শুক্রবার, ৫ নভেম্বর, ২০২১

কোলেস্টরেল ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das,

কোলেস্টরেল

হোমেন বরগোহাঞি



মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস

কোলেস্টরেল শব্দটির সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার বেশিদিন হয়নি। মাত্ৰ দশ বছর আগে শব্দটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। কিন্তু পরিচয়ের প্রথম মুহূর্ত থেকেই এই শব্দটি আমার জীবনে স্থায়ী বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে।

বিভীষিকার কথা বলার আগে প্রথমে কোলেস্টরেল  বিষয়ে কিছু কথা বলে নেওয়াটা উচিত হবে– কারণ পাঠকদের মধ্যে অনেকেরই এই রহস্যময় পদার্থটির বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকতে পারে। যেভাবে দশ বছর আগে আমার ছিলনা।

অত‍্যন্ত  সংক্ষেপে বলতে গেলে কোলেস্টরেল হল স্টেরইড জাতীয় এরকম এক ধরনের জিনিস যা সমস্ত মেরুদন্ডী প্রাণীর শরীরে থাকে। শরীরের সুষম বিকাশ এবং সুস্থতার জন্য এটা একটি দরকারি জিনিস। প্রাণী-দেহের মস্তিষ্ক ,মেরুদন্ড এবং লিভারে বেশি পরিমাণে জমা হওয়া এই জিনিসটি ডি ভিটামিন এবং অন্য কয়েক ধরনের স্টেরইড হরমোন তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই এরকম একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে যে সমস্ত জিনিস প্রাণী দেহের বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খুবই সহায়ক, সেই একই জিনিসের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা প্রাণী দেহের জন্য ভীষণ ক্ষতি কারক হয়।কোলেস্টরলও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়।

শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি হলে রক্তবাহী শিরাগুলিতে  জমা হতে শুরু করে কোনো বাধা না পেয়ে যদি রক্তবাহী শিরায় কোলেস্টরেল জমা হতে থাকে তাহলে তার ফলে শিরাগুলি ক্রমশ শক্ত এবং টান হতে শুরু করে। শিরাগুলির স্থিতিস্থাপকতাও হ্রাস পেতে শুরু করে।তখন শিরা গুলির মধ্য দিয়ে সুকলমে রক্ত চলাচল করতে পারে না।জল জোগানোর জন্য ব্যবহৃত পাইপের ভিতরে কাদা এবং অন্যান্য আবর্জনা জমা হলে জলের গতিবেগ যেভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়, রক্তবাহী শিরায় বেশি পরিমাণে কোলেস্টরেল জমা হলে ঠিক সেই একই অবস্থা হয়।রক্তবাহী শিরা গুলির মধ্য দিয়ে রক্তের চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হলে রক্তের গতিবেগ বৃদ্ধি করার জন্য হৃদপিণ্ডকে বেশি জোর দিতে হয়। তার ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং তার অবধারিত পরিনাম স্বরূপ শরীরে স্ট্রোক,থ্রম্বোসিস এবং হৃদপিন্ডের অসুখের  মতো নানা প্রাণঘাতী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে মাত্রাধিক কোলেস্টরেল হল আপনার জীবনের প্রতি একটি বড় বিপদ সংকেত।

এখন প্রশ্ন হল– শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কত হওয়া উচিত? অসমের চিকিৎসকরা রক্ত পরীক্ষা করে দেওয়া প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে মানুষের শরীরে কোলেস্টরেল ১৩০ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০  মিলিগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।অর্থাৎ কোলেস্টরেল ১৩০ মিলিগ্রামের কম এবং ২৫০ মিলিগ্রামের  বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ডক্টর হান্স ডিয়েহল নামের একজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞের এই হিসাব একেবারেই ভুল। তাঁর মতে শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ ১৬০ মিলিগ্রামে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলেই শরীর বিপদ মুক্ত হয়ে থাকতে পারে।

এখন দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল– শরীরে কোলেস্টেরল কেন বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ তা কেন বিপদসীমা অতিক্রম করে?

ওপরেই একবার বলা হয়েছে যে একমাত্র মেরুদন্ডী প্রাণীর শরীরেই কোলেস্টোরেল থাকে। উদ্ভিদ কখনও নিজের দেহে কোলেস্টরেল তৈরি করে না।তাই ওপরের প্রশ্নটির একমাত্র উত্তর হল এই যে মানুষ যখন জান্তব উৎস থেকে পাওয়া মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ঘি, মাখন এবং চীজ ইত্যাদি খাদ্যগুলি বেশি পরিমাণে খায়,তখনই শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।যে মানুষ কোলেস্টরলের পরিমাণ আদর্শ ঊর্ধ্ব সীমার ভেতরে রেখে নিজের জীবন বিপদমুক্ত করে রাখতে চায়, তিনি এই ধরনের আহার একেবারে না খেয়ে বা খুব কম পরিমাণে খেয়ে শাকসব্জি এবং ফলমূল বেশি পরিমাণে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে ধনী মানুষের রোগ গুলি থেকে নিস্তার পেতে হলে দুঃখী মানুষের আহার ভালোবাসতে শিখতে হবে। কোলেস্টেরল বেশি পরিমাণে থাকা খাদ্য গুলি ডিমের কুসুম, জীবজন্তুর লিভার এবং চারপেয়ে জন্তুর মাংস। একটিমাত্র ডিমের কুসুমে ২৫০ মিলিগ্রাম এবং তিন আউন্স লিভারে ৩৭০  মিলিগ্রাম কোলেস্টরেল থাকে। তাই যে সমস্ত মানুষের কোলেস্টরেল ইতিমধ্যেই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে  তাদেরকে এই দুই ধরনের খাদ্য সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে হবে। সঙ্গে ঘি- মাখন ইত্যাদি চর্বি জাতীয় আহার খাওয়াও ছেড়ে দিতে হবে।

এখন কোলেস্টরেল আমাদের জীবনে সৃষ্টি করা স্থায়ী বিভীষিকার প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। আমি নিজেকে লোভী বা ভোজনবিলাসী মানুষ বলে ভাবি না। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বলে জানলে যে কোনো লোভনীয় খাদ্যকেও আমি ত‍্যাগ করতে পারি। কিন্তু তা বলে আমি সর্ব ত্যাগী এবং জিতেন্দ্রিয় সন্ন্যাসীও নই। সবসময় না হলেও অন্তত মাঝেমধ্যে সুস্বাদু সুখাদ্য আস্বাদ করতে কার না ইচ্ছে হয়? বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় কুটুম্ব যখন আন্তরিক ভালোবাসায়  নিমন্ত্রণ করে একবেলা ভাত খাওয়াতে চায়, তখনও কেবল কোলেস্টোরেলের ভয়ে তাদের কীভাবে নিরাশ করব? কিন্তু সত্যটা হল এই যে কোলেস্টরেল নামের এই রহস্যময় জিনিসটির বিষয়ে আদ্যোপান্ত জানার দিনটি থেকে সুস্বাদু সুখাদ্য খাওয়ার আনন্দ থেকে আমি সমূলে  বঞ্চিত হয়েছি। কখনও খেলেও বা খেতে বাধ্য হলেও ভয়ে ভয়ে খাই– কে জানে হয়তো শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বিপদসীমা অতিক্রম করে যায়!

কোলেস্টরেল নিয়ে এই Obsession বা ভূতগ্রস্ততা অবশ্য কেবল আমার হয়নি। যে সমস্ত লোক খাদ্য-রসিক, সঙ্গে স্বাস্থ্য সচেতনও - তাদের প্রত্যেকেই এই ভূতের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। শরীরে কোলেস্টোরেল সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি করে ডিম। অন্যদিকে ডিম অনেক মানুষের ব্রেকফাস্টের অপরিহার্য অঙ্গ। বিশেষ করে পশ্চিমী দেশের। কয়েক বছর আগে বিখ্যাত সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী বার্ণাড লেভিন The Manchester guardian পত্রিকায় লেখা একটি প্রবন্ধ কলকাতার The Statesman পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। প্রবন্ধটিতে বার্নার্ড লেভিন  কোলেস্টোরেলের তত্ত্বটিকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে লিখেছেন যে ডিম খেলেই কোলেস্টেরল বৃদ্ধি হয় এ কথা তিনি বিশ্বাস করেন না, কারণ তিনি প্রতিদিন ব্রেকফাস্টে চারটি ডিমের অমলেট খান এবং আমৃত্যু খেয়ে যাবেন।কোলেস্টরেল হলেও তিনি পরোয়া করেন না। তিনি পরোয়া করতে না পারেন, কিন্তু তবুও সেই বিষয়টিকে নিয়ে তাকে যে একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে সেটাই প্রমাণ করে যে কোলেস্টরেল আধুনিক চেতনার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।

বিখ্যাত শিল্পপতি রুচি মোদি নাকি ৭৮ বছর বয়স পর্যন্ত দিনে ১৮ টি ডিম খেতেন। এখন তিনি আশির কোঠা পার হয়েছেন সেই জন্য ডিমের পরিমাণ চারটিতে নামিয়ে এনেছেন। কিন্তু এত বেশি ডিম খাওয়া সত্ত্বেও তিনি কোলেস্টরেল জনিত কোনো অসুখে ভোগেন নি। বরং তারুণ্য সুলভ শক্তিতে তিনি এখনও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স এবং এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানের গুরু দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এইসব দেখে শুনে আমার বন্ধু চন্দ্রধর ত্রিপাঠী কোলেস্টরেলের তত্ত্ব ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিতে চান এবং আমার সঙ্গে সেই বিষয়ে ভয়ঙ্কর তর্ক করেন।(তাঁর কোলেস্টেরলের মাত্রা একটা সময়ে প্রায় ৩০০ মিলিগ্রাম হয়েছিল)। কিন্তু বার্নার্ড লেভিন বা রুচি মোদি সারাজীবন ধরে এত ডিম খাওয়া সত্ত্বেও তারা কেন মাত্রাধিক কোলেস্টেরলের কবলে পড়েন নি তার ব্যাখ্যা অন্যভাবে করতে হবে। উইনস্টন চার্চিল সারাজীবন ধরে এত বেশি পরিমাণে সূরা এবং ধূমপান করেছিলেন যে তাঁর  স্বাস্থ্য  জীবনের মাঝবয়সে ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।কিন্তু তিনি কর্মক্ষম ছিলেন ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে চার্চিলের  শরীরে থাকা একটি বিশেষ জিনের (gene) জন্য তিনি নিজের দেহের কোনো ক্ষতি না করে এত বিপুল পরিমানের আ্যলকোহল এবং নিকোটিন সহ্য করতে পেরেছেন। তিনি একটি ব্যতিক্রম মাত্র,নিয়ম নন। কোলেস্টরেলের ক্ষেত্রেও বার্ণাড লেভিন এবং রুচি মোদিকে  নিশ্চয় ব্যতিক্রমী বলা যেতে পারে। 

আমাকে কিন্তু কোলেস্টরেলের ভয় এত কাবু  করেছে যে আমি আমার প্রিয় খাদ্য ডিম এবং পশুর মাংস খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছি।কয়েক বছর আগে আমার কোলেস্টরেল ২৩১ মিলিগ্রাম হয়েছিল।পরের বছর আমি তা ১৬৮ মিলিগ্রামে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলাম। নানা কারণে গত বছর তা আবার সামান্য বেড়েছে। কিন্তু আমি যে পুনরায় তাকে আদর্শ সীমায় নামিয়ে আনতে পারব সেই বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

ডক্টর হান্স ডিয়েহলের মতে কোলেস্টেরলের আদর্শ সীমা হল নিজের বয়সের সঙ্গে ১০০ যোগ দিলে যে সংখ্যা হয় ঠিক তত মিলিগ্রাম। অর্থাৎ একজন ৬০  বছরের মানুষের শরীরে কোলেস্টরেলের  পরিমাণ হওয়া উচিত ১৬০ মিলিগ্রাম।

আমরা কলেজে পড়ার সময় বাঙালি লেখক সন্তোষ কুমার ঘোষের ' কিনু গোয়ালার গলি' নামের একটি উপন্যাস খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই উপন্যাসটির জন্য কোনো কোনো সমালোচক তাকে সমারসেট মমের  সঙ্গে তুলনা করেছিল। উপন্যাসটি পড়ে আমারও খুব ভালো লেগেছিল। উপন্যাসটির বেশিরভাগ কথাই এখন ভুলে গেছি। ভুলতে পারিনি– কোনোদিনই ভুলতে পারব না – উপন্যাসটির একটি বাক্য। বেশ্যালয়ে যেতে চাওয়া একজন যুবককে অন্য একজন উপদেশ দিচ্ছে–' ক্ষণস্বর্গের বিনিময়ে অনন্ত নরক বরণ করে নিও না।' কেবল বেশ্যালয় কেন – জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই এই উপদেশ প্রযোজ্য।লোভ এবং দুর্বলতা জয় করতে না পেরে বেশিরভাগ মানুষই ক্ষণস্বর্গের বিনিময়ে  অনন্ত নরক বরণ করে নেয়। জিহ্বায় সুখাদ্যের তৃপ্তি মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত স্থায়ী হয়, কিন্তু সেই কয়েকটি মুহূর্তের তৃপ্তি লাভ করার জন্য অনেক মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক খাদ্য খেয়ে বা অতিভোজন পরে নানা যন্ত্রণা-দায়ক রোগ-ব্যাধি নিমন্ত্রণ করে আনে।

আমি ভাবি– প্রত্যেক মানুষেরই জীবনের অন্যতম বীজমন্ত্র হওয়া উচিত–' ক্ষণস্বর্গের বিনিময়ে অনন্ত নরক বরণ করে নিও না।'


লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।

















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...