রবিবার, ২২ আগস্ট, ২০২১

হাঁটার বিষয়ে || হোমেন বরগোহাঞি || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ –বাসুদেব দাস || Basudeb Das

 হাঁটার বিষয়ে

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ –বাসুদেব দাস    





যে সমস্ত ধনী ব্যবসায়ী জীবনের সুখ-শান্তি হারিয়ে ফেলেছে, তারা হারানো সুখ শান্তি ফিরে পাবার জন্য নিজের জীবন দর্শনই পরিবর্তন করার চেয়ে দিনে ছয় মাইল হাঁটলে বেশি উপকার পাবেন বলে আমি ভাবি।

– বার্ট্রান্ড রাসেল

একজন মানুষ স্বাস্থ্যবান, কিন্তু তার মনে সুখ নেই। এরকম একজন মানুষ দৈনিক পাঁচ মাইল করে হাঁটলে যত উপকার পাবেন– সে উপকার তিনি পৃথিবীর সমস্ত ঔষধ খেয়েও বা মনস্তত্ত্বের বিষয়ে সমস্ত জ্ঞান আয়ত্ব করেও পাওয়ার আশা করতে পারেন না।

― পল ডাডলি হোয়াইট

ওপরের কথাগুলি একসঙ্গে পড়লে কোনো একজন অপরের কথা ধার করে বলছেন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সেরকম একটি ধারণা করা ভুল হবে। বার্ট্রান্ড রাসেল কুড়ি  শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু দার্শনিক হলেও তিনি কেবল বিমুর্ত দার্শনিক চিন্তা করেই জীবনটা শেষ করেন নি। মানুষের জীবনটা কীভাবে আনন্দময় এবং উপভোগ্য করে তোলা যেতে পারে , সেই বিষয়েও তিনি যথেষ্ট চিন্তা চর্চা করেছেন। বস্তুতঃ তার একটি বহুপঠিত গ্রন্থের নামই হল Conquest of Happiness।' সুখের অন্বেষণ' নাম দিয়ে বইটি অধ্যাপক সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী অসমিয়া ভাষায় অনুবাদ করেছেন। তাই একথা নিশ্চয় না বললেও হবে যে পায়ে হাঁটার   উপকারিতা ব্যাখ্যা করার জন্য বার্টান্ড রাসেলকে পল ডালডি হোয়াইটের সাহায্য নেওয়ার  কোনো দরকার নেই।

ঠিক সেভাবে পল ডাডলি হোয়াইটও বার্ট্রান্ড রাসেলের সাহায্য নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই ।ডাঃ পল ডাডলি হোয়াইট  একজন বিশ্ব বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। হৃদরোগের প্রতিকার করার জন্য বা নিরাময় করার জন্য নিয়মিত ভাবে ব্যায়াম করা একান্ত প্রয়োজন।ডাঃ হোয়াইট ব্যায়ামের উপকারিতা বিষয়ে অনেক জনপ্রিয় প্রবন্ধ লিখেছেন। তাই  হাঁটা তথা ব্যায়ামের উপকারিতা বিষয়ে তিনি অন্য কারও কাছ থেকে না শিখলেও হবে। 

একজন দার্শনিক ,অন্যজন চিকিৎসক। কিছু দুজনই বিশ্বাস করেন যে দর্শন বা মনস্তত্ত্বের জ্ঞান মানুষকে সুখী হওয়ায় সাহায্য করতে পারে না। মানুষের সুখ বহু পরিমাণে নির্ভর করে শরীরের রক্ত সঞ্চালনের ওপরে। রক্ত সঞ্চালনের সাহায্য করা যে কোনো শারীরিক ব্যায়ামই মানুষকে সুখী এবং স্বাস্থ্যবান করতে পারে। কিন্তু দার্শনিক এবং চিকিৎসক দুজন হাটার ওপরে গুরুত্ব আরোপ করার কারণটা হল এই যে বেশিরভাগ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীর মতেই  হাঁটা হল সর্বোত্তম ব্যায়াম। এটি শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সতেজ এবং সজীব করে তোলা ছাড়াও  মনের মধ্যেও প্রফুল্লতার ভাব আনে।

ইংরেজরা হাঁটতে খুব ভালোবাসে। আমি কটন কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই বিকেলে কার্জন হলে(এখনকার কর্মবীর নবীন বরদলৈ হল) গিয়ে বই আর ম্যাগাজিন পড়তাম। সেখানে কোনো একটি বইয়ে না ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম যে কার্লাইল পায়ে হাঁটতে  এত ভালোবাসতেন  এবং এতটাই হাঁটতে পারতেন যে তিনি নাকি একদিন নিজের বাড়িতে ঢুকতে ভুলে  গিয়ে ৫২  মাইল পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন।কথাটা বিশ্বাস করতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল।আমার নিজেরও পায়ে হাঁটার অভ্যাস বড় কম নয় । পৃথিবীর যে অঞ্চলে আমার জন্ম হয়েছিল সেখানে আমার যুবক বয়স পর্যন্ত যন্ত্র চালিত যানবাহনের আবির্ভাব হয়নি । বেশিরভাগ মানুষের পা দুটিই ছিল একমাত্র সারথি । মাত্র বারো  বছর বয়সে মহকুমা শহরের হাইস্কুলে পড়তে গিয়ে আমি নিজে চব্বিশ মাইল পথ পায়ে হেঁটে  গিয়েছিলাম। স্কুল বন্ধ থাকার সময় যত বার গ্রামের বাড়িতে আসা যাওয়া করেছিলাম ততবারই পায়ে হেঁটে  গিয়েছিলাম। পায়ে হাঁটা বিষয়ে আমার এই ধরনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল যে কার্লাইল বাড়িতে প্রবেশ করতে ভুলে গিয়ে এক মাইল দুই মাইল নয় – পুরো ৫২  মাইল –- হেঁটে যেতেই থাকল।৫২ মাইল পায়ে  হেঁটে যেতে তার কত ঘন্টা সময় লেগেছিল ? 

কিন্তু পরবর্তীকালে আর ও কয়েকটি গ্রন্থে ইংরেজদের পায়ে হাঁটার অভ্যাসের  বিষয়ে নানা তথ্যের সম্ভেদ পেয়ে আমার মনে নতুন করে ধারণা হয়েছে যে কার্লাইলের ৫২ মাইল পায়ে হাঁটা টা অসম্ভব না হতেও পারে। উনিশ শতকের  ইংরেজ রোমান্টিক কবিরা পায়ে হাঁটতে  ভীষণ ভালোবাসতেন। বস্তুতঃ পায়ে হেঁটেই তারা প্রকৃতির বিচিত্র রূপ আবিষ্কার করেছিলেন এবং প্রকৃতিকে পুজো করতে শিখেছিলেন। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ অনবরত পায়ে হেটে বেড়াতেন। ডি কুয়েন্সি  হিসেব করে বের করা মতে জীবনের মাঝ বয়সে পৌঁছানোর সময় ওয়ার্ডসওয়ার্থ নাকি ১,৮০,০০০ মাইল পায়ে হেঁটেছিলেন। রোমান্টিক যুগের অন্য একজন শীর্ষস্থানীয় কবি কোলরিজের স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল না। ব্যায়াম করার চেয়ে বসে বসে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারতে বেশি ভালোবাসতেন। কিন্তু সেই কোল রিজ ও রাতের আহার খাওয়ার পরে উঠে একটা চিঠি ডাকে দেবার জন্য ষোলো মাইল পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে ফিরে আসাটাকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ  কথা বলে ভাবেন নি ।

কিছুদিন আগে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এ এল রাউজের একটি বই পড়েও ইংরেজদের পায়ে হাঁটা বিষয়ে অনেক কথা জানতে পারলাম । রাউজ লিখেছেন যে উনিশ শতকের ইংরেজ মনীষীরা পায়ে হাঁটতে বড় ভালোবাসতেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত ঐতিহাসিক জি এম ট্রেভেলিয়ান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ট্রেভেলিয়ান পায়ে হাঁটতে বড় ভালোবাসতেন। যুবক বয়সে তিনি নাকি দিনে  ৬০ মাইল পর্যন্ত হাঁটতে পারতেন। একবার তিনি ক্যামব্রিজ থেকে অক্সফোর্ড পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। দুটি জায়গার মাঝখানের দূরত্ব ছিল ৮৩  মাইল , আর সেই ৮৩  মাইল হেঁটে যেতে ট্রেভেলিয়ানের সময় লেগেছিল ২৪ ঘন্টা।

ইংরেজ সমালোচক এবং প্রবন্ধকার উইলিয়াম হেজলিটের প্রিয় জিনিস গুলির যে তালিকা আমরা পাই তাতে রয়েছে বই চিত্রকলা , প্রাকৃতিক সৌন্দর্য , অভিনয় , শক্তিশালী ভাবুকের প্রজ্ঞা , স্বাধীনতা –– ইত্যাদি ।

আর?

আর পায়ে হাঁটা।

কেবল উনিশ শতকের নয়,কুড়ি শতকের ইংরেজরাও  বোধহয় পায়ে হাঁটতে  ভালোবাসে। বহু বছর আগে Encounter নামের ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম – কবি স্টিফেন স্পেন্ডার অন্যান্য অনেক কথার সঙ্গে একা দীর্ঘ পথ হাঁটতে ভালোবাসেন।

ওপরের কথাগুলি থেকে এরকম একটা ধারণা হতে পারে যে ইংরেজরা ছাড়া আর কেউ যেন পায়ে হাঁটে না। বিখ্যাত আমেরিকান রাষ্ট্রনেতা টমাস জেফারসন ঘোড়ার নিন্দা করে বলেছিলেন যে ঘোড়া থাকার জন্যই মানুষ কম হাঁটতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ তিনি হাঁটতে খুব ভালোবাসতেন। জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের কাছে কথাটা ছিল শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার মতোই একটা ছাড়তে না পারা অভ্যাস । প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তিনি হাঁটতে বের হতেন । কোনোদিন এক সেকেন্ডও এদিক-ওদিক হত না । তার শহর কনিসবার্গের   মানুষ  তাকে হাঁটতে বের হতে দেখে নিজেদের ঘড়ি মিলিয়ে নিত। 

বেঁচে থেকে যদি আনন্দ পেতে চান, তাহলে হাঁটার অভ্যাস করুন।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...