সোমবার, ২২ জুন, ২০২০

শীলাবতী অববাহিকার ইতিহাস ও কৃৃষ্টি ৪ || মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি || প্রতি সোমবার

শীলাবতী অববাহিকার ইতিহাস ও কৃৃষ্টি
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

৪ ||

শীলাবতী নদী অববাহিকার হুমগড় এলাকার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-এলাকায় 'রামাইত গোস্বামী'দের বসবাস।বাঁকুড়ার মতো পশ্চিম মেদিনীপুরেও উৎকল ব্রাহ্মণ শ্রেণির বসবাস রয়েছে। এই উত্কবল ব্রাহ্মণ সমাজ সাধারণত উড়িষ্যার অধিবাসী। কিন্তু এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল ব্যাপী তাদের বসবাস কেন বিষয়টি
গবেষণা সাপেক্ষ। এই উচ্চ সংস্কৃতির সমাজ ছাড়াও দীর্ঘকাল ব্যাপী অনার্য অন্ত্যজশ্রেণির লোকেরাও এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল বসবাস করে এসেছে। সাঁওতাল, মাহালি, ভূমিজ প্রভৃতি আদিবাসী জনজাতি যেমন আছে তেমনই বাউরি, বাগতি, ডোম প্রভৃতি জাতি গোষ্ঠীর মানুষ তাদের স্ব স্ব সংস্কৃতি নিয়ে বিদ্যমান। তাম্বুলি, সদগোপ, তিলি, গোপ, কৈবর্ত্য, ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষও অনেক আছে। তবে সবচেয়ে একটা বড়ো সম্প্রদায় যারা আছে তারা হল মাহিষ্য সম্প্রদায়। কিছু গ্রাম আবার সম্পূর্ণ মুসলমান অধ্যুষিত। মায়তা, গড়বেতা, মাল্লা, কাঁকড়াশোল, পাটপুর, লক্ষ্যাটাপল, শিমুলিয়া, কুলডাঙ্গা, লোধা, জান্দা, বৃকভানুপুর, রাজবল্লভপুর, মালবান্দি, কিশোরপুর, গড়বেড়িয়া, বলদঘাটা, গোপালপুর, বিরাজপুর,
কেশেডাল,  রঘুনাথপুর, লাউমারা, খুড়শি, ধর্মপোতা, চৈতন্যপুর, নিত্যানন্দপুর, পলাশচাবড়ি, কড়াশিয়া প্রভৃতি গ্রামগুলি একেবারে শীলাবতী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। প্রায় সবগুলিই মাহিষ্য অধ্যুষিত গ্রাম। এলনা গ্রামে জেলে কৈবর্ত্যের বসবাস। গড়বেড়িয়া ও কিশোরপুর গ্রামে কিছু মানুষ কুম্ভকার সম্প্রদায়ের। আবার দেওয়ান, মহেশপুর, কল্লা গ্রামগুলিতে অধিক সংখ্যক জনগণ মুসলমান সম্প্রদায়ের। বড়াই গ্রামে সদগোপের পাশাপাশি ডোম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ আছে যারা বাঁশের নানারকম জিনিস যেমন-কুলো, ধামা, ধুচনি, ঝুড়ি তৈরি করে এবং তা বেচে জীবিকা নির্বাহ করে। শীলাবতীর তীরে অবস্থিত চন্দ্রপুর গ্রামে মানুষ আবার গোয়ালা সম্প্রদায়ের। চাঁড়ালিয়া এবং ঝাঁপুর এই দুটি গ্রামের মানুষ বাগদি সম্প্রদায়ের। আবার মালবান্দি গ্রামে মাহিষ্য সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি কয়েকঘর মাহালি সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। এই মাহালিদেরও প্রধান জীবিকা বাঁশশিল্প। বাঁশ থেকে নানারকম জিনিস তৈরি করে তা কাছে-দূরের হাটে বেচে তা থেকে যা আয় হয় তাই দিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করে।
   মঙ্গলাপোতা গ্রামের লাগোয়া একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম হল খড়কুশমা। এই খড়কুশমাতে মিশ্র জনজাতির বাস। প্রায় আধাআধি মুসলমান সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ, সদগোপ, তিলি, শুঁড়ি, ছুতোর, মৃতশিল্পী, কায়স্থ, কুম্ভকার, মাহিষ্য ইত্যাদি করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস।

   খড়কুশমা গ্রাম থেকে শীলাবতী নদীটি সোজা পূর্বদিকে বয়ে এসেছে। এখান থেকে  পাঁচ কিলোমিটার পর শিমুলিয়া গ্রামের কাছে নদীটি দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। যা   এই প্রবন্ধের লেখক অর্থাত্‍ আমার রাজবল্লভপুর গ্রাম থেকে দু’কিলোমিটার পশ্চিমে। জায়গাটিকে বলা হয় দোমোহনি, সংক্ষেপে দো’মনি। এই দো’মনিতেই শীলাবতী নদীটি বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ যথেষ্ট চওড়া এবং কিছুটা অগভীর হয়ে খানিকটা দক্ষিণমুখো এগিয়ে বিরাট একটা মোড় নিয়ে সোজা পূর্ব দিকে বেরিয়ে গেছে। আর অপরটি সামান্য উত্তরে বাঁক নিয়ে পড়ে সেটিও পূর্ব দিকে বয়ে গেছে। এটির চওড়া কিছুটা কম, কিন্তু গভীরতা বেশি। সারা বছরই এতে জল থাকে। প্রথমটিকে বলা হয় আসল শীলাবতী এবং উত্তর দিকে বয়ে যাওয়া স্রোতরেখাটিকে বলা হয় তার খাল। এটি এমনই বিধ্বংসী যে বলার নয়। শোনা যায় এটি আগে একটি সরু নালার মতো ছিল। এলাকার মানুষজন চাষবাসের জন্য সেচের জল যোগাতে এই নালাটি কেটেছিল। তাই এটিকে ‘কেঠে খাল’ বা ‘কেঠিয়া খাল’ বলা হয়। কালক্রমে এই কেঠে খালটিই আসল শীলাবতীকে হারিয়ে দিয়েছে। যাই হোক এই শীলাবতী এবং শীলাবতী নদীর বিধ্বংসী খাল বর্ষাকালে দু’টিই ভীষণ রূপ ধরণ করে। সে যে কী ভয়ঙ্কর রূপ তা না দেখলে বোঝা যাবে না। পলি মাটি মেশানো ঘোলা জল বুকে নিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যায় নিচের দিকে। যখন পাড় উপচে ছাপিয়ে যায় বন্যার জল তখন সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে এখানকার গ্রামগুলিকে।

আমার নিজের গ্রাম রাজবল্লভপুর সহ বৃকভানুপুর, কিশোরপুর, গড়বেড়িয়া, এলনা, লাউমারা, রঘুনাথপুর, বড়াই, দেওয়ান, কালিন্দীপুর, পাঁচামি, নিত্যানন্দপুর, চৈতন্যপুর, ধর্মপোতা ইত্যাদি গ্রামগুলি এই শীলাবতী নদী এবং তার খালের মধ্যবর্তী স্থানে অর্থাত্‍ বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থান করছে। স্বাভাবিকভাবেই বর্ষাকালে এই গ্রামগুলির মানুষজনের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। প্রায় বছরই শীলাবতীর বন্যায় প্লাবিত হয়ে পড়ে গ্রামগুলি। বাইরের সঙ্গে তখন সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এলাকাগুলি। যাতায়াতের একমাত্র যোগাযোগ তখন নৌকা। বন্যাতে প্রায় প্রতি বছরই এলাকার ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ১৯৭৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার কথা ভাবলে তো শিউরে উঠতে হয়। সেবার শীলাবতীর বিধ্বংসী বন্যায় সে যে কী ক্ষতি হয়েছিল তা এককথায় অবর্ণনীয়। কাঁচা মাটির বাড়ি একটিও ছিল না সেবার। সব বন্যার জলে তলিয়ে গিয়েছিল। কত নিরীহ গবাদি পশুর যে প্রাণহানি ঘটেছিল তার ইয়ত্তা নেই। বিঘার পর বিঘা চাষযোগ্য জমি সেই বন্যাতে বালিচাপা পড়ে গিয়েছিল। তার রেশ এখনো এত বছর পরেও এলাকার মানুষজনকে বহন করে বেড়াতে হচ্ছে । ১৯৭৮ সাল। তখন এই প্রবন্ধকারের বয়স ছিল ১৩ বছর। ক্লাস এইটের ছাত্র ছিলাম। সচোক্ষে দেখেছিলাম সেই প্রলয়ঙ্করী বন্যার মারাত্মক রূপ। মনে পড়ছে সেই বন্যার সময় আমাদের পরিবারকেও বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র উঁচু ভিটায়
গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। প্রায় এক মাস অন্যত্র বসবাস করতে হয়েছিল। শুধু আমাদের নয় এরকম দুর্ভোগ অসংখ্য মানুষকে পোয়াতে হয়েছিল। এখনো পোয়াতে হয়। এমনিতেই শীলাবতী বেশ শান্ত, ধীর। কিন্তু বর্ষার জল পেলেই সে ফুলে ফেঁপে উঠে। ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে আছড়ে পড়ে গ্রামগুলিতে। আমরা প্রতি বছরই ঘাটালে যে বন্যার কথা শুনি, শুনি ঘাটাল বন্যায় ভেসে গেছে তা এই শীলাবতী নদীর জন্যই।
   একসময় শীলাবতী নদী এবং তার খালের মধ্যবর্তী গ্রামগুলিতে রাস্তাঘাট বলতে কিছু ছিল না। হাঁটু অব্দি, কোথাও কোমর অব্দি কাদায় ভরাট থাকত। মোটর বাইক তো দূরের কথা সাধারণ বাই সাইকেল পর্যন্ত নিয়ে যাতায়াত করা যেত না প্রায় অগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত। এখন রাস্তাঘাটগুলির অনেক উন্নতি ঘটেছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামের মানুষই যে যার এলাকায় সারাবছর নদী পারাপার হওয়ার জন্য বাঁশের সেতু বানিয়েছে। কিন্তু বর্ষাকালে সে সেতু আর থাকে না। বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। বন্যার জল সরে গেলে গ্রামের মানুষ নিজেদের উদ্যোগে আবার সে সেতু বানায়। সারা বছর ভাঙাগড়ার খেলা চলে। ভাঙাগড়ার অনন্য নজির বোধহয় এই এলাকাতেই আছে।
 
 
   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...