শুক্রবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

বন্দি ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-- বাসুদেব দাস,Homen Bargohain

 বন্দি

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-- বাসুদেব দাস





আমার প্রিয় লেখক কয়েকজনের ভেতরে আর্জেন্টিনার লেখক জর্জ লুই বরখেছ অন্যতম। একজন লেখককে সারা জীবন ধরে ভালোবাসা সম্ভব নয়। জীবনের ঋতুতে ঋতুতে মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়, নতুন নতুন প্রয়োজন অনুভূত হয়। জীবনের একটি বিশেষ ঋতুতে বা বিশেষ একটি আধ্যাত্বিক সংকটের সময় যে লেখকের রচনার মধ্যে আমরা আশ্রয় বা আনন্দ খুঁজে পাই, সেই একই লেখকের প্রতি অন্য সময় আমরা অনুভব করি কেবল শীতল উদাসীনতা। পঞ্চাশের গণ্ডি পার হওয়ার পরে প্রায় পাঁচ বছর আমার মনের নিত্যসঙ্গী ছিল জর্জ লুই বরখেছ। আমার কাছে তাঁর প্রয়োজন এখন আগের চেয়ে কিছু কমেছে । কিন্তু তা বলে আমর প্রিয় লেখকের তালিকা থেকে এখনও তিনি সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়ে যাননি।অনেক মানুষ যেভাবে জীবনের ক্লান্তিকর গতানুগতিকতা থেকে সাময়িক মুক্তি চেয়ে দেশ বিদেশে ভ্রমণ করতে যায়, আমিও ঠিক সেই একই উদ্দেশ্যে বরখেছের যেকোনো বই হাতে নিয়ে বসি। তারপরে আমার মনের কী অবস্থা হয় তা জানতে হলে আপনাদেরও তার যেকোনো গ্রন্থের পাতা উল্টে দেখতে হবে কিন্তু আমি কীভাবে ধরে নিই যে আপনি হাত বাড়ালেই বরখেছের বই আপনি পাবেনই? বরং না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেই জন্য আমি নিচে বরখেছের গল্পের একটি নমুনা দিলাম।এটি তার সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প নয়। কিন্তু তার সৃষ্ট জগতটির রূপাভাস এখানে পরিস্ফুট। জীবন সুন্দর, জীবন ভয়ঙ্কর, জীবন রহস্যময়। সেই সুন্দর ভয়ঙ্কর রহস্যময় জীবন বরখেছের লেখনীতে আশ্চর্য ভাবে ধরা দেয়।

জুনিন  বা তাপালকুত এই গল্পটি তাঁরা প্রায়ই বলে। রেড ইন্ডিয়ানদের একটি আক্রমণের পরে গ্রাম থেকে একটি ছেলে নাই হয়ে  গেল।মানুষের বলা অনুসারে রেড ইন্ডিয়ানরা ছেলেটিকে বন্দি করে নিয়ে যায়।ছেলেটির মা-বাবার তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।অনেক বছর পরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একজন সৈ্নিক এল।তিনি গ্রামের লোকজনদের বললেন যে একজন রেড ইণ্ডিয়ানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল।তাঁর চোখদুটির রঙ আকাশী নীল।সেই রেড ইণ্ডিয়ানটাই তাদের ছেলে হতে পারে।অবশেষে তাঁরা সেই মানুষটাকে খুঁজে পেল।(ঠিক কী পরিস্থিতিতে মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া গেল তার সঠিক বিবরণ কাহিনিটিতে নেই।আর আমিও যে কথা ভালোভাবে জানি না সে কথা কল্পনায় সৃষ্টি করে নিতে চাই না)। তাঁরা ভাবলেন যে তারা মানুষটিকে নিজের পুত্র বলে চিনতে পারল। অরণ্যের মধ্যে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে মানুষটা মানুষের ভাষা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো আপত্তি না করে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন। ফিরে গেলেন উদাস, নির্বিকার বাধ্য হয়ে। ঘর পেয়েই তিনি থমকে গেলেন, কারণ অন্য মানুষরাও থমকে রইলেন। তিনি দরজার দিকে তাকালেন। কিন্তু তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ দেখি তিনি মাথাটা নিচু করলেন,তিনি একটা চিৎকার করলেন তার পরে তিনি মহিলাদের ঘরের সামনে দিয়ে দৌড় মেরে একেবারে রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন।বিন্দুমাত্র ইতস্তত নয়া করে তিনি মাকড়সার জালে ভরা রান্নাঘরের চিমনিতে হাত ঢুকিয়ে মোষের শিঙের নাল লাগানো একটা কটারি বের করে আনলেন।সে যখন একটি ছোট ছেলে ছিল তখনই সে সেখানে কটারিটা লুকিয়ে রেখেছিল। আনন্দে তার চোখদুটি তিরবির করে উঠল।তাঁর মা-বাবার চোখেও আনন্দে চোখের জল দেখা দিল। কারণ তারা নিজের ছেলেকে চিনতে পারলেন।

খুব সম্ভব এরপরে অন্যান্য স্মৃতি ও তাঁর মনে এসেছিল, কিন্তু রেডইন্ডিয়ানটি বেশিদিন সেই ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে পারল না। একদিন তিনি তাঁর পরিচিত এবং কাঙ্ক্ষিত অরণ্যের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। অতীত এবং বর্তমান সংমিশ্রিত হয়ে কুহেলিকায় পরিণত হওয়া সেই চিত্তবিভ্রমকারী মুহূর্তে তিনি ঠিক কি অনুভব করেছিলেন সে কথা আমি কখনও ভালোভাবে জানতে পারব না। সেই প্রবল আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মুহূর্তে হারানো সন্তানটির পুনর্জন্ম হয়েছিল, না তার মৃত্যু হয়েছিল, অথবা একটি শিশুর মতো বা অন্তত একটি কুকুরের মতো সে সেই মুহূর্তে নিজের মা-বাবাকে এবং বাড়িটিকে চিনতে সক্ষম হয়েছিল– সে কথা জানতে যে আমার এত ইচ্ছা করে।

গল্পটা এতটুকুই। গল্পটি যদি আপনার মনে কোনো রেখাপাত করে না থাকে তাহলে তার সমস্ত দোষ আমার অক্ষম অনুবাদের। বরখেছকে Master of precision বলা হয়ে থাকে। অসমিয়া ভাষা সেই আশ্চর্য প্রতিভা এখনও আয়ত্ত করতে পারেনি। তা ছাড়া লেখক মানুষ জানে যে মনের জগতে নানা রহস্যময় ঘটনার ফলে কখনও শব্দগুলি লেখকের সঙ্গে ভীষণভাবে সহযোগিতা করে, এবং লেখকের দাবি এবং প্রয়োজন অনুসারে তারা অতিশয়  বাধ্যতা এবং নমনীয়তা দেখায়। কখনও কিন্তু তারা প্রচন্ড অভিমান করে লেখকের সঙ্গে পদে পদে অসহযোগিতা করে  এবং তাকে বিপদে ফেলে। বরখেছের গল্পের আমি করা অসমিয়া অনুবাদ অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। আপনারা ইংরেজি অনুবাদে গল্পটি পড়ে দেখার চেষ্টা করবেন।বরখেছ সমস্ত রচনা স্পেনিশ ভাষায় লিখেছেন যদিও তিনি নিজে ইংরেজি ভাষা ভালো করে জানেন,তাঁর মা ইংরেজ, এবং তিনি তাঁর রচনার ইংরেজি অনুবাদে সাহায্য করেন।

ঠিক আছে, সেই সব কথা থাক। কেবল একবার কল্পনা করতে চেষ্টা করুন –বরখেছের গল্পের সেই ছেলেটি আপনিও নন কি ? পশুর কোনো স্মৃতি শক্তি নেই। থাকলেও তা ক্ষণস্থায়ী অথবা তার ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত।স্মৃতি একান্তভাবেই মানবিক। এবং কী রহস্যময় সেই স্মৃতির জগত। 


লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।  




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...