শুক্রবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২২

নরকের কথা ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস, Homen Bargohain

 নরকের কথা

হোমেন  বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস



কিছুদিন আগে নবকান্ত বরুয়া আমার বিষয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে এরকম একটি বাক্য লিখেছেন–' আমি তখন 'নরক' নিয়ে ব্যস্ত; হোমেনেরও 'নরক'টি সম্পর্কে কিছুটা খবর পেয়েছিলাম।

আমার 'নরক' এর খবর আমি নিজেই দিয়েছিলাম। বেশিরভাগ মানুষই একটি কথা জানে না যে নবকান্ত বরুয়া কেবল কবি বা গদ্যশিল্পী নয়, তিনি একজন ভাল চিত্রকরও। কবি নবকান্তের প্রতি আমি যতটা আকৃষ্ট হয়েছিলাম প্রায় ততটাই আকৃষ্ট হয়েছিলাম চিত্রকর নবকান্তের প্রতিও।তাঁর দুটি ছবি দেখার পরে আমার মনে এরকম একটি বাসনা হল যে আমার জীবনের প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতে  হবে নবকান্ত বরুয়াকেই।

আমি কটন কলেজের ছাত্র হয়ে থাকার সময়েই ' 'রামধেনু'তে ঘনঘন প্রকাশিত আমার কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধগুলি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এভাবে বললেও  বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না যে ছাত্র অবস্থাতে আমি একজন' প্রতিষ্ঠিত' লেখকের মর্যাদা লাভ করেছিলাম। কিন্তু আমার জীবনের যে প্রথম বই ছাপার অক্ষরে দেখার আমি আশা করেছিলাম তা গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধের বই ছিল না। এটি ছিল একটি উপন্যাস।কিন্তু  তা ছিল একটি অলিখিত উপন্যাস। অর্থাৎ আমি যদিও মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত বইটি তবে একটি উপন্যাস, কিন্তু উপন্যাসের একটি শব্দও আমি লিখতে আরম্ভ করিনি অথবা লিখতে পারিনি।

হাতে কলম নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখতে বসিনি সত্যি, কিন্তু আমার মস্তিষ্কের ভেতরে উপন্যাসটি অনবরত গুনগুন করছিল। রাম জন্মাবার আগেই রামায়ণ রচিত হওয়ার মতোই উপন্যাসটি লেখার আগেই তার নামটা ঠিক করে ফেলেছিলামঃ' নরকাগ্নি'। তৎসম শব্দের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা এখন প্রত্যেকেই জানে। এই দুর্বলতা আরম্ভ হয়েছিল আমার শৈশবেই। তার একটি কারন আমি এই বলে অনুমান করি যে আমার সাত আট বছর বয়স থেকে আমার কাব‍্যানুরাগী পিতা  আমাকে বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং অসমিয়া কবি ভোলানাথ দাসের অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত কাব্য গুলি পড়ে শোনাতেন, এবং সেইসব কাব্যের সংস্কৃত শব্দের ধ্বনি মাধুর্য আমার কোমল মনে মন্ত্রের মতো ক্রিয়া করেছিল । অবশ্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজে এই কথা অনুভব করতে লাগলাম যে আমি যে সমস্ত উদ্দেশ্য নিয়ে যে ধরনের গদ্য লিখতে চাই সেরকম গদ্যে তৎসম শব্দের প্রাধান্য বেশি থাকতে হবে।সে যাই হোক না কেন সেই বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা এখানে খুব প্রাসঙ্গিক হবে না।

আমার জীবনের প্রথম অলিখিত উপন্যাসটির জন্য আমি কি বিষয়-বস্তু বেছে নিয়েছিলাম তার আভাস দেবার জন্য উপন্যাসটির নামটিই যথেষ্টঃ' নরকাগ্নি'। নামটি আমাকে এভাবে গ্রাস করে ধরেছিল যে উপন্যাসের নামে একটি মাত্র শব্দ নৌ  লিখতেই আমি প্রচ্ছদটা আঁকানোর জন্য ব্যাগ্ৰ হয়ে পড়লাম। আমার জীবনে এই সমস্ত ঘটনা ঘটার সময় নবকান্ত বরুয়া কটন কলেজের অধ্যাপক এবং আমি ঢকুয়াখনা হাই স্কুলের শিক্ষক । আমি তাকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলাম যে আমার  'নরকাগ্নি' নামের একটি উপন্যাসের প্রচ্ছদের নক্সা এঁকে দ্রুত আমাকে পাঠিয়ে দিতে হবে । এই অনুরোধ করার সময় স্বাভাবিকভাবেই আমি তাকে উপন্যাসটির বিষয়বস্তু ও কিছুটা আভাস দিতে হয়েছিল। নবকান্ত বরুয়ার এভাবেই আমার নরকটির কিছু খবর পেয়েছিল। আমার চিঠি পাওয়ার এক মাসের মধ্যেই তিনি গভীর অর্থ ব্যঞ্জক একটি নক্সা এঁকে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জীবনের দীর্ঘ আকাবাকা পথে ঘুরে বেড়ানোর সময় অন্য অনেক জিনিস হারানোর মতো নবকান্ত অতিশয় যত্ন করে এঁকে  দেওয়া সেই ছবিটাও হারিয়ে গিয়েছে । কিন্তু ছবিটির স্মৃতি আমার মন থেকে এখনও হারিয়ে যায়নি।

' নরকাগ্নি' কখনও লেখা হল না। কিন্তু আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদের নক্সা নবকান্ত বরুয়াকেই  আঁকতে হবে বলে আমি যে ইচ্ছা করেছিলাম সেই ইচ্ছা পূরণ করে তিনি' বিভিন্ন কোরাস'এর প্রচ্ছদ এঁকে  দিয়েছিলেন। সেটি ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ।

পঞ্চাশের দশকে নবকান্ত বরুয়া লেখা কবিতাগুলির ভেতরে দুটি বিখ্যাত কবিতা হল' মাকে চিঠিঃ নরক থেকে' এবং' নরকে  ডন জুয়ান'। এর থেকে বোঝা যায় যে আমি যে সময়ে আমার নরককে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, প্রায় একই সময়ে নবকান্ত বরুয়া ব্যস্ত ছিলেন তাঁর নিজের নরক নিয়ে। তাই নবকান্ত বরুয়া আমার বিষয়ে লেখা প্রবন্ধটির এক জায়গায় লিখেছেন–' আমি তখন 'নরক' নিয়ে ব্যস্ত; হোমেনেরও ' নরক' টির বিষয়ে কিছু খবর পেয়েছিলাম।'

বিভিন্ন ধর্ম যেসমস্ত নরকের কল্পনা করেছে সেই সমস্ত নরকে প্রত্যেক পাপী একসঙ্গে বাস করে। তাই নরকের অভিজ্ঞতা সমস্ত পাপীর একই রকম। কিন্তু নবকান্ত বরুয়া যে নরকের কথা বলেন , সেই নরক ধর্ম কল্পনা করা পরকালের নরক  নয়। সেই নরক হল পার্থিবজীবনে লাভ করা একটি অন্তরের অভিজ্ঞতা, আধ্যাত্মিক কবিতা। এটা যেহেতু একান্তভাবে ব্যক্তিগত নরক, তাই কোনো দুজন মানুষের নরক কখনও এক হতে পারে না। প্রত্যেক মানুষই নিজের নিজের নরক নিজের অন্তরে বহন করে নিয়ে বেড়ায়। সেই জন্য যদিও নবকান্ত বরুয়া এবং আমি দুজনে প্রায় একই সময়ে নরকে বাস করেছিলাম, কিন্তু আমাদের দুজনের নরকের ভূগোল এবং ইতিহাস ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। খবরের কাগজ পড়ে আমি বসনিয়া বা রুয়ান্ডার খবর পাই, কিন্তু সেইসমস্ত জায়গা আমি কখনও দেখিনি বা দেখতে পাবার আশাও নেই। ঠিক সেভাবে নবকান্ত বরুয়ার কবিতা পড়ে আমি তাঁর নরকের অল্পস্বল্প খবর পেলেও তাঁর নরকের বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই। থাকাটা  সম্ভব নয়।

কিন্তু আমার নিজের নরকের বিষয়ে দু'একটি কথা আমি নিশ্চয় বলতে পারি।

আমার নরক-বাস আরম্ভ হয়েছিল তখন – যখন আরম্ভ হয়েছিল আমার জীবনের বসন্তকাল, অর্থাৎ যৌবন। কথাটা খুব অবাক বলে মনে হচ্ছে না? কিন্তু যদি আমরা একথা মনে করি যে আর্থার র‍্যাঁবো তাঁর 'নরকে এক ঋতু'(Une saison en enter) নামের বিখ্যাত কবিতা লিখে শেষ করেছিল মাত্র উনিশ  বছর বয়সে, তারপর তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন কবিতার নামে ক অক্ষরটিও   লিখেননি, তখন যৌবনের সঙ্গে নরকের কাছাকাছি সম্পর্ক আবিষ্কার করার জন্য খুব একটা বেশি কষ্ট করার প্রয়োজন নাও হতে পারে। নরকের অভিযান একটি অতি বিপদসংকুল দুঃসাহসিক অভিযান। একমাত্র যৌবনকালেই এরকম অভিযান সম্ভবপর। নবকান্ত বরুয়ার নরক সম্পর্কীয় কবিতাদুটি  পড়ে দেখুন তো। ভাটিতে চলা কোনো বয়সের মানুষ এরকম কবিতা লিখে না, লিখতে পারেনা।

নরক একটি জায়গা নয়, আসলে এটি একটি মনের অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ জা পল সাঁত্রের নরকের সংজ্ঞা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর মতে  The hell is other অন্য মানুষেরাই হল নরক।

আমাকে নরকের খবর দেওয়া প্রথম মানুষটি  ছিলেন ফরাসি কবি শার্ল  বোদলেয়ার । আমরা কলেজে পড়ার সময় ইংরেজি সাহিত্যের চার সীমা অতিক্রম করে মহাদেশীয় সাহিত্যের খবর নিতে শুরু করেছিলাম। তখনই আমি বোদলেয়ার এবং র‍্যাঁবোকে আবিষ্কার করেছিলাম। সেই আবিষ্কারের উন্মাদনা আজও আমার মন থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি। আমি তৃতীয় বার্ষিকের ছাত্র থাকাকালীন জা পল সাঁত্রে লেখা বোদলেয়ারের বিখ্যাত জীবনী পড়ার সুযোগ পেলাম। তারপর থেকেই বহুদিন পর্যন্ত বোদলেয়ার ছিল আমার মনের নিত্য-সঙ্গী। তাঁর কবিতা আমাকে এভাবে অস্থির করেছিল যে তার কয়েকটি কবিতা ইংরেজি থেকে অসমিয়াতে অনুবাদ করার পরেই আমি কিছুটা শান্তি পেয়েছিলাম। সেরকম একটি অনুবাদ (সাতজন বুড়ো মানুষ)  রামধেনুতে   প্রকাশিত হয়েছিল। সেটাই ছিল বোদলেয়ারের কবিতার প্রথম অসমিয়া অনুবাদ।

পরে অবশ্য বীরেশ্বর বরুয়াও বোদলেয়ারের কয়েকটি কবিতা অসমিয়া ভাষায় অনুবাদ করেছেন।

বোদলেয়ারের কাছে বেঁচে থাকার অর্থ ছিল জীবনটাকে নির্মমভাবে ধ্বংস করা। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন স্পর্শকাতর' এবং আতিশয্য- প্রবণ। অনন্ত নিঃসঙ্গতা হবে তাঁর চিরসঙ্গী– সে কথা তিনি শৈশবেই বুঝতে পেরেছিলেন।তাঁর জীবনে হ্যামলেটের জীবনে ঘটা একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল।তাঁর জন্মের সময়ে পিতার বয়স ছিল ৬২ বছর  এবং মায়ের ছাব্বিশ বছর। বোদলেয়ার বাবাকে ভালোবাসতেন;কিন্তু মাকে মনে মনে ঘৃণা করতেন। মায়ের প্রতি সেই ঘৃণা তীব্রতর হল– যখন বোদলেয়ারের পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পরে মা অশোভনীয় দ্রুততার সঙ্গে একজন সামরিক অফিসারকে বিয়ে করলেন। পিতার মৃত্যুর পরে বোদলেয়ারের হাতে যখন কিছু ধনসম্পত্তি এল, অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে সেই ধনসম্পত্তি উড়িয়ে শেষ করলেন অপরিমেয় মদ্যপান এবং বেশ্যা  গমন করে। বেশ‍্যা গমনের  ফলে তিনি সেই সময়ের দুরারোগ্য সিফিলিস রোগের দ্বারা আক্রান্ত হলেন । রোগীর যন্ত্রণা দমন করে রাখার জন্য তিনি অবিরাম ভাবে নানা নেশার জিনিস খেতে লাগলেন। মানুষের শরীর অনেক অত্যাচার সহ্য করতে পারে, কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে। বোদলেয়ার নিজের শরীরটার ওপরে এত অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছিলেন যে মাত্র ৪০ বছর বয়সে তাঁর সম্পূর্ণ শরীর ভেঙ্গে পড়ল। তারপরও তিনি ছয় বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু জীবনের শেষের দুইটি বছর সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত ভাবে জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন। তিনি শরীরের কোনো অঙ্গ নাড়াচাড়া করতে পারতেন না, কথা বলতে পারতেন না, নিজের নামটা মনে করতে পারতেন না, এমনকি আয়নায় নিজের মুখটাকেও চিনতে পারতেন না।নরক! 

কিন্তু এই মানুষটির একটি অন্য জীবনও ছিল। সেই জীবনটি ছিল কঠোর তপস্যা এবং সাধনার জীবন। শারীরিক জীবনে যে মানুষ ছিলেন চরম উচ্ছৃঙ্খল এবং এক অসংযমী, সেই একই মানুষ কবিতা লিখতে বসে হয়ে পড়েছিল কঠোর সংযমী এবং পরিশ্রমী।তাঁর কবিতার তথা ধ‍্যানের বিষয় ছিল যন্ত্রণা, উন্মাদনা, অবক্ষয়, কুশ্রীতা, মৃত্যু, অবসাদ.... এই সমস্ত বিষয়ে তিনি আহরণ করেছিলেন নিজের জীবন থেকে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। অন্যভাবে বলতে গেলে বোদলেয়ারের কবিতা হল তাঁর নরক বাসের বর্ণনা।তাঁর সমসাময়িক একজন ফরাসি লেখক বোদলেয়ারের বিষয়ে বলেছিলেন–' দান্তে নরকে  কেবল বেড়াতে গিয়েছিলেন কিন্তু বোদলেয়ার নরক থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন । বোদলেয়ারের কবিতা বিশ্বজনীনতা লাভ করার কারণ হল এটাই যে সীমাহীন  দুঃখ ,বিষাদ এবং বেদনা বোদলেয়ার নিজের জীবনে স্বেচ্ছায় ভোগ করে অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে সেইসব বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে রেখে গিয়েছেন নিজের কবিতায় ।

ভারতে যে বছর সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল সেই বছরেই অর্থাৎ ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত  হয় বোদলেয়ারের কবিতা সংগ্রহ Les Fleurs Du Mal (The Flowers of Evil)। বোদলেয়ারের কবিতা সিপাহী বিদ্রোহের চেয়ে অনেক বড় বিপ্লব সংঘটিত ওষুধের বাজার করল মানুষের মনোজগতে। বইটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর নিন্দা এবং অশ্লীলতার অভিযোগে আদালতে কবির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বিচারক বোদলেয়ারকে ঈশ্বর- নিন্দার অভিযোগ থেকে  অব্যাহতি দিলেন যদিও অশ্লীলতার অভিযোগে ছয়টি কবিতা পাঠ 

থেকে বাদ দিতে হল। বোদলেয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনে এই বলে ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর কবিতায় অসৎ এবং অমঙ্গলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে সত্যি, কিন্তু এসবের উদ্দেশ্য হল পাঠকের মনে অসৎ এবং অমঙ্গলের প্রতি ভীতি সঞ্চার করা । সমগ্র জীবন পাপাচারে লিপ্ত হয়ে থাকা বোদলেয়ারের মনে গভীর আকর্ষণ ছিল ধর্মের প্রতি – বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক ভক্তিবাদের প্রতি । পাপের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে বোদলেয়ার এগিয়ে গিয়েছিলেন ধর্মের উপকূলের দিকে।  

বোদলেয়ারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় ফ্রান্সের কোনো একজন কবি বা লেখকই উপস্থিত ছিলেন না; নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে যাওয়া কবি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল সকলের দ্বারা অবজ্ঞা এবং উপহাসের পাত্র হয়ে। কিন্তু মৃত্যুর পরে তিনি স্বীকৃত হয়েছেন আধুনিক যুগের অন্যতম প্রভাবশালী কবিরূপে। ইয়েটস, এলিয়ট, এজরা পাউন্ড... আধুনিক যুগের এমন একজন কবি নেই যিনি বোদলেয়ারের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছেন।

প্রথম যৌবনের সোনালি বছরগুলিতে আমি আমার মস্তিষ্কে বহন করে নিয়ে বেরিয়েছিলাম 'নরকাগ্নি' নামের একটি উপন্যাস; মনে মনে সেই উপন্যাসটি লিখে থাকার সময় আমার নরক-বাসের অভিজ্ঞতা হয়েছিল।না, কথাটা এভাবে বললে বোধহয় বেশি শুদ্ধ হবে যে আমি ভেতরে ভেতরে নরকের আগুনে পুড়ে মরেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে পরিকল্পনা করেছিলাম' নরকাগ্নি' নামের একটি উপন্যাস। অবশ্য আমার এই নরকটি ধর্ম কল্পনাই করেনি । দুরন্ত যৌবনের উচ্ছ্বাসে জীবনের অর্থ এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে ক্ষণে ক্ষণে আমার মনে উদিত হওয়া হাজারটা প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আমার মন সমস্ত বিশ্ব বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল, আর সেই বিদ্রোহ আমার অর্ন্তজীবন লন্ডভন্ড করে সৃষ্টি করা নরকের আগুনে আমি পুড়ে মরেছিলাম। সেই আগুনে ইন্ধন জুগিয়ে ছিল বোদলেয়ার এবং র‍্যাঁবো ইত্যাদি আধুনিক কবিদের কবিতাই।

এটা হল আমার নরকের কথা। নবকান্ত বরুয়ার নরকটির কথা তিনিই বলতে পারবেন। সেই বিষয়ে কিছু একটা ধারণা করাও আমার পক্ষে অসম্ভব।

------- 

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।






1 টি মন্তব্য:

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...