রাসেলের স্মরণে
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস
১৯১৪ সমে বার্ট্রাণ্ড রাসেল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাগৃহে তিনি যখন বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়ালেন তখন নাকি সেখানে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ তার ফ্যাকাশে আর রুগ্ন চেহারা দেখে এই বলে ভয় করেছিলেন যে, যে কোনো মুহূর্তে তিনি হয়তো দুম করে গড়িয়ে পড়ে মরে থাকতে পারেন। তখন রাসেলের বয়স ছিল ৪১ বছর। সেই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়েই রাসেল আর ও সুদীর্ঘ ৫৬ বছর বেঁচে ছিলেন । কেবল বেঁচে থাকাই নয়, মৃত্যুর প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মানবজীবনের উৎকর্ষ সাধনের জন্য অবিরাম ভাবে কাজ করে গেছেন। কেবল রাসেলই ৯৭ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা একমাত্র মানুষ নন। কিন্তু এত দীর্ঘ জীবন লাভ করা বেশিরভাগ মানুষ এই বয়সে একটি জীবন্ত শব দেহে পরিণত হয়। ৯৪ বছর বয়সে রাসেল লন্ডনের রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে আনবিক অস্ত্র নির্মাণের বিপক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন, জেলে গিয়েছিলেন, ভিয়েতনামে আমেরিকান বর্বরতার বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী শোনার মতো করে প্রতিবাদী চিৎকার করেছিলেন। সেই ক্ষীণ, ফ্যাকাশে এবং রুগ্ন দেহটির মধ্যে প্রায় একটি শতাব্দী ধরে যে এক অকুতোভয় অপরাজেয় এবং চির বিদ্রোহী আত্মা বাস করত তার সমতুল্য প্রতিভা এবং প্রাণশক্তি মানবজাতির ইতিহাসে খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না।
রাসেলের মতো ঈর্ষা যোগ্য ভালো স্বাস্থ্য খুব কম মানুষের শরীরে দেখা যায়। স্বাস্থ্যের সঙ্গে মনের খুব নিকট সম্পর্ক রয়েছে বলে আমরা সবাই মুখে বলে থাকি। কিন্তু কথাটার গুরুত্ব খুব কম মানুষই উপলব্ধি করে। স্বাস্থ্যের সঙ্গে মনের নিকট সম্পর্ক বলে বলা কথাটির অন্য একটি অর্থ হল স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানুষের মানসিক প্রকৃতি, চিন্তা ধারা এবং জীবন দর্শনের নিকট সম্পর্ক স্বীকার করা। রাসেল তার বিস্তীর্ণ রচনাবলীর নানা জায়গায় তাঁর স্বাস্থ্যের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। তা থেকে বোঝা যায় যে তার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষের প্রকৃতির গঠনে সুস্বাস্থ্যের প্রভাব সম্পর্কে রাসেল নিজেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সমস্ত ক্ষেত্রে সংযত এবং পরিমিত জীবনযাপনই যে তার দীর্ঘায়ু লাভের প্রধান কারণ ছিল সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু এটাকে একটি ফর্মুলা হিসেবে নিলে ভুল করা হবে কারণ সমস্ত সংযত এবং পরিমিত জীবনযাপন করা মানুষই প্রায় এক শতাব্দীকাল বেঁচে থাকে না । তথাপি একটা কথা বিশেষভাবে লক্ষণীয় দার্শনিকরা সাধারণত দীর্ঘজীবী হয়। উইলিয়াম কান্টের স্বাস্থ্য ও খুব ভালো ছিলনা। তার বুকটা এত চ্যাপ্টা এবং ভেতরে প্রবেশ করা ছিল যে সারা জীবন সেই কথাটা তার মানসিক কষ্ট এবং বিষন্নতার কারণ হয়ে পড়েছিল। তার চিকিৎসকরাও ভেবেছিলেন যে কান্ট বোধহয় বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারবেন না। যুবক বয়সে তার মৃত্যু হবে । কিন্তু সেই ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েই তিনি চার কুড়ি বছরের চেয়ে বেশি সময় বেঁচে ছিলেন । প্লেটো, সক্রেটিস থেকে আরম্ভ করে রাসেল পর্যন্ত বেশিরভাগ দার্শনিকের কথা মনে এলেই অজস্র দীর্ঘজীবী অশীতিপর বৃদ্ধ চিত্র -শালা মনের চোখের সামনে ভেসে উঠে। অবশ্য তার যে ব্যতিক্রম নেই তাও নয়। আমাদের শঙ্করাচার্য ৩২ বছর বয়সে ,হবস, পাস্কেল এবং স্পিনোজা ইত্যাদি দার্শনিকরা বেঁচে থাকতে যথেষ্ট রুগ্ন ছিলেন এবং তাদের মৃত্যু হয়েছিল অল্প বয়সে । কিন্তু তথাপি একথা সত্য যে সম্প্রদায় হিসেবে দার্শনিকরা বেশিদিন বেঁচে থাকেন এবং তার একটি কারণ রয়েছে । সেই কারণটা হল এই যে তারা হৃদয়ের চেয়ে বেশি মস্তিষ্ক খরচ করেন। হৃদয় খরচ করে যে মানুষ বেঁচে থাকে তাদের তাড়াতাড়ি মৃত্যু হয় ।।মস্তিষ্ক খরচ করে বেঁচে থাকা মানুষের জীবনী শক্তি বেশি খরচ হয় না। ফলে তারা দীর্ঘকালীন আয়ু ভোগ করে।
বার্ট্রান্ড রাসেলকে আমি গুরু বলে স্বীকার করে নিয়েছিলাম । কথাটা শুনে অনেকের মুখে বিদ্রুপের বাঁকা হাসি ফুটে উঠবে ,সে কথা আমি জানি। কোথায় সেই দুর্ধর্ষ গাণিতিক এবং দার্শনিক আর কোথায় এই অখ্যাত এবং প্রায় নিরক্ষর কলমজীবী। এটা তো কেবল ছোট মুখে বড় কথা নয়, এটা প্রায় বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো। কথাটা সত্যি, সেটা আমি অস্বীকার করি না। রাসেলের দার্শনিক চিন্তায় দন্তস্ফুট করার শক্তি এবং ধৃষ্টতা এখনও আমার নেই- ভবিষ্যতেও কখনও হবে বলে আমি আশা করি না। অবশ্য একটা আশা নিশ্চয় করি। রাসেলের দর্শন পড়ে আমি কিছুই বুঝতে পারিনা সত্যি( সমগ্র সভ্য জগতে কয়জনই বা বুঝে?)কিন্তু তা বলে যে সেই দর্শন আমার মতো সাধারণ মানুষের কাজে লাগে না এটা কিন্তু সত্যি নয়। পৃথিবীর উপরিভাগের যে সামান্য অংশটি (top-soil)সমগ্র উদ্ভিদ জগতকে বুকে ধারণ করে আছে তার মাত্র এক বর্গ ইঞ্চি জায়গা তৈরি হতে নাকি ৫০০ বছর লাগে। অর্থাৎ ৫০০ বছর ধরে বিভিন্ন উৎস থেকে সার সংগ্রহ করে এক বর্গ ইঞ্চি মাটি উদ্ভিদ জীবনের বিকাশের জন্য উপযোগী হয় ।মানুষের চিত্তভূমির বিষয়েও সেই একই কথা বলা যেতে পারে। মানুষের যে বিশ্বজোড়া চিত্তভূমি থেকে আমার মন বা প্রতিটি মানুষের মন সঞ্জীবনী রস আহরন করে তার প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গা সারাবান করার জন্য শত শত বছর ধরে সবার দৃষ্টির অলক্ষে নানা পদার্থ জমা হতে শুরু করেছে। রাসেলের দুরুহ দর্শন আমি বুঝতে না পারি কিন্তু মানুষের যে বিশ্বজুড়ে চিত্তভূমি প্রোথিত হয় তা তাকে সারবান করে তুলবে - এখান থেকে আমিও মনের রস আহরন করব এবং এভাবেই পরোক্ষভাবে হলেও রাসেলের দর্শন আমার কাজে আসবে।.... কিন্তু আমি বলতে চাইছিলাম যে রাসেলকে আমি গুরু বলে মেনে নিয়েছিলাম প্রধানত দুটি কারণে আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। প্রথমটি হল তার ভাষা বা রচনারীতি সরল সুস্পষ্ট এবং নির্মেদ। এই রচনারীতির বিশিষ্ট শক্তি এবং সৌন্দর্য আমাকে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই মন্ত্রমুগ্ধ করে আসছে। তার জীবনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে বলতে গিয়ে রাসেল বলেছেন যে তিনি hazy mist বা অস্পষ্ট ধূসরতা ভালোবাসেন না তিনি ভালোবাসেন sharp outlines, স্পষ্ট রূপরেখা। সমগ্র জীবন ধরে তিনি hazy mist এর মধ্যে এই sharp outlines এর অন্বেষণ করেছেন । সেই অন্বেষণের প্রতীক হল রাসেলের ভাষা। রাসেলের আগের বয়সের রচনা The Free Man's Worship বা মুক্ত মানুষের উপাসনা পড়ে আমরা এক সময় আবেগে শিউরে উঠেছিলাম, পরে রাসেলের ভাষাতেই পড়লাম যে সেই রচনাটির জন্য তিনি নাকি লজ্জিত। বোধহয় সেই রচনাটির কাব্যিক ভাষা তার অন্যতম কারণ। কাব্যিক ভাষার প্রতি যে সমস্ত মানুষের দুর্বলতা আছে বা যারা নিজের ভাষার দুর্বল পেশীগুলি কিছুটা সবল করে তুলতে চায় তারা কিছুদিন রাসেলের রচনাবলী পড়লে একটা ভালো স্বাস্থ্যকর ব্যায়াম করা হবে বলে মনে হয়। ভাষা সম্পর্কে রাসেলের ধারণা কি সেই বিষয়ে নিচে একটি উদাহরণ দিলাম। আজকাল ইংরেজি ভাষার যেকোনো সমাজবিদ্যার গ্রন্থে নিচে উদ্ধৃত করার মতো বাক্য পাওয়া যায়- Human beings are completely example from undesirable behaviour patterns only when certain pre- requisites ,not satisfied except in a small percentage of actual cases ,have through some fortuitous concourse of favourable circumstances,whether congenital or environmental,chanced to combine in producing an individual in whom many factors deviate from the norm in a society advantageous manner.’
‘রাসেল বলেছেন:’ এই বাক্যটা আমরা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে পারি নাকি চেষ্টা করেই দেখি আসুন। আমার মনে হয় যে এই বলে অনুবাদ করলেই ভালো হবে-‘All men are scoundrels,or at any rate almost all. The men who are not must have had unusual luck,both in their birth and in their upbringing.’
দ্বিতীয় যে কারণটির জন্য আমি রাসেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম সেটা হলো জীবন সম্পর্কে তার অতিশয় সরল, সুস্পষ্ট এবং সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গি। এই ধরনের কোনো মানুষ আছে যে জীবনের কোনো না কোনো একটা সময়ে মৃত্যু ভয়ের দ্বারা বিচলিত হয়নি? এই ধরনের কোনো মানুষ আছে যে জীবনের অর্থ বা উদ্দেশ্য খুঁজে একদিনের জন্যও বিমূঢ় হয়নি? এসব হলো মানব জীবনের চিরকালীন সমস্যা এবং সেসবের উপযুক্ত উত্তর না পেলে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আমি একথা বলতে চাইছি না যে রাসেলের রচনার মধ্যে আমি এই দুটি প্রশ্নের চরম উত্তর পেয়ে গেছি কিন্তু উত্তর পাবার জন্য যে পথে এগোতে হয় তার সন্ধান পেয়েছি বলে অন্তত বলতে পারি। রাসেল তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে যে সমস্ত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেই সব মানুষদের সম্পর্কে তিনি তার মতামত লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন ।অনেককেই তিনি স্পষ্ট ভাবে নিন্দা করেছেন (যেমন- ডি এইচ লরেন্স) অন্য অনেকের প্রতি তার প্রশংসার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছে উপহাস ( যেমন এইচ জি ওয়েলস এবং ওয়েবস দম্পতি) কিন্তু মাত্র একজন মানুষকে দেখলাম যার প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ এবং অবিমিশ্র প্রশংসা। সেই মানুষটি হলেন জোসেফ কনরাড । কনরাডকে রাসেল এতটাই প্রশংসা করেছিলেন যে তার নিজের একজন ছেলের নাম রেখেছিলেন কনরাড। কনরাড নৈতিক শৃঙ্খলা বা সংযমের ওপরে অসাধারণ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। রাসেলের নিজের ভাষায় বলতে গেলে-‘His (Conrad’s) point of view,one might perhaps say ,was the antitheis of Rousseau’s:’Man is born in a chain,but he can become free.’He becomes free ,so I believe Conrad would have said ,not by letting loose his impuls,not by being casual and uncontrolled ,but by subduing wayward impulse to a dominant purpose.’
যদিও এই কথাটা রাসেল কনরাডের মুখ দিয়েই বলিয়েছেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাসেল তার সমগ্র জীবনে এবং রচনাগুলিতে এই আদর্শটিকেই বাস্তবে পরিণত করার জন্য চেষ্টা করে গিয়েছেন ।সাধারণভাবে একটি সৎ ,সুখী এবং উদ্দেশ্যধর্মী জীবন যাপন করার জন্য আধুনিককালের সমস্ত লেখকের মধ্যে রাসেল বেশি করে সাহায্য করে বলে আমি ভাবি । আমার অর্ন্তজীবনের অনেক কথার জন্য আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে রাসেলের কাছে অনেক পরিমাণে ঋণী।
------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন