শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Homen Borgohain

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস



ভূমিকা


এক


বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবন কাহিনি বলতে শুরু করার আগে আমি কীভাবে তাকে আবিষ্কার করলাম সে কথা প্রথমে বলে নিতে চাই।

প্রায় অর্ধশতক আগের কথা। আমি তখন গ্রামের মিডল স্কুলের ছাত্র। সেই সময় আমাদের স্কুলের প্রধান উৎসব ছিল দুটি একটি হল সরস্বতী পুজো অপরটি বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভা। এই দুটি উৎসবের মধ্যে সরস্বতী পুজোর পরিবেশ ছিল বেশি আনন্দময় কারণ এই উৎসবে স্কুলের সমস্ত ছাত্রই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারত। অন্যদিকে পুরস্কার বিতরণী সভা আনন্দ বহন করে আনত শুধুমাত্র নির্বাচিত কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য– যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী সারা বছর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান অধিকার করে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। আমি সরস্বতী পূজা খুব ভালোবাসতাম। তার প্রধান কারণ ছিল দুটি। বলা বাহুল্য যে প্রথম কারণটি ছিল পুজোর প্রসাদ হিসেবে বিশুদ্ধ মোষের দুধ এবং জুহা চাল দিয়ে তৈরি করা সুস্বাদু পায়েশ খাওয়ার লোভ। জুহা চালে এমনিতেই সুন্দর গন্ধ থাকে।পায়েসের সুগন্ধ বাড়ানোর জন্য তাতে আবার সামান্য কর্পূর দেওয়া হত।বসন্তের মৃদু বাতাস পায়েসের সুগন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে সমগ্র গ্রামে একটা মন মাতাল করা উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করত।কিন্তু সুস্বাদু পায়েস খাওয়ার লোভের চেয়ে দ্বিতীয় যে কারণটার জন্য আমি সরস্বতী পুজো ভালোবাসতাম সেটা ছিল পায়েস দেবার জন্য ব্যবহার করা শালপাতার খোঁজে গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে থাকা ঘন অরণ্যটা তন্ন তন্ন করে খোঁজার সুযোগ।এই কাজের ভার পড়েছিল স্কুলের উঁচু শ্রেণির বয়সে বড়ো অর্থাৎ নয় দশ বছরের ছেলেদের ওপরে।শালপাতা খোঁজার অজুহাতে আমরা জঙ্গলটার একটুও জায়গা বাদ না দিয়ে সমগ্র জঙ্গলটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিলাম।আর সেটা করতে গিয়ে একটা রোমাঞ্চকর অভিযানের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম।জঙ্গলটাতে এভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময় বিচিত্র গাছ-লতা,পশু-পাখি এবং কীট পতঙ্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলাম।সেইসবের মধুর স্মৃতি আজও আমার জীবন আনন্দময় করে রেখেছে।

সরস্বতী পুজো খুব ভালোবাসতাম যদিও সত্যি কথা বলতে গেলে আমার কাছে সরস্বতী পুজোর চেয়েও বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভার আকর্ষণ ছিল তীব্র।আমি শ্রেণিতে সবসময় প্রথম বা দ্বিতীয় হতাম এবং তার ফলে বাৎসরিক পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম।স্কুলের প্রায় দুশো ছাত্রের মধ্যে পুরস্কার পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা ছিল স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত কম।মাত্র আঠারো কুড়ি জন।স্কুলের হেডপণ্ডিত পুরস্কার পাওয়া ছাত্রের নাম ঘোষণা করে তাকে পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য ডাকার সঙ্গে সঙ্গে সে যখন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ,তখন গৌরব এবং আনন্দে তাঁর ছোট্ট বুকটা গর্বে ফুলে উঠে। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া বইগুলি অমূল্য সম্পদের মতো দুইহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে সে যখন নিজের আসনে ফিরে আসে,তখন শত শত জোড়া চোখ ঈর্ষা এবং প্রশংংসার সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে।অন্তত কয়েকটি মুহূর্তের জন্য সে পুরস্কার হিসেবে লাভ করা বইগুলি থেকে বেশি লোভনীয় যেন অনুভব করে সহপাঠী-বন্ধুদের এই ঈর্ষা-কাতর এবং প্রশংসাপূর্ণ দৃষ্টিকে।যেহেতু বাৎসরিক পুরস্কার পাওয়া ছাত্রদের ভেতরে আমিও ছিলাম অন্যতম,তাই গৌ্রব এবং আনন্দের এই মুহূর্তগুলি বারবার ফিরে পাওয়ার লোভে আমি সারাটা বছর উন্মুখ হয়ে পথ চেয়ে থাকতাম।

ব্যক্তি এবং সমাজের উন্নতির জন্য দুটো জিনিস সমান প্রয়োজন বলে বিবেচনা করা হয়।একটি হল প্রতিযোগিতা,অন্যটি সহযোগিতা।প্রতিযোগিতা মানুষকে নিজের প্রতিভা এবং বুদ্ধি-বৃত্তির বিকাশের জন্য প্রেরণা দান করে;সেভাবে বিকশিত হওয়া প্রতিভাকে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য নিয়োগ করাটা সম্ভব হয় সহযোগিতার মাধ্যমে।তাই একটু গভীরভাবে ভাবলেই দেখা যায় যে ব্যক্তি এবং সমষ্টি উভয়ের উন্নতি এবং কল্যাণের জন্য প্রতিযোগিতা এবং সহযোগিতা দুটিই অপরিহার্য।

প্রতিযোগিতার মাদকতা পাঠশালার ছাত্র অবস্থায় যতটা তীব্রভাবে অনুভব করা যায়,জীবনের অন্য কোনো সময়েই সেভাবে করা যায় না।স্কুলের ভালো ছাত্র (এবং ছাত্রী)কয়েকজন শ্রেণিতে নিজের শীর্ষস্থান রক্ষা করার জন্য অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করার সময় প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে সুস্থ প্রতিযোগিতার এই তীব্র মাদকতা।কিছুদিন আগে আমি জনপ্রিয় ইংরেজ লেখক জেফ্রে আর্চারের দি প্রডিগেল ডটার (The Prodigal Daughter) নামে একটি উপন্যাস পড়েছিলাম।উপন্যাসের একটি অধ্যায়ে একজন নয়-দশ বছরের মেয়ে একজন সহপাঠী ছেলেকে শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করার জন্য দৃঢ়সংকল্প নিয়ে কঠোর সাধনায় নিমগ্ন হওয়ার বর্ণনা আছে।সেই অধ্যায়টি পড়ার সময় আমি নিজের দূর অতীতের পাঠশালার দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছিলাম এবং আমি মেয়েটি অনুভব করা প্রতিযোগিতার মধুর মাদকতাটুকু  নিজে অনুভব করেছিলাম। আমার মনে হয় যে যে সমস্ত ছাত্র ছাত্রী প্রতিযোগিতার মঙ্গলজনক অভিজ্ঞতার স্বাদ জীবনে একবারও উপভোগ করে নি তাঁরা একটি মূল্যবান জিনিস হারিয়েছে।অবশ্য প্রতিযোগিতা কেবল যে শ্রেণিতে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়ার জন্যই হওয়া উচিত এরকম কোনো কথা নয়।খেলা-ধুলা,ব্যায়াম,সঙ্গীত,সাহিত্য-চর্চা এবং এমনকি সমাজ-সেবার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার জন্য প্রতিযোগিতা হতে পারে।আমি গ্রামের যে সরকারি মিডল স্কুলে পড়াশোনা করতাম সেই স্কুলে সহজ স্বভাব-চরিত্র এবং আচরণের জন্যও বাৎসরিক পুরস্কার দেবার ব্যবস্থা ছিল।

আমাদের শৈশবে অসমিয়া বই পত্রের সংখ্যা এখনকার তুলনায় অনেক কম ছিল।পুরস্কার দেবার জন্য যে সমস্ত বই বাছা হত সেইসব ছিল প্রধানত মহৎ লোকের জীবন চরিত,রামায়ণ-মহাভারত-ইলিয়াদ আদি মহাকাব্যের সংক্ষিপ্ত কাহিনি এবং ছেলে- মেয়েদের চরিত্র গঠনে সাহায্যকারী বই।সেই সময় অসমিয়া বইপত্রের সংখ্যা খুবই কম ছিল বলে আমরা বছরে পুরস্কার পাওয়া ছেলেরা প্রায় একই বই পুরস্কার হিসেবে বছরের পরে বছর পেতাম।আমি পুরস্কার হিসেবে পাওয়া কয়েকটি বইয়ের নাম এখনও মনে আছে।মহাদেব শর্মা লেখা ‘মহম্মদ চরিত’পেয়েছিলাম পাঁচটি।অম্বিকাপ্রসাদ গোস্বামীর লেখা ‘চরিত্র গঠন’ এবং ‘ইলিয়াদ’ও প্রায় সমান সংখ্যকই পেয়েছিলাম।‘মৌ-মহাভারত’,ধ্রুব,বুদ্ধদেব ইত্যাদি কয়েকটি বইয়ের কথাও মনে আছে।বছরের পর বছর একই বই পুরস্কার হিসেবে পেয়ে আর পড়ে একঘেয়েমি লাগছিল।ঠিক তখনই কোনো একটি বছরে ‘বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন’ নামের একটি বই পুরস্কার হিসেবে পেলাম,তারমধ্যে আবার বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামটা আমার কাছে একেবারে নতুন।আমরা বই পড়তে ভালোবাসা ছেলেরা সেইসময় গো-গ্রাসে বই গিলতাম,অর্থাৎ একটা নতুন বই হাতে পড়লেই অন্য সমস্ত কাজ-কর্ম এবং চিন্তা-ভাবনা একপাশে রেখে দিয়ে বইটা দ্রুত শেষ করতে চেষ্টা করতাম।আমি আগে পড়া অন্য সমস্ত বই থেকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আমার মনকে বেশি করে গ্রাস করেছিল,কারণ বইটির বিষয়বস্তু ছিল আমার কাছে একেবারে নতুন।বইটি পড়ে আমি যখন শেষ করলাম,তখন আমি অনুভব করলাম যে আমার জীবনে এই বইটির প্রভাব হবে চিরস্থায়ী।সেই তখন থেকেই আমি মনে এরকম একটি সঙ্কল্প পুষে রেখেছিলাম যে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বিষয়ে লেখা যতগুলি বই এবং প্রবন্ধ সংগ্রহ করতে পারি সেই সমস্ত বই পড়ব এবং সম্ভব হলে আমিও তাঁর একটা জীবনী লিখব।এই জীবনীটা লিখে আমি দীর্ঘকাল ধরে মনের মধ্যে পুষে রাখা সেই সঙ্কল্প পূরণ করতে পেরেছি।কিন্তু বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বিষয়ে লেখা অনেক বই পত্র পড়েছি বলে আমি দাবি করতে পারি না,কারণ অসমে বসবাস করে বইপত্র জোগাড় করা একটি অতি কঠিন কাজ।উদাহরণস্বরূপ কার্ল ভান দোরেন লেখা যে বইটিকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন-চরিত বলে বলা হয়ে থাকে সেই বইটা আমার এখনও পড়ার সুযোগ হয় নি।তথাপি তাঁর বিষয়ে লেখা যতগুলি বই এবং প্রবন্ধ পড়েছি সেগুলি তাঁর মহত্ত্ব উপলদ্ধি করার জন্য যথেষ্ট।তাছাড়া তাঁর আত্ম-জীবনীটাও আমি পড়েছি।অবশ্য আত্মজীবনীটা তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি।অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় সেটি প্রকাশ করা হয়েছে। 

         

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...