রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন -৮ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





আট

(৮)

বেঞ্জামিনের বহুমুখী সাধনা

বেঞ্জমিন কর্মজীবন আরম্ভ করেছিলেন মুদ্রক এবং সাংবাদিক হিসেবে।একজন সফল সাংবাদিক হওয়াটা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ছাপাখানার ব্যবসা কৃতকার্যতার মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি খবরের কাগজ আরম্ভ করলেন।। নাম দা ‘পেনসিলভেনিয়া গেজেট’।

বেঞ্জামিন এখন ফিলাডেলফিয়ার একজন বিশিষ্ট এবং সম্মানিত নাগরিক। তিনি নিজে একটি বড়ো ছাপাখানার মালিক। তাছাড়া তিনি একটি খবরের কাগজের সম্পাদক। কিন্তু বেঞ্জামিন কেবল ব্যক্তিগত কৃতকার্যতায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকার মানুষ ছিলেন না। তিনি সবসময় নিজের স্বাস্থ্য স্বভাব চরিত্র এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নত করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার সমান্তরাল ভাবে তিনি আরও একটি ব্রত গ্রহণ করেছিলেন– তিনি যে পরিবেশ এবং যে সমাজে বাস করেন সেই পরিবেশ এবং সেই সমাজের উন্নতি সাধন করার জন্য কাজ করা। নিজের উন্নতি সঙ্গে অন্যেরও উন্নতি– এই সংকল্প তিনি সারা জীবন চোখের সামনে রেখে ছিলেন এবং সেই অনুসারে কাজ করে গেছেন।

  ফিলাডেলফিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তার বিশিষ্ট এবং বিদগ্ধ বন্ধুদের নিয়ে একটি ক্লাব খুললেন। ক্লাবটির নাম দিলেন জুন্টো (Junto)।অহরহ উন্নতির কথা চিন্তা করা বেঞ্জামিনের এই ক্লাবটি খোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে ক্লাবের প্রতিটি সদস্যের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করা। ক্লাবের বৈঠক বসত প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা বেলা। ক্লাবের নিয়মাবলী তৈরি করেছিলেন বেঞ্জামিন নিজে। সেই নিয়ম অনুসারে ক্লাবের প্রতিটি সদস্যই পর্যায়ক্রমে রাজনীতি, দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে একটি বা ততোধিক প্রশ্ন উত্থাপন করবে এবং বাকি সদস্যরা সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে। তিন মাস পরে পরে ক্লাবের প্রতিটি সদস্য নিজের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো বিষয়ের উপরে একটি পাঠ করবে এবং বাকি সদস্যরা তার উপরে তর্ক করবে। কিন্তু তর্ক যুদ্ধে জয়লাভ করাটা কারও উদ্দেশ্য হবে না। তর্কের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে সত্যের সন্ধান।

যে সময়ের কথা লিখছি সেই সময় আমেরিকা স্বাধীন ছিল না বা এখনকার মতো একটি বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রও ছিল না।ব্রিটেন থেকে যাওয়া শরণার্থীরা তখন পর্যন্ত উত্তর আমেরিকায় তেরোটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।প্রতিটি উপনিবেশই ছিল ব্রিটিশ রাজ শক্তির অধীন।বেঞ্জামিন ক্লাব খুলে বন্ধুদের সঙ্গে নানা বিষয়ে তর্ক এবং আলোচনা করে থাকার সময় তেরোটি উপনিবেশে মুদ্রার অভাব জনসাধারণের জন্য জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।ক্লাবের বৈঠকে সেই বিষয়েও একদিন আলোচনা হল।সেই আলোচনার ভিত্তিতে বেঞ্জামিনের নিজের নাম না দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে বিতরণ করলেন।প্রবন্ধটিতে মাটির মূল্যের ওপর ভিত্তি করে কাগজের নোট ছাপার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।সরল ভাষায় লেখা বেঞ্জামিনের অকাট্য যুক্তিতে বিশ্বাস করে পেনসিলভেনিয়ার বিধান সভা কাগজের নোট প্রচলন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং নোট ছাপার দায়িত্বটাও দিলেন বেঞ্জামিনের ছাপাখানাকে।ফলে একই সময়ে বেঞ্জামিনের হাতে অনেক টাকা এল।যা অল্প কিছু ঋণ পরিশোধ করার জন্য বাকি ছিল সেটা পরিশোধ করে তিনি এখন একজন ধনী মানুষ হলেন।বেঞ্জামিন নিজে স্বীকার করা মতে তাঁর জীবনে উন্নতি এবং কৃ্তকার্যতা লাভ করার একটি প্রধান সম্বল ছিল তাঁর ভালো গদ্য লেখার ক্ষমতা।কাগজের নোট ছাপিয়ে ধনী হওয়াটাও তার একটি প্রমাণ বলে তিনি নিজে লিখে রেখে গেছেন।

ঠিক প্রায় এই সময়ে জনগণের জন্য একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করার চিন্তাও বেঞ্জামিনের মনে এল।এর আগে পর্যন্ত আমেরিকায় গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব ছিল না।জুন্টো ক্লাবে পাঠ করা রচনাগুলিতে প্রায় নানা ধরনের বইয়ের উল্লেখ থাকে। সেই প্রতিটি বই ক্লাবের সদস্যদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বই। বেঞ্জামিন একদিন ক্লাবের বৈঠকে প্রস্তাব করলেন যে সদস্যরা যদি তাদের বইগুলি বাড়ি থেকে এনে ক্লাবে বসার ঘরে একসঙ্গে করে রাখে, তাহলে রচনাগুলোর বিষয়ে আলোচনা করার সময় সদস্যরা প্রয়োজন হলে বই গুলির পাতা উল্টিয়ে দেখতে পারবে; তাছাড়া তারা একে অপরের বই পড়ার জন্য বাড়িতেও নিতে পারবে। বেঞ্জামিনের প্রস্তাবে জুন্টো ক্লাবের সদস্যরা সম্মত হলেন। তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বইগুলি ক্লাবে জমা দিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হল না। যত্ন নেওয়া মানুষের অভাবে বইগুলি নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। প্রায় এক বছর পরে সদস্যরা বইগুলি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। ঠিক এই সময়ে বেঞ্জামিন একটি সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করার কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন।

বেঞ্জামিনের পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তাবিত গ্রন্থাগারের জন্য প্রথমে পঞ্চাশজন সদস্য খুঁজে বের করা হল। সদস্য হওয়ার জন্য তাদের প্রত্যেককেই চল্লিশ সিলিং করে ভর্তি মাশুল দিতে হল। তাছাড়া ঠিক হল যে পঞ্চাশ বছরের জন্য তাদের বছরে দশ শিলিং করে দান করতে হবে। এই টাকা দিয়ে বই কিনে আমেরিকার সর্বপ্রথম সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করা হল। বেঞ্জামিন স্থাপন করা গ্রন্থাগার গড়ে তোলার আদর্শে পরবর্তীকালে সমগ্র আমেরিকায় এই ধরনের অসংখ্য গ্রন্থাগার (Subscription Library) স্থাপন করা হল। পরবর্তীকালে এই আদর্শ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ল।বেঞ্জামিন নিজের জীবনকালে তাঁর সৎ কর্মের সুফল দেখে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে লিখে রেখে গেছেন–’ এই গ্রন্থাগার গুলি আমেরিকানদের সাধারণ কথাবার্তা মান অনেকখানি উন্নত করল, এবং সাধারণ কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের বুদ্ধিমান করে তুলল। তাছাড়া এই গ্রন্থাগার গুলি সাধারণ মানুষকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলে সেই সমস্ত রক্ষা করার জন্য তাদেরকে প্রেরণা দান করল।’

এই গ্রন্থাগার বেঞ্জামিনের নিজের কতটা উপকার করেছে সেই কথা তিনি লিখে যেতে ভুলেন নি। বেঞ্জামিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন–’ নিয়মিত ভাবে বই পড়ে নিজের উৎকর্ষ সাধন করার জন্য এই গ্রন্থাগার আমাকে অনেকখানি সাহায্য করেছে। বাবার ইছা অনুসারে উচ্চশিক্ষা আহরণ করতে না পারার ফলে আমার যে ক্ষতি হয়েছিল সেই ক্ষতি আমি অনেক পরিমাণে পূরণ করতে পেরেছি এই গ্রন্থাগারের সাহায্যে। আমি প্রতিদিন একঘণ্টা বা দুইঘন্টা সময় আলাদাভাবে রেখেছিলাম। বই পড়াটাই ছিল আমার একমাত্র আমোদ প্রমোদ। তাস খেলে বা মজা করে আমি একটি মুহূর্তও নষ্ট করিনি।’

 সবসময় আত্মোৎকর্ষের সাধনা করা বেঞ্জামিন ঠিক এই সময় নিজের নৈতিক উৎকর্ষের জন্য আরও একটি অভিনব পরিকল্পনা হাতে নিলেন। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি নিচে উল্লেখ করা বারোটি বিশেষ গুণ আয়ত্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং সেই গুণগুলি একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করে নিলেন।–

১) মিতাচার –শরীর ভারী হওয়ার মতো খাবার না খাওয়া, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হওয়ার মতো মদ্যপান না করা।

২) নীরবতা– যে কথা বললে তোমার নিজের বা অন্যের কোনো উপকার হয় না, সেরকম কথা বলবে না, তুচ্ছ অর্থহীন কথা বলে সময় নষ্ট করবে না।

৩) পরিপাটিতা – যে জিনিস যেখানে রাখা উচিত ঠিক সেখানে রাখবে, যে কাজ যখন করা উচিত ঠিক তখনই করবে।

৪) সংকল্প– যে কাজ উচিত সেরকম কাজ করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করবে; যে কাজ করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করবে, সেই কাজ কখনও না করে থাকবে না।

৫) মিতব্যয়িতা– নিজের বা অন্যের উপকারে না আসা কোনো কাজে টাকা পয়সা খরচ করবে না, কোনো ধরনের অপচয় করবে না।

৬) অধ্যবসায়– সময় নষ্ট করবে না; সব সময় কিছু না কিছু একটা কাজে লেগে থাকবে; অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম সমূলে বাদ দেবে।

৭) আন্তরিকতা– অন্যের অপকার করতে পারা কোনো ধরনের ছলনা বা প্রতারণার আশ্রয় নেবে না, সৎ ভাবে চিন্তা করবে; কথাও বলবে সৎভাবে চিন্তা করা অনুসারে।

৮) ন্যায়পরায়ণতা– অন্যে আঘাত পেতে পারে সেরকম কোনো কাজ করে অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ করবে না; ঠিক সেভাবে অন্যের উপকার করাটা যদি তোমার কর্তব্য, সেটাও না করে থাকবে না।

৯) আত্ম-সংযম– সমস্ত কথায় আতিশয্য পরিহার করে চলবে; প্রাপ্য শাস্তি বা আঘাত পেলে তার জন্য ক্রোধ বা অসন্তোষ প্রকাশ করবে না।

১০) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা– নিজের শরীর, পরা কাপড়-চোপড়, বিছানা পত্র এবং বাসস্থান সমস্ত সময়ে নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করে রাখবে।

১১) মানসিক প্রশান্তি– ছোটো ছোটো কথায় বিরক্ত হবে না; সচরাচর হয়ে থাকা বা এড়াতে না পারা বিপদ-আপদে বিচলিত হয়ে মনের শান্তি হারাবে না।

১২) নম্রতা– যিশুখ্রিষ্ট এবং সক্রেটিসের আদর্শ অনুসরণ করে চলবে।

অনুশীলন করার জন্য বারোটি গুণের তালিকা করে নেবার পরে বেঞ্জামিন প্রতিটি গুণের অনুশীলন করার জন্য এক একটি সপ্তাহ উৎসর্গ করা ঠিক করলেন। অর্থাৎ সম্পূর্ণ একটি সপ্তাহ তিনি একটি মাত্র গুণের অনুসরণ করায় নিয়োগ করার কথা ভাবলেন। প্রথম সপ্তাহের জন্য তিনি বেছে নিলেন মিতাচার। প্রথম সপ্তাহের জন্য মিতাচার বেছে নেওয়ার কারণ এই যে, বেঞ্জামিনের মতে পান ভোজনের ক্ষেত্রে সংযম রক্ষা করে চললে মানুষের মগজ শীতল এবং পরিষ্কার হয়ে থাকে। মগজের এরকম অবস্থায় সমস্ত কথা ভালোভাবে চিন্তা করে শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।

 এক সপ্তাহ মিতাচারের অনুশীলন করে বেঞ্জামিন দ্বিতীয় সপ্তাহের জন্য বেছে নিলেন নীরবতার অনুশীলনী। যে মানুষ মুখে কম কথা বলে, কিন্তু কান সবসময় খোলা রাখে, সেই মানুষ অন্যের কথা শুনে বেশি করে জ্ঞান আহরণ করতে পারে। অন্যদিকে যে মানুষের অনবরত কথা বলে থাকার অভ্যাস, সে অন্যের কাছ থেকে কোনো কথাই শিখতে পারেনা। সেই জন্যই বেঞ্জামিন নীরবতা তথা কম কথা বলার উপরে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন এবং তার গুণের তালিকায় তাকে দ্বিতীয় স্থান দিয়েছিলেন।

 তৃতীয় সপ্তাহে অনুশীলন করার জন্য তিনি বেছে নিলেন পরিপাটিতা। যে মানুষের সমস্ত জিনিস পরিপাটি করে রাখার এবং সমস্ত কাজ পরিপাটি করে করার অভ্যাস, তিনি কাজ করার জন্য এবং পড়াশোনা করার জন্য বেশি সময় বের করে নিতে পারেন।

 চতুর্থ সপ্তাহে তিনি অনুশীলন করতে শুরু করলেন সংকল্পের। এর অর্থ এটাই যে, সেই সপ্তাহের প্রতিটি দিনে তিনি যে যে কাজ করার জন্য সংকল্প নিয়েছিলেন, সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত তিনি কখনও ক্ষান্ত হতেন না।সংকল্পের দৃঢ়তা তার তালিকাটিতে থাকা বাকি গুলগুলি সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করার জন্য তার মনে সাহস জুগিয়ে ছিল।

 মিতব্যয়িতা এবং অধ্যবসায়ের অনুশীলন তাকে সমস্ত ধারের বোঝা থেকে মুক্ত করে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল এবং স্বাধীন করে তুলেছিল। তার ফলেই বাকি দুটি গুণ, আন্তরিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতার অনুশীলন করাটা তার পক্ষে বেশি সহজ হয়েছিল।

 অবিরাম সাধনার দ্বারা নিজের স্বভাব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করার জন্য চেষ্টা করা মানুষ বেঞ্জামিন ছাড়াও অন্য অনেকে নিশ্চয় আছে। কিন্তু তার মতো পরিকল্পিত এবং প্রণালীবদ্ধ ভাবে এই কাজ করার উদাহরণ বড়ো বেশি নেই। নিজের চরিত্র গঠনের জন্য বেঞ্জামিন উদ্ভাবন করা এই পদ্ধতি পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা দান করেছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...