সৌমিত্র রায় -এর জন্য গদ্য
প্রভাত চৌধুরী
৮৬.
আজ রুদ্র কিংশুক-এর কথা। রুদ্র-সম্পর্কিত যে কোনো কথা শুরু করতে গেলেই এসে যাবে সমুদ্রগড়ের কথা। কাটোয়া-লাইনের স্টেশনগুলির নাম দেখলেই বোঝা যাবে অঞ্চলগুলির সাংস্কৃতিক অবস্থান। আজ সেসব কথা থাক। আজ অন্যকথা।
১৯৯৯-এর নভেম্বর -ডিসেম্বর নাগাদ একটা খাম এসেছিল কপা দপ্তরে। খামটা খুলেছিল রজত বা রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।খামে আসা কবিতাগুলো রজতের ভালো লেগেছিল। ফোন নম্বর দেওয়া ছিল।রজতই ফোন করেছিল। উত্তর দিচ্ছিল রজত। আমি পাশে আছি অপর-প্রান্ত সেটা বুঝতে পেরেছিল। পরে আমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল রুদ্র কিংশুক।
আমি যথারীতি জানতে চেয়েছিলাম :
কী কর ।বাড়ি কোথায় । কোথায় পড়াশুনো। বাড়িতে কে কে আছে ।ইত্যাদি ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক খোঁজখবর। আমি অন্যজনের কাছে যেমন , রুদ্র-র কাছেও ঠিক তেমনই।
ওই খামটিতে মোট ৮ টি কবিতা ছিল। সিরিজকবিতা।
সিরিজটির নাম : সন্তরণশিল্পের পাঠ।
এই পাঠ্যসূচি থেকে কবিতাপাক্ষিক-এর পাঠকরা ঠিক কী পাঠ গ্রহণ করেছিলেন তা জানার জন্য কবিতাগুলির কাছে পৌঁছতে হবে :
১ ॥ সেই থেকে আমি কুয়োর মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে আছি / লবণজলে পা গলে যদি পাখনা হয়
২ ॥ একটি গাছকে নিয়ে বহুকাল খেলা হল / গাছের স্পর্শে মানুষ পাখি হয়
৩ ॥ লকাই বাউল বলেছিল সন্তরণকালে / মাছেরা সব বিহঙ্গ হয়ে যায়।
৪ ॥ নৌশিল্প শেখাবে এমন বই পৃথিবীতে নেই
৫ ॥ প্রতিটি সাঁতার শেষ হলে/ অজ্ঞতা তীব্রতর হয়,
৬ ॥ ফুলেদের কাছে এলে কুণ্ডলিত সাপেরাও/ দীপ্যমান শিখা হয়
রুদ্র কিংশুক-এর শুরুটা দেখে আমি একবিন্দু অবাক হইনি। কারণ ওটাই ছিল চরম বাস্তব। আমি তখন প্রকাশ্যেই বলতাম : সাক্ষাৎকার থেকে নতুন বাংলাকবিতা লেখা শুরু হবে। ঠিক এই সূত্র ধরেই শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় আফজল আলি বা রুদ্র কিংশুক-এর মতো কবিরা শুরু করেছিল তাদের কবিতাযাত্রা। এরা কোনো অর্থেই আধুনিক-প্রভাবিত নয়। এরা এবং আরো কয়েকজন শুরু করার আগেই জেনে গিয়েছিল যুক্তিফাটলের কথা।
রুদ্র কিংশুকের পরবর্তী কবিতাগুচ্ছটির নাম ' শব্দজব্দ অথবা সন্তরণশিল্প। প্রথমটির নাম ছিল সন্তরণশিল্পের পাঠ। দুটির মধ্যে কমন হল সন্তরণ। এখন একটা প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে তা হল হোয়াই সন্তরণ। চারদিকের ব্যবহৃত শব্দমালা থেকে উঠে এল সন্তরণ ! কেন ? এর জন্য আমাকে কি জবাবদিহি করতেই হবে ? আমি যদি বলি , রুদ্র জানে সেকথা। তাহলেই মিটে যায়। তাহলে কি সম্পাদক হিসেবে আমার কোনো দায় বা দায়িত্ব নেই।সে দায়িত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি না।
আমি আমার মতো একটা উত্তর দিচ্ছি , এটা যে রুদ্র-র উত্তরের সঙ্গে মিলে যাবে , তেমনটা নাও হতে পারে।
সন্তরণ = সাঁতার , জলে শরীর ভাসিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
আমরা স্থলচর। কিন্তু আমরা প্রয়োজনে সাঁতার শিখি। সেটা যে জলের ওপর শরীরটা ভাসিয়ে রেখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটা জেনে গেলে কাজটার বাঁদিকে '
' শুভ ' এই মঙ্গলকর বিশেষ্যটি যুক্ত করা যায়।আমি
' এগিয়ে যাওয়া ' এই শব্দটিকে মাথায় তুলে রাখলাম।এই এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পই বাংলাকবিতাকে আধুনিকতা থেকে মুক্ত করেছিল। রুদ্র কিংশুক ছিল সেই কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি।
আমি খুব বেশি উদ্ধৃতি দিচ্ছি না। দু-একটা :
১ ॥ রবিশংকরের সেতার শেষ হতেই দেখি , চিনেমাটির ফুলদানিটির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে কমলারঙের পাত্রের মাথায়।
২ ॥ বর্গীয় ' জ ' উচ্চারণ করলেই একটা পাখি তার গোলাপি ডানাদুটো ছাড়িয়ে দিয়ে ঝর্না ঝর্না নাচতে নাচতে ছাতাদিঘির দিকে উড়ে যায়।
মাননীয় পাঠক অবশ্যই বুঝতে পারছেন আধুনিকতা থেকে কবিতা তার নতুন যাত্রাপথে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছে।
এখন অন্য কিছু জরুরি কথা বলে রাখতে চাইছি। যেমন :
আমার একটা শান্তিনিকেতনযাপন আছে। এই যাপনে শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায় দেবাশিস ভট্টাচার্য প্রবীর দাস প্রমুখ আত্মজনেরা। এদের মধ্যে সবথেকে বেশি সান্নিধ্য পেয়েছি রুদ্র কিংশুক-এর ।
সকলেই জানেন আমি পোস্টমডার্ন চিন্তাচেতনার প্রায় কিছুই জানতাম না। এখনো জানি না। তবে সমীর রায়চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং রুদ্র কিংশুক-এর প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে লোকজন আমাকে পোস্টমডার্ন চেতনার মানুষ বলে মেনে নিয়েছেন।
আমার একটা দৈবশক্তি আছে। আমি টের পেয়ে যাই , পৃথিবীর কোন ভাষায় ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে। খবর পেলে গণদেবতা। রুদ্র-র বাড়ি। যতটুকু জানার তার থেকে কিছুটা বেশি জেনে নিয়ে পরদিন ব্যাক টু কলকাতা।
আরো একটা কথা রুদ্র কেবলমাত্র আমাকে শিক্ষিত করার জন্য ' পোস্টমডার্ন শব্দাভিধান " একটি পুরো অভিধানগ্রন্থ রচনা করেছিল। যার পাঁচটা সংস্করণও মূলত আমাকে শিক্ষিত করার জন্য।
আমি যে ইংরেজি একদম জানি না , আমার এই অভাববোধ থেকে আমাকে মুক্ত করার রুদ্র বিদেশি কবিতার অনুবাদ শুরু করে। আমি ভালোভাবে পরিচিত হই গ্রিক কবিতার সঙ্গে।অন্যান্য ভাষার কবিতার সঙ্গে।
শেষের দিকে শান্তিনিকেতনে গেলে একঘণ্টা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গান শুনতে যেতাম। মোহরদি ভেতর থেকে গাইতেন , রুদ্র আর আমি শুনতাম।এবং কথা দিলাম আবার শুনবো
প্রভাত চৌধুরী
৮৬.
আজ রুদ্র কিংশুক-এর কথা। রুদ্র-সম্পর্কিত যে কোনো কথা শুরু করতে গেলেই এসে যাবে সমুদ্রগড়ের কথা। কাটোয়া-লাইনের স্টেশনগুলির নাম দেখলেই বোঝা যাবে অঞ্চলগুলির সাংস্কৃতিক অবস্থান। আজ সেসব কথা থাক। আজ অন্যকথা।
১৯৯৯-এর নভেম্বর -ডিসেম্বর নাগাদ একটা খাম এসেছিল কপা দপ্তরে। খামটা খুলেছিল রজত বা রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।খামে আসা কবিতাগুলো রজতের ভালো লেগেছিল। ফোন নম্বর দেওয়া ছিল।রজতই ফোন করেছিল। উত্তর দিচ্ছিল রজত। আমি পাশে আছি অপর-প্রান্ত সেটা বুঝতে পেরেছিল। পরে আমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল রুদ্র কিংশুক।
আমি যথারীতি জানতে চেয়েছিলাম :
কী কর ।বাড়ি কোথায় । কোথায় পড়াশুনো। বাড়িতে কে কে আছে ।ইত্যাদি ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক খোঁজখবর। আমি অন্যজনের কাছে যেমন , রুদ্র-র কাছেও ঠিক তেমনই।
ওই খামটিতে মোট ৮ টি কবিতা ছিল। সিরিজকবিতা।
সিরিজটির নাম : সন্তরণশিল্পের পাঠ।
এই পাঠ্যসূচি থেকে কবিতাপাক্ষিক-এর পাঠকরা ঠিক কী পাঠ গ্রহণ করেছিলেন তা জানার জন্য কবিতাগুলির কাছে পৌঁছতে হবে :
১ ॥ সেই থেকে আমি কুয়োর মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে আছি / লবণজলে পা গলে যদি পাখনা হয়
২ ॥ একটি গাছকে নিয়ে বহুকাল খেলা হল / গাছের স্পর্শে মানুষ পাখি হয়
৩ ॥ লকাই বাউল বলেছিল সন্তরণকালে / মাছেরা সব বিহঙ্গ হয়ে যায়।
৪ ॥ নৌশিল্প শেখাবে এমন বই পৃথিবীতে নেই
৫ ॥ প্রতিটি সাঁতার শেষ হলে/ অজ্ঞতা তীব্রতর হয়,
৬ ॥ ফুলেদের কাছে এলে কুণ্ডলিত সাপেরাও/ দীপ্যমান শিখা হয়
রুদ্র কিংশুক-এর শুরুটা দেখে আমি একবিন্দু অবাক হইনি। কারণ ওটাই ছিল চরম বাস্তব। আমি তখন প্রকাশ্যেই বলতাম : সাক্ষাৎকার থেকে নতুন বাংলাকবিতা লেখা শুরু হবে। ঠিক এই সূত্র ধরেই শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় আফজল আলি বা রুদ্র কিংশুক-এর মতো কবিরা শুরু করেছিল তাদের কবিতাযাত্রা। এরা কোনো অর্থেই আধুনিক-প্রভাবিত নয়। এরা এবং আরো কয়েকজন শুরু করার আগেই জেনে গিয়েছিল যুক্তিফাটলের কথা।
রুদ্র কিংশুকের পরবর্তী কবিতাগুচ্ছটির নাম ' শব্দজব্দ অথবা সন্তরণশিল্প। প্রথমটির নাম ছিল সন্তরণশিল্পের পাঠ। দুটির মধ্যে কমন হল সন্তরণ। এখন একটা প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে তা হল হোয়াই সন্তরণ। চারদিকের ব্যবহৃত শব্দমালা থেকে উঠে এল সন্তরণ ! কেন ? এর জন্য আমাকে কি জবাবদিহি করতেই হবে ? আমি যদি বলি , রুদ্র জানে সেকথা। তাহলেই মিটে যায়। তাহলে কি সম্পাদক হিসেবে আমার কোনো দায় বা দায়িত্ব নেই।সে দায়িত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি না।
আমি আমার মতো একটা উত্তর দিচ্ছি , এটা যে রুদ্র-র উত্তরের সঙ্গে মিলে যাবে , তেমনটা নাও হতে পারে।
সন্তরণ = সাঁতার , জলে শরীর ভাসিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
আমরা স্থলচর। কিন্তু আমরা প্রয়োজনে সাঁতার শিখি। সেটা যে জলের ওপর শরীরটা ভাসিয়ে রেখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটা জেনে গেলে কাজটার বাঁদিকে '
' শুভ ' এই মঙ্গলকর বিশেষ্যটি যুক্ত করা যায়।আমি
' এগিয়ে যাওয়া ' এই শব্দটিকে মাথায় তুলে রাখলাম।এই এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পই বাংলাকবিতাকে আধুনিকতা থেকে মুক্ত করেছিল। রুদ্র কিংশুক ছিল সেই কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি।
আমি খুব বেশি উদ্ধৃতি দিচ্ছি না। দু-একটা :
১ ॥ রবিশংকরের সেতার শেষ হতেই দেখি , চিনেমাটির ফুলদানিটির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে কমলারঙের পাত্রের মাথায়।
২ ॥ বর্গীয় ' জ ' উচ্চারণ করলেই একটা পাখি তার গোলাপি ডানাদুটো ছাড়িয়ে দিয়ে ঝর্না ঝর্না নাচতে নাচতে ছাতাদিঘির দিকে উড়ে যায়।
মাননীয় পাঠক অবশ্যই বুঝতে পারছেন আধুনিকতা থেকে কবিতা তার নতুন যাত্রাপথে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছে।
এখন অন্য কিছু জরুরি কথা বলে রাখতে চাইছি। যেমন :
আমার একটা শান্তিনিকেতনযাপন আছে। এই যাপনে শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায় দেবাশিস ভট্টাচার্য প্রবীর দাস প্রমুখ আত্মজনেরা। এদের মধ্যে সবথেকে বেশি সান্নিধ্য পেয়েছি রুদ্র কিংশুক-এর ।
সকলেই জানেন আমি পোস্টমডার্ন চিন্তাচেতনার প্রায় কিছুই জানতাম না। এখনো জানি না। তবে সমীর রায়চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং রুদ্র কিংশুক-এর প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে লোকজন আমাকে পোস্টমডার্ন চেতনার মানুষ বলে মেনে নিয়েছেন।
আমার একটা দৈবশক্তি আছে। আমি টের পেয়ে যাই , পৃথিবীর কোন ভাষায় ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে। খবর পেলে গণদেবতা। রুদ্র-র বাড়ি। যতটুকু জানার তার থেকে কিছুটা বেশি জেনে নিয়ে পরদিন ব্যাক টু কলকাতা।
আরো একটা কথা রুদ্র কেবলমাত্র আমাকে শিক্ষিত করার জন্য ' পোস্টমডার্ন শব্দাভিধান " একটি পুরো অভিধানগ্রন্থ রচনা করেছিল। যার পাঁচটা সংস্করণও মূলত আমাকে শিক্ষিত করার জন্য।
আমি যে ইংরেজি একদম জানি না , আমার এই অভাববোধ থেকে আমাকে মুক্ত করার রুদ্র বিদেশি কবিতার অনুবাদ শুরু করে। আমি ভালোভাবে পরিচিত হই গ্রিক কবিতার সঙ্গে।অন্যান্য ভাষার কবিতার সঙ্গে।
শেষের দিকে শান্তিনিকেতনে গেলে একঘণ্টা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গান শুনতে যেতাম। মোহরদি ভেতর থেকে গাইতেন , রুদ্র আর আমি শুনতাম।এবং কথা দিলাম আবার শুনবো
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন