অনুবাদ কবিতা
প্রাঞ্জল কুমার লাহন
কবি পরিচিতি—১৯৮১ সনে কবি প্রাঞ্জল কুমার লাহনের জন্ম হয়। যোরহাট ফাইন আর্টস সোসাইটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রাঞ্জল ‘খোজ’দ্য আর্টস্ট গীল্ডের দ্বারা অসমের
বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত অনুষ্ঠান ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চিত্র-ভাস্কর্য-গ্রাফিক্সের প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত শ্রী লাহনের প্রথম কাব্য সংকলন ‘প্রেমের কবিতা’ ২০০৩ সনে প্রকাশিত হয়। ২০১৪ সনে কবির চতুর্থ কাব্যসংকলন ‘নিজ নিজ পৃ্থিবীর কথা’প্রকাশিত হয়।
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-- বাসুদেব দাস
একদিন একটি রুটির জন্যই অভিমান করে বসে ছিলাম
আজ একটি রুটি দেখে
অন্য একটি রুটির পৃথিবী দেখছি বলে মনে হচ্ছে
সেই রুটি
কখনও পূর্ণিমার স্নিগ্ধ চাঁদ হয়েছে
কখন ডগমগ লাল সূর্য হয়েছে
ভাবনাগুলি রুটির মতোই ঘুরছে গোলাকার হয়ে
রুটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
এই রুটির পৃথিবীতে দেখেছি
কে কাকে কীভাবে হত্যা করেছে
কে কাকে কীভাবে বিক্রি করেছে
আজ রুটির পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য একটি রুটি খোঁজ করতে যাওয়ায়
একদিন অভিমান করে বসে থাকা দিনটির কথা বড় মনে পড়ছে
সেই দিনটিতে একটি-রুটি না খেয়ে উপোসে মরে যাইনি
বরঞ্চ রুটির পরিবর্তে অন্য খাদ্য পেয়ে রুটির কথা ভুলেছিলাম
আজ কিন্তু রুটির পৃথিবীতে একটি রুটির জন্য যুদ্ধ করার জন্য
রুটির মতোই প্রতিদিন আগুনে পুড়েছি,জ্বলেছি…
রুটির পৃথিবী আমার পুড়ে যাওয়া শুকনো শরীর দেখে উপহাস করছে
এই রুটির পৃথিবীর কেউ আবার আমার জন্যই মুখ মেলে অপেক্ষা করছে।
এই রুটির পৃথিবীর মায়ায় আমিও যে ধীরে ধীরে একটি রুটি হয়ে পড়েছি!
শিশুরা হে
কার জন্য দুহাত মেলে দিই
( নিঃসঙ্গতায় জীবন যাপন করা প্রতিটি পরিচিত-অপরিচিত বয়োজ্যেষ্ঠর হাতে….)
প্রাঞ্জল কুমার লাহন
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস
শিশুরা হে
কার জন্য দুহাত মেলে দিই
কাঁপা কাঁপা হাত দুটিকে খামচে ধরবে হে
শিশুরা হে
দেখেছি, শুনেছি
তোদের
কারও হাতগুলি ছোট
কারও হাতগুলি দীর্ঘ
কারও হাত গুলি রুক্ষ
কারও হাত গুলি পিছল
কার হাতে আমার দুই হাত তুলে দিই হে
শিশুরা হে
জেনেছি, বুঝেছি…
একটা হাত নিজে নিজেই কাছাকাছি চলে আসে না
একটা হাত নিজের ইচ্ছায় দূরে দূরে থাকে
একদিন এই দুটি হাত ধরেই তোদের হাতগুলি
অন্য একটি দুটি করে অনেক হাতের পৃথিবী খুঁজে পেয়েছিল
তোদের হাত গুলো এখন অনেক নতুন হাতের সঙ্গে পরিচিত হল
আমার হাতদুটিই তোদের হাত গুলির কাছে অপরিচিত হয়ে রইল
শিশুরা হে
হাত দুটি এমনিতেই বারবার কেঁপে ওঠে না
জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা কাঁপিয়ে তুলেছে হে
তোদের হাতগুলিও হয়তো একদিন আমার মতই কেঁপে উঠবে
তখনই হয়তো বুঝতে পারবি শিশুরা হে
কেন স্বপ্নে খুঁজে বেড়িয়েছি
তোদের নিজেদের হাতটা কোথায়!
তোদের নিজেদের হাতটা কোথায়!
যুদ্ধের মধ্যে খুঁজে বেড়াই বুদ্ধকে
প্রাঞ্জল কুমার লাহন
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস
যুদ্ধের মধ্যে খুঁজে বেড়াই বুদ্ধকে
যুদ্ধ মানেই
আমার মনের ভেতরে- বাইরে
চলতে থাকা অন্তহীন যুদ্ধ
কিছু দেখা কিছু না দেখা
বুদ্ধ মানেই
শান্তির চুক্তিতে মুক্তির সনাতন পথ
যুদ্ধ চায়না বুদ্ধকে
বুদ্ধ চায়না যুদ্ধকে
রেল পথের মতো
দুজন দুজনকে
স্পর্শ করতে পারে না
তথাপি যুদ্ধের অন্তহীন আখড়া চলার সময়
বুদ্ধের খোঁজে প্রতিনিয়তঃ স্বপ্ন দেখি
বুদ্ধ ধ্যানমগ্ন
যুদ্ধ আগ্নেয়
কাকে পাব আমরা
বুদ্ধকে না যুদ্ধকে!
ঈশ্বর
প্রাঞ্জল কুমার লাহন
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
রূপকথার মতে ঈশ্বরের ঘরে যাবার পথ সোজা নয়
আঁকা বাঁকা দুর্গম পথে গেলেই হয়তো পেতে পারি ঈশ্বরের ঘর
রূপকথা থেকে বেরিয়ে এসে গলিতে গলিতে পেতে পারি ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন ঘর
ভক্তের জন্য ঈশ্বরের ঘরেরও নির্দিষ্ট শ্রেণি আছে।শ্রেণিতে প্রতিজন ঈশ্বর ব্যস্ত থাকে।
ঈশ্বরের ঘরে ঝুলে থাকে নিজের নিজের নামের ফলক।ভক্ত ভুল করলে নারাজ হয় ঈশ্বর।
ঈশ্বরের ঘরে সতত সমস্যা সমাধানের আবেদন নিয়ে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন ভক্তের স্রোত বয়
ঈশ্বরের ঘরে প্রত্যেকে ঈশ্বরকে পায় কী না পায় জানি না।ঈশ্বরের ঘরে ঈশ্বরকে না পেলেও কিন্তু
ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঘরের মালিকের মতো ভক্তের শ্রেণি অনুযায়ী আচরণে সদা ব্যস্ত হয়
ঈশ্বরের ঘর বললে সেলিব্রিটি কিম্বা আঢ্যবন্ত ভক্ত ভিআইপি হয়ে সংক্ষিপ্ত রাস্তায় যায়
ঈশ্বরের ঘর বললে সর্ব সাধারণ রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়ায়
ঈশ্বরের ঘরে ঈশ্বরের দর্শন দানের জন্য ঈশ্বরের প্রতিনিধিরা দান দক্ষিণা নেয়
দাম দক্ষিণার পরিমাণ ভারী হলে ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিনিধিও অত্যন্ত সুখী হয়
রাজার ঘর প্রজার ঘর কেউ ঈশ্বরের ঘরের দান-দক্ষিণার সঠিক খবর রাখে না
ঈশ্বরের ঘর ধনী হতে থাকে। ধনী ঈশ্বরের ঘর দেখলে ভক্তেরও আকর্ষণ বাড়ে
রাজার ঘর দেশ চালানোর জন্য প্রজার কাছ থেকে আয়কর নেয়, জিএসটিও নেয়
ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্যও রাজার ঘর ঈশ্বরের সঙ্গে গোপনে বোঝাবোঝি করে
পৃথিবীর অসুখে আজ লকডাউন ঈশ্বরের ঘর। ঈশ্বর আজ অসুখী। ভক্ত আজ অসুখী।
এখন ঈশ্বর কী করবে ঈশ্বরের ঘরের প্রতিনিধি ঘরেই থাকবে কি অসুখী ঈশ্বর
আজ হয়তো ঘরেই বিশ্রাম নেবে ঈশ্বর। ভক্তের অবিহনে ঈশ্বরের বড় বিরক্তি বোধ হবে।
অবশ্য দিনরাত ঈশ্বর ভক্তের দান-দক্ষিণার পরিমান গুনে গুনে ব্যস্ত হতে পারবে
রূপকথার মতে আবার ঈশ্বরের ঘর ভক্তের হৃদয়, ঈশ্বর নিরাকার ,ঈশ্বর সর্বজান্তা
ঈশ্বর করুণাময় ইত্যাদি ইত্যাদি বহু অভিধা, বহু উপমা ,অপার মহিমা…
রূপকথার থেকে বেরিয়ে এলেই প্রকট হয় ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন রূপ
ঈশ্বর আকালে সারাদিনের উপোশী ভক্তের মুখে গুঁজে দিতে পারেন না এক মুঠো ভাত
ঈশ্বর মহামারীর কবলে আর্তর্জনের চোখের জল মুছিয়ে ফিরিয়ে দিতে পারেন না হারানো হাসি
ঈশ্বর অসুস্থ পৃথিবীর বুকের দুঃখ ভুলিয়ে বাজাতে জানেন না সুখের বাঁশি
ঈশ্বরের কথাগুলি রূপকথাতেই থাকা ভালো
রূপকথা থেকে বেরকরে আনলেই ঈশ্বরকে হারাতে হবে আমাদের!
মহানগরের জানালা
প্রাঞ্জল কুমার লাহন
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস
মহানগরের বন্ধ ঘরে ঢুকে ছটফট করছি
মহানগরের জানালাগুলি খুলে দিতে যেতেই
মহানগরের চোখে যেন একজন অপরাধী হয়ে পড়েছি
মহানগর চোখ দুটি পাকিয়ে ধরেছে আমাকে
বিনয়ের সঙ্গে বলেছি–
অনুগ্রহ করে জানালাগুলি খুলতে দিন
একটু মুক্ত বাতাস ভেতরে আসুক
একটু রোদের আলো ভেতরে আসুক
স্বপ্ন হেন জোৎস্না ভেতরে আসুক
মহানগরের চোখ দুটি আমাকে ঘিরে ঘিরে প্রশ্ন করছে
কেন চাই মুক্ত বাতাস, রোদের আলো কিংবা জ্যোৎস্না
বাতাস চাই যদি ফ্যান নিন, কুলার নিন, এসি নিন
রোদের আলো চাই যদি চোখ ঝলসানো রঙ্গিন লাইট নিন
তবু মহানগরের জানালা খুলে দেওয়া হবে না
মহানগর জানেনা
ফ্যান, এসি, কুলার ও শীতল করে তুলতে পারে না দেহ-মন
চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া রঙ্গিন লাইটের আলোও আলোকিত করতে পারে না মন
অত্যাধুনিক লাইট ও জোৎস্নার মত প্রশান্তিতে ভরাতে পারে না মন
মহানগরের একটিও জানালা খুলতে না পেরে ধীরে ধীরে যেন মরতে চলেছি
মহানগরকে পুনরায় কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করছি– কেন মহানগরের জানালা খোলা হয় না!
চেলাপতি জোঁকের মতো জানালার কথায় লেগে থাকাটা
মহানগরের একটুও সহ্য হয়নি। মহানগরের প্রচণ্ড রাগ হয়েছে।
রাগ মহানগরের দেহ অধিক উত্তপ্ত করে তুলেছে।
মহানগরের ক্রোধ বেড়েছে। জানালাগুলি অত্যন্ত রহস্যঘন হয়ে পড়েছে।
মহানগর আমাকে বারবার সতর্ক করে দিয়েছে
মহানগরের জানালাগুলি স্বপ্নেও খোলা হবে না
মহানগরের জানালাগুলি খোলার কথা বারবার বলায়
নিশ্চুপ জানালাগুলি যেন ধীরে ধীরে কথকী হয়ে পড়েছে
জানালাগুলি মনে মনে বলে চলেছে মহানগরের বহু গোপন কথা
মহানগর মাঝেমধ্যে উন্মাদ হয়ে পড়ে। মাঝরাতে ও চিৎকার করে। একুরিয়ামে বন্দি মাছের মতো ছটফট করতে থাকে
তথাপি মহানগর জানালাগুলি খোলার সাহস করে না
একটু মুক্ত বাতাসের পরিবর্তে
একটু রোদের আলোর পরিবর্তে
স্বপ্ন হেন জ্যোৎস্নার পরিবর্তে
জানালাগুলি দিয়ে চলে আসে কী জানি
অপরিচিত ধুলি
মহানগরের অসহায় জানালাগুলি কেবল
স্বগতোক্তি করে–
সেই ধূলি কেবল অপরিচিত ধুলি নয়
তা স্তরে স্তরে মহানগরের মনেরও ধুলি…!
অনুবাদ পড়ে আসল পড়ার ইচ্ছে উসকে উঠলো। অনুবাদককে আন্তরিক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন