শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৪

রম্যরচনা ।। ভোট প্রার্থী ।। কাশীনাথ সাহা, Kashinath Saha

 রম্যরচনা

ভোট প্রার্থী 

কাশীনাথ সাহা 



ভোটের দামামা বাজবো বাজবো করছে, সেই সময়ই বিছুটি দলের নেতারা এসে ধরলো, দাদা আপনাকে দাঁড়াতে হবে। আমি খাটিয়ায় বসে ছিলাম, সোজন্যতা বশতঃ উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, দাঁড়িয়েছি, বলুন কি বলবেন! নেতা বললো, আরে দাদা ও দাঁড়ানো নয়, এবার নির্বাচনে আমাদের বিছুটি দলের হয়ে আপনাকে ভোটে দাঁড়াতে হবে। আমাকে ভোটে?আমার ভোটে দাঁড়ানোর যোগ্যতা কি আছে যে আমার কথা আপনাদের মাথায় এলো? না মানে, ওই যে আপনি কবিতা লিখেন!  তো? ওটাই যোগ্যতা, অন্য সব দল ডাক্তার, উকিল,বিচারক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, ফুটবলার, ক্রিকেটার সবাইকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা নতুন কিছু খুঁজছিলাম। আপনার মতো কবি টবি জাতীয়  নতুন কিছু। আমার কবিতা আপনারা পড়েছেন? পাশ থেকে একজন বলে উঠলো, পড়েছি কিছু ই বুঝতে পারিনি। খুব দুর্বোধ্য। সেই জন্যই মনে হলো আপনি একজন বড় মাপের কবি, যাঁর কবিতা সহজে বোঝা যায় না। আমার যোগ্যতার মাপকাঠিটা বুঝতে পেরে শিহরিত হলাম! অগত্যা সকলের ধরাধরিতে বিছুটি দলের হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরদিন সকালে মা কালীর মন্দিরে, দুপুরে মসজিদে, বিকেলে চার্জে,সন্ধ্যায় গুরদোয়ারায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে ময়দানে দেড় প্যাঁচ মেরে দিলাম। প্রথম দিন প্রচারে বের হচ্ছি, বউ থালায় গোটা কয়েক বিছুটি পাতা এনে বলল,তুমি বিছুটি দলের হয়ে ভোটে লড়ছো, কপালে নিজে থেকে একটু বিছুটি পাতা ঘসে প্রথম দিনের প্রচারটা শুরু করে দাও। আমি আশীর্বাদ করছি তুমি জিতবেই জিতবে!  আমি অবাক হয়ে বললাম, সেকী,  আমি স্বামী, গুরুজন হই তোমার, তুমি আমাকে আশীর্বাদ করছো মানে!  মাথাটা গেছে না-কি?বউ গুরুজন মার্কা একটা হাসি ঝেড়ে বললো, না আমার মাথা খারাপ হয়নি, দিদিমণি লক্ষ্মীর ভান্ডার দিচ্ছে না, তাহলে আমরা হলাম,মা লক্ষ্মী স্বরূপা। মাতৃসমা। বুঝতে পারলে? পারলাম। কপালে আলতো করে বিছুটি পাতার ছোঁয়া নিয়ে অপপ্রচারে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে দু'দশটা সমর্থক। আমার ইলেকশন এজেন্ট একজন দক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তি। লাল সবুজ, গেরুয়া হলুদ সব দল পাল্টে এখন বিছুটি দলের ব্লক সভাপতি। তিনি কানে কানে বলে দিলেন, হাতটা সবসময়ই জোড় করে রাখবেন, প্রণাম করা ছাড়া খুলবেন না। হাসি মুখে হাত জোড় করে হাঁটতে লাগলাম। যেতে যেতে যাকে সামনে পাচ্ছি তারই পায়ের ধুলো মাথায় ঠেকাচ্ছি। ছোট বড় কাউকেই বাদ দিচ্ছি না। দেখলাম সকলেই হাসি মুখে প্রণাম গ্রহণও করে নিচ্ছে। কারও কোন মায়া দয়া নেই। এক জায়গায় একটা বউ তার বাচ্চা শিশুটিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বউটিকে প্রণাম করে বাচ্চাটাকেও প্রণাম করতে যাচ্ছিলাম, পাশ থেকে একজন বলে উঠলো কোলে কোলে! ইচ্ছে থাকলেও  পরস্ত্রীকে কোলে নেওয়াটা কি ঠিক হবে! বিশেষত এই জনসমক্ষে!  কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করলাম, পরের বউ, কোলে নেব কি? পাশ থেকে আওয়াজ এলো, আরে বউকে নয় বাচ্চাটাকে কোলে নিন। ও তাই বলো,কলগেট হাসি ঝরিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুললাম, পাশ থেকে সমর্থকরা পটাপট কয়েকটা ফটো তুলে নিল। পাবলিক নাকি, এইসব ভালো খায়! ইতিমধ্যে আনন্দে নয়তো ভয়ে শিশুটি নতুন পাঞ্জাবি পেয়ে একটু জলত্যাগ করে দিল। হাসি মুখে সেটাও মানতে হলো। যতো বিরক্তিকর লাগুক না কেন, মুখ থেকে হাসি মোছা চলবে না। কিছুদূর যেতেই মাঠ থেকে একজন দৌড়ে এসে জাপটে ধরলো।মাঠে কাজ করছিল ধুলো কাদায় মাখামাখি শরীর। নিয়ম মতো আমিও জড়িয়ে ধরলাম। ভোট বড়ো বালাই। জামাটার দফারফা। দুপুরে এক জায়গায় খাওয়ার আয়োজন ছিল। দেখলাম আমার পাশাপাশি হাঁটতে থাকা নেতা সমর্থকদের জন্য, মাছ ভাজা,মুরগী মাংসের ঝোল আরও গোটা কয়েক তরকারি। আমি যেহেতু ভোটে দাঁড়িয়েছি, সেজন্য আমার জন্য পান্তা, পেঁয়াজ, কাঁচা লংকা, শাক ভাজা। আমি কেমন সাধারণ জীবনযাপন করি সেটা বোঝানোই নাকি মূল উদ্দেশ্য। সেই পান্তা যখন খাচ্ছি, তখনও ছবি তুলতে লাগলো কয়েকজন, একটা টি ভির সাংবাদিক ক্যামেরা তাক করে আমার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার মুখে সাঁটিয়ে রাখলো। দুপুরে খাওয়ার পরে কয়েকজন আমার সমর্থক বললো, দাদা ছ'ঘন্টা হয়ে গেছে। আমাদের বিলটা দিয়ে দিন,সাতজন আছি  প্রত্যেকের পাঁচশো করে সাড়ে তিন হাজার। বিকেলে আবার অন্য দলের হয়ে প্রচারে বের হতে হবে। বুঝলাম। অবাধ গনতন্ত্র একেই বলে। টাকা নিয়ে ওরা চলে গেল। 

বিকেলে পুনরায় প্রচারের জন্য বের হওয়ার আগে আমার নির্বাচনী এজেন্ট অভিসন্ধি বাবু বললেন, দাদা আপনার মুখটা বড্ড ধূর্ত টাইপের। মানে পাবলিক সিমপ্যাথি আদায়ের জন্য যেমন মুখ ভোটে লাগে ঠিক তেমনটি আপনার মুখ নয়।  সে তো আমিও জানি, বউ তো  আমাকে ধূর্ত, বদমাশ, পাজির পা ঝাড়া এসব 

শব্দ দিনে দশবার বলে!কিন্তু কিন্তু করে বললাম, কিন্তু আমার মুখটাকে তো আমি পাল্টাতে পারবো না। এই মুখ টাকেই যখন নির্বাচন করেছেন তখন একে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিন। অভিসন্ধি বাবু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, একটা ছোট্ট ইনজুরি মুখে হয়ে গেলে ওটা হয়ে যাবে। ইনজুরি মানে? কাটাকাটি করবেন না-কি?  সামান্য। আমার পাটির ছেলেদের বলে দেব মাথায় একটু হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে দেবে। চোখের ঠিক উপরে। দেখবেন একটু কেটে গিয়ে চোখ মুখটা সামান্য ফুলে গেলে পাবলিক সিমপ্যাথি বেড়ে যাবে। সামান্য লাগবে, কিন্তু ভোট যুদ্ধে সেটুকু তো মেনে নিতে হবে। ওটা কাল পরশু করে দেব।মন্টাকে বলে দেব, খুব শান্তিপ্রিয় ছেলে, ওই পারবে।সদাকে বললে ও আবার ছোরা ছুরি বা বোমা বন্দুক ছাড়া কিছু বিশ্বাস করে না। সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে আপনার মতো কবি মানুষের পক্ষে।... 

প্রচারে বেরিয়ে ভোটারদের নানান আবদার শুনতে হচ্ছে। জমিজমার সমস্যা, চাকরি চাই, এসব তো আছেই, একজন এসে বললো, দাদা আমার বউ একমাস হলো রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। আমি আনতে গেলেও আসছে না, আপনি দাদা পাটির লোক ( ভাগ্য ভালো যে পটি-র লোক বলেনি!) একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে এনে দিন। কথা দিচ্ছি বউ ফিরে এলে দু'জনেই আপনার দলকে  কলকে চিহ্নে ভোট দেব। আর একজন এসে অভিযোগ জানালো, দাদা আমরা মদ খাই বলে কি মানুষ নই! সরকার পেট্রোল ডিজেল গ্যাসের দাম কমালো, লক্ষ্মী ভান্ডারে টাকা বাড়িয়ে দিল, আমাদের সামান্য নেশার জিনিস মদের দামটা একটুও কমালো না। এটা সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ নয়? অভিসন্ধি বাবু বলে দিয়েছেন, সকলকেই সন্তুষ্ট করতে হবে। পারিব না একথাটি মুখে উচ্চারণ করা, নৈব নৈব চ। সকলকেই প্রতিশ্রুতি দিলাম। সকলের সব সমস্যার সমাধান করে দেব। মদের দাম শুধু কমাবো না,আমাদের দল ক্ষমতায় এলে সপ্তাহে দু'দিন মদ ফ্রী করবোই করবো। এই কয়েকদিনের মধ্যে মিথ্যা কথাটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছি। আগে যেমন কলম ধরলে কবিতা বের হতো, এখন মুখ খুললেই প্রতিশ্রুতি গলগল বের হচ্ছে। সেদিন একটা জনসভায় মহিলাদের প্রতিশ্রুতি দিলাম, যে সমস্ত মহিলা বিধবা ভাতা পাচ্ছেন না বলে দুঃখ পাচ্ছেন, তাঁদের জানাচ্ছি এবার থেকে আপনারা বিধবা না হলেও বিধবা হওয়ার আবেদন করলেই দু হাজার টাকা করে বিধবা ভাতা পাবেন। বলার সাথে সাথে যা হাততালি পড়লো তাতেই বুঝতে পারছি, আমার জয় আটকাবার ক্ষমতা কোনও মাঈ কী লালের নেই। আমি জিতবোই জিতবো...

সেদিন প্রচার সেরে বাড়ি ফিরতেই বউ আদুরে গলায় বললো, তুমি না খুব ভালো, তোমার মতো লোক হয় না, শোন না, ওই বিধবা ভাতার টাকাটা দু’হাজার টাকা নয় ওটা পাঁচ হাজার করে দিও। তাতে আমারও একটু সাশ্রয় হবে। তবে তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি, আমি কিন্তু সরকারকে ঠকাবো না, বিধবা না হয়ে কিছুতেই ওই বিধবা ভাতা-র  টাকা স্পর্শ করবো না।


শেষ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...