সবাই মিলে সিনেমা হলে~ ৭
কান্তিরঞ্জন দে
পকেটে পকেটে সিনেমা
সিনেমা হল নিয়ে এত কথা লিখছি , কারণ , দর্শক সিনেমা দেখতে না পেলে সিনেমা বানানোর কোনও মানেই হয় না । সত্যজিৎ রায়ের ভাষায় ----- সিনেমা ব্যাপারটা অনেকটা রান্না করা খাবারের মতো । অতিথিকে পরিবেশন না করতে পারলে রান্না করা অর্থহীন ।পুরোটাই জলে যাওয়া ।
হলে গিয়ে সিনেমা দেখা একটা অবসরমূলক বিনোদন । অবসর কাটানোর সময় লোকে একটু আরাম চাইবেই । অতএব হলের ব্যবস্থা যদি আরামদায়ক না হয় , তবে ভালো সিনেমা ভালোভাবে উপভোগ করাটা মুস্কিল হয়ে দাঁড়ায় ।
সত্যজিৎ রায় যেমন ---- পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পরে সবসময় চাইতেন , তাঁর ছবি যেন শীতকালে রিলিজ করে । ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যাবার পরে শীতের ছুটিতে সপরিবারে সিনেমা দেখার মজাই আলাদা ।
শীতকালে এমনিতেই মানুষ একটু হাল্কা মেজাজে থাকে । এ সময় সবাই পিকনিক , বেড়ানো , সার্কাস , সিনেমা একটু বেশি পছন্দ করে । শীতকালে সম্ভব না হলে , সত্যজিৎ চাইতেন , তাঁর ছবি অন্তত যেন গ্রীষ্মের কিংবা পুজোর ছুটিতে রিলিজ করে ।
পঞ্চাশের দশকে এসপ্ল্যানেড চত্বরের মেট্রোসহ অন্যান্য হলগুলিতে ছিল ইংরিজি ছবির রমরমা । বাংলা ছবি সে হলগুলিতে পাত্তাই পেত না । এইরকম পরিস্থিতিতে ১৯৫৭ সালে মেট্রো সিনেমায় বাংলা ছবি " চন্দ্রনাথ " রিলিজ করে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিল । মেট্রোতে সেই প্রথম বাংলা ছবি । শরৎচন্দ্রের গল্প । তাতে উত্তম-সুচিত্রা জুটি । তায় নভেম্বরের শীতের আমেজ । সঙ্গে মেট্রো-র আরামদায়ক ব্যবস্থা । ছবিটি প্রযোজককে কেন সাত গুণ বেশি মুনাফা ফিরিয়ে দিয়েছিল , বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হয় কি ? ওই একই বছরে ইংরিজি সিনেমার আরেক স্বর্গরাজ্য লাইট হাউসে উত্তম -সুচিত্রার প্রথম রঙিন ছবি " পথে হল দেরী " রিলিজ করেছিল । উত্তমকুমার - সুচিত্রা সেন জুটি তুঙ্গে উঠবার অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটিও একটি ।
রাজনৈতিক ছবি করিয়ে বলে বিখ্যাত , মৃণাল সেনের ব্যতিক্রমী ছবি , " কলকাতা -৭১ " ( অক্টোবর-১৯৭২ )মেট্রোয়, এবং " পদাতিক " ( সেপ্টেম্বর -১৯৭৩) এলিট সিনেমাহলে রিলিজ হওয়া ছিল সত্যিকারের ব্যতিক্রমী এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা । আসলে ,ছবির প্রদর্শক বা ডিস্ট্রিবিউটাররা দেখেন , কোন ছবি কিভাবে তাকে সবচেয়ে বেশি পয়সা ফেরত দেবে । সিনেমা হলে নায়ক-নায়িকা কিংবা পরিচালক, যার নাম তাকে সবচেয়ে বেশি মুনাফা দেবে , তিনি তার পেছনেই বেশি দৌড়বেন । সিনেমার বিষয় কি ও কেমন , সেটা তাদের কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় ।
আজ সিনেমা দেখা ও দেখানোর প্রকরণ- পদ্ধতি একেবারেই বদলে গেছে । ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে সিনেমা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে । এ কথা আগের সংখ্যাতেই বলেছি । এখন , লোকের ঘরে ঘরে সিনেমা । পকেটে পকেটে সিনেমা । বাসে, ট্রামে , ট্রেনে , ট্যাক্সিতে , রিক্সায় , অটো-তে চলতে চলতে সিনেমা দেখা এখন জলভাত ।
লকডাউনের এই ঘরবন্দি অবস্থায় সিনেমাহলে ছবি রিলিজ করাতে না পেরে , এই তো সেদিন , প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত নতুন ছবি " নিরন্তর " একই সঙ্গে জি-টিভি বাংলা এবং মোবাইল ফোনের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে একত্রে প্রথম রিলিজ করল ।
হলে রিলিজ হবার আগেই নতুন সিনেমা চোরাপথে ডাকাতি ( পাইরেসি ) হয়ে গোপনে সিডি আকারে ফুটপাথে ঢেলে বিক্রি হত, কিছুদিন আগেও । কলকাতায় - ঢাকায় একই অবস্থা চলেছিল, বেশ কয়েকবছর । কয়েকবছর আগেও এ নিয়ে খুব হৈ-চৈ হত । সিনেমা ব্যবসায়ীদের প্রচুর পয়সার ক্ষতি হত ।
আজ , হলের পাশাপাশি কিংবা আগেই ইউ টিউব, নেটফ্লিক্স , অ্যামাজন , হটস্টার এবং অন্যান্য ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবি রিলিজ করিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর । যস্মিন দেশে যদাচার । লকডাউনের বাজারে বিশাল বিশাল বাজেটের হিন্দি ছবি ফোনে , ল্যাপটপে রিলিজ করিয়ে দিতেই প্রযোজকেরা বেশি নিরাপদ বোধ করছেন ।
আত্মহত্যা করবার কিছুদিনের মধ্যেই সুশান্ত সিং রাজপুতের শেষ ছবি " দিল বেচারা " ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ইতিমধ্যেই কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে ।
বেচারা প্রযোজক । দলে দলে তারা এখন দর্শকদের পকেটে সরাসরি ঢুকে পড়ছেন ।
সিনেমা দেখা ও দেখানো ব্যবস্থার অ-নেক উন্নতি হয়েছে, মানছি । এখন প্রশ্ন হচ্ছে , এতে সিনেমা মাধ্যমটি এগোচ্ছে কি ??
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব, আগামী সপ্তাহ থেকে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন