রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





সাত

(৭)

 

বেঞ্জামিনের ফিলাডেলফিয়ায় আসার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল উইলিয়াম ব্রেডফোর্ডের ছাপাশালায় চাকরির খোঁজে। কিন্তু বেঞ্জামিন এন্ট্রু বেটফোর্ডকে তার ছাপাশালায় সাক্ষাৎ করে জানতে পারলেন যে তার ছাপাশালাতে সেই সময় কোনো পদ খালি ছিল না। অবশ্য তিনি বেঞ্জামিনকে সম্পূর্ণ নিরাশ করলেন না। তিনি বেঞ্জামিনকে খবর দিলেন যে কাছেই কেইমার নামের একজন ভদ্রলোকের একটি ছাপাশালা আছে। বেঞ্জামিন সেখানে চাকরির জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যদি সেখানেও তিনি চাকরি না পান, তাহলে অন্য কোথাও চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বেঞ্জামিন তাঁর সঙ্গে থেকে ছাপাখানার ছোটোখাটো কাজগুলি করে তাকে সাহায্য করতে পারবেন।

কিন্তু বেঞ্জামিনের ভাগ্য ভালো যে কেইমারের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেঞ্জামিনকে নিজের ছাপাশালায় নিযুক্তি দিলেন। 

সেই সময়ে পেনসিলভিনিয়ার গভর্নর ছিলেন স্যার উইলিয়াম কীথ।(ফিলাডেলফিয়া পেনসিলভিনিয়া রাজ্যের একটি প্রধান শহর)। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তার কানে গিয়ে পৌঁছালো যে বেঞ্জামিন নামের একজন যুবক পায়ে হেঁটে নিউইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়ায় এসেছে।যুবকটিকে দেখার জন্য তিনি নিজে একদিন কেইমারের ছাপাশালায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। বেঞ্জামিনের সরস এবং বুদ্ধি-দীপ্ত কথাবার্তা গভর্নর কে খুব মুগ্ধ করল। তিনি বেঞ্জামিনকে নিজের একটি ছাপাশালা  স্থাপন করার জন্য উপদেশ দিলেন। তার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য দেওয়ার জন্যও তিনি প্রস্তুত ছিলেন ।কিন্তু ছাপাশালা স্থাপন করার আগে একবার লন্ডন যাবার জন্য তিনি বেঞ্জামিনকে পরামর্শ দিলেন।লন্ডনে তিনি ছাপাশালার নতুন যন্ত্রপাতি কিনতে পারবেন এবং পুস্তক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন।

কিন্তু স্যার উইলিয়াম কীথ প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় যতটা উদার ছিলেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার প্রতি তাঁর আগ্রহ বা মনোযোগ ততটা ছিল না। তিনি বেঞ্জামিনকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি লন্ডনের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেঞ্জামিনের পরিচয় জানিয়ে  একটা চিঠি লিখে দেবেন।এবং বেঞ্জামিন চিঠি গুলি সঙ্গে নিয়ে যাবে।গভর্নরের কয়েকজন বন্ধু ছাপাশালার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বেঞ্জামিনকে কিছু টাকা ধরে দেবেন। কিন্তু গভর্নর নিজের কথামতো কাজ না করায় বেঞ্জামিনকে কোনো পরিচয়পত্র ছাড়াই লন্ডনে যেতে হল। উচ্চ পদে থাকা মানুষ কথা দিয়ে কথা না রাখার এই ধরনের আরও কয়েকটি তিক্ত অভিজ্ঞতা পরবর্তী কয়েক বছরে হল। ফলে তিনি উচ্চ পদে থাকা ক্ষমতাশালী মানুষের ছলনা ভরা কথায় বিশ্বাস করলেন না। 

১৭২৪ সনের ২৪ ডিসেম্বর বেঞ্জামিন লন্ডনে উপস্থিত হলেন। তখন তার হাতে ধন ছিল মাত্র বারো পাউন্ড। এত কম টাকায় ছাপাশালার যন্ত্রপাতি কেনার আশা বাদ দিয়ে বেঞ্জামিন চাকরি খুঁজতে লাগলেন।তাকে বেশি দিন বেকার হয়ে থাকতে হল না। লন্ডনের বার্থলোমিও ক্লজ নামের একটি জায়গায় সেমুয়েল পামার নামের একজন মানুষের একটি বড়োসড়ো এবং বিখ্যাত ছাপাশালা ছিল। নিজের যোগ্যতা বলে বেঞ্জামিন সেখানে চাকরি পেলেন। বেঞ্জামিন অতিশয় পরিশ্রমী ছিলেন। ছাপাশালায় কাজ করে তিনি যথেষ্ট টাকা পয়সা রোজগার করেছিলেন। ছাপাশলায় কাজ করে তিনি যথেষ্ট ধন রোজগার করেছিলেন। কিন্তু প্রথম অবস্থায় তিনি সঞ্চয়ের দিকে মন না দিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত নাট্যশালা গুলিতে নাট্যাভিনয় দেখে এবং অন্যান্য আমোদ প্রমোদে উপার্জনের বেশিরভাগ টাকা খরচ করতেন। সেটাও ছিল তাঁর আত্ম-শিক্ষার একটি অংশ।

কিন্তু বেঞ্জামিন তাঁর অবসর সময়টুকু কেবল নাট্যাভিনয় দেখার জন্যই খরচ করতেন না। বেঞ্জামিন লন্ডনের যে বাড়িটাতে ছিলেন, সেই বাড়িটার প্রায় গায়ে লেগে থাকা একটি বইয়ের দোকান ছিল। দোকানটিতে অনেক পুরোনো বইপত্র ছিল। বেঞ্জামিন সামান্য দক্ষিণার বিনিময়ে সেই বইগুলি পড়ার জন্য দোকানের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করলেন। এভাবে তিনি দোকানটার বেশিরভাগ বই পড়ে শেষ করে নিজের জ্ঞানের ভান্ডার আগের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে তুললেন। 

সেমুয়েল পামারের ছাপাশালায় প্রায় এক বছর কাজ করার পরে বেঞ্জামিন জেমস ওয়ার্ড নামের অন্য একজন মানুষের ছাপাশলায় কাজ পেলেন। এই ছাপার শালাটা পামারের ছাপা শালার চেয়ে  অনেক বড়ো ছিল। পামারের ছাপা শালায় বেঞ্জামিন প্রধানত কম্পোজিঙের কাজ করতেন। পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য তারা প্রচুর পরিমাণে বিয়ার নামের এক ধরনের লঘু সূরা জাতীয় পানীয় পান করতেন। কিন্তু বেঞ্জামিন দিনরাত এই ধরনের সঙ্গে বসবাস করেও কেবল বিশুদ্ধ খাওয়ার জল ছাড়া কোনো কিছু খেতেন না। বিয়ার খাওয়া ইংরাজকর্মীরা বেঞ্জামিনকে’জল পান করা আমেরিকান’বলে ক্ষ্যাপাতেন; কিন্তু তারা একটা কথা দেখে আশ্চর্য হয়েছিল যে জল খাওয়া আমেরিকান ঠিক তাদের চেয়ে শারীরিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। ছাপাশালার টাইপের ভারী পাচিগুলি সিঁড়িবে অনায়াসে নিচ থেকে উপরে নিয়ে যেতে হলে ইংরেজ কর্মীরা দুটি হাতে একটি মাত্র পাঁচই ভার নিয়ে যেত, কিন্তু বেঞ্জামিন দুটো হচ্ছে দুটো নিয়ে যেত।

বেঞ্জামিন ইংল্যান্ডে আসার সময় জাহাজে টমাস ডেনহাম নামের একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়েছিল। ডেনহাম একদিন বেঞ্জামিনের কাছে এসে প্রস্তাব দিল যে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে গিয়ে সেখানে গ্রাহকের প্রয়োজনীয় সমস্ত সামগ্রী এক জায়গায় পাওয়ার মতো করে একটি বড়ো দোকান খুলতে চান এবং বেঞ্জামিনকে তিনি সেই দোকানের হিসেব রক্ষকের দায়িত্ব দিতে চান। বেঞ্জামিন প্রস্তাবটিতে সম্মত হলেন। ১৭২৬ সনের জুলাই মাসে তাঁরা লন্ডন ত্যাগ করে ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 

লন্ডনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশে অনেকখানি সাহায্য করল কেবল একটি কথায় তার মনে কিছুটা অতৃপ্তি থেকে গেল। বেঞ্জামিন লন্ডনে থাকার সময় বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার নিউটন জীবিত ছিলেন। তাকে একবার সশরীরে দেখার জন্য বেঞ্জামিনের খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল না।

ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে এসে টমাস ডেনহাম তার প্রস্তাবিত দোকানটি আরম্ভ করলেন এবং আগের প্রতিশ্রুতি মতো তিনি বেঞ্জামিনকে হিসেবে রক্ষকের চাকরি দিলেন। কিন্তু দোকান খোলার কয়েক মাস পরে ডেনহামের হঠাৎ একদিন মৃত্যু হল। বেঞ্জামিন পুনরায় তার পূর্বের নিয়োগকর্তা কেইমারের ছাপাশালায় চাকরি নিতে বাধ্য হলেন। ১৭৩০ সনের পহেলা সেপ্টেম্বর তিনি দেবরারীভ নামের একজন মহিলাকে বিয়ে করে সংসার জীবনে প্রবেশ করলেন। 

কেইমারের ছাপাশালায় একজন অধীনস্থ কর্মচারী হিসেবে বেঞ্জামিনকে বেশি দিন কাজ করতে হল না। নিজের একটি ছাপা সাদা স্থাপন করার সংকল্প তিনি মনে মনে বহুদিন ধরে পোষণ করে আসছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে লন্ডন ছাড়ার আগেই তিনি ছাপাশ খেলার নতুন টাইপ কেনার ব্যবস্থা করে এসেছিলেন। কেইমারের ছাপাশালায় কিছুদিন কাজ করার পরে লন্ডন থেকে নতুন টাইপ গুলি এসে গেল। ব্যন জামিন বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে নিজের ছাপাশালা আরম্ভ করলেন।

১২ বছর বয়সে ছাপাশালার শিক্ষানবিশ হিসেবে জীবন আরম্ভ করা পরিশ্রমী এবং অধ্যবসায়ী বেঞ্জামিন ছাপাশালার যাবতীয় বিদ্যা অতি নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। কেইমারের ছাপাশালায় যাবতীয় বিদ্যা অতি নিখুঁতভাবে আয়ত্ব করেছিলেন। তাছাড়া কেইমারের ছাপাশালায় কাজ করার সময় শহরের প্রতিটি গণ্যমান্য ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। বেঞ্জামিন নিজেই আত্মজীবনীতে লিখে রেখে গেছেন যে ছাপাশালার মালিক কেইমারের তুলনায় তার অধ্যয়নের পরিধি ছিল বিশাল; ফলে মানুষ ছাপাশালার মালিকের চেয়ে তার সঙ্গে কথা বলে বেশি খুশি হতেন। বিভিন্ন কাজে ছাপাশালায় আসা মানুষেরা বেঞ্জামিনের সরস বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে উপযাচক হয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন। তাঁরা বেঞ্জামিনকে নিজের বাড়িতে আহার করার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন এবং অন্যান্য বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই কেইমারের ছাপাশালায় অধীনস্থ কর্মচারী হয়ে থাকার সময়েই ফিলাডেলফিয়ায় বেঞ্জামিনের গুণমুগ্ধ একটি বড়ো বন্ধু চক্র গড়ে উঠেছিল। ফলে তিনি নিজে যখন ছাপা শালার ব্যবসা আরম্ভ করলেন, তখন অতি কম সময়ের ভেতরে তার ব্যাবসায় দ্রুত উন্নতি হতে লাগল।

বেঞ্জামিনের স্বভাবের অন্য কিছু গুণাবলিও কর্মজীবনে কৃতকার্য হওয়ায় তাকে সাহায্য করেছিল। প্রচলিত অর্থে বেঞ্জামিনকে ধর্মভিরু মানুষ বলে বলা যায় না, কারণ ধর্মীয় আচরণ অনুষ্ঠান যান্ত্রিকভাবে পালন করার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে কিছু নীতি এবং আদর্শ মেনে চলার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দান করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত হওয়া উচিত  সত্য ,আন্তরিকতা এবং ন্যায় পরায়ণতা। এই কয়েকটি কথার উপরে তিনি এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে তিনি একটি সংকল্পের রূপে কথাগুলি একটি কাগজে লিখে নিয়েছিলেন এবং দৈনন্দিন জীবনে সেই সংকল্প নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। সেই কাগজটি মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তার ডায়েরিতে ছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...