সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১

দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত আটপৌরে কবিতা সম্পর্কে || অলোক বিশ্বাস || Atpoure, Alok Biswas

দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত আটপৌরে কবিতা সম্পর্কে

অলোক বিশ্বাস

    আটপৌরে কবিতা নিয়ে বেশ অবিরাম স্রোত চলছে দৈনিক বাংলা ওয়েবজিনে। দেবযানী বসুর আটপৌরে কবিতাগুচ্ছে  হৈচৈহৈচৈ লেগে আছে। semantics সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা তো উৎপল কুমার বসু, মলয় রায়চৌধুরী, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল প্রমুখ অনেকেই কোরে গেছেন। দেবযানী বসু তাঁদের উত্তরসূরী এবং নিজের মতো সেমান্টিক্সের আজব প্যাথলজি চালাচ্ছেন। কবিতার ভাষায় অন্য এক ডায়ালেক্ট নির্মাণ যাকে ভার্সিফিকেশনের ডায়াস্পোরাও বলা যায়। এই কর্কশতা একেবারে যে বিরল তা বলা যাবে না। ষাটের দশকে স্বল্প কিছু কবি এবং প্রকল্প সাহিত্যের কবিরা এটায় হেস্তনেস্ত কোরেছিলেন। সেই ইতিহাস কতোটা গ্রহণযোগ্য এখানে প্রশ্ন তোলার মতো পাঠক খুব কম এই কারণে যে, তাঁরা পাঠ অভিজ্ঞতায় কোনো রিস্ক নিতে চান না। তাছাড়া ইউরোপ আমেরিকায় কবিতায় সেমান্টিক্সের বৈচিত্র্যময় খেলার গবেষণায় সরকারি বেসরকারিভাবে আর্থিক মূল্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই স্বীকৃত। কিন্তু, এখানে এসব নিয়ে গবেষণা কোরলে, অ্যাকাডেমিসিয়ান এবং প্রচল ধারার রচনাকারেরা রে-রে কোরে উঠবেন। তারপরে, সহকর্মী নিকটজন কবি লেখকদের তো প্যাঁচামুখ দর্শন কোরে যেতেই হবে। অনেক বাধা সত্ত্বেও, মুখপোড়া মন্তব্য থাকলেও, দেবযানীর এইসব কবিতার পাঠক আছে অনেক। হয়তো তাঁরা এইমুহূর্তে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবেন না, কিন্তু মনে মনে কবিতাটি অধিকবার পাঠ কোরতে থাকবেন। জিগজ্যাগ পথও হয়তো খুঁজবে কেউ কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থে পৌঁছনোর জন্য। যাবতীয় আয়লা, ফোনি, আম্ফান, ইয়াস ইত্যাকার প্রাকৃতিক অবস্থানগুলির চরিত্রগত মোডাস অপারেন্ডি শিল্পের কোথাও কোথাও ঢুকে পড়বেই কাব্য প্রকৃতির রসায়নগত তাগিদে। প্লেটো কথিত দ্য রিপাবলিকের কবি সম্পর্কিত নির্দেশাবলী আজকের পাঠক কতোটা গুরুত্ব দেবেন, এখন সেটাই দেখার। তথাপি দেবযানী এমনটাই লিখে যাবেন, তাঁকে রাষ্ট্র বহির্ভূত কোরে দিলেও। গঠন প্রক্রিয়ার অভিনবত্বকে ও ক্লাসসিজমের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। ওর আটপৌরে কবিতাগুলো সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত। সঙ্গে কবিতার নামকরণও আছে। নামকরণ গুলো কখনো ২,৩,৪ শব্দে অর্থাৎ আট শব্দে লিখিত আটপৌরে কবিতার নামকরণ কখনো দীর্ঘায়িত। আর একটা ব্যাপার অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করছি, কবিতাগুলোর ভাষা উচ্চাঙ্গের আবহকে আচ্ছন্ন করলেও নামকরণগুলো উচ্চাঙ্গ তার বা ক্লাসসিকতার বিপরীত মেরুতে গিয়ে এনগ্রেভড। পাঠকের এও মনে হতে পারে কবিতার নামকরণ গুলো কবিতার থিম অবলম্বন করে আছে অথবা একটা কবিতাই : পৃথিবী মাত্র এক পেপারওয়েট/ভূতের নক্ষত্রজনিত অসুখ/ছাতাটির ছাউনি ভাঙা কলংক/জমি অনুযায়ী আকাশের সীমানা/শনিবার ভালো কাটুক বিদেশি/পেন্সিলরা সৈনিক সেজেছিল/নিপাতনে সিদ্ধ গ্লিসারিন/অসহ্য পঞ্চভূত/স্কুলের ঝাউগাছ সাক্ষী/বোকামির অপর নাম মিরান্দা... এরকম সব দেবযানীর আটপৌরে কবিতার নাম। কবিতাগুলোতে শব্দ বিন্যাসের অবয়বে বিশেষ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করছি। যেমন, প্রথম পংক্তির তিনটি শব্দের প্রতিটির পরে যতি চিহ্ন। দ্বিতীয় লাইনে ব্যবহৃত শব্দের পরে যতিচিহ্ন নেই। তৃতীয় পংক্তিটির শেষে  যতিচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জোড়কলম শব্দ বানানো হয়েছে। যেমন, লাড্ডুগণেশ, ব্রহ্মরাক্ষস, তীর্থরেণুসৌরভ, সাগরমানসী। কখনো দুটো শব্দের মাঝখানে হাইফেন বসিয়ে অন্য ব্যঞ্জনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে কবিতার থিমকে। যেমন, আইনি-বৌ, কুকুর-বৌ। প্রথম লাইনে যতিচিহ্ন সহ তিনটি শব্দের পৃথক অর্থ ব্যঞ্জনাকে দ্বিতীয় লাইনে একটি শব্দ প্রয়োগে প্রথম লাইনের তিনটি শব্দের মুডকে ধরে, তৃতীয় লাইনে সেই মুডের চরিত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা অবজেকটিফাই করা হয়েছে সমগ্রতাকে। দেবযানীর আটপৌরে কবিতায় বাংলা তৎসম শব্দের পর্যাপ্ত প্রয়োগে পৌরাণিকতার প্রবাহকে জারি রাখা হতে দেখছি। একপ্রকার চিরকালীন সনাতনী বনেদিয়ানার প্রবহমানতা ধরা আছে। আছে কি কোথাও নার্সিসিজম ? সেই চিরকালীন নিজেকে দেখা উল্টেপাল্টে ? বাংলা কবিতা যখন পুরাণপ্রাণিত কাব্যিকতার রূপ বহুকাল পূর্বে ত্যাগ করে ক্রমশঃ নাগরিক চেতনায় পলিশড হয়ে উঠেছে, উনিশ শতক থেকেই, সেই সময় দেবযানী বসুর আটপৌরে কবিতাগুলো নিশ্চিতভাবে অতীত আত্মগত সংস্কৃতির কাছে ফেরার মনোভাব পোষণ করে। পুরাণকল্পের পরম্পরার ধ্বনি যেন শোনা যাচ্ছে নতুন আদলে। যেন কথামৃতের সংরক্ষণ প্রবণতা। বাংলা কবিতায় নতুনতর ক্লাসিক বা আর্যত্ব নির্মাণ করলেন তিনি এইসব ধ্যানস্থ কবিতায়। সংস্কৃত সাধনার ধ্যানস্থ রূপটির স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিশ্লোকসম অর্থগূঢ় কবিতাগুলোতে।
##
কবি নীলিমা সাহার আটপৌরে কবিতায় আমরা খুঁজে পাবো জগতের মধ্যে সর্বদা জন্ম নেওয়া আরো জগৎ। নক্ষত্রপুঞ্জের ভেতর ঘটছে যে বিস্ফোরণ, তারই কিছু অভিব্যক্তি। ৩৭ থেকে ৩৯ সংখ্যক কবিতায় তিনি তিনরকমের অস্তিত্বকে চিহ্নিত কোরেছেন। ২৫ থেকে ২৭ সংখ্যক কবিতায় সুন্দরকে খুঁজছেন চেনা অচেনায়। যেকোনো বস্তুতে, এমনকি বিষাদের ভেতর, না-পাওয়ার ভেতর, শুষ্কতার ভেতর সৌন্দর্যের সন্ধান তাঁর। জীবন চর্যার ইমপ্রেশন অকপট তাঁর আটপৌরে কবিতায়। দৈনিক বাংলা ওয়েবজিনে প্রকাশিত ১৫৪ থেকে ১৫৬ সংখ্যক আটপৌরে কবিতায় সমসাময়িক রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার তথা ভারসাম্যহীনতার কথা। তাঁর কবিতায় এসে পড়ে রাজনৈতিক দেউলেপনার মর্মার্থ। দৃশ্যের চলমানতায় শব্দকল্লোলের নির্মিত অবস্থানটি অন্যান্যের আটপৌরে থেকে পৃথকায়নায়িত। আমরা জেনেছি, রলাঁ বার্থ উল্লিখিত মাল্টি-ডাইমেনশনালিটি, মিনিং-এর বহুত্বময় প্রকাশ। কাব্যে শব্দের প্রবেশায়নে অনুভব আর পর্যবেক্ষণের মিশ্রিত রূপ ক্রমশঃ তাদের অবস্থান বদল কোরছে। বাংলা কবিতার প্রবহমানতায় শব্দের রূপকে কতোভাবে নির্মিত হতে দেখছি নীলিমা সাহার কবিতায়। ৩ সংখ্যক কবিতাটি যেন মনালগ। নিরালাকে অনুভব কোরতে চাওয়া : 'ডুমুর ফুলের আবডালে/সন্ধ্যাভাষা/অপাঙ্গে নিরালায় খেলে তৃষ্ণাজল'। আটপৌরে কবিতার গঠনে নীলিমা সাহার কিছু পার্থক্য দেখেছি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত অন্যান্যদের আটপৌরের সঙ্গে। অল্প কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া, নীলিমা সাহা যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি। নির্জনতা, শূন্যতা, ব্যর্থ অভিজ্ঞান, ভাঙচুর জীবনকে নিয়ে তাঁর অনেক প্রকাশ। আটপৌরে জীবনের ঢঙে গল্পের মেজাজে কখনো তাঁর বলে ওঠা : জীবন গল্পের সমাহার/মুখোমুখি/বিস্ময়-প্রশ্নচিহ্ন ! বিগঠিত এক উপন্যাস'। ৩১ থেকে ৩৩ সংখ্যক কবিতায় বিশেষভাবে গঠিত শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় : মেঘালো, শ্রাবণীবুক, মেঘমাস, জলৌৎসব। মনুষ্যকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত হতে চাওয়া চারপাশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাস্তুতান্ত্রিক, প্রাকৃতিক চঞ্চলতার মুহুর্মুহু প্রোফাইল এসেছে নীলিমা সাহার কবিতায়। তিনি যেন সেসবের মধ্যেই যাপন কোরছেন আর স্বগত উচ্চারণে বলছেন নিজের সম্পৃক্ততার প্রবণতাগুলো। কবিতার মধ্যে প্রশ্নচিহ্ন বা বিস্ময়চিহ্ন থাক বা না থাক, সেগুলো যেন শব্দের মধ্যে সংযোজিত হয়েই আছে। তাঁর দেখাটা যেন দর্শনসমৃদ্ধ সন্তরণ, সাঁতারতে সাঁতরাতে দূরে চলে যাচ্ছেন, কাছে চলে আসছেন। সকল অস্তিত্বকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কোরছেন। সেখানে মানুষ থেকে শুরু কোরে অন্য প্রাণীদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ, উৎপত্তি থেকেই বিস্ময়চিহ্ন : 'গাছমূল বেয়ে জট/কাঠবেড়াল/এক জীবনে কীভাবে খুলবে !'(৩৯ সংখ্যক কবিতা)। আর একটিতে বলছেন : 'আছি না আছির ধন্ধে/নিত্য/মঞ্চ জিইয়ে রাখা পুতুলনাচ'।  নীলিমা সাহার আটপৌরে নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় দেবযানী বসু লিখছেন : 'সবার চিৎকারকে রূপ দিচ্ছেন কবি'(১০ই জুলাই, ২০২১)। আটপৌরে কবিতায় যেহেতু শব্দ সংখ্যা মাত্র আট, সেই কারণে শব্দকে এখানে অনেক বড়ো ভূমিকা পালন কোরতে হয়। সেই ভূমিকা পালন আটটি শব্দে নির্ধারিত হলেও, শব্দের মধ্যে কবিকে সীমাহীন বিশ্বের উপাদান পারম্পর্য ও রহস্যকে আত্মস্থ কোরতে হচ্ছে। এখানে শব্দ অতিরিক্ত ধ্বনি, শব্দ অতিরিক্ত অর্থআত্মা, শব্দ অতিরিক্ত বিমোচন, শব্দ অতিরিক্ত মেধা ও চাতুর্য, শব্দ অতিরিক্ত ব্যুৎপত্তি, শব্দ অতিরিক্ত দৃশ্যাবলী, শব্দ অতিরিক্ত জাগরণ, শব্দ অতিরিক্ত প্রক্রিয়ার ব্যবহার আয়ত্ত কোরতে হচ্ছে কবিকে। অন্যান্য ছোটো কবিতার শব্দ-সচেতনা আর আটপৌরের শব্দ-সচেতনা, কোথাও কোথাও অবশ্যই পৃথক। অন্যান্য ছোটো কবিতার বাক্য তথা পংক্তির নির্মিতির দিকে বেশি নজর রাখা হয়। মেসেজ বা একটি বার্তাও সেখানে হয়তো প্রধান ভূমিকা পালন করে ভাবনা অনুসারে। কিন্তু আটপৌরেতে শব্দের খেলাটিকে সকল বস্তুচিন্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়। ধারালো রাখতে হয় প্রতিটি শব্দ। শব্দের গ্রহণ ক্ষমতাকে তীব্র রাখতে হয়। শব্দকে মেশাতে হয় অন্য শব্দের উপকরণ প্রকরণের সঙ্গে। নীলিমা সাহা দৈনিক বাংলা ওয়েবজিনে প্রকাশিত আটপৌরে কবিতায় এই কাজটি কোরে চলেছেন নীরবে, নির্জনে, সাধনামুখর অন্তরাত্মায়।
##
আটপৌরে কবিতায় সুদীপ বিশ্বাস পাঠকের মনে নতুন এক ক্লাসিসিজমের গন্ধ এনে দিলেন। প্রতিটি কবিতাই সংহত। আটপৌরে কবিতায় সংহতি লক্ষনীয়। তবু কিছু গঠনের কথা বলতে হলো। 'জোনাকি' কবিতায় প্রথম পংক্তি এমন হলে ভালো হতো--- 'মৃদুআলো। নেভাআলো। জ্বেলে দিলো।'  শব্দ যদি জোড় না করা হয়, তাহলে প্রথম পংক্তিতে হয়ে যাচ্ছে ৬ টি শব্দ, তিনটির পরিবর্তে। 'নভস্থল' কবিতার প্রথম লাইন সেভাবেই হতে চাইছে--- 'দুইখণ্ড। লঘুমেঘ। শূন্যময়।' আটপৌরে কবিতায় প্রথম লাইনে তিনটি শব্দ, দ্বিতীয় লাইনে একটি শব্দ এবং তৃতীয় লাইনে চারটি শব্দ দেখা যায়। শব্দসংখ্যা কোনো কারণে বৃদ্ধি পেলে তাকে অন্য শব্দের সঙ্গে জোড়কলম শব্দে রূপান্তরিত করা চাই। আটপৌরে কবিতায় ৮টি শব্দের বেশি শব্দ আনা যায় না। এই মূল গঠনটা ঠিক রেখে শব্দকে বিভিন্ন স্থানে সংস্থাপন করা যেতেই পারে। বাংলা কবিতার নতুন ভবিষ্যত তৈরি হচ্ছে আটপৌরে কবিতা আন্দোলনে। এর বিকাশে, সম্প্রসারণে। কবি সুদীপ বিশ্বাসের কাজে এক্ষেত্রে আরো ভাবনা সংযোজন হবে। ভবিষ্যতে বহু কবি আটপৌরে লিখতে চাইবেন, নিজের মতো কোরে। এই কবিতা আন্দোলনের জনক কবি ও সম্পাদক সৌমিত্র রায়, আমি যতদূর জানি। আজকে যাঁরা কবিতা লিখছেন, তাঁরা অনেকেই জানেন, ইতিমধ্যে আটপৌরে কবিতা নিয়ে দৈনিক বাংলা এবং আই-সোসাইটি ব্যাপক কাজ শুরু কোরে দিয়েছে। আটপৌরে কবিতার কাজে সৌমিত্র রায়ই প্রথম লেখার অনুরোধ নিয়ে আসে আমার কাছে বহু বছর আগে। ভবিষ্যতে বাংলা কবিতার নতুন গবেষণার ক্ষেত্র হতে পারে আটপৌরে কবিতা। এই ধরণের কবিতায় নতুন কোরে পেয়েছি দেবযানী বসু এবং নীলিমা সাহাকে। ইতিমধ্যে আমিও লিখেছি ১০০ হাজারেরও বেশি আটপৌরে কবিতা। অনেকেই আটপৌরে কবিতা আই-সোসাইটি পত্রিকায় এবং কেউ কেউ দৈনিক বাংলায় লিখেছেন। এই বিশেষ ধরণের বিশেষ অভিধায় দৈনিক বাংলাতেই পেয়েছি সুদীপ বিশ্বাসকে। সুদীপের আটপৌরে কবিতা অত্যন্ত পরিণত লেখা। কিছুটা ক্লাসিক ধর্মিতার মিশ্রণ আছে। প্রতিটি কবিতার পৃথক নামকরণ কোরেছেন কবি। ওর 'বোষ্টমী' কবিতাটির প্রথম পংক্তির তিনটি শব্দের প্রত্যেকটির পরে যতিচিহ্ন। পদাবলীর প্রেম চেতনায় যেমন বহু প্রক্ষোভযুক্ত ভাবনাপর্ব আছে, তেমনি, সুদীপের ওই কবিতাটির যতিচিহ্ন সমেত প্রথম তিনটি শব্দে যেন একক প্রেমেরই বিভিন্ন পর্বের পৃথক অবস্থা : 'হৃদিসরোবরে। গহীনজলে। একতারাতে।' দ্বিতীয় লাইনের 'প্রেমযমুনা' শব্দটির পরে যতিচিহ্ন নেই। তৃতীয় লাইনে চারটি শব্দের সমন্বয়ে একটি বাক্য এবং তার শেষে যতিচিহ্ন। এরকম অবয়বেই সুদীপ সাজিয়েছেন 'মর্ষকাম' 'ভগ্নতরী', 'চিত্ত' ইত্যাদি কবিতা। ওর আটপৌরেতে নিবেদন প্রয়াস আত্মার বিশুদ্ধতা বহন করে সম্পূর্ণতই। আটপৌরে কবিতা বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে অকারণ উপমাহীন অলঙ্কারহীন লোকজ কবিতার অবয়ব। বাংলার চিরকালীন ঘরোয়া জীবনের সাধনা ধ্যান, অঞ্জলি, মন্ত্রসদৃশ্য উচ্চারণ আর লৌকিক রসে ভরা কর্মসক্রিয়তা। পৌরাণিক আদলে সংরক্ষিত রূপকথা উপকথা আর লোক্যাল, প্রান্তিক কথোপকথনের বিশেষ এক সুরভঙ্গি। এসবই কিছুটা কিছুটা দ্রাবিত হয়েছে সুদীপ বিশ্বাসের আটপৌরে কবিতায়। মন-কেমন করা তত্ত্বজ্ঞানহীন উদাসীনতাও পেয়েছি সেখানে। হয়তো সেটা আত্মার আর এক দার্শনিক উন্মোচন, যে উন্মোচনে মিশে থাকে মানব জন্মের চিরকালীন গাথা, ব্যাল্যাড আর মন্ত্রসঙ্গীত। উল্লেখ করা যাক 'হৃদয়বাড়ি' কবিতাটি : 'জীর্ণঘরে। নিত্যখেলা। সালতামামি। / লজ্জাহরণ/থাকবে তুমি থাকবো আমি।' অনুভব করা যাচ্ছে বাংলার আত্মগীতিপ্রিয় প্রাকৃত জীবনের সহজিয়া মানস। ধর্ম সেখানে লৌকিক জীবনের অন্যতম শক্তিদায়ক। মিথ পুরাণ, অলৌকিককে জাগিয়ে তোলা প্রতীক, অন্ত্যজ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রবণতা, মায়ারূপ প্রজ্ঞা, সবই যেন সুদীপ বিশ্বাস নামক এক জীবন পথিকের যাপনের আকর। জীবনমন্থন এইসব কবিতার সুরসত্তা। কবি যেন আপন মেজাজ ও সৃষ্টিসত্তার মেজাজকে নতুন কোরে ঝাঁকিয়ে দেখছেন। মনে হতে পারে, রাবীন্দ্রিক ভাবসত্তাকে ব্যবহার কোরতে চেয়েছেন জীবনদেবতার কথায়। প্রতিটি কবিতা আত্মদর্শনে জায়মান। সুদীপের কবিতার অন্তর্লীন অনুভব জগতের প্রগাঢ়তাকে কুর্নিশ জানাই।  



 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...