আজ অভিভাবকহীন হলাম
বাসুদেব দাস
অন্যান্য দিনের মতো আজও সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কম্পিউটারে সৌরভ কুমাৰ চলিহার একটি গল্প বাংলায় অনুবাদ করছিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বারবার হোমেন বরগোহাঞির কথা মনে পড়ছিল। কয়েকদিন আগে তিনি কোভিদে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন বলে খবরের কাগজ থেকে জানতে পেরেছিলাম। এসব কথাই ভাবছিলাম। অসুবিধা হবে ভেবে ফোন করছিলাম না। এর আগে কয়েকবার এরকম হয়েছে আমি স্বপ্ন দেখেছি বরগোহাঞি স্যারের শরীর ভাল নয়। কয়েকদিন পরে স্যারকে ফোন করে জানতে পেরে অবাক হয়েছিলাম সেই সময় সত্যিই বরগোহাঞি স্যার অসুস্থ ছিলেন। এর ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। কারণ বিজ্ঞানের ছাত্র নাহলেও আমি কোনো ধরনের ঐশ্বৰিক অথবা অলৌকিকতায় বিশ্বাস করিনা। কিন্তু একটা কথা আামি বলতে পারি আমি মাঝে মধ্যেই বরগোহাঞির সঙ্গে কথা বলি। আমার এরকম একটা অনুভব হয় বরগোহাঞি যেন আমার কাছে বসে আছেন এবং আমার সঙ্গে কথা বলছেন। আমার লেখালিখির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা অথবা প্রশ্ন দেখা দিলেই এভাবে বরগোহাঞির কাছ থেকে আমি সমাধান সূত্র পেয়ে যাই। তিনি এত ব্যস্ততার মধ্যে থাকতেন যে ফোন করার হাজার ইচ্ছা থাকলেও সব সময় তা সম্ভব ছিল না। তাই আজ সকালবেলা যখন বারবার বরগোহাঞি স্যারের কথা মনে পড়ছিল তখন ভেবেছিলাম আজ একটু দেরিতে হলেও একটা ফোন করতেই হবে। ঠিক তখনই অসমের বন্ধু দিবাকর শেনচোওয়ার কাছে থেকে মোবাইলে এই মর্মান্তিক খবরটা ভেসে এল যে সাহিত্যক্ষেত্রে আমার দ্রোণাচার্য হোমেন বরগোহাঞি স্যার আর নেই। প্রখ্যাত সাংবাদিক মনোজ গোস্বামীর কাছ থেকে পাওয়া খবরটা আমাকে জানিয়েছে। ঠিক যে সময়ে স্যারের কথা আমার বারবার মনে পড়ছিল সেই সময়ে তিনি আমাদের ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেছেন বলে জানতে পারলাম । এটাকে কী ধরনের টেলিপ্যাথি পথে বলে তা আমি জানি না।
কে এই হোমেন বরগোহাঞি? এবার সেই প্রসঙ্গে আসছি। ১৯৩২ সনের ৭ ডিসেম্বর অসমের লক্ষ্ণী্মপুরে ঢকুয়াখনায় বরগোহাঞির জন্ম হয়।কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক হন।স্কুল জীবন থেকেই বরগোহাঞির সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা ছিল ঈর্ষনীয়।দেশ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই বরগোহাঞির নিবিড় পরিচয় গড়ে উঠেছিল। মূলত দেশ পত্রিকার মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে তাঁর হাতে খড়ি হয়।দীর্ঘকাল ‘আজকাল’পত্রিকার উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন। গৌ্রকিশোর ঘোষ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। বরগোহাঞির যে কথা আমাকে তাঁর প্রতি আকর্ষণ করেছিল তা হল –‘আমি বইয়ের সঙ্গে কথা বলি,ঝগড়া করি।’এই একটি কথা থেকেই আমরা বুঝতে পারি বই বরগোহাঞির জীবনে কতখানি ছিল। আমার মনে হয় শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্যই বরগোহাঞি বই পড়তেন না,অধ্যয়নের মধ্যেই তিনি আনন্দ পেতেন। বরগোহাঞির অধ্যয়ন থেকে হোমার,সেক্সপীয়র,টলস্টয়,গ্যেটে,ভলতেয়ার,এমারসন,জা পল সার্তে,আদ্রেঁ মালরো,আনাতোল ফ্রাঁ,টমাস মান,হেনরি ডেভিড থরো,লিওনার্ডো দ্য ভিন্সি,কোলরিজ,মাইকেল অ্যাঞ্জেলো বিশ্বসাহিত্যের এই দিকপালদের কেউ আর বাকি ছিল না। শুধু কি বিপুল অধ্যয়ন? স্মৃতিশক্তিও ছিল রীতিমতো ঈর্ষনীয়।আলস্য বা অবসর যাপনে সময় নষ্ট করা ছিল বরগোহাঞির দুচোখের বিষ। অসম আন্দোলনের সময় স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলনের সমালোচনা করতে তিনি কোনোদিন দ্বিধা বোধ করেন নি। তাঁর সম্পাদিত ‘নীলাচল’পত্রিকা সেই দিনগুলির ইতিহাস নির্মোহভাবে তুলে ধরেছেন। চাকরি সূত্রে দীর্ঘকাল প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন তারই অসামান্য রূপায়ন ঘটেছে ‘হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায়’নামে উপন্যাসে।
আজ থেকে মোটামুটি ১৬/১৭ বছর আগে আমি বরগোহাঞি স্যারকে একটা চিঠিতে লিখেছিলাম –‘আমি নিজেকে একলব্য এবং আপোনাকে দ্রোণাচার্য বলে মনে করি।’ আমার এই বক্তব্যে হয়তো আবেগ ছিল কিন্তু সত্য নেই তা নয়। আমি মনেপ্রাণে এই কথাকে আজও বিশ্বাস করি। বরগোহাঞির প্রবন্ধ আমার জীবনের গতি বদলে দিয়েছে। আমি জীবনে প্রেয়কে বাদ দিয়ে শ্রেয়কে গ্রহণ করতে শিখেছি। মনে পড়ে প্রথম যখন অরবিন্দ আশ্রমের মুখপত্র ‘শৃ্ন্বন্তু’পত্রিকায় বরগোহাঞির প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, সম্পাদক সুপ্রিয় ভট্টাচার্য আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন আপনি বরগোহাঞির যত প্রবন্ধ আছে আমাদের অনুবাদ করে দিন ,আমরা সানন্দে ছাপাব। একদিন সকালবেলা ব্যাঙ্গালোর থেকে একজন পরিচিত দিদির ফোন এল।তিনি শৃ্ন্বন্তু পত্রিকায় বরগোহাঞিৰ প্রবন্ধগুলি নিয়মিত ভাবে পাঠ করে থাকেন। দিদি আমাকে বললেন-‘বাসুদেব ,হোমেন বরগোহাঞি লিখেছেন সক্রেটিস তাঁর প্রিয় মানুষ ,আমরা বলব বাসুদেব আমাদের প্রিয় মানুষ। কেননা তুমি অনুবাদ না করলে আমরা প্রবন্ধটা পড়তে পারতাম না।’ সেদিন আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। কার কথা বলব,মহাশ্বেতা দেবী আমাকে পূ্র্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন,তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘বর্তিকা’য় অসমিয়া সাহিত্যের অনুবাদ করার জন্য। বরগোহাঞির ‘মৎস্য গন্ধা’উপন্যাস এবং আরও বহু গল্প আমি ‘বর্তিকা’য় অনুবাদ করেছি। কবি সুবোধ সৰকার তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘ভাষানগর’ এ বরগোহাঞির প্রবন্ধের অনুবাদ ছাপিয়েছেন। কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন আমি দেখা করতে গেলে আমার কাছ থেকে বরগোহাঞির অনুবাদ গল্প নিয়ে ছাপিয়েছেন।
১৯৬৭ সনে হোমেন বরগোহাঞির ‘মৎস্যগন্ধা’রচিত হয়।উপন্যাসটি আকারে ক্ষুদ্র হলেও বরগোহাঞির প্রতিভার বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর হিসেবেই শুধু নয় অসমিয়া উপন্যাসে সমাজ বাস্তবতার উজ্জল নিদর্শন হিসেবেও বইটির গুরুত্ব অপরিসীম।আমাদের সমাজে প্রচলিত জাতিভেদের সমস্যাকে কেন্দ্র করে এর কাহিনি গড়ে উঠেছে।অসমের সুদূর গ্রামে গঞ্জে এখনও জাতিভেদের কুৎসিত ব্যাধি বর্তমান লেখক তারই ছবি নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মেনকা জাতিতে ডোম।উচ্চবর্ণের লোকদের শুচিবায়ুগ্রস্ততা পদে পদে তথাকথিত নিম্নবর্ণের লোকদের উপর সামাজিক ও অর্থনৈ্তিক শোষণ মেনকাকে সমস্ত হিন্দুদের প্রতিই বিদ্রোহী করে তোলে।উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি মেনকার বহুদিনের প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ হয়েছে। ভাষার বলিষ্ঠতার সঙ্গে ধ্বনিমাধুর্য ও কল্পচিত্র যুক্ত হওয়ায় উপন্যাসটি একটি বিশেষ মাত্রা লাভ করেছে।
‘হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায়’ (১৯৭৩) শীর্ষক উপন্যাসটি হোমেন বরগোহাঞির সামাজিক উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম।উপন্যাসের নায়ক রসেশ্বর সাতটি ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত।তার সম্বলের মধ্যে এক টুকরো জমি ছিল।একদিন সকালবেলা রসেশ্বর যখন মাঠে চাষ করছে,তখন সেখানে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয় গ্রামের সবচেয়ে ধনী ঠিকাদার সনাতন শর্মা। সনাতনের মতো চতুর এবং ধুরন্ধর লোককে দেখে রসেশ্বর প্রমাদ গোণে।কিছুক্ষণের মধ্যে তার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়। সে অবাক হয়ে শোনে এতদিন ধরে যে জমি চাষ করছে তার মালিক নাকি সনাতন শর্মা। তারপর শুরু হয় সেই চিরন্তন ইতিহাস।ধনীর রুদ্ধ দুয়ারে রসেশ্বর মাথা কুটে মরে। নিরুপায় হয়ে রসেশ্বর মামলা করে। ডিম্বেশ্বর মণ্ডলের কাছে মামলা সংক্রান্ত পরামর্শ চাইলে ডিম্বেশ্বর তাকে মিথ্যা আশ্বাস দেয় আর ভেতরে ভেতরে রসেশ্বরকে সর্বস্বান্ত করার নতুন নতুন ফন্দি ফিকির বের করে।সরকারি আমলাতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপশাসনের যে বীজ গোটা শাসন ব্যবস্থাকে অন্যায় অবিচারের পীঠস্থান করে তুলেছে তা তিনি চাকরি সূত্রে নিজের চোখে খুব কাছ থেকে দেখেছেন।উপন্যাসের চরিত্রগুলিও তাই এত জীবন্ত হয়ে উঠেছে।রসেশ্বরের কাহিনি আমাদের সহজেই রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমির’উপেন এবং গোগোলের ‘ওভারকোট’গল্পের আকাকি বাশমাচকিনকে মনে পড়িয়ে দেয়।
১৯৮৭ সনে রচিত হোমেন বরগোহাঞির ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’উপন্যাসটি শিশু মনস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।অজ্ঞানতা ও অন্ধকারে ঘেরা এক গ্রামের একটি অবোধ শিশুর নাগরিক জীবনে প্রবেশ লাভ এবং ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে এসে এক নতুন আনন্দময় জগতের সন্ধান অত্যন্ত মনোরম ভাষায় বর্ণিত হয়েছে।বিক্রম ওরফে বাপুকণ এর মুখ্য চরিত্র।বাপুকণ এবং তাঁর বন্ধু হেবাঙ এই দুই বালকের নিত্য নতুন দুষ্টুমিতে ভরা জীবন আমাদের শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। লেখকের অত্যন্ত প্রিয় বিষয় মৃত্যুচেতনা এবং প্রকৃ্তির প্রতি নিবিড় ভালোবাসা উপন্যাসটিকে একটা বিশিষ্টতা দান করেছে।বাপুকণ আর রেণুর কিশোর প্রেম আমাদের ‘পথের পাঁচালী’র অপু-লীলার প্রেমের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
প্রবন্ধের পরিসরের কথা ভেবে বরগোহাঞির ছোটগল্প এবং প্রবন্ধের কথা আলোচনা করা গেল না।আজ বরগোহাঞি এই ইহজগতে নেই।কিন্তু তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি চিরকাল আমাদের কাছে বাঁচিয়ে রাখবে।তাঁর প্রতিবাদী সত্তার একটি বড় উদাহরণ সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে ধর্মের নামে যে আতিশয্য চলছে তার প্রতিবাদে বরগোহাঞি নিজে এবং তাঁর স্ত্রী নিরুপমা বরগোহাঞি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমার অনুভব বরগোহাঞির মৃত্যুতে আমি অভিভাবহীন হলাম।
-------
বাসুদেৱ দাসৰ এই লেখা টোৱে মোৰ প্ৰাণ স্পৰ্শ কৰি গল।মই বৰগোহাঞি চাৰৰ দৰে প্ৰেৰণা দায়ক লেখকৰ ৰচনা কেতিয়াও পঢ়া নাই। সচাকৈ য়ে আমি অভভাৱকহীন হৈ পৰিলো।
উত্তরমুছুনমোৰো প্ৰথম উপন্যাস তেখেতেই প্ৰকাশ কৰিছিল।