।

অভিজ্ঞতার পাঠশালা অতিমাত্রায় খরচে 

কিন্তু মূর্খ তার বাইরে অন্য কিছু পাঠশালায় শিখতে পারে না।

যে মানুষের কাঁটা ছড়ানো অভ্যাস,তার কখনও খালি পায়ে হাঁটা উচিত নয়।

তিনজন মানুষের পক্ষে একটা গোপনীয় কথা গোপন করে রাখা সম্ভব-যদি সেই তিনজন মানুষের ভেতরে দুজন মানুষের ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়।

কুয়ো শুকিয়ে তলা বেরিয়ে গেলে তবেই আমরা জলের মূল্য বুঝি।

সময় হল এমন একটি মহৌষধের ,যা সমস্ত ধরনের রোগ নিরাময় করতে পারে।

কেবল জ্ঞানী এবং সাহসী মানুষ নিজের ভুলটা স্বীকার করতে পারে।

খারাপ ইস্পাত দিয়ে কখনও ভালো দা তৈরই করা যায় না।

তুমি যদি তোমার শত্রুর কোনো অপকার কর,তাহলে তুমি তোমার শত্রুর চেয়ে নিচু স্তরের মানুষ বলে পরিগণিত হবে।

তুমি যদি শত্রু তোমার করা অপকারের প্রতিশোধ নিতে চাও,তাহলে তুমি তোমার শত্রুর একই সারির মানুষ বলে গণ্য হবে।কিন্তু যদি শত্রু তোমার প্রতি করা অপকারের জন্য তুমি তাকে ক্ষমা করে দিতে পার,তাহলে প্রমাণ করা হবে যে তুমি তোমার শত্রুর চেয়ে উঁচু স্তরের মানুষ।

রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন -৮ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





আট

(৮)

বেঞ্জামিনের বহুমুখী সাধনা

বেঞ্জমিন কর্মজীবন আরম্ভ করেছিলেন মুদ্রক এবং সাংবাদিক হিসেবে।একজন সফল সাংবাদিক হওয়াটা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ছাপাখানার ব্যবসা কৃতকার্যতার মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি খবরের কাগজ আরম্ভ করলেন।। নাম দা ‘পেনসিলভেনিয়া গেজেট’।

বেঞ্জামিন এখন ফিলাডেলফিয়ার একজন বিশিষ্ট এবং সম্মানিত নাগরিক। তিনি নিজে একটি বড়ো ছাপাখানার মালিক। তাছাড়া তিনি একটি খবরের কাগজের সম্পাদক। কিন্তু বেঞ্জামিন কেবল ব্যক্তিগত কৃতকার্যতায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকার মানুষ ছিলেন না। তিনি সবসময় নিজের স্বাস্থ্য স্বভাব চরিত্র এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নত করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার সমান্তরাল ভাবে তিনি আরও একটি ব্রত গ্রহণ করেছিলেন– তিনি যে পরিবেশ এবং যে সমাজে বাস করেন সেই পরিবেশ এবং সেই সমাজের উন্নতি সাধন করার জন্য কাজ করা। নিজের উন্নতি সঙ্গে অন্যেরও উন্নতি– এই সংকল্প তিনি সারা জীবন চোখের সামনে রেখে ছিলেন এবং সেই অনুসারে কাজ করে গেছেন।

  ফিলাডেলফিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তার বিশিষ্ট এবং বিদগ্ধ বন্ধুদের নিয়ে একটি ক্লাব খুললেন। ক্লাবটির নাম দিলেন জুন্টো (Junto)।অহরহ উন্নতির কথা চিন্তা করা বেঞ্জামিনের এই ক্লাবটি খোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে ক্লাবের প্রতিটি সদস্যের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করা। ক্লাবের বৈঠক বসত প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা বেলা। ক্লাবের নিয়মাবলী তৈরি করেছিলেন বেঞ্জামিন নিজে। সেই নিয়ম অনুসারে ক্লাবের প্রতিটি সদস্যই পর্যায়ক্রমে রাজনীতি, দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে একটি বা ততোধিক প্রশ্ন উত্থাপন করবে এবং বাকি সদস্যরা সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে। তিন মাস পরে পরে ক্লাবের প্রতিটি সদস্য নিজের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো বিষয়ের উপরে একটি পাঠ করবে এবং বাকি সদস্যরা তার উপরে তর্ক করবে। কিন্তু তর্ক যুদ্ধে জয়লাভ করাটা কারও উদ্দেশ্য হবে না। তর্কের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে সত্যের সন্ধান।

যে সময়ের কথা লিখছি সেই সময় আমেরিকা স্বাধীন ছিল না বা এখনকার মতো একটি বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রও ছিল না।ব্রিটেন থেকে যাওয়া শরণার্থীরা তখন পর্যন্ত উত্তর আমেরিকায় তেরোটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।প্রতিটি উপনিবেশই ছিল ব্রিটিশ রাজ শক্তির অধীন।বেঞ্জামিন ক্লাব খুলে বন্ধুদের সঙ্গে নানা বিষয়ে তর্ক এবং আলোচনা করে থাকার সময় তেরোটি উপনিবেশে মুদ্রার অভাব জনসাধারণের জন্য জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।ক্লাবের বৈঠকে সেই বিষয়েও একদিন আলোচনা হল।সেই আলোচনার ভিত্তিতে বেঞ্জামিনের নিজের নাম না দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে বিতরণ করলেন।প্রবন্ধটিতে মাটির মূল্যের ওপর ভিত্তি করে কাগজের নোট ছাপার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।সরল ভাষায় লেখা বেঞ্জামিনের অকাট্য যুক্তিতে বিশ্বাস করে পেনসিলভেনিয়ার বিধান সভা কাগজের নোট প্রচলন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং নোট ছাপার দায়িত্বটাও দিলেন বেঞ্জামিনের ছাপাখানাকে।ফলে একই সময়ে বেঞ্জামিনের হাতে অনেক টাকা এল।যা অল্প কিছু ঋণ পরিশোধ করার জন্য বাকি ছিল সেটা পরিশোধ করে তিনি এখন একজন ধনী মানুষ হলেন।বেঞ্জামিন নিজে স্বীকার করা মতে তাঁর জীবনে উন্নতি এবং কৃ্তকার্যতা লাভ করার একটি প্রধান সম্বল ছিল তাঁর ভালো গদ্য লেখার ক্ষমতা।কাগজের নোট ছাপিয়ে ধনী হওয়াটাও তার একটি প্রমাণ বলে তিনি নিজে লিখে রেখে গেছেন।

ঠিক প্রায় এই সময়ে জনগণের জন্য একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করার চিন্তাও বেঞ্জামিনের মনে এল।এর আগে পর্যন্ত আমেরিকায় গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব ছিল না।জুন্টো ক্লাবে পাঠ করা রচনাগুলিতে প্রায় নানা ধরনের বইয়ের উল্লেখ থাকে। সেই প্রতিটি বই ক্লাবের সদস্যদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বই। বেঞ্জামিন একদিন ক্লাবের বৈঠকে প্রস্তাব করলেন যে সদস্যরা যদি তাদের বইগুলি বাড়ি থেকে এনে ক্লাবে বসার ঘরে একসঙ্গে করে রাখে, তাহলে রচনাগুলোর বিষয়ে আলোচনা করার সময় সদস্যরা প্রয়োজন হলে বই গুলির পাতা উল্টিয়ে দেখতে পারবে; তাছাড়া তারা একে অপরের বই পড়ার জন্য বাড়িতেও নিতে পারবে। বেঞ্জামিনের প্রস্তাবে জুন্টো ক্লাবের সদস্যরা সম্মত হলেন। তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বইগুলি ক্লাবে জমা দিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হল না। যত্ন নেওয়া মানুষের অভাবে বইগুলি নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। প্রায় এক বছর পরে সদস্যরা বইগুলি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। ঠিক এই সময়ে বেঞ্জামিন একটি সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করার কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন।

বেঞ্জামিনের পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তাবিত গ্রন্থাগারের জন্য প্রথমে পঞ্চাশজন সদস্য খুঁজে বের করা হল। সদস্য হওয়ার জন্য তাদের প্রত্যেককেই চল্লিশ সিলিং করে ভর্তি মাশুল দিতে হল। তাছাড়া ঠিক হল যে পঞ্চাশ বছরের জন্য তাদের বছরে দশ শিলিং করে দান করতে হবে। এই টাকা দিয়ে বই কিনে আমেরিকার সর্বপ্রথম সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করা হল। বেঞ্জামিন স্থাপন করা গ্রন্থাগার গড়ে তোলার আদর্শে পরবর্তীকালে সমগ্র আমেরিকায় এই ধরনের অসংখ্য গ্রন্থাগার (Subscription Library) স্থাপন করা হল। পরবর্তীকালে এই আদর্শ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ল।বেঞ্জামিন নিজের জীবনকালে তাঁর সৎ কর্মের সুফল দেখে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে লিখে রেখে গেছেন–’ এই গ্রন্থাগার গুলি আমেরিকানদের সাধারণ কথাবার্তা মান অনেকখানি উন্নত করল, এবং সাধারণ কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের বুদ্ধিমান করে তুলল। তাছাড়া এই গ্রন্থাগার গুলি সাধারণ মানুষকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলে সেই সমস্ত রক্ষা করার জন্য তাদেরকে প্রেরণা দান করল।’

এই গ্রন্থাগার বেঞ্জামিনের নিজের কতটা উপকার করেছে সেই কথা তিনি লিখে যেতে ভুলেন নি। বেঞ্জামিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন–’ নিয়মিত ভাবে বই পড়ে নিজের উৎকর্ষ সাধন করার জন্য এই গ্রন্থাগার আমাকে অনেকখানি সাহায্য করেছে। বাবার ইছা অনুসারে উচ্চশিক্ষা আহরণ করতে না পারার ফলে আমার যে ক্ষতি হয়েছিল সেই ক্ষতি আমি অনেক পরিমাণে পূরণ করতে পেরেছি এই গ্রন্থাগারের সাহায্যে। আমি প্রতিদিন একঘণ্টা বা দুইঘন্টা সময় আলাদাভাবে রেখেছিলাম। বই পড়াটাই ছিল আমার একমাত্র আমোদ প্রমোদ। তাস খেলে বা মজা করে আমি একটি মুহূর্তও নষ্ট করিনি।’

 সবসময় আত্মোৎকর্ষের সাধনা করা বেঞ্জামিন ঠিক এই সময় নিজের নৈতিক উৎকর্ষের জন্য আরও একটি অভিনব পরিকল্পনা হাতে নিলেন। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি নিচে উল্লেখ করা বারোটি বিশেষ গুণ আয়ত্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং সেই গুণগুলি একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করে নিলেন।–

১) মিতাচার –শরীর ভারী হওয়ার মতো খাবার না খাওয়া, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হওয়ার মতো মদ্যপান না করা।

২) নীরবতা– যে কথা বললে তোমার নিজের বা অন্যের কোনো উপকার হয় না, সেরকম কথা বলবে না, তুচ্ছ অর্থহীন কথা বলে সময় নষ্ট করবে না।

৩) পরিপাটিতা – যে জিনিস যেখানে রাখা উচিত ঠিক সেখানে রাখবে, যে কাজ যখন করা উচিত ঠিক তখনই করবে।

৪) সংকল্প– যে কাজ উচিত সেরকম কাজ করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করবে; যে কাজ করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করবে, সেই কাজ কখনও না করে থাকবে না।

৫) মিতব্যয়িতা– নিজের বা অন্যের উপকারে না আসা কোনো কাজে টাকা পয়সা খরচ করবে না, কোনো ধরনের অপচয় করবে না।

৬) অধ্যবসায়– সময় নষ্ট করবে না; সব সময় কিছু না কিছু একটা কাজে লেগে থাকবে; অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম সমূলে বাদ দেবে।

৭) আন্তরিকতা– অন্যের অপকার করতে পারা কোনো ধরনের ছলনা বা প্রতারণার আশ্রয় নেবে না, সৎ ভাবে চিন্তা করবে; কথাও বলবে সৎভাবে চিন্তা করা অনুসারে।

৮) ন্যায়পরায়ণতা– অন্যে আঘাত পেতে পারে সেরকম কোনো কাজ করে অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ করবে না; ঠিক সেভাবে অন্যের উপকার করাটা যদি তোমার কর্তব্য, সেটাও না করে থাকবে না।

৯) আত্ম-সংযম– সমস্ত কথায় আতিশয্য পরিহার করে চলবে; প্রাপ্য শাস্তি বা আঘাত পেলে তার জন্য ক্রোধ বা অসন্তোষ প্রকাশ করবে না।

১০) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা– নিজের শরীর, পরা কাপড়-চোপড়, বিছানা পত্র এবং বাসস্থান সমস্ত সময়ে নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করে রাখবে।

১১) মানসিক প্রশান্তি– ছোটো ছোটো কথায় বিরক্ত হবে না; সচরাচর হয়ে থাকা বা এড়াতে না পারা বিপদ-আপদে বিচলিত হয়ে মনের শান্তি হারাবে না।

১২) নম্রতা– যিশুখ্রিষ্ট এবং সক্রেটিসের আদর্শ অনুসরণ করে চলবে।

অনুশীলন করার জন্য বারোটি গুণের তালিকা করে নেবার পরে বেঞ্জামিন প্রতিটি গুণের অনুশীলন করার জন্য এক একটি সপ্তাহ উৎসর্গ করা ঠিক করলেন। অর্থাৎ সম্পূর্ণ একটি সপ্তাহ তিনি একটি মাত্র গুণের অনুসরণ করায় নিয়োগ করার কথা ভাবলেন। প্রথম সপ্তাহের জন্য তিনি বেছে নিলেন মিতাচার। প্রথম সপ্তাহের জন্য মিতাচার বেছে নেওয়ার কারণ এই যে, বেঞ্জামিনের মতে পান ভোজনের ক্ষেত্রে সংযম রক্ষা করে চললে মানুষের মগজ শীতল এবং পরিষ্কার হয়ে থাকে। মগজের এরকম অবস্থায় সমস্ত কথা ভালোভাবে চিন্তা করে শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।

 এক সপ্তাহ মিতাচারের অনুশীলন করে বেঞ্জামিন দ্বিতীয় সপ্তাহের জন্য বেছে নিলেন নীরবতার অনুশীলনী। যে মানুষ মুখে কম কথা বলে, কিন্তু কান সবসময় খোলা রাখে, সেই মানুষ অন্যের কথা শুনে বেশি করে জ্ঞান আহরণ করতে পারে। অন্যদিকে যে মানুষের অনবরত কথা বলে থাকার অভ্যাস, সে অন্যের কাছ থেকে কোনো কথাই শিখতে পারেনা। সেই জন্যই বেঞ্জামিন নীরবতা তথা কম কথা বলার উপরে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন এবং তার গুণের তালিকায় তাকে দ্বিতীয় স্থান দিয়েছিলেন।

 তৃতীয় সপ্তাহে অনুশীলন করার জন্য তিনি বেছে নিলেন পরিপাটিতা। যে মানুষের সমস্ত জিনিস পরিপাটি করে রাখার এবং সমস্ত কাজ পরিপাটি করে করার অভ্যাস, তিনি কাজ করার জন্য এবং পড়াশোনা করার জন্য বেশি সময় বের করে নিতে পারেন।

 চতুর্থ সপ্তাহে তিনি অনুশীলন করতে শুরু করলেন সংকল্পের। এর অর্থ এটাই যে, সেই সপ্তাহের প্রতিটি দিনে তিনি যে যে কাজ করার জন্য সংকল্প নিয়েছিলেন, সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত তিনি কখনও ক্ষান্ত হতেন না।সংকল্পের দৃঢ়তা তার তালিকাটিতে থাকা বাকি গুলগুলি সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করার জন্য তার মনে সাহস জুগিয়ে ছিল।

 মিতব্যয়িতা এবং অধ্যবসায়ের অনুশীলন তাকে সমস্ত ধারের বোঝা থেকে মুক্ত করে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল এবং স্বাধীন করে তুলেছিল। তার ফলেই বাকি দুটি গুণ, আন্তরিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতার অনুশীলন করাটা তার পক্ষে বেশি সহজ হয়েছিল।

 অবিরাম সাধনার দ্বারা নিজের স্বভাব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করার জন্য চেষ্টা করা মানুষ বেঞ্জামিন ছাড়াও অন্য অনেকে নিশ্চয় আছে। কিন্তু তার মতো পরিকল্পিত এবং প্রণালীবদ্ধ ভাবে এই কাজ করার উদাহরণ বড়ো বেশি নেই। নিজের চরিত্র গঠনের জন্য বেঞ্জামিন উদ্ভাবন করা এই পদ্ধতি পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা দান করেছে।


রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





সাত

(৭)

 

বেঞ্জামিনের ফিলাডেলফিয়ায় আসার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল উইলিয়াম ব্রেডফোর্ডের ছাপাশালায় চাকরির খোঁজে। কিন্তু বেঞ্জামিন এন্ট্রু বেটফোর্ডকে তার ছাপাশালায় সাক্ষাৎ করে জানতে পারলেন যে তার ছাপাশালাতে সেই সময় কোনো পদ খালি ছিল না। অবশ্য তিনি বেঞ্জামিনকে সম্পূর্ণ নিরাশ করলেন না। তিনি বেঞ্জামিনকে খবর দিলেন যে কাছেই কেইমার নামের একজন ভদ্রলোকের একটি ছাপাশালা আছে। বেঞ্জামিন সেখানে চাকরির জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যদি সেখানেও তিনি চাকরি না পান, তাহলে অন্য কোথাও চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বেঞ্জামিন তাঁর সঙ্গে থেকে ছাপাখানার ছোটোখাটো কাজগুলি করে তাকে সাহায্য করতে পারবেন।

কিন্তু বেঞ্জামিনের ভাগ্য ভালো যে কেইমারের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেঞ্জামিনকে নিজের ছাপাশালায় নিযুক্তি দিলেন। 

সেই সময়ে পেনসিলভিনিয়ার গভর্নর ছিলেন স্যার উইলিয়াম কীথ।(ফিলাডেলফিয়া পেনসিলভিনিয়া রাজ্যের একটি প্রধান শহর)। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তার কানে গিয়ে পৌঁছালো যে বেঞ্জামিন নামের একজন যুবক পায়ে হেঁটে নিউইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়ায় এসেছে।যুবকটিকে দেখার জন্য তিনি নিজে একদিন কেইমারের ছাপাশালায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। বেঞ্জামিনের সরস এবং বুদ্ধি-দীপ্ত কথাবার্তা গভর্নর কে খুব মুগ্ধ করল। তিনি বেঞ্জামিনকে নিজের একটি ছাপাশালা  স্থাপন করার জন্য উপদেশ দিলেন। তার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য দেওয়ার জন্যও তিনি প্রস্তুত ছিলেন ।কিন্তু ছাপাশালা স্থাপন করার আগে একবার লন্ডন যাবার জন্য তিনি বেঞ্জামিনকে পরামর্শ দিলেন।লন্ডনে তিনি ছাপাশালার নতুন যন্ত্রপাতি কিনতে পারবেন এবং পুস্তক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন।

কিন্তু স্যার উইলিয়াম কীথ প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় যতটা উদার ছিলেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার প্রতি তাঁর আগ্রহ বা মনোযোগ ততটা ছিল না। তিনি বেঞ্জামিনকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি লন্ডনের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেঞ্জামিনের পরিচয় জানিয়ে  একটা চিঠি লিখে দেবেন।এবং বেঞ্জামিন চিঠি গুলি সঙ্গে নিয়ে যাবে।গভর্নরের কয়েকজন বন্ধু ছাপাশালার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বেঞ্জামিনকে কিছু টাকা ধরে দেবেন। কিন্তু গভর্নর নিজের কথামতো কাজ না করায় বেঞ্জামিনকে কোনো পরিচয়পত্র ছাড়াই লন্ডনে যেতে হল। উচ্চ পদে থাকা মানুষ কথা দিয়ে কথা না রাখার এই ধরনের আরও কয়েকটি তিক্ত অভিজ্ঞতা পরবর্তী কয়েক বছরে হল। ফলে তিনি উচ্চ পদে থাকা ক্ষমতাশালী মানুষের ছলনা ভরা কথায় বিশ্বাস করলেন না। 

১৭২৪ সনের ২৪ ডিসেম্বর বেঞ্জামিন লন্ডনে উপস্থিত হলেন। তখন তার হাতে ধন ছিল মাত্র বারো পাউন্ড। এত কম টাকায় ছাপাশালার যন্ত্রপাতি কেনার আশা বাদ দিয়ে বেঞ্জামিন চাকরি খুঁজতে লাগলেন।তাকে বেশি দিন বেকার হয়ে থাকতে হল না। লন্ডনের বার্থলোমিও ক্লজ নামের একটি জায়গায় সেমুয়েল পামার নামের একজন মানুষের একটি বড়োসড়ো এবং বিখ্যাত ছাপাশালা ছিল। নিজের যোগ্যতা বলে বেঞ্জামিন সেখানে চাকরি পেলেন। বেঞ্জামিন অতিশয় পরিশ্রমী ছিলেন। ছাপাশালায় কাজ করে তিনি যথেষ্ট টাকা পয়সা রোজগার করেছিলেন। ছাপাশলায় কাজ করে তিনি যথেষ্ট ধন রোজগার করেছিলেন। কিন্তু প্রথম অবস্থায় তিনি সঞ্চয়ের দিকে মন না দিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত নাট্যশালা গুলিতে নাট্যাভিনয় দেখে এবং অন্যান্য আমোদ প্রমোদে উপার্জনের বেশিরভাগ টাকা খরচ করতেন। সেটাও ছিল তাঁর আত্ম-শিক্ষার একটি অংশ।

কিন্তু বেঞ্জামিন তাঁর অবসর সময়টুকু কেবল নাট্যাভিনয় দেখার জন্যই খরচ করতেন না। বেঞ্জামিন লন্ডনের যে বাড়িটাতে ছিলেন, সেই বাড়িটার প্রায় গায়ে লেগে থাকা একটি বইয়ের দোকান ছিল। দোকানটিতে অনেক পুরোনো বইপত্র ছিল। বেঞ্জামিন সামান্য দক্ষিণার বিনিময়ে সেই বইগুলি পড়ার জন্য দোকানের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করলেন। এভাবে তিনি দোকানটার বেশিরভাগ বই পড়ে শেষ করে নিজের জ্ঞানের ভান্ডার আগের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে তুললেন। 

সেমুয়েল পামারের ছাপাশালায় প্রায় এক বছর কাজ করার পরে বেঞ্জামিন জেমস ওয়ার্ড নামের অন্য একজন মানুষের ছাপাশলায় কাজ পেলেন। এই ছাপার শালাটা পামারের ছাপা শালার চেয়ে  অনেক বড়ো ছিল। পামারের ছাপা শালায় বেঞ্জামিন প্রধানত কম্পোজিঙের কাজ করতেন। পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য তারা প্রচুর পরিমাণে বিয়ার নামের এক ধরনের লঘু সূরা জাতীয় পানীয় পান করতেন। কিন্তু বেঞ্জামিন দিনরাত এই ধরনের সঙ্গে বসবাস করেও কেবল বিশুদ্ধ খাওয়ার জল ছাড়া কোনো কিছু খেতেন না। বিয়ার খাওয়া ইংরাজকর্মীরা বেঞ্জামিনকে’জল পান করা আমেরিকান’বলে ক্ষ্যাপাতেন; কিন্তু তারা একটা কথা দেখে আশ্চর্য হয়েছিল যে জল খাওয়া আমেরিকান ঠিক তাদের চেয়ে শারীরিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। ছাপাশালার টাইপের ভারী পাচিগুলি সিঁড়িবে অনায়াসে নিচ থেকে উপরে নিয়ে যেতে হলে ইংরেজ কর্মীরা দুটি হাতে একটি মাত্র পাঁচই ভার নিয়ে যেত, কিন্তু বেঞ্জামিন দুটো হচ্ছে দুটো নিয়ে যেত।

বেঞ্জামিন ইংল্যান্ডে আসার সময় জাহাজে টমাস ডেনহাম নামের একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়েছিল। ডেনহাম একদিন বেঞ্জামিনের কাছে এসে প্রস্তাব দিল যে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে গিয়ে সেখানে গ্রাহকের প্রয়োজনীয় সমস্ত সামগ্রী এক জায়গায় পাওয়ার মতো করে একটি বড়ো দোকান খুলতে চান এবং বেঞ্জামিনকে তিনি সেই দোকানের হিসেব রক্ষকের দায়িত্ব দিতে চান। বেঞ্জামিন প্রস্তাবটিতে সম্মত হলেন। ১৭২৬ সনের জুলাই মাসে তাঁরা লন্ডন ত্যাগ করে ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 

লন্ডনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশে অনেকখানি সাহায্য করল কেবল একটি কথায় তার মনে কিছুটা অতৃপ্তি থেকে গেল। বেঞ্জামিন লন্ডনে থাকার সময় বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার নিউটন জীবিত ছিলেন। তাকে একবার সশরীরে দেখার জন্য বেঞ্জামিনের খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল না।

ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে এসে টমাস ডেনহাম তার প্রস্তাবিত দোকানটি আরম্ভ করলেন এবং আগের প্রতিশ্রুতি মতো তিনি বেঞ্জামিনকে হিসেবে রক্ষকের চাকরি দিলেন। কিন্তু দোকান খোলার কয়েক মাস পরে ডেনহামের হঠাৎ একদিন মৃত্যু হল। বেঞ্জামিন পুনরায় তার পূর্বের নিয়োগকর্তা কেইমারের ছাপাশালায় চাকরি নিতে বাধ্য হলেন। ১৭৩০ সনের পহেলা সেপ্টেম্বর তিনি দেবরারীভ নামের একজন মহিলাকে বিয়ে করে সংসার জীবনে প্রবেশ করলেন। 

কেইমারের ছাপাশালায় একজন অধীনস্থ কর্মচারী হিসেবে বেঞ্জামিনকে বেশি দিন কাজ করতে হল না। নিজের একটি ছাপা সাদা স্থাপন করার সংকল্প তিনি মনে মনে বহুদিন ধরে পোষণ করে আসছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে লন্ডন ছাড়ার আগেই তিনি ছাপাশ খেলার নতুন টাইপ কেনার ব্যবস্থা করে এসেছিলেন। কেইমারের ছাপাশালায় কিছুদিন কাজ করার পরে লন্ডন থেকে নতুন টাইপ গুলি এসে গেল। ব্যন জামিন বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে নিজের ছাপাশালা আরম্ভ করলেন।

১২ বছর বয়সে ছাপাশালার শিক্ষানবিশ হিসেবে জীবন আরম্ভ করা পরিশ্রমী এবং অধ্যবসায়ী বেঞ্জামিন ছাপাশালার যাবতীয় বিদ্যা অতি নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। কেইমারের ছাপাশালায় যাবতীয় বিদ্যা অতি নিখুঁতভাবে আয়ত্ব করেছিলেন। তাছাড়া কেইমারের ছাপাশালায় কাজ করার সময় শহরের প্রতিটি গণ্যমান্য ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। বেঞ্জামিন নিজেই আত্মজীবনীতে লিখে রেখে গেছেন যে ছাপাশালার মালিক কেইমারের তুলনায় তার অধ্যয়নের পরিধি ছিল বিশাল; ফলে মানুষ ছাপাশালার মালিকের চেয়ে তার সঙ্গে কথা বলে বেশি খুশি হতেন। বিভিন্ন কাজে ছাপাশালায় আসা মানুষেরা বেঞ্জামিনের সরস বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে উপযাচক হয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন। তাঁরা বেঞ্জামিনকে নিজের বাড়িতে আহার করার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন এবং অন্যান্য বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই কেইমারের ছাপাশালায় অধীনস্থ কর্মচারী হয়ে থাকার সময়েই ফিলাডেলফিয়ায় বেঞ্জামিনের গুণমুগ্ধ একটি বড়ো বন্ধু চক্র গড়ে উঠেছিল। ফলে তিনি নিজে যখন ছাপা শালার ব্যবসা আরম্ভ করলেন, তখন অতি কম সময়ের ভেতরে তার ব্যাবসায় দ্রুত উন্নতি হতে লাগল।

বেঞ্জামিনের স্বভাবের অন্য কিছু গুণাবলিও কর্মজীবনে কৃতকার্য হওয়ায় তাকে সাহায্য করেছিল। প্রচলিত অর্থে বেঞ্জামিনকে ধর্মভিরু মানুষ বলে বলা যায় না, কারণ ধর্মীয় আচরণ অনুষ্ঠান যান্ত্রিকভাবে পালন করার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে কিছু নীতি এবং আদর্শ মেনে চলার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দান করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত হওয়া উচিত  সত্য ,আন্তরিকতা এবং ন্যায় পরায়ণতা। এই কয়েকটি কথার উপরে তিনি এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে তিনি একটি সংকল্পের রূপে কথাগুলি একটি কাগজে লিখে নিয়েছিলেন এবং দৈনন্দিন জীবনে সেই সংকল্প নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। সেই কাগজটি মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তার ডায়েরিতে ছিল।

শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ৬ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





ছয়

সাংবোস্টন থেকে ফিলাডেলফিয়ায়

(৬)

 বেঞ্জামিন যদিও জেমসের নিজের ভাই ছিল তথাপি জেমস ভাইয়ের সঙ্গে নিজের অধীনস্থ কর্মচারীর মতো ব্যবহার করতেন। ছাপাখানার মালিক হিসেবে তিনি অন্যান্য কর্মচারীদের কাছ থেকে যতটুকু কাজ এবং যে ধরনের বাধ্যতা দাবি করতেন ঠিক ততটাই তিনি দাবি করেছিলেন নিজের ভাইয়ের কাছ থেকেও। বেঞ্জামিন এই কথাটা মোটেই পছন্দ করেন নি। জেমস তাকে করতে দেওয়া কতগুলি কাজ তিনি অতিশয় অপমানজনক বলে মনে করেছিলেন।ফলে দাদা-ভাই দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটির সৃষ্টি হত। জেমস কিছুটা রাগী প্রকৃতির লোক ছিলেন।মাঝে মাঝে তিনি ভাইকে মারধরও করতেন।পরিস্থিতি ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠায় বেঞ্জামিন ছাপাখানার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু সেটা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ একুশ বছর না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাদার ছাপাখানায় চাকরি করতে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন।

 কিন্তু ঘটনাক্রমে বেঞ্জামিনের মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার একটা সুযোগ এসে গেল।The New England Courant এর কোনো একটি সংখ্যায় বোস্টনের বিধান পরিষদকে সমালোচনা করে লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। কাগজটির সম্পাদক জেমস প্রবন্ধ লেখকটির নাম প্রকাশ করতে রাজি না হওয়ায় তাকে বিধানসভার অধ্যক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী এক মাসের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হল। জেমসের অনুপস্থিতে বেঞ্জামিনকেই অস্থায়ীভাবে কাগজটি চালাতে হল। বেঞ্জামিন দাদার নানা কথায় অসন্তুষ্ট ছিল যদিও বোস্টনের শাসকরা খবরের কাগজের একজন সম্পাদককে এভাবে নিগ্রহ করা কার্যকেও সমর্থন করতে পারেননি। সেই জন্য কাগজটির সম্পাদনা করার অস্থায়ী দায়িত্ব গ্রহণ করেই বেঞ্জামিন শাসকদের আক্রমণ করে লেখা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে লাগলেন। এর আগেও তিনি শ্রীমতি সাইলেন্স ডগ উডের ছদ্মনামে শাসকদের স্বৈরাচার এবং আতিশয্যের সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

 এক মাস পরে জেমস জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন; কিন্তু বিধানসভা এই বলে হুকুম জারি করল যে জেমস ফ্রাঙ্কলিন The New England Courant নামের খবরের কাগজটা প্রকাশ করতে পারবেন না। এইরকম পরিস্থিতিতে কাগজটি বেঞ্জামিনের নামে প্রকাশ করা ছাড়া জেমসের অন্য কোনো উপায় ছিল না। এই উদ্দেশ্যে জেমস এবং বেঞ্জামিনের মধ্যে থাকা চুক্তিপত্রটি নতুন করে করতে হল, কারণ পুরনো চুক্তি-পত্র মতে বেঞ্জামিন একজন মাত্র শিক্ষানবিশ ছিলেন আর জেমস ছিলেন প্রকাশক। নতুন করে কোনো অভিযোগে যদি কাগজটি পুনরায় বিচারের সম্মুখীন হতে হয় এবং খানা তল্লাশির ফলে পুরোনো চুক্তিপত্রটা বিচারকের হাতে পড়ে, তাহলে বিধান সভার আদেশ উপেক্ষা করে জেমসই কাগজটির প্রকাশক হয়ে থাকা বলে প্রমাণিত হবে।

 বেঞ্জামিন কাগজটির প্রকাশক তথা স্বত্বাধিকারী হল সত্যি, কিন্তু তখনও দাদা তার ওপরে খবরদারি চালাতে ছাড়ল না। দুজনের মধ্যেই আগের মতো ঝগড়াঝাটি চড় থাপ্পড় চলতে থাকল। কিন্তু এখন যেহেতু বেঞ্জামিন কাগজটির মালিক, অন্তত নামে, সেই জন্য তিনি আগের মতো দাদার শাসন মেনে চলল না। ফলে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য বেড়ে চলল। অবশ্য এখানে বেঞ্জামিনের মহত্ত্ব যে দাদার সঙ্গে চলতে থাকা এই মনমালিন্যের জন্য তিনি কেবল দাদাকে দোষ দেননি। সব সময় আত্ম-সমালোচনা করে নিজের স্বভাব চরিত্র উন্নত করতে বেঞ্জামিন নিজেও আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন যে দাদা তার ওপরে সব সময় ক্রুদ্ধ হয়ে থাকার জন্য তিনি নিজের স্বভাবকেও কিছু পরিমাণে দায়ী করেছেন।

 সে যাই হোক না কেন, বেঞ্জামিনের প্রতি দাদার দুর্ব্যবহার ক্রমশ এতটা বেড়ে চলল যে তা অবশেষে সহ্যের অতীত হল। তিনি ছাপাখানার চাকরি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। জেমস যখন জানতে পারল যে ভাই তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার জন্য মনস্থির করে নিয়েছে তখন তিনি বোস্টনের ছাপাখানার মালিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেঞ্জামিনকে তাদের ছাপাখানায় চাকরি না দিতে অনুরোধ করলেন। বেঞ্জামিন তখন বুঝতে পারল যে বোস্টন ত্যাগ করে ভাগ্যের অন্বেষণে অন্য কোনো শহরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই।

 তিনি নিউইয়র্কে যাবার কথা ভাবলেন। নিজের বইয়ের সংগ্রহ থেকে কিছু বই বিক্রি করে জাহাজের ভাড়ার জন্য টাকা যোগাড় করলেন। তারপরে তিনি একদিন নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তখন তার বয়স সতেরো বছর। ইতিমধ্যে তিনি ছাপাখানা পরিচালনার বিদ্যা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছেন। সেই কম বয়সে তিনি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশি বই পড়ে ফেলেছেন। তাই ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি যখন বাড়ি ছেড়ে বের হলেন, তখন তার একমাত্র মূলধন ছিল গভীর আত্ম-বিশ্বাস।

 সমুদ্রপথে বোস্টন থেকে নিউইয়র্কের দূরত্ব প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার। তিন দিনে সেই পথ অতিক্রম করে বেঞ্জামিন যখন নিউইয়র্কে পা রাখলেন, তখন তার পকেট প্রায় খালি; অন্যদিকে কারও কাছ থেকে সাহায্য বা আশ্রয় চাওয়ার মতো পরিচিত কেউ নিউইয়র্কে ছিল না।

 যেহেতু বেঞ্জামিন একমাত্র ছাপাখানার কাজই ভালোভাবে জানেন, সেই জন্য তিনি নিউইয়র্কে একটা ছাপাখানা খুঁজে বের করলেন। ছাপাখানাটার মালিকের নাম উইলিয়াম ব্রেডফোর্ড। ব্রেডফোর্ডের ছাপাখানায় তখন কোনো পদ খালি ছিল না। কিন্তু তিনি বেঞ্জামিনকে চাকরি দিতে না পারলেও একটা আশার খবর জানালেন। নিউইয়র্ক থেকে একশো ষাট কিলোমিটার দূরে ফিলাডেলফিয়া শহরে ব্রেডফোর্ডের এক ছেলে থাকে। সে একটি ছাপাখানার মালিক। কিন্তু তার প্রধান সহকারীর কিছুদিন আগে মৃত্যু হয়েছে। বেঞ্জামিনকে ব্রেডফোর্ড বললেন যে তিনি যদি ফিলাডেলফিয়ায় যান, তাহলে ব্রেডফোর্ডের ছেলের ছাপাখানায় তিনি একটা চাকরি পেলেও পেতে পারেন।

 বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়ায় নৌকায় যাবেন বলে স্থির করলেন। কিন্তু তার এবারের ভ্রমন ছিল অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ। প্রচন্ড তুফান তার নৌকাটিকে পথচ্যুত করে লং আইল্যান্ডের দিকে ঠেলে দিল। লং আইল্যান্ডের কাছে গিয়ে তিনি দেখলেন–শিলাময় উঁচু খাড়াইতে সাগরের ফেনিল ঢেউ গুলি আছড়ে পড়ছে; সেখানে নৌকা ভিড়ানোর কোনো উপায় নেই। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা নৌকায় বসে রইল। নৌকার ছইয়ের অসংখ্য ফুটো দিয়ে বৃষ্টি পড়ে তাদেরকে কাক ভেজা করে তুলল। ক্ষুধা- তৃষ্ণা তাদেরকে আধ-মরা করে ফেলল, কারণ প্রায় ত্রিশ ঘন্টা তাদের পেটে একটা দানাও পড়েনি। বিকেলের দিকে বেঞ্জামিনের তীব্র কম্পণের সঙ্গে জ্বর এল।

 রাতের দিকে জ্বর কিছুটা কমল। অন্য একটি পথ দিয়ে নৌকা পারে লাগিয়ে বেঞ্জামিন সেখান থেকে আশি কিলোমিটার দূরের বার্লিংটন নামের শহরে পায়ে হেঁটে যাত্রা করলেন।বার্লিংটন থেকে ফিলাডেলফিয়া নৌকায় যাওয়া যায় বলে তিনি জানতে পেরেছিলেন।

 বার্লিংটন যাওয়া পথটাও খুব একটা সুখের ছিল না। সারাদিন আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল।ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে বেঞ্জামিন আধমরা হয়ে পড়েছিলেন।তার চেহারা এরকম হয়েছিল যে লোকেরা তাকে কারও বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা চাকর বলে সন্দেহ করেছিল। এভাবে অশেষ দুঃখ কষ্ট সহ্য করে তিনি একদিন বারলিংটনে পৌছালেন এবং সেখান থেকে ফিলাডেলফিয়া যাওয়া নৌকায় উঠে তিনি অবশেষে তার গন্তব্যস্থল অর্থাৎ ফিলাডেলফিয়ায় পা রাখলেন।

 ক্ষুধায় আধমরা হয়ে এবং হাতে একটিও কড়ি না থাকা অবস্থায় ফিলাডেলফিয়ায় এসে উপস্থিত হওয়ার দিন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে সেই দরিদ্র এবং অজ্ঞাত কুলশীল ভাগ্যান্বেষী যুবক শহরে প্রথম পা দেওয়ার ঘটনাটিকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য ভবিষ্যতে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তার বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হবে?


শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৪

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudeb Das

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





চার

বেঞ্জামিনের আত্মশিক্ষার শুরু

 স্কুল ছাড়ার পরে প্রায় দুই বছর বেঞ্জামিন তাঁর পিতার ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

  বেশিরভাগ দুঃখী ছেলে-মেয়ে স্কুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি হওয়া বলে মনে করে। কিন্তু বেঞ্জামিনের ক্ষেত্রে হল ঠিক উল্টোটা। স্কুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হল তার আত্মশিক্ষার সাধনা— যা অব্যাহত ভাবে চলতে থাকল তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজে লিখে গেছেন—’শৈশব থেকেই বই পড়তে আমি খুব ভালোবাসতাম। হাতে কিছু টাকা এলে আমি সেই টাকা অন্য কোনো কাজে খরচ না করে কেবল বই কিনতাম। বুনিয়ানের Pilgrims Progress নামের বইটি পড়ে খুশি হয়ে আমি তার অন্য বই গুলোও কিনেছিলাম। সেই বইগুলি ছিল আমার বইয়ের প্রথম সংগ্রহ। পরে সেই বইগুলি বিক্রি করে সেখান থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে আমি আর বার্টনের ইতিহাস রচনার সংকলন গুলি কিনেছিলাম।বইগুলির আকার ছোটো ছিল এবং দামও বেশি ছিল না।আমার বাবার ছোটো গ্রন্থাগারটিতে থাকা বইগুলির বেশিরভাগ ছিল ধর্ম সম্পর্কে বাদানুবাদের বই। বই গুলির বেশিরভাগই আমি পড়েছিলাম যদিও মনে এই বলে একটা আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল যে সময় আমার জ্ঞানের তৃষ্ণা ছিল অতি প্রবল, সেই সময়ে সেইরকম তৃষ্ণা পূরণ করার জন্য বই পড়তে পেলে আমার নিশ্চয় বেশি উপকার হত ।আমি যেহেতু ধর্মযাজক হওয়ার সংকল্প বাদ দিয়েছিলাম সেই জন্য ধর্ম সম্পর্কিত বই পড়া থেকে আমার বিশেষ কোনো লাভ হল না। বাবার গ্রন্থাগারে প্লুটার্কের Lives বইটা ছিল। সেটা আমি উল্টেপাল্টে পড়েছিলাম আমি এখনও ভাবি যে সেই বইটি পড়ার পেছনে যে সময়টুকু খরচ করেছিলাম তা সম্পূর্ণ সার্থক হয়েছিল।গ্রন্থাগারটিতে ডিফোর Essays on Projects এবং ডক্টর মেথারের Essays to do Good নামের অন্য দুটি বই ছিল। আমার জীবনে ভবিষ্যতে ঘটতে চলা কয়েকটি প্রধান ঘটনার ওপরে সেই বই দুটির প্রভাব পড়েছে বলে আমার মনে হয়।’

 পিতার ছোটো গ্রন্থাগারটির বইপত্র পড়ে শেষ করার পরে অন্যান্য জায়গায় বইয়ের খোঁজ করতে লাগলাম। পিতা প্রথমে তাকে ধর্মযাজক করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু বইয়ের প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে তিনি অবশেষে প্রিন্টার তথা মুদ্রক করার জন্য ঠিক করলেন।আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে একটি নতুন সভ্যতার শুরু করা ইংরেজদের মধ্যে সেই সময়ে ছাপাশালা একটি অতি জনপ্রিয় ব্যাবসা ছিল। জোসিয়া ফ্রাঙ্কলিনের অন্য একজন ছেলে জেমস ইংল্যান্ডের মুদ্রণ বিদ্যা শিখে স্বদেশে ফিরে এসে বোস্টনে একটি ছাপাশালা আরম্ভ করেছিলেন এবং সেখান থেকেই তিনি একটি খবরের কাগজ বের করেছিলেন। পিতার নির্দেশ অনুসারে বেঞ্জামিন শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিলেন। তখন তার বয়স মাত্র বারো বছর।

  জেমসের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল যে একুশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাদার ছাপাশালায় শিক্ষানবিশ হয়ে থাকবেন এবং সেই সময় তিনি বেতনের পরিবর্তে কেবল দৈনিক হাজিরা পাবেন। সে যে কাজে হাত দেয় সেই কাজটির সমস্ত কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝে নিয়ে তাকে নিখুঁতভাবে করাটা ছিল তার স্বভাব। ছাপাখানার কাজও তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে শিখতে লাগলেন। অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে তিনি সেই কাজে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে উঠলেন।

 কিন্তু ছাপাখানার কাজে যোগ দিয়ে তিনি বইয়ের কথা ভুলে যাননি।বরং বই খোঁজার কাজ আগের চেয়ে সহজ হয়ে উঠল, কারণ বই ব্যাবসায়ীর সঙ্গে ছাপা শালার ওতপ্রোত সম্পর্ক। ছাপাশালার কাজের মধ্য দিয়েই বইয়ের দোকানে কাজ করা একজন কর্মচারীর সঙ্গে বেঞ্জমিনের পরিচয় হল। কিন্তু যেহেতু দোকানে বিক্রির জন্য রাখা বই দিনের বেলা বের করে দেওয়া যায় না, সেই জন্য বেঞ্জামিন সন্ধ্যাবেলা বই দোকান থেকে ধার করে আনে এবং রাতে ঘুমের ক্ষতি করে হলেও বইটি পড়ে শেষ করে। সকালবেলা সে বইটি ফিরিয়ে দেয়। বইটি যাতে কোনো ভাবে নষ্ট না হয় বা ধুলোবালি লেগে নোংরা না হয় সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি থাকে।

 যে মানুষ নিজেকে সাহায্য করে তাকে ভাগ্যও সাহায্য করে। ম্যাথিউ আদমস নামের একজন স্থানীয় ব্যাবসায়ী প্রায়ই বেঞ্জামিনের ছাপাখানায় আসতেন। তাঁর নিজস্ব একটি গ্রন্থাগার ছিল। বইয়ের প্রতি বেঞ্জামিনের গভীর অনুরাগ দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন এবং নিজের গ্রন্থাগারের দরজা তিনি বেঞ্জামিনের জন্য মুক্ত করে দিলেন। ম্যাথিউ আদমসের গ্রন্থাগারটা ছিল যথেষ্ট বড়ো। বেঞ্জামিন এবার মনের আশ মিটিয়ে বই পড়তে লাগলেন।

 কিন্তু কেবল বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেই বেঞ্জামিন সন্তুষ্ট ছিলেন না । উৎকৃষ্ট গদ্য রচনা করার ক্ষমতা অর্জন করাটা ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই কঠোর সাধনায় ব্ৰতী হয়েছিলেন। 

 বেঞ্জামিন গদ্যের সাধনায় ব্রতী হওয়ার পেছনে তাঁর জীবনের একটি ছোটো কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল।

 বেঞ্জামিনের জন কলিন্স নামের একজন বন্ধু ছিল। বেঞ্জামিনের মতো তিনিও বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। দুই বন্ধুর মধ্যে প্রায়ই নানা বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হত। একদিন তর্কের বিষয় হল নারী শিক্ষা।কলিন্সের মতে নারী শিক্ষা লাভের উপযুক্ত নয়, কারণ শিক্ষা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিভা প্রকৃতি তাদের দেয়নি। বেঞ্জামিনের মত হল ঠিক তার উল্টো। বেঞ্জামিনের যুক্তি বেশি সবল ছিল যদিও তর্কে তিনি হেরে গেলেন, কারণ ভাষার ওপরে কলিন্সের দখল ছিল অনেক শক্তিশালী। কেবল বাক নৈপুণ্যের জোরে তিনি বেঞ্জামিনকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে দিলেন।

 কিন্তু বেঞ্জামিন এই পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারলেন না কারণ তার যুক্তি যে বেশি সবল ছিল সে কথা তিনি নিজেও ভালো করে জানতেন। তর্কযুদ্ধের পরে অনেকদিন তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। সেই সময় বেঞ্জামিন একদিন তাঁর যুক্তিগুলি পরিষ্কার করে লিখে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিলেন। বন্ধুটিও তার উত্তর লিখিতভাবে দিলেন। এভাবে বেশ কয়েকটি চিঠির আদান-প্রদান হল, অর্থাৎ তর্কযুদ্ধটা এবার মৌখিকভাবে না হয়ে চিঠির মাধ্যমে হল। এই সময় বেঞ্জামিন কলিন্সকে লেখা একটি চিঠি বেঞ্জামিনের পিতার হাতে পড়ল। তিনি চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে সেই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য বেঞ্জামিনকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ছেলেকে বললেন–’ তোমার বানান শুদ্ধ। যতি চিহ্নও ঠিক জায়গায় দিতে শিখেছ। এই বিষয়ে তুমি তোমার বন্ধুর চেয়ে এগিয়ে রয়েছ। কিন্তু তোমার ভাষা সরল নয়। কথাগুলি পাঠকের সহজ বুদ্ধিতে বুঝতে পারার মতো তাকে রসালো করে তুলতে তুমি পারনি। এই বিষয়ে উন্নতি করার জন্য তোমাকে আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে।’

 পিতার কথায় বেঞ্জামিন সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলেন, কারণ পিতা তার কথার সমর্থনে বেঞ্জামিনের লেখা থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরলেন। বেঞ্জামিন তখনই সংকল্প করলেন যে ভাষার ওপরে দখল বাড়ানোর জন্য আরও ভালো গদ্য লেখার কায়দাটা আয়ত্ত করার জন্য সে চেষ্টার কোনো রকম ত্রুটি করবে না।

 সেই সময়ে তিনি একটি বইয়ের দোকানে’ স্পেকটেটর’(Spectator) নামের একটি ইংরেজি পত্রিকার একটি বাঁধানো খন্ড দেখতে পেলেন। তিনি এর আগে পত্রিকাটি কখন ও দেখেননি বা তার নামও শোনেন নি। পত্রিকাটি কিনে এনে তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়তে লাগলেন। পত্রিকাটির গদ্যরীতি তাকে এতটাই মুগ্ধ করল যে সম্ভব হলে তিনি নিজেও সেই গদ্যরীতির অনুকরণ করতে এবং সেই রীতিতে গদ্য লিখতে মনস্থ করলেন।

 পত্রিকাটি পড়ার সময় বেঞ্জামিন একটি কথা জানতেন না তিনি পড়ে মুগ্ধ হওয়া পত্রিকাটি আসলে ছিল ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ পত্রিকার একটি। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন জোসেফ এডিসন (১৬৭২-১৭১৯)একজন বিরাট প্রতিভাশালী গদ্য-লেখক এবং প্রবন্ধকার হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অন্য একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি ডঃসেমুয়েল জনসন বলেছিলেন—‘ইংরেজি ভাষায় উৎকৃ্ষ্ট গদ্য রচনার কৌশল যারা আয়ত্ত করতে চায় তাঁরা দিন রাত জোসেফ এডিসনের রচনাবলী অধ্যয়ন করায় মনোনিবেশ করতে হবে।’স্পেকটেটরের বেশিরভাগ লেখক ছিলেন জোসেফ এডিসন।এডিসনের গদ্য বিষয়ে ডঃজনসন কী বলেছিলেন সেকথা না জেনে বেঞ্জামিন তাঁর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করেছিলেন।

 বেঞ্জামিন নিজে লিখে রেখে গেছেন—‘স্পেকটেটরের গদ্য রচনার কৌশল আয়ত্ত করার জন্য আমি পত্রিকাটার প্রবন্ধগুলি পড়ে প্রত্যেকটি বাক্যের ভাবার্থ গুলি লিখে রাখলাম।কয়েকদিন পার হয়ে যাবার পরে আমি বইটা না দেখে সেই স্পেকটেটরের মূল প্রবন্ধটির সঙ্গে আমার নিজের লেখাটা মিলিয়ে দেখলাম। যে সমস্ত ভুল ভ্রান্তি আমার চোখে পড়ল সেগুলি পুনরায় শুদ্ধ করলাম। কখনও আমি ইতিমধ্যে লিখে রাখা ভাবার্থ গুলি মিশ্রিত করে ফেলে কয়েক সপ্তাহ পড়ে পুনরায় সেগুলি পরিপাটি করে সাজিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম। এরকম করার উদ্দেশ্য ছিল ভাব গুলি পরিচ্ছন্নভাবে সাজানোর জন্য নিজেকে শেখানো। মূল প্রবন্ধের সঙ্গে আমি নিজের লেখা গুলি মিলিয়ে দেখে দ্বিতীয়বার চোখে পড়া ভুল ভ্রান্তি গুলি শুদ্ধ করলাম। এভাবে অভ্যাস করার সময় আমার মনে হল যে কিছু কথা মূল প্রবন্ধের চেয়ে আমি বেশি ভালো করে লিখতে পারব। একজন ভালো গদ্য লেখক হওয়াটা ছিল আমার জীবনের একটি প্রধান আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারব বলে এখন আমার মনে আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। এভাবে গদ্যরচনার অনুশীলন করার জন্য এবং পড়ার জন্য আমি কেবল রাতের বেলায় সময় পেতাম। কাজ থেকে ফিরে এসে বা সকালে কাজ আরম্ভ করার আগেই আমি রাতের মধ্যে লেখা এবং পড়া দুটো কাজই করতাম। আমার পিতার আকাঙ্ক্ষা অনুসারে আমি রবিবার গির্জায় না গিয়ে তার পরিবর্তে ছাপা শালায় যেতাম —যাতে ছাপাশলায় কোনো মানুষ না থাকা অবস্থায় আমি সেখানে শান্তিতে লেখাপড়া করতে পারি।’( বেঞ্জামিন লেখা মূল কথাটা এখানে সরল এবং সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে)।

 অতি সাধারণ অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় উন্নতি করে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তার সমসাময়িক পৃথিবীর একজন অতি মহৎ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে পরিগণিত হয়েছিলেন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজে স্বীকার করে গিয়েছেন তার এই উন্নতির মূলে ছিল ভালো গদ্য লেখার দক্ষতা— যা তিনি অত্যন্ত কষ্ট করে আয়ত্ত করেছিলেন। মনের ভাব সরল এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করার ওপরে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি লিখে রেখে গেছেন—’ গদ্য রচনা আমার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে এবং এটা আমার উন্নতির একটি প্রধান কৌশলে পরিণত হয়েছিল।’

 





 

শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Homen Borgohain

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস



ভূমিকা


এক


বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবন কাহিনি বলতে শুরু করার আগে আমি কীভাবে তাকে আবিষ্কার করলাম সে কথা প্রথমে বলে নিতে চাই।

প্রায় অর্ধশতক আগের কথা। আমি তখন গ্রামের মিডল স্কুলের ছাত্র। সেই সময় আমাদের স্কুলের প্রধান উৎসব ছিল দুটি একটি হল সরস্বতী পুজো অপরটি বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভা। এই দুটি উৎসবের মধ্যে সরস্বতী পুজোর পরিবেশ ছিল বেশি আনন্দময় কারণ এই উৎসবে স্কুলের সমস্ত ছাত্রই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারত। অন্যদিকে পুরস্কার বিতরণী সভা আনন্দ বহন করে আনত শুধুমাত্র নির্বাচিত কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য– যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী সারা বছর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান অধিকার করে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। আমি সরস্বতী পূজা খুব ভালোবাসতাম। তার প্রধান কারণ ছিল দুটি। বলা বাহুল্য যে প্রথম কারণটি ছিল পুজোর প্রসাদ হিসেবে বিশুদ্ধ মোষের দুধ এবং জুহা চাল দিয়ে তৈরি করা সুস্বাদু পায়েশ খাওয়ার লোভ। জুহা চালে এমনিতেই সুন্দর গন্ধ থাকে।পায়েসের সুগন্ধ বাড়ানোর জন্য তাতে আবার সামান্য কর্পূর দেওয়া হত।বসন্তের মৃদু বাতাস পায়েসের সুগন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে সমগ্র গ্রামে একটা মন মাতাল করা উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করত।কিন্তু সুস্বাদু পায়েস খাওয়ার লোভের চেয়ে দ্বিতীয় যে কারণটার জন্য আমি সরস্বতী পুজো ভালোবাসতাম সেটা ছিল পায়েস দেবার জন্য ব্যবহার করা শালপাতার খোঁজে গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে থাকা ঘন অরণ্যটা তন্ন তন্ন করে খোঁজার সুযোগ।এই কাজের ভার পড়েছিল স্কুলের উঁচু শ্রেণির বয়সে বড়ো অর্থাৎ নয় দশ বছরের ছেলেদের ওপরে।শালপাতা খোঁজার অজুহাতে আমরা জঙ্গলটার একটুও জায়গা বাদ না দিয়ে সমগ্র জঙ্গলটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিলাম।আর সেটা করতে গিয়ে একটা রোমাঞ্চকর অভিযানের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম।জঙ্গলটাতে এভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময় বিচিত্র গাছ-লতা,পশু-পাখি এবং কীট পতঙ্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলাম।সেইসবের মধুর স্মৃতি আজও আমার জীবন আনন্দময় করে রেখেছে।

সরস্বতী পুজো খুব ভালোবাসতাম যদিও সত্যি কথা বলতে গেলে আমার কাছে সরস্বতী পুজোর চেয়েও বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভার আকর্ষণ ছিল তীব্র।আমি শ্রেণিতে সবসময় প্রথম বা দ্বিতীয় হতাম এবং তার ফলে বাৎসরিক পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম।স্কুলের প্রায় দুশো ছাত্রের মধ্যে পুরস্কার পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা ছিল স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত কম।মাত্র আঠারো কুড়ি জন।স্কুলের হেডপণ্ডিত পুরস্কার পাওয়া ছাত্রের নাম ঘোষণা করে তাকে পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য ডাকার সঙ্গে সঙ্গে সে যখন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ,তখন গৌরব এবং আনন্দে তাঁর ছোট্ট বুকটা গর্বে ফুলে উঠে। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া বইগুলি অমূল্য সম্পদের মতো দুইহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে সে যখন নিজের আসনে ফিরে আসে,তখন শত শত জোড়া চোখ ঈর্ষা এবং প্রশংংসার সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে।অন্তত কয়েকটি মুহূর্তের জন্য সে পুরস্কার হিসেবে লাভ করা বইগুলি থেকে বেশি লোভনীয় যেন অনুভব করে সহপাঠী-বন্ধুদের এই ঈর্ষা-কাতর এবং প্রশংসাপূর্ণ দৃষ্টিকে।যেহেতু বাৎসরিক পুরস্কার পাওয়া ছাত্রদের ভেতরে আমিও ছিলাম অন্যতম,তাই গৌ্রব এবং আনন্দের এই মুহূর্তগুলি বারবার ফিরে পাওয়ার লোভে আমি সারাটা বছর উন্মুখ হয়ে পথ চেয়ে থাকতাম।

ব্যক্তি এবং সমাজের উন্নতির জন্য দুটো জিনিস সমান প্রয়োজন বলে বিবেচনা করা হয়।একটি হল প্রতিযোগিতা,অন্যটি সহযোগিতা।প্রতিযোগিতা মানুষকে নিজের প্রতিভা এবং বুদ্ধি-বৃত্তির বিকাশের জন্য প্রেরণা দান করে;সেভাবে বিকশিত হওয়া প্রতিভাকে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য নিয়োগ করাটা সম্ভব হয় সহযোগিতার মাধ্যমে।তাই একটু গভীরভাবে ভাবলেই দেখা যায় যে ব্যক্তি এবং সমষ্টি উভয়ের উন্নতি এবং কল্যাণের জন্য প্রতিযোগিতা এবং সহযোগিতা দুটিই অপরিহার্য।

প্রতিযোগিতার মাদকতা পাঠশালার ছাত্র অবস্থায় যতটা তীব্রভাবে অনুভব করা যায়,জীবনের অন্য কোনো সময়েই সেভাবে করা যায় না।স্কুলের ভালো ছাত্র (এবং ছাত্রী)কয়েকজন শ্রেণিতে নিজের শীর্ষস্থান রক্ষা করার জন্য অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করার সময় প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে সুস্থ প্রতিযোগিতার এই তীব্র মাদকতা।কিছুদিন আগে আমি জনপ্রিয় ইংরেজ লেখক জেফ্রে আর্চারের দি প্রডিগেল ডটার (The Prodigal Daughter) নামে একটি উপন্যাস পড়েছিলাম।উপন্যাসের একটি অধ্যায়ে একজন নয়-দশ বছরের মেয়ে একজন সহপাঠী ছেলেকে শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করার জন্য দৃঢ়সংকল্প নিয়ে কঠোর সাধনায় নিমগ্ন হওয়ার বর্ণনা আছে।সেই অধ্যায়টি পড়ার সময় আমি নিজের দূর অতীতের পাঠশালার দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছিলাম এবং আমি মেয়েটি অনুভব করা প্রতিযোগিতার মধুর মাদকতাটুকু  নিজে অনুভব করেছিলাম। আমার মনে হয় যে যে সমস্ত ছাত্র ছাত্রী প্রতিযোগিতার মঙ্গলজনক অভিজ্ঞতার স্বাদ জীবনে একবারও উপভোগ করে নি তাঁরা একটি মূল্যবান জিনিস হারিয়েছে।অবশ্য প্রতিযোগিতা কেবল যে শ্রেণিতে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়ার জন্যই হওয়া উচিত এরকম কোনো কথা নয়।খেলা-ধুলা,ব্যায়াম,সঙ্গীত,সাহিত্য-চর্চা এবং এমনকি সমাজ-সেবার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার জন্য প্রতিযোগিতা হতে পারে।আমি গ্রামের যে সরকারি মিডল স্কুলে পড়াশোনা করতাম সেই স্কুলে সহজ স্বভাব-চরিত্র এবং আচরণের জন্যও বাৎসরিক পুরস্কার দেবার ব্যবস্থা ছিল।

আমাদের শৈশবে অসমিয়া বই পত্রের সংখ্যা এখনকার তুলনায় অনেক কম ছিল।পুরস্কার দেবার জন্য যে সমস্ত বই বাছা হত সেইসব ছিল প্রধানত মহৎ লোকের জীবন চরিত,রামায়ণ-মহাভারত-ইলিয়াদ আদি মহাকাব্যের সংক্ষিপ্ত কাহিনি এবং ছেলে- মেয়েদের চরিত্র গঠনে সাহায্যকারী বই।সেই সময় অসমিয়া বইপত্রের সংখ্যা খুবই কম ছিল বলে আমরা বছরে পুরস্কার পাওয়া ছেলেরা প্রায় একই বই পুরস্কার হিসেবে বছরের পরে বছর পেতাম।আমি পুরস্কার হিসেবে পাওয়া কয়েকটি বইয়ের নাম এখনও মনে আছে।মহাদেব শর্মা লেখা ‘মহম্মদ চরিত’পেয়েছিলাম পাঁচটি।অম্বিকাপ্রসাদ গোস্বামীর লেখা ‘চরিত্র গঠন’ এবং ‘ইলিয়াদ’ও প্রায় সমান সংখ্যকই পেয়েছিলাম।‘মৌ-মহাভারত’,ধ্রুব,বুদ্ধদেব ইত্যাদি কয়েকটি বইয়ের কথাও মনে আছে।বছরের পর বছর একই বই পুরস্কার হিসেবে পেয়ে আর পড়ে একঘেয়েমি লাগছিল।ঠিক তখনই কোনো একটি বছরে ‘বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন’ নামের একটি বই পুরস্কার হিসেবে পেলাম,তারমধ্যে আবার বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামটা আমার কাছে একেবারে নতুন।আমরা বই পড়তে ভালোবাসা ছেলেরা সেইসময় গো-গ্রাসে বই গিলতাম,অর্থাৎ একটা নতুন বই হাতে পড়লেই অন্য সমস্ত কাজ-কর্ম এবং চিন্তা-ভাবনা একপাশে রেখে দিয়ে বইটা দ্রুত শেষ করতে চেষ্টা করতাম।আমি আগে পড়া অন্য সমস্ত বই থেকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আমার মনকে বেশি করে গ্রাস করেছিল,কারণ বইটির বিষয়বস্তু ছিল আমার কাছে একেবারে নতুন।বইটি পড়ে আমি যখন শেষ করলাম,তখন আমি অনুভব করলাম যে আমার জীবনে এই বইটির প্রভাব হবে চিরস্থায়ী।সেই তখন থেকেই আমি মনে এরকম একটি সঙ্কল্প পুষে রেখেছিলাম যে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বিষয়ে লেখা যতগুলি বই এবং প্রবন্ধ সংগ্রহ করতে পারি সেই সমস্ত বই পড়ব এবং সম্ভব হলে আমিও তাঁর একটা জীবনী লিখব।এই জীবনীটা লিখে আমি দীর্ঘকাল ধরে মনের মধ্যে পুষে রাখা সেই সঙ্কল্প পূরণ করতে পেরেছি।কিন্তু বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বিষয়ে লেখা অনেক বই পত্র পড়েছি বলে আমি দাবি করতে পারি না,কারণ অসমে বসবাস করে বইপত্র জোগাড় করা একটি অতি কঠিন কাজ।উদাহরণস্বরূপ কার্ল ভান দোরেন লেখা যে বইটিকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন-চরিত বলে বলা হয়ে থাকে সেই বইটা আমার এখনও পড়ার সুযোগ হয় নি।তথাপি তাঁর বিষয়ে লেখা যতগুলি বই এবং প্রবন্ধ পড়েছি সেগুলি তাঁর মহত্ত্ব উপলদ্ধি করার জন্য যথেষ্ট।তাছাড়া তাঁর আত্ম-জীবনীটাও আমি পড়েছি।অবশ্য আত্মজীবনীটা তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি।অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় সেটি প্রকাশ করা হয়েছে। 

         

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...