বিদেহ নন্দিনী~ ৩১
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(৩১)
হনুমান আমাকে বালীর ভার্যা তারার বিচক্ষণতার কথা বলেছিল-' হে মাতা সীতাদেবী, সেদিন মহারানী তারা না হলে মহারাজ সুগ্ৰীব সুমিত্রা নন্দন লক্ষ্মণের ক্রোধ থেকে রক্ষা পেত না। স্বামী বিয়োগের শোক সম্বরণ করে প্রত্যুৎপন্নমতি তারা মহারাজ সুগ্রীবকে প্রতিটি কথায় বুদ্ধি ভরসা দিয়ে রাজকার্য সঠিকভাবে চালানোয় আরম্ভ থেকেই সাহায্য করছিলেন। সুগ্রীবের উপরে লক্ষ্মণের কেন রাগ হয়েছিল আমি সে কথা জানতে চাওয়ায় হনুমান কিছুই না লুকিয়ে বলেছিল-' হে দেবী, সুমিত্রা নন্দনের রাগ হওয়ারই কথা। দুঃখের জীবন যেন আর শেষ হতে চায় না। প্রভু রামচন্দ্র না হলে সুগ্রীব কিস্কিন্ধার রাজা হতে পারত না। তিনি সুগ্রীবকে যেভাবে কথা দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবে কাজ করে দিলেন ।কিন্তু সুগ্রীব বর্ষা আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রভুকে কথা দেওয়া মতে কাজ করে দিল না। তাই রাঘব সুগ্রীবকে বর্ষার দিন কয়টি কিস্কিন্ধায় থেকে রাজ্য শাসন করার জন্য উপদেশ দিলেন। কিন্তু শরৎ ঋতু শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একত্রিত হয়ে সীতাদেবীর অন্বেষণে লেগে যাওয়ার জন্য বলে পাঠালেন।প্রভু রামচন্দ্রের উপদেশ অনুসরণ করে আমরা সবাই কিস্কিন্ধা ফিরে এলাম। সুগ্ৰীব দুজনকে রাজ্যে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রাঘব বনবাসের বছর শেষ না করে রাজ্যে প্রবেশ করতে চাইলেন না। তাই প্রস্রবণ গিরির গুহায় বর্ষা কালটা কাটাতে মনস্থ করলেন।
এদিকে রাজা হয়ে সুগ্রীব ভোগবিলাসে দিন কাটাতে লাগলেন। বর্ষা পার হয়ে শরৎকাল এসে গেল। তবু রাজা সুগ্রীবের খবর নেই যে প্রভু রামচন্দ্র প্রস্রবণ গিরির গুহায় তার পথ চেয়ে রয়েছেন, প্রিয়তমা পত্মীর অন্বেষণ অভিযান আরম্ভ করার জন্য। অবশ্য শরৎকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেই একদিন সুগ্ৰীবকে প্রভু রামের কাজে অবহেলা না করার জন্য সাবধান করে দিয়েছিলাম। রাজা ও মহাবীর নীলকে রাজ্যের সমস্ত বাঁদর সৈন্যকে একত্রিত করার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজে আগের সেই গতি ছিল না। এমনকি রাজা হওয়ার পরে একদিনও প্রভুর খবর করার জন্য রাজা সুগ্রীব সময় করে উঠতে পারলেন না ।'
হনুমানের কথা শুনে আমি মাঝখানে বললাম -'তুমি দেখছি বলেছিলে যে সুগ্রীব ধর্মাত্মা। সে রামচন্দ্রের মিত্র হয়ে উঠেছে ।তাহলে একজন মিত্র অন্য মিত্রের সমস্যায় গুরুত্ব দেবে না কেন?'
হনুমান কিছুটা সংকোচের সঙ্গে বলল-' রাজা হওয়ার পরে মহারাজ সুগ্রীবের চরিত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি ধর্ম-কর্ম থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন বলে মনে হচ্ছে। রাজকার্যের ভারও পুরোপুরি মন্ত্রীদের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন ।এমনকি মন্ত্রীরা কীভাবে কাজ কর্ম চালাচ্ছে তারও কোনো খবরা খবর নিচ্ছেন না। সব সময় পত্নীদের সঙ্গে থেকে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে রয়েছেন। কথাগুলি বলে হনুমান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর দুই কূল রক্ষা করে পুনরায় বলল -'তাই একদিন প্রভু রামচন্দ্র তার কর্তব্য বিষয়ে তাকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য লক্ষ্মণকে কিস্কিন্ধায় পাঠালেন। সেই সময় রাজা সুগ্রীব সুরার নেশায় নিদ্রামগ্ন ছিলেন। লক্ষ্মণ বালির পুত্র অঙ্গদকে তার আসার খবর দেবার জন্য পাঠালেন। কিন্তু নিদ্রামগ্ন রাজাকে অঙ্গদ সেই খবর দিতে পারল না। অঙ্গদের মা তারা এবং কাকিমা রুমা রাজাকে ধাক্কা দিয়েও জাগাতে পারলেন না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্মণের রাগ হয়েছিল। এদিকে অঙ্গদ লক্ষ্মণের কাছে দ্বিতীয়বার যেতে সাহস করল না। ক্রোধিত সুমিত্রানন্দন সিংহদরজা দিয়ে ভেতরে এসে রাজপ্রাসাদে অনেক নারীকে নাচ-গানে মত্ত দেখে তিনি ভেতর প্রবেশ করলেন না। তার আগমনের বার্তা জানানোর জন্য ধনুতে টংকার দিলেন। সেই টঙ্কারে সবার অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হল । মহারাজ সুগ্রীবের ও নেশা কেটে গেল। অঙ্গদের কাছ থেকে যখন জানতে পারলেন যে লক্ষ্মণ এসেছে, তিনি নিজে লক্ষ্মণের সামনে বেরিয়ে আসতে সাহস না করে দ্রুত তার আছে, তার সঙ্গে কথা বলার জন্য তারাকে পাঠিয়ে দিলেন।'
তারা লক্ষ্ণণকে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন-'হে সুমিত্রা নন্দন, আপনি ক্রোধিত হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। এই সংসারে এমন কে দুর্মতি আছে যে আপনার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে ? লক্ষ্মণ শান্তভাবে তীক্ষ্ণ শব্দ প্রয়োগ করে বললেন-'দেবী তারা, আপনাদের রাজা সুগ্রীব কেবলমাত্র ভোগবিলাসে মত্ত হতেই জানে। তিনি আমাদের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন। বিদেহ নন্দিনীর উদ্ধারের জন্য বর্ষায় যাত্রা করা সম্ভব নয় বলায় আমরা তার কথা মতোই চার মাস বসে রইলাম। এখন শরৎকালের মাঝামাঝি। দাদা রামচন্দ্র তাকে কিস্কিন্ধার রাজা পেতে দেওয়ার পর আজ পর্যন্ত একটা খবরও করে নি। সব সময় সূরা এবং স্ত্রীদের সঙ্গে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে রয়েছেন ।'
লক্ষ্মণের কথা শুনে তারা বড় কোমল স্বরে বললেন-'আপনাদের ক্রোধ হওয়াটা স্বাভাবিক। মিত্রকে কথা দিয়ে সেই কাজ দ্রুত না করাটা রাজা সুগ্রীবের ভুল হয়েছে। তা বলে তার পেটের মধ্যে কোনো কপটতা নেই ।আমি ভালোভাবে জানি যে আপনাদের সাহায্য করার জন্য তিনি বড় ইচ্ছুক। আপনারা জীব শ্রেষ্ঠ প্রাণী ।তাই হীনবুদ্ধির প্রাণী সুগ্রীবকে ক্ষমা করে দিন। বাঁদর সুলভ চরিত্রের জন্যই এই সমস্যাটা হয়েছে। ভেবে দেখুন সব সময় তপস্যা, ধর্ম কর্মে লিপ্ত হয়ে থাকা মহর্ষিরাও কামপাশে আবদ্ধ হয়ে দেহ সুখে লিপ্ত হয়। তাই বাঁদরদের কথা তো কোন ছার । তাবলে সুগ্রীব কর্তব্য ভুলে যায়নি। প্রায় পনেরো দিন আগে সমস্ত বাঁদর সেনাকে একত্রিত করার জন্য নীলকে পাঠিয়েছে। কথাটা বলে তারা লক্ষ্মণকে অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে সুগ্রীব শয্যা ত্যাগ করে সাজ পোশাক পরে সিংহাসনে বসে ছিল। তাকে আলিঙ্গন করে পাশেই বসে ছিল পত্নী রুমা। সিংহাসনের চারপাশে বিভিন্ন সুন্দরীরা বসে রয়েছে।সুগ্ৰীব কল্পনাও করতে পারেনি যে তারা লক্ষ্মণকে এভাবে রাজ অন্তপুরে নিয়ে যাবে। তাই সে থতমত খেয়ে গেল ।সঙ্গে সঙ্গে সিংহাসন থেকে উঠে এসে প্রণাম জানাল।সুগ্ৰীবকে এহেন অবস্থায় দেখে লক্ষ্মণের রাগ হল। তিনি ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে বললেন-' মিথ্যাবাদী বাঁদর, তুমি ঠগ, অকৃতজ্ঞ এবং অধর্মী। তুমি রামচন্দ্রের মাধ্যমে তোমার কাজ সিদ্ধ করে এখন তার দিকে পিঠ দিয়েছ। রামচন্দ্র বলেই তোমার মতো একটা পাপিষ্ঠকে রাজ সিংহাসনে বসিয়েছেন। তুমি তার সামনে করা প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করলে তোমার অবস্থা ও বালীর মতোই হবে । লক্ষ্মণের ক্রোধ দেখে রাজা সুগ্রীবের মুখের ভাষা হারিয়ে গেল। রাজার হয়ে মহারানী তারা বলে উঠলেন-' হে সুমিত্রানন্দন আপনার মহারাজের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি। তিনি ঠগ,মিথ্যাবাদী বা অধর্মী নন। রামচন্দ্রের উপকারের কথা তার সব সময় মনে আছে। মাত্র অনেক বছর পাহাড়ে পর্বতে, বনে - বনান্তরে ,ঘুরে বেড়ানোর পরে রাজ সুখ, অঙ্গসুখ, রাজভোগ পেয়ে জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা হয়েছে। সেটাকে দূষণীয় বলা যায় না। বাঁদরের স্বভাবগত চঞ্চলতার কথা আপনারা ভালোভাবেই জানেন। তার হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি ।আপনি চিন্তা করবেন না। রাজ্যের সমস্ত দিক থেকে লক্ষ লক্ষ বাঁদর ভালুক সেনা আজকের মধ্যেই কিস্কিন্ধা পৌঁছে যাবে। আপনার ক্রোধ সম্বরণ করে শান্ত হন। বুদ্ধিমতী তারা এভাবে লক্ষ্ণণের ক্রোধ সংবরণ করিয়ে সুগ্রীবকে প্রভু রামচন্দ্রের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
হনুমানের মুখে তারার ব্যক্তিত্বের কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম তারা সত্যিই জ্ঞানী এবং বুদ্ধি মতী মহিলা। হনুমান তারার কথা যদিও সাধারণভাবেই বলেছিল, আমার কিন্তু তারার প্রতিটি বাক্য স্বামী রামচন্দ্র এবং লক্ষ্মণের প্রতি প্রহার করা বাক্যবাণ যেন বলে মনে হয়েছিল।স্বামী বালীকে ডালের মৃগ বলেছিল বলেই হয়তো তারা বারবার লক্ষ্মণকে শ্রেষ্ঠ জীব বলে সম্মোধন করে সেই কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অন্তরের ক্ষোভ প্রশমিত করেছিল। তাবলে আমি তারাকে দোষ দিতে চাইনা। তার জায়গায় আমি হলেও হয়তো আমিও এরকম আচরণই করতাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন