রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১

 পাখিদের পাড়া পড়শী - ১০ ।। পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  Pankaj Gobinda Medhi,

পাখিদের পাড়া পড়শী - ১০ 

পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,  Pankaj Gobinda Medhi,




(দশ)

নিজের নিত্যকর্মাদি সমাপন করে সকালবেলা আমি প্রাকৃতিক চেয়ারে বকের সন্ধানে এসে বসলাম ।

ততক্ষনে আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল । বকের ছোট ঝাঁকটিকে আমি আজও দেখতে পেলাম না। কিন্তু আজ যে আমি সারাদিন অপেক্ষা করব। কিশোর কুমার চৌধুরী আমাকে দেওয়া বক বিষয়ক লেখাটির আমি আমার ক্যামেরার ব্যাগটিতে  ভরিয়ে নিয়ে এসেছি।  বকগুলি অপেক্ষা করে থাকা  সময়টুকুতে আমি পুনরায় আউরানোর চেষ্টা করব। 

আমার সামনের জলরাশিতে কয়েকটি পাখি উড়ে এসে পড়ল এবং ওরা জলকেলি করতে লাগল। পাখি কয়েকটিকে দেখে আমি প্রথমে পানকৌড়ি বলে ভেবেছিলাম। আসলে সেগুলি কৈলাঙী পাখি। ইন্ডিয়ান কর্মোরেট। ফেলাক্র'ক'রাস্ক ফিউসিক'লিছ। লিটল কর্মোরেট বা পানকৌড়ি এবং কৈলাঙী বা ইন্ডিয়ান কর্মোরেটের মধ্যে আমার কখনও কখনও গন্ডগোল লেগে যায় । দুই ধরনের পাখির রং কালো । কিন্তু কৈলাঙী পাখির থুতনি এবং ঠোঁট জুড়ে স্পষ্ট সাদা এবং পিছনের দিকের ডানায় কিছু পরিমাণে সাদা দাগ থাকে । পানকৌড়িকে আমি প্রায়ই ডানা মেলে বসে থাকতে দেখি কিন্তু কৈলাঙী  পাখিকে সেভাবে বসে থাকতে দেখিনি। পাখিগুলি আমার সামনে এটা ওটাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানোয় জল বিহারের মজা অনুভব করছে। আমারও জলে  নেমে গিয়ে দুহাত মেলে ওদের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা হলেই সব কাজ করা যেত যদি।

আমি কিশোরকুমার চৌধুরীর তথ্যটুকু বের করে নিলাম। তথ্য অনুসারে বক সংকটাপন্ন প্রজাতির প্রাণী।

বর্গীকরণ পদ্ধতিতে বকের অবস্থানও স্পষ্ট করে এই তথ্যসমূহ দেখানো হয়েছে। জগত, কিংদম– অ্যানিম্যালিয়া, পর্ব, ফাইলাম–ক'রডাটা; শ্রেণী, ক্লাস–এভছ,বর্গ, অর্ডার-চিকনফরমিছ,গোত্র,ফেমিলি –চিক'নাইডি ;গণ,জেনাস–লেপ্ট'পটিলস: প্রজাতি, স্পেশিস,-এল,ডুবিয়াছ এবং শেষে  লেখা আছে বৈজ্ঞানিক নাম–লেপ্ট'পটিলস ডুবিয়াছ।

বক স্টর্ক গোত্র চিক'নাইডিরের অন্তর্ভুক্ত। এর গণে আছে হাড়গিলা, লেসার অ্যাডজুভেন্ট স্টর্ক এবং আফ্রিকায় পাওয়া মারাবু স্টর্ক । এক সময়ে এই পাখিগুলি দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে ভারতবর্ষ থেকে বোর্ণিও পর্যন্ত পাওয়া যেত। বক এখন কেবল ভারতবর্ষ এবং কম্বোডিয়াতে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের অসমে । বসবাসের ভিত্তিতে বকের বিচরণভূমি তিন প্রকারের । ব্রীডিং রেঞ্জ- যেখানে পাখিগুলি ডিম পেড়ে বাচ্চার জন্ম দান করে,রেসিডেন্ট নন ব্রিডিং রেঞ্জ সেখানে বসবাস করে কিন্তু ডিম পেড়ে বাচ্চা দেয় না এবং তৃতীয়তঃ সিজনেল নন ব্রিডিং রেঞ্জ– মাঝেমধ্যে সেখানে আসে কিন্তু ডিম পেড়ে বাচ্চা দেয় না।

আমি লক্ষ‍্য করেছি বক প্রজাতির পাখিরা বরকুরিহা এবং এর আশেপাশে বছরের বিভিন্ন সময় বসবাস করে এবং এখানে ডিম পেড়ে তা দিয়ে বাচ্চার জন্ম দেয় । সংখ্যায় অনেক কম হলেও এই অঞ্চল বকের ডিম পেড়ে জন্মদেবার স্থান - ব্রিডিং রেঞ্জ।

বগলছ চকের  হোটেলের মালিক কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন – বক পাখিরা কয়েক বছর আগে নলবারী শহরের মাছের বাজারের কাছে উচ্ছিষ্ট মাছ-মাংস খাবার জন্য এখান থেকে সেখানে যেত। আজকাল সেখানে মাছ-মাংসের  উচ্ছিষ্ট ফেলা হয় না তাই বকের আহারের অভাব। মাঠের মধ্যেও পোকামাকড় ব্যাঙ ইত্যাদি পাওয়া যায় না । সার এবং কীটনাশক  সব মেরে শেষ করে দিয়েছে ।

মালিকের কথায় আমি রাজি হয়েছিলাম । আমার হাতে থাকা তথ্যসমূহের পাতা উল্টে গিয়েছিলাম । সেখানে বকের বিষয়ে সন্নিবিষ্ট বর্ণনায় লিখেছে – বক পাখির ঠোঁটের অগ্রভাগ সূঁচলো এবং পেছনটা বিস্তৃত । মাথায় টাক। গলায় ডানা নেই। গলার শেষ এবং বুকের  শুরুতে একটি থলে আছে। অনেকে মনে করে বক সেখানে খাদ্য জমা করে রাখে। কথাটা সত্যি নয়। ১৮২৫ সনে ডক্টর জন অ্যাডাম বকের উপরে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছিলেন যে এই থলেটা আসলে খাদ্য তন্ত্রের সঙ্গে নয় শ্বাসতন্ত্রের সঙ্গে সংলগ্ন। কিন্তু এর মূল কাজ কী সেটা এখনও জানতে পারা যায় নি। আমি পড়ে গেলাম।

– বককে হাড়গিলা বলেও বলা হয়। হাড়গিলা শব্দটিমূল সংস্কৃত হাড্ডিগিলা থেকে এসেছে। ইংরেজি শব্দ অ্যাডজুটেন্টটো আবার বকের সামরিক কায়দায় চলাফেরা থেকে উদ্ভূত।

তথ্যাদির একটি পাতায় লেখা আছে–

– ওজন মাপতে হলে একটি বকের ওজন ৮ থেকে   থেকে ১১  কেজি পর্যন্ত হয়। প্রায় ১৩ ইঞ্চি দীর্ঘ ঠোঁটে বক উচ্ছিষ্ট খাদ্য খুঁজে বেড়ায়। উচ্ছিষ্ট খাদ্যে মাথায় ঢুকাতে হয় বলে প্রকৃতি পাখিগুলোর মাথায় ডানার ব্যবস্থা রাখেনি। উড়ার জন্য বক তার দুই ফুট দীর্ঘ ডানা দুটি ব্যবহার করে। প্রয়োজন অনুসারে বক কিছু দূরত্ব পর্যন্ত মাটিতেও দৌড়াতে পারে। পাখি গুলির মধ্যে পুরুষ এবং স্ত্রী বুঝতে অসুবিধা হয়। ডিম পাড়ার সময় পাখিদের মধ্যে বাহ্যিক পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময় বকের গলার থলেটা উজ্জ্বল কমলার রং ধারণ করে। পায়ের উপরের অংশ মেটেরঙ থেকে রঙ্গিণ বর্ণে পরিবর্তিত হয়। অন্য ষ্টর্কজাতীয় প্রাণীর মতো বকের স্বর পেশী নেই বলে অন্য বহু পাখির মতো সুললিত কন্ঠে ডাকতে পারে না । বক পাখি উপর এবং নিচের ঠোঁট দুটো ধাক্কা দিয়ে শব্দ করে এবং প্রজননের সময় গলা দিয়ে বিভিন্ন শব্দ বের করার চেষ্টা করে ।

কিশোর কুমার চৌধুরী আমাকে দেওয়া তথ্যসমূহ পড়ে  আমি কেবল বক পাখির শারীরিক গঠন, শরীর বিকাশ প্রক্রিয়া, চরিত্র, খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান, বিভিন্ন সময়ে পাখির নামের পরিবর্তে আজকের নাম গ্রহণই নয় , পাখিগুলির প্রতি থাকা মানুষের অন্ধবিশ্বাস এবং ধারণা বিষয়ক সম্যক জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হলাম। অন্ধ বিশ্বাসের উদ্ধৃতিতে তাতে লেখা আছে–' মোগল বাদশাহ বাবর সংরক্ষিত করা তথ্য অনুসারে বকের মাথায়' সর্প শিলা' নামে এক ধরনের শিলাখণ্ড থাকে। শিলাখণ্ডের সাহায্য নিয়ে সাপের বিষ এবং অন্যান্য বিষ নিরসন করা যেতে পারে। সেই সর্পশিলা আহরণ করার জন্য শিকারিকে অত্যন্ত দক্ষ হতে হয়। সেই  সময়ে কথিত ছিল যে পাখিটাকে নিধন করার সময় ঠোঁটটি ভূমি স্পর্শ করলে সর্পশিলা তখনই বাষ্পীভূত হয়ে যায়। গলাটা দীর্ঘ এবং ঠোঁটটির ওজন বেশি হওয়ায় শিকারি হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটটি মাটি স্পর্শ করেছিল  এবং তার ফলে সর্পশিলা আহরণের নামে যথেষ্ট বককে হত্যা করা হয়েছিল অথচ তারা সর্পশিলা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি ।

অন্য একটি পৃষ্ঠায় লেখা আছে– সেই সময়ের বৈদ্যরা বিশ্বাস করতেন যে সুপারির সঙ্গে বকের শুকনো মাংসের টুকরো চিবিয়ে খেলে কুষ্ঠ রোগ নির্মূল হয়। এটা ছিল নিতান্তই মিথ্যা কথা এবং বক পাখি শিকার করার জন্য ব্যবহৃত একটি অজুহাত।

তথ্য রাজ্যের মধ্যে আমি একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য লাভ করতে সমর্থ হলাম। তাতে উল্লেখ করা অনুসারে–১৮০০ সনের পরবর্তী সময়ে গ্রীষ্মকালের বৃষ্টি বাদলের আবহাওয়ায় কলকাতার নদীর ঘাট অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে বক দেখা যেত। কিন্তু ১৯ সনের পরবর্তী কয়েকটি দশকের পরে নগর পরিষ্করণ প্রক্রিয়ার জন্য বক পাখি সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়। বক পাখিকে গুরুত্ব প্রদান করে কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের পুরোনো প্রতীক চিহ্নটা মুখোমুখি করে থাকা দুটি বক পাখি সাজানো হয়েছিল। কলকাতায় এমনকি আইন প্রণয়ন করে বক পাখিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কেউ বক পাখিকে হত্যা করলে ৫০ টাকা জরিমানা হিসেবে আদায় করার ব্যবস্থা আইনে রাখা হয়েছিল।

মাথার উপরে শো শো শব্দ করে আসা পাখিটার শব্দে আমি কাগজের স্তূপটা একপাশে রেখে মাথার ওপরের দিকে তাকালাম। পাখার শব্দ তুলে একটা বক এসে উঁচু শিমুল গাছের ডালে বসল। ডানা- মাথা এবং ঠেং নাড়াচাড়া করে পাখিটা সমতা রক্ষা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ভারসাম্য রাখার জন্য ডানা দুটি বিস্তারিত ভাবে মেলে দিয়ে ধীরে ধীরে বন্ধ করছে এবং শরীরটা নাড়াচাড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নড়তে থাকা গাছের ডালটা সুস্থির হওয়ার জন্য পাখিটা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা আমি দেখতে পেলাম।

কিছুক্ষণ পরে অন্য একটি পাখি উড়ে এসে গাছের ডালে আশ্রয় নিল।

দশ পনেরো  মিনিট পরে অন্য একটি। প্রায় দেড় ঘণ্টা সময়ে  গাছ দুটিতে  পাঁচটা পাখির উপস্থিতি আমি দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ আগেই পড়া তথ্য রাজিতে আমি জানতে পেরেছি – প্রজননের সময়ে বকের গলা এবং থলেটা উজ্জল কমলার বর্ণ এবং পায়ের উপরের অংশ মেটে রঙ  থেকে  রঙ্গিণ বর্ণে পরিবর্তিত হয়। বাইনোকুলারটা দুই চোখে লাগিয়ে আমি প্রথমে ওরা প্রজনন আবর্তে আছে কিনা দেখতে চাইলাম। একবার হয় বলে মনে হল, অন্যবার হয় না বলে মনে হল। অনভিজ্ঞতার জন্য আমার সেরকম হয়েছে বলে নিজেই সন্তুষ্টি লাভ করলাম যদিও আমি বারবার গলা এবং থলে  নিরীক্ষণ করতে থাকলাম।

দেখতে পেলাম আলাদা করে থাকা একটা বক গাছের একটা ডাল ঠোঁট দিয়ে ভেঙ্গে এনে অন্য একটি পাখির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। ইস। জীবনে প্রথমবারের জন্য দেখতে পেলাম পাখির প্রেম নিবেদন। যে পাখিটা ডালটা এগিয়ে দিয়েছিল সেই পাখিটা অন্য পাখিটার দীর্ঘ একটা ঠেং ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরেছে এবং ঠোট জোড়া  অন্য পাখিটার ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেছে। কী কথা বলছে পাখি দুটো– অমি বুঝতে পারছি, বলতে গিয়ে দেখি আমার ভাষার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেই বিষয়ে আমি হয়তো অনভিজ্ঞ।

প্রজননের সময় পুরুষ বক পাখি ঠোঁটটা  ওপর করে অন্য বক পাখিকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করে এবং নিজের বাসার জন্য একটা নির্দিষ্ট এলাকা দখল করে নেয়। আমি বাইনোকুলার দিয়ে চেয়ে থাকা সময়টুকুতে দুটো পাখিকে সেরকম করতে দেখলাম। সম্ভবত সেই দুটি পুরুষ বক। সংসার পাতার ইচ্ছায় নিজেদের ঘর বাড়ি তৈরি করার কথা চিন্তা করছে। বক গুলির লম্ফঝম্প, উড়াউড়ি মাঝেমধ্যে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখতে সত্যি আমি বক গুলির উপস্থিত হওয়ার পরবর্তী সময়টুকু পার করে দিলাম । দুপুরবেলা প্রায় দুটোর সময় বক গুলি এক এক করে কোথায় উড়ে গেল । কাছের জলাশয় বা মাঠে  উড়ে যাওয়া বলে আমার মনে হল । অনুমান করলাম ঠিক সন্ধে বেলা ওরা আবার ফিরে আসবে । ওরা আসে নাকি দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলাম। 

আমাকে আশ্বাস দেবার জন্য বক গুলি এক এক করে  সন্ধ্যেবেলা পুনরায় ফিরে এল। ওদের নিরীক্ষণ করে আমি স্থির করলাম যে বক গুলি এক এক করে উড়ে যায় এবং ফেরার সময়ও  এক এক করে ফিরে আসে অর্থাৎ তারা দল বেঁধে থাকে না। শিকারের সন্ধানে একে অপরের কাছ থেকে কিছুটা দূরে থাকে। ফিরে আসার সময়ও সেই সময় এবং দূরত্বের ব্যবধান মেনে চলে।

ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। ফুরফুরে বাতাস আমাকে কাঁপিয়ে  দিয়ে গেল। দশ পনেরো মিনিট সময়ের মধ্যে চার পাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল।   ফিরে আসতে রাত হবে বলে ধরেই নিয়েছিলাম বলে সঙ্গে টর্চটা নিয়ে গিয়েছিলাম। গত কয়েকদিন একই রাস্তা ধরে আসা-যাওয়া করার ফলে আমার পায়ের চাপে বন‍্য ঘাসলতা বসে গিয়ে মানুষ আসা-যাওয়া করা একটি ছোট পথের সৃষ্টি করেছে। আমি সেই পথ দিয়ে ফিরে আসতে চলেছি। অরণ্য অঞ্চল ছোট হলেও,বাঘ-ঘোং না থাকলেও আমি অরণ্যকে উপহাস করতে চাইনা।

আমার সামনে দিয়ে কিছু একটা দৌড়ে চলে গেল। জন্তুটার আকার দেখে আমি খরগোশ বলে ভাবলাম। জন্তুটা যেদিকে  গিয়েছে সেদিকে টর্চের আলো ফেলে ও কিছুই দেখতে পেলাম না। আমার বাপুটির  কথা মনে পড়ল। সে সঙ্গে থাকলে আস্তিক নাস্তিক বলে অথবা কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে কতনা দেবতাকে ডাকাডাকি করত।

আমার অবচেতন মন আমাকে সজাগ করে তুলল। আমি অনুভব করলাম কিছু একটা আমাকে অনুসরণ করছে। সম্ভবত আমার সামনে দিয়ে পার হয়ে যাওয়া জন্তুটা পুনরায় ফিরে এসে আমাকে পেছন থেকে লক্ষ করছে। আমি হঠাৎ দাড়িয়ে পড়লাম এবং পেছনদিকে টর্চের আলো ফেলে চারপাশ আলোকিত করে তুললাম। উহু । দেখতে পেলাম না। নিজের সাম্রাজ্যে সবাই রাজা।

ফুরফুরে বাতাস নদীর দিক থেকে অর্থাৎ আমাদের পেছন দিক থেকে বৈছিল। কিছুদূর আসার পরে আমার নাকে এক ধরনের সুগন্ধ এসে লাগল। আমার বুঝতে বাকি রইল না। আমার পেছন পেছন কে আসছে আমি মুহূর্তের মধ্যে চিনে ফেললাম।এটা একটি ভাম ,সিবেট,ভাইভেরা জাইকেরথার ছাড়া অন্য কিছু নয় । আমার অনুমান যদি ভুল হয়ে না থাকে তাহলে ভামটির সঙ্গে সাত-আট মাসের দুই তিনটি বাচ্চা থাকা উচিত। এপ্রিল-মে মাস ভামের বাচ্চা প্রসব করার সময়। বাচ্চা সঙ্গে থাকা বলে আমাদের ভয় দেখানোর জন্য এবং বাচ্চাদের সাহস দেবার জন্য হয়তো ভামটা আমাদের অনুসরণ করছিল ।

ফিরে আসার পথে আমার অন্য কোনো সমস্যা হল না। ভামটা বাচ্চাদের সঙ্গে নিজের পথে চলে গেল।

আমি তো একদিন সারারাত আমার জন্য সাজিয়ে রাখা প্রাকৃতিক চেয়ারটাতে বসে বকগুলিকে নিরীক্ষণ করব বলে মনে মনে স্থির করে রেখেছিলাম। তার জন্য আমি শুক্লপক্ষের রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। সেই রাতের কথা কল্পনা করে আমি পুলকিত হয়ে পড়ি। জিম করবেটের  শুক্লপক্ষের রাতে বাঘ শিকার করতে যাওয়ার কথা আমার মনে পড়ে । অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমি মৃত গাছটার গোড়ায় যাব । ঠান্ডার জন্য খুব একটা মশা নেই যদিও দুই একটা মশা বের হতে পারে । মশা যাতে কামড়াতে না পারে সেই জন্য দেহের কাপড় দিয়ে ঢেকে না রাখা অংশে একটু মলম মেখে নিতে পারলে ভালো কথা হবে । ঠান্ডা যেন না লাগে সেভাবে জ্যাকেট পরে নেব । ধীরে ধীরে নদীর ওপার থেকে চাঁদ বেরিয়ে আসবে। চাঁদকে বক গুলির পেছনদিকে পর্দা করে রেখে সুন্দর সুন্দর ফটো নেবার চেষ্টা করব। চাঁদ মাথার উপর চলে এলে মধ্যরাত হবে। আমি মাঝেমধ্যে বাইনোকুলার বের করে পাখিগুলিকে দেখার চেষ্টা করব । রাতের আলোতে বাইনোকুলারের বিশেষ কোনো কাজ নেই। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া এবং সময় পার করার জন্যই কেবল বাইনোকুলারের ব্যবহার হতে পারে । যদি আমার সঙ্গে একটা ইনফ্রা রেড ক্যামেরা থাকত।

দিনের পর দিন পরে থাকা কাপড়গুলি নাম বদলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি পাখিদের প্রতিবেশীর কথা ভাবছিলাম। পুকুরে গিয়ে হাত মুখ ধোয়ার জন্য হাত দুটি বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা বলে মনে হচ্ছে । হাত দুটো মুঠো করে দুই বগলের মধ্যে ঢুকিয়ে শরিরটাকে গরম করে তোলার চেষ্টা করছি।

এক কাপ চায়ের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি করে উপলব্ধি করছি। দিনের-পর-দিন ক্যামেরাটা ব্যবহার করছি। ব্যাটারীতে চার্জ করার প্রয়োজন হবে, না হলে আগামীকাল অসুবিধায় পড়তে পারি। দুই প্রয়োজন পূরণ করার জন্য আমি কাকার বাড়িতে যাওয়াটা সমীচীন হবে বলে মনে মনে স্থির করলাম।

পোশাক পাল্টে ক্যামেরা এবং মোবাইলের চার্জার দুটো নিয়ে আমি সোজাসুজি কাকার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ধীরে ধীরে আশেপাশের এবং থানে আসার মানুষগুলি আমার উপস্থিতির কথা জানতে পেরেছে। আমার উদ্দেশ্য বিষয়ে কি জানি হয়তো আমার অলক্ষিতে তারা আলাপ-আলোচনাও করেছে। আমি জানিনা কেবল আমার মনে হওয়া ভাব এটা।

– কাকা।

দরজায় টোকা  দিয়ে আমি কাকিমাকে ডাকলাম।না, বা কোনো উত্তর নেই। কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ভালো লাগল না। আমার কন্ঠস্বর প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কম হয়েছিল নাকি?

– কাকু।

এবার একটু জোরে ডাকলাম।

– কে?

আমি কাকু।

কে বলে যে জিজ্ঞেস করল তিনি কাকু নন। কোনো নারী কন্ঠ।

দরজা খোলার শব্দটা আমার বুকের কোনো অপরিচিত জায়গায় অদ্ভুত শব্দে ঝন ঝন করে উঠল।

– আসুন।

আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম।

একজন আধবয়সী মহিলা। সম্ভবত কাকিমা। সেদিন আমি যখন এসেছিলাম কাকিমার সঙ্গে দেখা হয়নি। 

– উনি নেই।

– আপনি কাকিমা।

– হ্যাঁ। তুমি আস বলে সেদিন উনি বলেছিলেন। আমি পাশের একটা বাড়িতে গিয়েছিলাম। সত্যনারায়ণের পুজো ছিল। উনাকে যেতে বলেছিলাম, যাবেন না বললেন। আমাকেই যেতে হল।

কথাটা বলে মানুষটা হাসলেন।

– বস বস। তোমার কাকা এখুনি চলে আসবে। বাজারে গিয়েছে। মানুষটা বাজারে বেশিক্ষণ থাকে না। তার মনের সঙ্গে না মিললে কথা বলতে ভালোবাসে না।

কথাবার্তায় বেশ আত্মীয়তা থাকার মতো মহিলার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল।

আমি সেদিন বসা  চেয়ারটাতে আজও বসে পড়লাম।

মানুষটা আমার হাতের চার্জার দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন– 'তুমি মোবাইল চার্জ করবে। কর। আমি একটু ভেতর দিকে আসছি। একা একা বিরক্ত অনুভব করবে না তো!

– না, না বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। আমিতো দিনের বেশিরভাগ সময় একাই থাকি।

আমি মোবাইলটাতে চার্জার সংযোগ করে প্লাগে ভরিয়ে দিলাম। চার্জে দিলে আমি মোবাইল সুইচ অফ করে রাখি না, আজও রাখিনি।

ককার আসার অপেক্ষায় রয়েছি। মাঝখানে কাকিমা এসে এককাপ চা, দুটো বিস্কুট, একমুঠো ভুজিয়া এবং একটা সিদ্ধ ডিম দিয়ে গেল।

– খেয়ে নাও।

টেবিলের উপরে থাকা গঙ্গাপুকুর হাই স্কুলের বার্ষিক মুখপত্রে চোখ বুলোতে  থাকা আমি না বলে মাথা নাড়লাম ।

মানুষটার কাজের ব্যস্ততা ছিল বোধহয়, কথাটা বলেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন – আমার সেরকমই মনে হল।

ছোট ছেলেমেয়েরা লেখা কিছু কথা কাহিনি পড়তে আমি খুব ভালোবাসি। বিশেষ করে রহস্য জাতীয় লেখা পড়ে আমি বেশ মজা পাই । দৈনিক খবরের কাগজে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ পৃষ্ঠার লেখাগুলি আমি সুবিধা পেলেই পড়ে দেখি। তার মধ্যে তাদের প্রকাশ পাওয়া বিভিন্ন লেখার মধ্যে কবিতা এবং গল্প ও থাকে। সাধারণত এই লেখাগুলি অন্যেরা লিখে দেয়। অভিভাবক অথবা অন্য কোনো বয়স্ক ব্যক্তি। নাহলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র বা ছাত্রী একজন কীভাবে প্রেমের সূক্ষ্ম অনুভূতি বুঝতে পাারে কবিতা লিখতে পারে তা আমি জানিনা। ছোট ছেলেমেয়েদের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গভীর ধরনের লেখা পড়ে  আমার এরকমই ধারণা হয়। 

মোবাইলটার আওয়াজে আমি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কল্পনার পৃথিবী থেকে ফিরে এলাম। মোবাইলের স্ক্রিনে নম্বরটা দেখে আমি সচকিত হয়ে উঠলাম।ম্যানেজার স্যারের ফোন।

–হ্যালো স্যার।

– হ্যালো। বিশেষ দরকারে আপনাকে ফোন করেছি।

– হ‍্যাঁ,স্যার।

– পরশুদিন ইনস্পেকশনের জন্য সেন্ট্রাল টিম আসছে। তাই আপনার ছুটি ক্যানসেল করা হয়েছে। আশাকরি পরশুদিন আপনি জয়েন করবেন। ঠিক আছে!

এর অন্যথা বলার আমার কোনো উপায় ছিল না। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা হল। আমাদের ব্যাংক কর্মচারীদের ছুটি যেকোনো মুহূর্তে রদ করা যেতে পারে। এইক্ষেত্রেও সেরকমটাই হয়েছে। আমার পরিকল্পনায় যতি পড়ল।

– কী ভাবছ?

দরজাটা ঠেলে ভেতরে চলে আসা কাকা আমাকে সোজাসুজি এই প্রশ্নটা করলেন।

–এখানে দুদিন থাকব বলে বড় আশা করেছিলাম।

–কী হয়েছে তোমার ?

– ম্যানেজার স্যার ফোন করে সেন্ট্রাল ইনস্পেকশন টিমে আসবে জানিয়ে আমার ছুটি ক্যানসেল করে দিয়েছে।

– এখন কী করবে?

– যেতেই হবে কাকা। কাল সকালেই যেতে হবে।

–এত দৌড়াদৌড়ি করে।

– আমাদের কাজগুলিই যে এই ধরনের।

– আবার কবে আসবে?

– যত তাড়াতাড়ি পারি আসব কাকা। আমি গিয়েই  আবার  ছুটির জন্য আবেদন  করব। দেখি কী বলে। 

– আমার ছেলের বিয়ে ঠিক করেছি, তোমাকে আসতেই হবে।

– আপনার ছেলের? কবে? তার কথা তো আমাকে সেদিন বলেননি। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নি।

বলার মতো সেরকম সুবিধা পাইনি। ছেলে এখানে থাকে না, ছত্তিশগড়ে থাকে। সৈন্যবাহিনীতে চাকরি করে।

-- সুন্দর। বিয়ের পাত্রী ঠিক হয়ে গেছে তাহলে।

– বিয়ের দিন

 ঠিক হয়ে গেছে। রহার দিকের মেয়ে।

– কাকা, আমি আসতে চেষ্টা করব। নিশ্চয় চেষ্টা করব।

মানুষটার মনে আমি প্রত্যয় জন্মাতে চেষ্টা করলাম।

– তোমার ফোন নাম্বারটা দাও।

কাকু এগিয়ে দেওয়া সাদা কাগজটাতে আমি আমার নামটা এবং তার নিচে ফোন নাম্বার লিখে দিলাম। কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরে তিনি আমার নামটা বিশেষ ধরনে উচ্চারণ করে পড়তে লাগলেন–

–উ  দ  য়  শ  ং  ক র।

আমি মানুষটার মুখের ভাব ভঙ্গি পড়তে চেষ্টা করলাম।

তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি দেখা গেল না, যদিও মানুষটা আমার নামটা নিয়ে কিছু একটা করতে চাইছে, এটা আমার মনে হল। কথা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার ইচ্ছায় আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম– বিয়ের দিন এগিয়ে আসায় আপনাকেও নিশ্চয়ই প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। ছেলে যেহেতু দূরে থাকে আপনার উপরে অনেকটা দায়িত্বই পড়েছে। তাই নয় কি? 

– ঠিক বলেছ। সমস্ত দায়িত্বই আমার ওপরে। ছেলে আসবে বিয়ে করবে আবার চলে যাবে। কত দিন আর ছুটি পাবে সে? খুব বেশি এক মাস বা দু মাস।

আমি মাথা নেড়ে ফৌজে চাকরি করা মানুষের প্রতি সমাজ জানানো সমবেদনার অংশীদার  হলাম।

মানুষটা ছেলের বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন।

জানি কাকার ছেলের বিয়ের সময় পাখিদের প্রতিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়বে। আমি জানিনা সবগুলি সেই সময়ে পাখিদের প্রতিবেশী হয়ে থাকবে কিনা। তবুও আমি ওদের খুঁজে আসব হরগোবিন্দ ডেকার ছেলের বিয়ের অজুহাত নিয়ে।

যাবার সময় পুরোহিত শর্মা এবং সুনন্দকে বলে যেতে হবে। কাকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি সুনন্দকে ফোন করলাম। সুনন্দ নলবারী শহরে গিয়েছে। আমি তাকে আগামীকাল সকাল বেলা পাখিদের অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার কারণ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে বললাম। থাকতে না পারার দুঃখ প্রকাশ করে আমি সুনন্দকে বললাম – কাকার ছেলের বিয়ের সময় তোমার সঙ্গে দেখা হবে সুনন্দ। এবার তোমার সঙ্গে দেখা হল না। 

সুনন্দ তার প্রতিক্রিয়া জানাল।

কথাপ্রসঙ্গে সনন্দ দুঃখ প্রকাশ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল– আপনার সঙ্গে দেখা করার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, এবার হল না। আশা করছি, আপনার সঙ্গে শীঘ্রই দেখা হবে।

– নিশ্চয় সুনন্দ। পুরোহিত শর্মার সঙ্গে দেখা হবে কিনা জানিনা, বাড়ির চাবি দেওয়ার কথা ছিল যে।

চাবি কোথায় কীভাবে রাখতে হবে সুনন্দ আমাকে বুঝিয়ে বলল, বাকি কাজটুকু সেই করবে।

সুনন্দ আমার একটা গুরুতর সমস্যার সমাধান করে দিল। পুরোহিত শর্মার জন্য অপেক্ষা করতে হলে দিনের অর্ধেকটা সময় মিছামিছি নষ্ট হত। এখন  আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে পারব। তবু আমার খারাপ লাগল– পুরোহিত শর্মা আর বাপুটিকে একবার বলে যাওয়াটা  আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাদের আমার সমস্যাটা বুঝিয়ে বলার জন্য যাবার সময় আমি পুনরায় সুনন্দকে  ফোন করে অনুরোধ জানালাম।

সেই জন্যই আমার মনে পুনরায় সেই একই প্রশ্নের উদয় হল।

– আমার ক্ষেত্রেই কেন বারবার এরকম হয়?

অন্য অনেক প্রশ্নের উত্তর না থাকার মতো এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর আমার কাছে ছিল না।


     















 





 








 










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...