লামাঞ্চার মানুষটি
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস
অনেকদিন সিনেমা দেখি নি। একদিন সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করল। কোন ছবি ঘরে কী চলছে তা জানার জন্য খবরের কাগজে চোখ বোলাতেই চোখে পড়ল ক্যালভিন হলে ম্যান অফ লামাঞ্চা; অভিনয়ে রয়েছেন পিটার ও'টুল এবং সোফিয়া লরেন।
পিটার ও'টুল এর অভিনয় আমি ভালোবাসি। সত্যি কথা বলতে গেলে তার নামটা আমাকে সেদিন দুপুরবেলা 11 টার সময় সিনেমা হলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। লামাঞ্চা নামের জায়গাটা উত্তর মেরুতে না দক্ষিণ মেরুতে আর ভদ্রলোকটির জীবনবৃত্তান্ত বা কার্যকলাপ কী - সেই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল বা ধারণা ছিল না। না থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রায় জ্ঞান হওয়ার দিন থেকে ডন কিহোতের(Don Quixote নামটা অসমিয়া বানান এবং উচ্চারণে ডন কুইক্সোট নামেই সমধিক পরিচিত) কাহিনি শুনে আসছি যদিও বিশ্বসাহিত্যের এই অমর গ্রন্থটির সম্পূর্ণ নাম যে The Ingenious Gentleman Don Quixote of La Mancha - সে কথাটা প্রায়ই মনে থাকেনা। সিনেমাটি আরম্ভ হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে কথাটা পরিস্কার হয়ে পড়ল। ম্যান অফ লামাঞ্চা হল ডন কিহোতের চিত্ররূপ।
ডন কিহোতে কে? ডন কিহোতে হলেন সার্ভেন্তিসের দ্বারা রচিত সেই নামের বিশ্ব বিখ্যাত কাহিনি গ্রন্থের নায়ক কিন্তু আসলে ডন কিহোতে হলেন সার্ভেন্তিস নিজেই । ম্যান অফ দ্যা লামাঞ্চা নামের সিনেমাটির ও আসল নায়ক সার্ভেন্তিস। কিন্তু সিনেমাটি দেখার পরে আমার অনুভব হল এটা তো দেখছি আমারই জীবনের চিত্ররূপ। সিনেমাটি দেখলে আপনারও সেই একই ধরনের অনুভূতি হত।
প্রতিটি মানুষই সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কম বা বেশি পরিমাণে এক একজন ডন কিহোতে। প্রত্যেক মানুষই নিজের বুকের মধ্যে গোপনে একটা স্বপ্ন পুরন করে বেড়ায়। একটা অমর এবং অসম্ভব স্বপ্ন। কিন্তু ধূলিধূসরিত প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে কেউ কখনও সেই স্বপ্নের মিল খুঁজে পায়না। কিন্তু কখনও একটা দিন বা এমনকি একটি মুহূর্তের জন্য ও - বাস্তব জীবনের সঙ্গে সেই স্বপ্নের মিল খুঁজে পেতে ইচ্ছা করে না কি ? যখনই মন চায়, তখনই মানুষ হতে চায় ডন কিহোতে। ডন কিহোতে প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা চিরন্তন গোপন আকূতির প্রতীক। তাই একথা মোটেই আশ্চর্য নয় যে বাইবেলের পরেই সার্ভেন্তিসের 'ডন কিহোতে’ হল পাশ্চাত্য জগতের সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ ।
কিন্তু সার্ভেন্তিস নামের এই ভদ্রলোকটি কে?
একজন লেখক কোথায় যেন লিখেছিলেনঃ' ‘গত প্রায় দুই হাজার বছরের খ্রিস্টিয় যুগটি যে চার জন মহত্তম সাহিত্য প্রতিভার জন্ম দিয়েছিল তার তিনজনেরই আবির্ভাব হয়েছিল ষোলো শতকেঃ স্পেনে সার্ভেন্তিস, ইংল্যান্ডে সেক্সপীয়ার এবং ফ্রান্সে রাবেলা। অথচ সার্ভেন্তিসের ব্যক্তিগত জীবন বিষয়ে আমরা অতি সামান্য কথাই জানি, রাবেলের বিষয়ে প্রায় কিছুই জানিনা, আর সেক্সপিয়ারের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কথা কিছুই জানিনা।'
যাইহোক, সেক্সপিয়র বা রাবেলার তুলনায় সার্ভেন্তিসের ব্যক্তিগত জীবন ইতিহাস অধিক সু-পরিজ্ঞাত। ১৫৪৭ সনে সার্ভেন্তিসের জন্ম হয়েছিল। (সম্পূর্ণ নাম মিগুয়েল দ্য সার্ভেন্তিস )১৫৬৪ সনে অর্থাৎ সার্ভেন্তিসের জন্মের ষোলো বছর পরে জন্ম হয়েছিল শেক্সপিয়রের। ১৬১৬ সনে সার্ভেন্তিসের মৃত্যু হয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে সার্ভেন্তিস এবং শেক্সপিয়রের একই দিনে মৃত্যু হয়। আবার অন্য অনেকের মতে সেক্সপিয়র থেকে দশ দিন আগে সার্ভেন্তিসের মৃত্যু হয়। আশ্চর্যের কথা এই যে সাহিত্য জগতের কলোসাস সদৃশ এই দুই বিরাট প্রতিভা একই সময়ে জীবিত এবং সৃষ্টি কর্মে ব্যাপৃত হয়ে থাকা সত্ত্বেও একে অপরের অস্তিত্বের বিষয়ে জানতে পারার কোনো প্রমাণ নেই।
সার্ভেন্তিস ছিলেন অত্যন্ত দুঃখী পরিবারের ছেলে। কোমল বয়স থেকেই জীবিকার সন্ধানে তাকে স্পেন এবং ইটালির বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। ঠিক সেই সময় স্পেন,ভেনিস এবং পোপের মিত্রশক্তি অটোমেন তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় সার্ভেন্তিস জীবিকার তাড়নায় সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে। ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে লেপান্টোতে হওয়া যুদ্ধে সার্ভেন্তিসের বাঁ হাতটায় তিনটি গুলি লাগায় হাতটা চিরকালের জন্য অকেজো হয়ে যায়-সার্ভেন্তিসের নিজের ভাষায়-For greater glory of the right?
এর পরেও সার্ভেন্তিসকে আরও চারবছর সৈন্যবাহিনীতে থাকতে হল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে বাড়ি ফিরে আসতে কিছু তুর্কি জলদস্যু সার্ভেন্তিসকে পথে আটকে বন্দি করে আলজিরিয়াতে নিয়ে গেল এবং তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবী করল। বন্দি-দশা থেকে বারবার পালানোর চেষ্টা করার জন্য অবশেষে তাকে একটা নির্জন ঘরে অহর্নিশ লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন।
অশেষ যাতনাময় দীর্ঘ প্রবাস যাপনের পরে সার্ভেন্তিস বাড়ি ফিরে এলেন,কিন্তু সেই বাড়ি তার জন্য ছিল না Home, sweet home! বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাঁধে এসে পড়ল একজন জারজ কন্যা,পত্নী,মাতা,দুই বোন এবং একজন ভাইঝি সহ একটি বিশাল পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব। সার্ভেন্তিসের জীবিকার একমাত্র সম্বল তাঁর কলমটি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তিনি স্বপ্ন দেখে আসছিলেন যে সাহিত্য রচনা করেই তিনি অতুল ধন-সম্পত্তি এবং খ্যাতির অধিকারী হবেন। অবিশ্রাম কলম চালিয়ে তিনি অজস্র কবিতা এবং কুড়িটিরও বেশি নাটক রচনা করেন,কিন্তু সেই সবের দ্বারা তিনি খ্যাতি তো দূরের কথা –দুবেলা দুটি রুটিরও জোগাড় করতে পারলেন না। নিরুপায় হয়ে তিনি খাজনা আদায়ের মুহুরির কাজ নিলেন। কিন্তু সেখানেও বিপদ দেখা দিল। সংগৃহীত খাজনার ধন তিনি একজন পরিচিত ব্যাঙ্কারের কাছে জমা রেখেছিলেন,কিন্তু ব্যাঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় সার্ভেন্তিসকে জেলে যেতে হল।অনেকের অনুমান যে জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ‘ডন কিহোতে’র কাহিনি লিখতে শুরু করেন।
১৬০৫ সনে ডন কিহোতের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হল। প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বইটি অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করল। কিন্তু তার ফলে সার্ভেন্তিসের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত পড়ল না। ১৬০৫ সনে অর্থাৎ ডন কিহোতের প্রথম খণ্ড প্রকাশ হওয়া বছরটিতে তাকে আবার পুনরায় জেলের ভাত খেতে হল।
কী জীবন!!একটা হাত চিরকালের জন্য অকেজো। যৌবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বছরগুলি অতিবাহিত হল যন্ত্রণাময় বন্দিদশায়,দারিদ্র্যের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রামে। অথচ সেই মানুষটাই লিখলেন ডন কিহোতের কাহিনি-এক উজ্জ্বল আশাবাদ এবং চির-অপরাজেয় আদর্শবাদিতার কাহিনি। Man of La Mancha কথা ছবিটিতে সোফিয়া লরেনের মুখের কয়েকটি কথা এখনও আমার কানে বাজছেঃ
‘একটা অসম্ভব স্বপ্ন,এক অন্তহীন অন্বেষণ-সেখানেই তো জীবনের একমাত্র সার্থকতা। জয়-পরাজয় বা সাফল্য-ব্যর্থতা তুচ্ছ কথা। জীবনের একমাত্র গৌরব হল স্বপ্ন অসম্ভব বলে জেনেও তাকে অনুসরণ করা ছেড়ে না দেওয়া,অন্বেষণ অন্তহীন বলে জেনেও তাকে কখনও পরিহার না করা।’
এই অন্তহীন অভিযান এবং অসম্ভব স্বপ্নের নিমন্ত্রণই পশ্চিমের মানুষকে যুগ যুগ ধরে অস্থির এবং অশান্ত করে রেখেছে,যুগযুগ ধরে পশ্চিমের মানুষ সঙ্কল্প গ্রহণ করেছেঃ
To follow knowledge ,like a sinking star,
Beyond the utmost bound of human thought.
* * * *
To strive ,to seek, to find, and not to yield
(Ulysses: Tennyson)
‘সূর্যাস্তের ওপার পর্যন্ত জাহাজ চালিয়ে যাবার জন্য’সঙ্কল্প গ্রহণ করা এই পশ্চিমের মানুষই আজ মহাশূন্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে,’অসম্ভব স্বপ্ন’দেখছে মহাকাশের দূরতম সীমান্তে গিয়ে দাঁড়ানোর। পশ্চিমের মানুষ প্রমিথিউস,ইউলিসিস,ডন কিহোতে,ফাউস্ট।
---------
লেখক পরিচিতি- ১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
অনেকদিন সিনেমা দেখি নি। একদিন সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করল। কোন ছবি ঘরে কী চলছে তা জানার জন্য খবরের কাগজে চোখ বোলাতেই চোখে পড়ল ক্যালভিন হলে ম্যান অফ লামাঞ্চা; অভিনয়ে রয়েছেন পিটার ও'টুল এবং সোফিয়া লরেন।
পিটার ও'টুল এর অভিনয় আমি ভালোবাসি। সত্যি কথা বলতে গেলে তার নামটা আমাকে সেদিন দুপুরবেলা 11 টার সময় সিনেমা হলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। লামাঞ্চা নামের জায়গাটা উত্তর মেরুতে না দক্ষিণ মেরুতে আর ভদ্রলোকটির জীবনবৃত্তান্ত বা কার্যকলাপ কী - সেই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল বা ধারণা ছিল না। না থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রায় জ্ঞান হওয়ার দিন থেকে ডন কিহোতের(Don Quixote নামটা অসমিয়া বানান এবং উচ্চারণে ডন কুইক্সোট নামেই সমধিক পরিচিত) কাহিনি শুনে আসছি যদিও বিশ্বসাহিত্যের এই অমর গ্রন্থটির সম্পূর্ণ নাম যে The Ingenious Gentleman Don Quixote of La Mancha - সে কথাটা প্রায়ই মনে থাকেনা। সিনেমাটি আরম্ভ হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে কথাটা পরিস্কার হয়ে পড়ল। ম্যান অফ লামাঞ্চা হল ডন কিহোতের চিত্ররূপ।
ডন কিহোতে কে? ডন কিহোতে হলেন সার্ভেন্তিসের দ্বারা রচিত সেই নামের বিশ্ব বিখ্যাত কাহিনি গ্রন্থের নায়ক কিন্তু আসলে ডন কিহোতে হলেন সার্ভেন্তিস নিজেই । ম্যান অফ দ্যা লামাঞ্চা নামের সিনেমাটির ও আসল নায়ক সার্ভেন্তিস। কিন্তু সিনেমাটি দেখার পরে আমার অনুভব হল এটা তো দেখছি আমারই জীবনের চিত্ররূপ। সিনেমাটি দেখলে আপনারও সেই একই ধরনের অনুভূতি হত।
প্রতিটি মানুষই সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কম বা বেশি পরিমাণে এক একজন ডন কিহোতে। প্রত্যেক মানুষই নিজের বুকের মধ্যে গোপনে একটা স্বপ্ন পুরন করে বেড়ায়। একটা অমর এবং অসম্ভব স্বপ্ন। কিন্তু ধূলিধূসরিত প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে কেউ কখনও সেই স্বপ্নের মিল খুঁজে পায়না। কিন্তু কখনও একটা দিন বা এমনকি একটি মুহূর্তের জন্য ও - বাস্তব জীবনের সঙ্গে সেই স্বপ্নের মিল খুঁজে পেতে ইচ্ছা করে না কি ? যখনই মন চায়, তখনই মানুষ হতে চায় ডন কিহোতে। ডন কিহোতে প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা চিরন্তন গোপন আকূতির প্রতীক। তাই একথা মোটেই আশ্চর্য নয় যে বাইবেলের পরেই সার্ভেন্তিসের 'ডন কিহোতে’ হল পাশ্চাত্য জগতের সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ ।
কিন্তু সার্ভেন্তিস নামের এই ভদ্রলোকটি কে?
একজন লেখক কোথায় যেন লিখেছিলেনঃ' ‘গত প্রায় দুই হাজার বছরের খ্রিস্টিয় যুগটি যে চার জন মহত্তম সাহিত্য প্রতিভার জন্ম দিয়েছিল তার তিনজনেরই আবির্ভাব হয়েছিল ষোলো শতকেঃ স্পেনে সার্ভেন্তিস, ইংল্যান্ডে সেক্সপীয়ার এবং ফ্রান্সে রাবেলা। অথচ সার্ভেন্তিসের ব্যক্তিগত জীবন বিষয়ে আমরা অতি সামান্য কথাই জানি, রাবেলের বিষয়ে প্রায় কিছুই জানিনা, আর সেক্সপিয়ারের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কথা কিছুই জানিনা।'
যাইহোক, সেক্সপিয়র বা রাবেলার তুলনায় সার্ভেন্তিসের ব্যক্তিগত জীবন ইতিহাস অধিক সু-পরিজ্ঞাত। ১৫৪৭ সনে সার্ভেন্তিসের জন্ম হয়েছিল। (সম্পূর্ণ নাম মিগুয়েল দ্য সার্ভেন্তিস )১৫৬৪ সনে অর্থাৎ সার্ভেন্তিসের জন্মের ষোলো বছর পরে জন্ম হয়েছিল শেক্সপিয়রের। ১৬১৬ সনে সার্ভেন্তিসের মৃত্যু হয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে সার্ভেন্তিস এবং শেক্সপিয়রের একই দিনে মৃত্যু হয়। আবার অন্য অনেকের মতে সেক্সপিয়র থেকে দশ দিন আগে সার্ভেন্তিসের মৃত্যু হয়। আশ্চর্যের কথা এই যে সাহিত্য জগতের কলোসাস সদৃশ এই দুই বিরাট প্রতিভা একই সময়ে জীবিত এবং সৃষ্টি কর্মে ব্যাপৃত হয়ে থাকা সত্ত্বেও একে অপরের অস্তিত্বের বিষয়ে জানতে পারার কোনো প্রমাণ নেই।
সার্ভেন্তিস ছিলেন অত্যন্ত দুঃখী পরিবারের ছেলে। কোমল বয়স থেকেই জীবিকার সন্ধানে তাকে স্পেন এবং ইটালির বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। ঠিক সেই সময় স্পেন,ভেনিস এবং পোপের মিত্রশক্তি অটোমেন তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় সার্ভেন্তিস জীবিকার তাড়নায় সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে। ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে লেপান্টোতে হওয়া যুদ্ধে সার্ভেন্তিসের বাঁ হাতটায় তিনটি গুলি লাগায় হাতটা চিরকালের জন্য অকেজো হয়ে যায়-সার্ভেন্তিসের নিজের ভাষায়-For greater glory of the right?
এর পরেও সার্ভেন্তিসকে আরও চারবছর সৈন্যবাহিনীতে থাকতে হল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে বাড়ি ফিরে আসতে কিছু তুর্কি জলদস্যু সার্ভেন্তিসকে পথে আটকে বন্দি করে আলজিরিয়াতে নিয়ে গেল এবং তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবী করল। বন্দি-দশা থেকে বারবার পালানোর চেষ্টা করার জন্য অবশেষে তাকে একটা নির্জন ঘরে অহর্নিশ লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন।
অশেষ যাতনাময় দীর্ঘ প্রবাস যাপনের পরে সার্ভেন্তিস বাড়ি ফিরে এলেন,কিন্তু সেই বাড়ি তার জন্য ছিল না Home, sweet home! বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাঁধে এসে পড়ল একজন জারজ কন্যা,পত্নী,মাতা,দুই বোন এবং একজন ভাইঝি সহ একটি বিশাল পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব। সার্ভেন্তিসের জীবিকার একমাত্র সম্বল তাঁর কলমটি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তিনি স্বপ্ন দেখে আসছিলেন যে সাহিত্য রচনা করেই তিনি অতুল ধন-সম্পত্তি এবং খ্যাতির অধিকারী হবেন। অবিশ্রাম কলম চালিয়ে তিনি অজস্র কবিতা এবং কুড়িটিরও বেশি নাটক রচনা করেন,কিন্তু সেই সবের দ্বারা তিনি খ্যাতি তো দূরের কথা –দুবেলা দুটি রুটিরও জোগাড় করতে পারলেন না। নিরুপায় হয়ে তিনি খাজনা আদায়ের মুহুরির কাজ নিলেন। কিন্তু সেখানেও বিপদ দেখা দিল। সংগৃহীত খাজনার ধন তিনি একজন পরিচিত ব্যাঙ্কারের কাছে জমা রেখেছিলেন,কিন্তু ব্যাঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় সার্ভেন্তিসকে জেলে যেতে হল।অনেকের অনুমান যে জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ‘ডন কিহোতে’র কাহিনি লিখতে শুরু করেন।
১৬০৫ সনে ডন কিহোতের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হল। প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বইটি অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করল। কিন্তু তার ফলে সার্ভেন্তিসের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত পড়ল না। ১৬০৫ সনে অর্থাৎ ডন কিহোতের প্রথম খণ্ড প্রকাশ হওয়া বছরটিতে তাকে আবার পুনরায় জেলের ভাত খেতে হল।
কী জীবন!!একটা হাত চিরকালের জন্য অকেজো। যৌবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বছরগুলি অতিবাহিত হল যন্ত্রণাময় বন্দিদশায়,দারিদ্র্যের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রামে। অথচ সেই মানুষটাই লিখলেন ডন কিহোতের কাহিনি-এক উজ্জ্বল আশাবাদ এবং চির-অপরাজেয় আদর্শবাদিতার কাহিনি। Man of La Mancha কথা ছবিটিতে সোফিয়া লরেনের মুখের কয়েকটি কথা এখনও আমার কানে বাজছেঃ
‘একটা অসম্ভব স্বপ্ন,এক অন্তহীন অন্বেষণ-সেখানেই তো জীবনের একমাত্র সার্থকতা। জয়-পরাজয় বা সাফল্য-ব্যর্থতা তুচ্ছ কথা। জীবনের একমাত্র গৌরব হল স্বপ্ন অসম্ভব বলে জেনেও তাকে অনুসরণ করা ছেড়ে না দেওয়া,অন্বেষণ অন্তহীন বলে জেনেও তাকে কখনও পরিহার না করা।’
এই অন্তহীন অভিযান এবং অসম্ভব স্বপ্নের নিমন্ত্রণই পশ্চিমের মানুষকে যুগ যুগ ধরে অস্থির এবং অশান্ত করে রেখেছে,যুগযুগ ধরে পশ্চিমের মানুষ সঙ্কল্প গ্রহণ করেছেঃ
To follow knowledge ,like a sinking star,
Beyond the utmost bound of human thought.
* * * *
To strive ,to seek, to find, and not to yield
(Ulysses: Tennyson)
‘সূর্যাস্তের ওপার পর্যন্ত জাহাজ চালিয়ে যাবার জন্য’সঙ্কল্প গ্রহণ করা এই পশ্চিমের মানুষই আজ মহাশূন্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে,’অসম্ভব স্বপ্ন’দেখছে মহাকাশের দূরতম সীমান্তে গিয়ে দাঁড়ানোর। পশ্চিমের মানুষ প্রমিথিউস,ইউলিসিস,ডন কিহোতে,ফাউস্ট।
---------
লেখক পরিচিতি- ১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন