স্মৃতিকথা - ১৩
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
(গত মাসের পর)
খুব ভালোভাবে মনে আছে গড়বেতা হায়ার সেকেন্ডারি
স্কুলে ঢুকতে গিয়ে একটি বাণীর মুখোমুখি আমাদের হতে হত । একটি তোরণের ওপর বাণীটি ছিল। বাণীটি:
" কী চাই ?
নহে মনীষীর মেধা
নহে মনীষীর মতো
নহে মৃত শাস্ত্র বাণী
চাহি নিত্য সত্য পথ "
তোরণ দিয়ে ঢুকলেই শুরু হল সারি সারি দোতলা ক্লাস ঘর । স্কুলের পেছনে বোর্ডিং । কিছু ছাত্র সেখান থেকে পড়াশোনা করতো। তার পরে ছিল খেলার মাঠ । পরিবেশ হিসেবে স্কুলটি ছিল আদর্শ ।
গনগনির ডাঙাকে স্থানীয় লোকজন ' খুলা' বলতো । গড়বেতাতে গিয়ে কিছু নতুন নতুন ভাষা শিখেছিলাম,
যেমন মহিষকে ' কাড়া' রামছাগলকে ' বদা ' ইত্যাদি ইত্যাদি । লাল মাটির এই এলাকায় গ্রীষ্ম কালে জল কেনা হত টিন প্রতি চার আনা করে । মিষ্টির দোকানে
মিষ্টি র সঙ্গে এক গ্লাস ফ্রি জল দেওয়া হতো । বাকি লাগলে বেশি পয়সা লাগতো । আমাদের বাড়ির পাশে
দু দুটি দোকান ছিল । এদের মধ্যে মানিক কাকুর সঙ্গে
আমার ভাব ছিল বেশি । তার ছিল স্টেশনারী দোকান । পরবর্তীতে মনোমালিন্য হয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ।
আমাদের খেলাধুলা বলতে প্রধান ছিল গুলি খেলা । গুলি আমাদের পকেটে পকেটে থাকত । আর
থাকতো সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে বানানো কার্ড । তখন সিগারেটের কত নাম চারমিনার, সিজার্স, ক্যাপস্টান, পাসিং শো , গোল্ড ফ্লেক, উইলস ফ্লেক এই সব। চারমিনারের রেট ছিলো কম , আর পাসিং শো-রেট ছিল বেশি । নির্দিষ্ট গুলি টল দিয়ে মেরে আমরা জিততাম নয় হারতাম সিগারেটের কার্ড। এমন খেলা এখন দেখা যায় না ।
আস্তে আস্তে মেদিনীপুর শহর থেকে আসা এই আমি চরিত্রটি ক্রমশ গড়বেতাতে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা
করলাম । কিন্তু আমার চিন্তা ও ধারনার মধ্যে কারোর তেমন মিলত না । ফলে মাঝে মধ্যে নিঃসঙ্গ হতে লাগলাম । তখন চলে যেতাম গড়বেতা মুন্সেফ কোর্ট ও থানার পাশে যেখানে লন টেনিস খেলা হত তার একমাত্র দর্শক হতাম। কারোর সঙ্গে মিশতে মন চাইতো না। কারণ মিশতে গিয়ে দেখেছি সমবয়সীদের ভেতরে স্বার্থপরতা । তাই তারা আমাকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো না । তাছাড়া একজন এইরকম ছেলের সাথে পেছনে লাগার আনন্দ কেই বা ছাড়তে পারে । সহপাঠীরা চুটিয়ে আমার পেছনে লাগতো । অনেক সময় তা হেনস্থার পর্যায়ে চলে যেত । অন্তর্মুখী এই চরিত্র তাই লন টেনিসের জায়গা বিকেলের জন্য বেছেছিল । লন টেনিস খেলতেন মুন্সেফ কোর্টের জাজ , স্কুল টিচার , সরকারি অফিসারদের মতো গণ্যমান্যরা ।
চটির ভাড়া বাড়িতে থাকার সময় প্রথম প্রথম আমার পরিবারের সঙ্গে দোতলার পরিবারের
মেলামেশা থাকলেও পরে তা ছিল না । পরে কুঁয়োর জলকে কেন্দ্র করে ঝগড়া ও শেষ আবধি থানা পুলিশ
অবধি পৌঁছোয় । গড়বেতা নিয়ে মা একটি কথা বলতো , ' এখানে পরিবেশ ভালো হলেও মানুষ ভালো নয় । ' আমি ছোট ছিলাম তবু এর কিছু কিছু দেখেছি ।এখন মনে হয় এই এলাকার সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির পার্থক্য তার প্রধান কারণ। দু-চারজন ছাড়া তেমনভাবে কারোর সঙ্গে মিশতে পারতাম না। দিদিদের ক্ষেত্রে স্কুলের মেয়েরা ওদের পেছনে লাগতো । দিদিরা এসে সে সব গল্প মায়ের সঙ্গে করতো। মা দিদিদের উচিত জবাব দেবার শিক্ষা দিত । ( চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন