কিছু বই কিছু কথা ৷ অলোক বিশ্বাস ৷
করোনা কালের কবিতা : বিপ্লব চক্রবর্তী।। গৌরাঙ্গ দাস।। সোফিয়ার রহমান।।
আলোচক : অলোক বিশ্বাস
নন্দন চত্বরে লিটল ম্যাগাজিন মেলা চলাকালীন কবি বিপ্লব চক্রবর্তী আমার হাতে একটি ৪৮ পৃষ্ঠার বই তুলে দিয়ে বললেন, পড়ে তোমার প্রতিক্রিয়া জানিও। বাড়িতে এসে দেখলাম, বইটির হৃদয়গ্রাহী প্রচ্ছদে তিনজন কবির নাম : বিপ্লব চক্রবর্তী, গৌরাঙ্গ দাস এবং সোফিয়ার রহমান। বইটির নাম : 'করোনা কালের কবিতা'। যেহেতু আমি নিজে করোনা কালখণ্ডের অনুভূতিতে বেশকিছু কবিতা লিখেছি, সেই কারণে, বইটি পড়তে আমার খুব আগ্রহ জাগলো। আরো আগ্রহ জাগলো, সম্প্রতি তিন কবির কবিতা বিভিন্ন জায়গায় পাঠ কোরে আমার কমবেশি ভালো লাগছিলো। বইয়ের ভূমিকায় ইচ্ছেনদী প্রকাশনার পক্ষে কবি তথা সম্পাদক লিখেছেন : "করোনা আক্রান্ত সময়ে আমরা কি সত্যি-সত্যিই মৃত্যু চেতনায় নিমগ্ন হয়েছিলাম। যদি নাও হই, স্বজনহীন গৃহবন্দী একাকিত্ব আমাদের সৃজনের কাছে নিয়ে গিয়েছিল অনুভূতি প্রকাশের জন্য।...কবি গৌরাঙ্গ দাস ও কবি সোফিয়ার রহমান দুজনেই দীর্ঘ সময়ের কবিতাশ্রমিক। কবিতা যাপনে অনায়াস পরিশ্রমী তাঁরা। ওঁদের দুজনের অবরুদ্ধ সময়ের সৃজনের পাশাপাশি আমাকেও উপস্থাপন করছি। তিন কবির সৃষ্টি নিয়েই আমাদের করোনাকালের কবিতা।"
#
তিনজনের কবিতায় কিছু সাদৃশ্য কিছু বৈসাদৃশ্য আছে। কথা উঠলো, কারণ তিনজনের কাছে লেখার কেন্দ্র বিন্দুটি হলো করোনা ভাইরাস। বইয়ের শেষ থেকে পড়া শুরু করি, সোফিয়ার রহমানের কবিতা। দীর্ঘদিন লিখতে লিখতে কী লিখতে হবে, সেই ভাবনার চেয়ে কিভাবে লিখতে হবে, সেটাতেই মনোযোগ দেন বেশি। সোফিয়ারের কবিতা পরিণত মনস্কতার চূড়ান্তে পৌঁছেছে। একেবারে মুখের ভাষাই সোফিয়ারের কবিতার অবলম্বন। একজায়গায় এসে চোখ আটকে যায়। আবার পড়ি। শিহরিত হই। আবার পড়ি। শরীরের যাবতীয় অবসাদ বিদূরিত হয় এরকম পংক্তি পড়তে পড়তে--- "বাড়িতে ফিরে মেয়ের ড্রইং খাতা খুলে দেখলাম ঘরবাড়ি আছে, গাছ-পালা আছে, গ্রাম-গঞ্জ আছে, ঝড়-বৃষ্টি আছে। এমন কি বিস্তীর্ণ আকাশও আছে। শুধু মানুষ নেই। বললাম, 'কি রে, একটাও মানুষ আঁকিসনি যে!' ---মানুষ আঁকা খুব কঠিন। কিছুতেই পারছি না। ওর বিষণ্ন জবাবে আমি তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে দাঁড়াই" (না মানুষ, পৃষ্ঠা ৪৪)। করোনা কালে কবিরা নিজেদেরকে আরও একবার নয়, বহুবার আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে নিজের ভেতর জাগিয়ে তুলেছে অন্যতর হতে পারার মানুষ। তাঁদের ভেতরে নিশ্চিত কোনো অবসাদ বা গভীর মৃত্যুচেতনা বাসা বাঁধেনি। বরং, অনন্ত মুক্তির আনন্দ উপলব্ধি করেছেন করোনাকে জীবনের বিভিন্ন অবস্থায় রেখে। করোনার কাছে পরাজয় স্বীকার করতে দেখিনি আমি কোনো কবিকেই। তাঁদের কবিতার ভাষা নতুন পথে বাঁক নিয়েছে এই অতিমারীর কালখণ্ডে। অনন্ত মহাকালের চেতনার দিকে এগিয়েছেন তাঁরা। 'অনন্ত মহাকাল' নামক এক কালজয়ী কবিতা রচিত হয়েছে সোফিয়ারের কলমে--- "অনন্ত একটা জাতি/অনন্ত একটা সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে/অনন্ত আকাশ থেকে/অনন্ত বৃষ্টি আশ্রয় নিচ্ছে তাদের চোখে/অনন্ত শ্রমিকেরা/অনন্ত মহাকালের দিকে এগিয়ে চলেছে"(অনন্ত মহাকাল)। সোফিয়ারের কবিতার পংক্তি অত্যন্ত সংহত। কবিতায় নেই কোনো বাহুল্য বা অতিকথন। কখনো গল্পের ছলে একটা কবিতা শুরু হলেও সমগ্র কবিতাটি গল্প নয়, কবিতাই। যেমন মৃত বন্ধুদের সঙ্গে শিরোনামে কবিতাটা শুরু হচ্ছে এভাবে--- "এই করোনাকালে রোজ কথা বলি/মৃত বন্ধুদের সঙ্গে/সামান্য এক মফস্বলে থাকি আমি/অশোকনগরে"। এখানে অশোকনগর শুধু একটা ভৌগলিক নাম নয়, সে হয়ে উঠেছে শোকহীন এক নগর, এই কারণে যে সেই ভৌগলিক নগরে অনেক বিষাদের মধ্যেও একজন বন্ধু বলে উঠছে--- "কবে আসবি" ? বন্ধুত্বের শাশ্বত চেতনায় লেখা কবিতা। বিষয়ের কেন্দ্রে করোনা থাকলেও, সোফিয়ারের কবিতা মতবাদহীন কবিতা, আটপৌরে স্বভাবের কবিতা। নাগরিকতার কিছু স্বভাব থাকলেও সেই কবিতা নাগরিকতার কোনো কূটত্ব ধারণ কোরে নেই। জটিলতা বর্জিত খোলা মনের কবিতা। করোনা কালে কবির মন বিষাদগ্রস্ত হয়নি, মৃত্যুকে পরাজয়ের ভাবনা তাঁর কাছে হয়েছে প্রধান। বরং কবি ভাবনাগুলোর ভেতরে মানুষের অস্তিত্বের রূপকে দেখতে চাইছেন গভীর কোরে--- "আমি নিঃশব্দে চেয়ে দেখি মানুষের রূপ।"(ক'ফর্মা) এই খোলামনের স্ফূর্তি সোফিয়ার রহমানের কবিতায়, প্রথাসিদ্ধ ফর্মে বাইরে গিয়ে প্রকাশিত হতে দেখে ভালো লাগছে।
#
এই সংকলনের গৌরাঙ্গ দাসের ছোটো ছোটো ৪২ টি কবিতা আছে। কবিতাগুলো তিন থেকে বারো লাইনের মধ্যে। পংক্তিগুলো কোথাও সম্প্রসারিত পংক্তি নয়। অধিকাংশ পংক্তি তিন চারটি শব্দে লিখিত। গৌরাঙ্গ দাসের কবিতা মনোসমীক্ষণের, মনোদৃশ্যের, মনোচাঞ্চল্যের কবিতা। পাঠকের সক্রিয় মনোযোগ দাবি করে। অবস্থা ও অবস্থানের ছোটো ছোটো মুহূর্তকে অত্যন্ত সযত্নে সাজিয়েছেন কবি গৌরাঙ্গ দাস 'করোনা কালের কবিতা' সংকলনে। 'দৃশ্যচিন্তা' আর 'চিন্তাদৃশ্য'--- এই দুটো শব্দকে ব্যবহার করতে ইচ্ছা করছে ওনার কবিতার প্রতিক্রিয়ায়। চিন্তা আর দৃশ্য, দৃশ্য আর চিন্তা--- এই উভয়ের গাঢ় মিশেল ঘটেছে ওনার কবিতায়। গৌরাঙ্গর কবিতা শ্রুতিমধুর। শ্রবণে ব্যাঘাত ঘটে না কোথাও। কিছুটা মন্ত্রিক নিমগ্নতার স্পর্শ আছে কখনো--- "যে ছায়ার কাছে হাত বাড়িয়েছিলাম/সেও আজ বিপন্ন/সেও বাউল; একা একা হেঁটে যায়/সঙ্কটের শরীরে/সঙ্কটের ছায়াপথে যে আলো ছড়িয়ে পড়ে/তাকে ভয় ভেবে একটা বন্দরের দিকে/এগিয়ে যাওয়া/একটা পৃথিবী বোনা, জরির ওড়না"(৩৯ সংখ্যক কবিতা)। যতিচিহ্ন অধিকাংশ স্থানে ব্যবহার করেননি। মাত্র তিনটি পংক্তিতে ৪০সংখ্যক কবিতাটি বেদনার তীব্র অনুভূতিতে গুছিয়ে লেখা--- "বিনীত শেষে যে নামটি এসে পড়ে/আমি তাকে মৃত্যুর মতো ভাবি/ভাবি, কষ্ট মৃত্যুর থেকেও বড়।" মন্ত্র মুগ্ধের আবেশে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় ৫ সংখ্যক কবিতাটি পাঠের পর--- "স্বপ্নের সীমানা বাড়তে বাড়তে/আমি শূন্য ছুঁয়ে ফেলেছি/শূন্য অর্থাৎ একটা মৃত্যু চেতনা"।
#
সোফিয়ার রহমানের কবিতায় নিজের পরম প্রিয় মেয়ের কথা এসেছিল। বিপ্লব চক্রবর্তীর কবিতাতেও এসেছে নিজের মেয়ের প্রসঙ্গ--- "আমার মেয়ে টিউটোরিয়াল থেকে বাড়ি এলে/মনে হয় ঈশ্বর পবিত্রতা নিয়ে ঘরে এলো/ওকে বলেছি কোনো পুরুষ তোর বাবা নয়/তোর বেড়ে ওঠার ক্লান্তি মুছিয়ে মাটিতে শক্ত করে/দাঁড় করাবার একটি স্বর্গীয় ছাউনির নাম বাবা/আমার বাড়িতে কোনো নারী নেই, ঈশ্বর থাকেন।"(আমার বাড়িতে নারী নেই)। সংকলন ভুক্ত অন্য দুই কবির কবির কবিতার ফর্মের থেকে আলাদা বিপ্লবের কবিতা। তুলনায় ওঁর কবিতায় বাক্যের পরিসরে প্রাচুর্য রয়েছে। বিপ্লবের কবিতা অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত। অনেক বেশি স্পষ্ট ওর বলার বিষয়। মৃত্যু সম্পর্কে কবির ধারণা স্বচ্ছ--- "মৃত্যু বলে কিছু নেই শুধু মেঘ হয়ে ঝরে পড়া।" বিবৃতি মুখরতার আনন্দ কথ্যরূপে জায়মান থাকে। মানুষের ভোগসুখের চেহারাকে নিজেকে কবিতায় কথক হিসেবে বলেছেন নির্দ্বিধায়--- "অনেকদিন আমার আর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না/বাজার করছি অফিস করছি সংসার সামলাচ্ছি/রাতে বিছানায় গা লাগালেই ঘুম চলে আসছে/এইভাবে আমি দ্বিতীয় ঈশ্বর মূর্তি হয়ে উঠলাম(হেফাজতে নিয়ে গেছে)। দুর্যোগ অতিমারী বা মহামারী যে কোনো ভাবেই ঢুকে পড়বে আমাদের জীবনে। আর শিল্পীর জীবনে তুলিতে। শিল্পী বা কবি খুঁজে পেতে চান রবীন্দ্রনাথকে দূর্যযোগের কালে অবলম্বন হিসেবে। কিন্তু তিনি অকৃত্রিমভাবে মেনে নিচ্ছেন দুর্যোগের প্রভাব--- "এই দুর্যোগের সময় আস্ত মানুষটাকে চাই/খুঁজে পাচ্ছি না পরিপূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে"(রবীন্দ্রনাথ)। মধ্যবিত্ত জীবনের আর্তি, মধ্যবিত্ত জীবনের মনোভঙ্গিমা প্রাতিস্বিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে বিপ্লব চক্রবর্তীর কবিতায়। বিপ্লব কবিতায় আড়াল রাখার চাইতে খোলাখুলি ব্যক্ত করতে চান সামাজিক উপলব্ধিকে। পারিবারিক ভাবনার সঙ্গে সামাজিক ও প্রাকৃতিক অবস্থার চিত্রকর দক্ষতার সঙ্গে মেশাতে ইচ্ছা করে তাঁর, কবিতায়। 'করোনা কালের কবিতা' সংকলনে তিনজন কবির অকৃত্রিম উপস্থিতি আমার মনকে করোনাজনিত বিষাদকে মুক্ত করেছে।
পৃথিবী শ্যাওলা মাখা। কবিকে কবিতার হাত ধরে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।
উত্তরমুছুন