এইচ জি ওয়েলস এবং জোসেফ স্টালিনের কথোপকথন
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-- বাসুদেব দাস
কুড়ি শতকের সবচেয়ে প্রতিভাশালী এবং প্রভাবশালী লেখকদের মধ্যে নিঃসন্দেহে একজন অগ্রগণ্য লেখক হলেন এইচ জি ওয়েলস। তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞান থেকে নানা সংকেত নিয়ে ওয়েলস কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক কাল্পনিক কাহিনি রচনা করেছিলেন। এই কাহিনি গুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এইযে তিনি যে সমস্ত ঘটনা কেবল কল্পনায় ভেবেছিলেন সেগুলিই পরবর্তীকালে বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ তাঁর 'The First Men in the Moon' নামে উপন্যাসটির কথাই বলতে পারি। মানুষ চন্দ্রে পদার্পণ করার বহু আগেই ওয়েলস তাঁর উপন্যাসে এরকম একটি সম্ভাবনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর অন্য একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক উপন্যাসের নামই ছিল The Shape of Things to Come। সেই কাল্পনিক কাহিনির ভিত্তিতে একটি সিনেমাও করা হয়েছিল, এবং আমরা হাই স্কুলের ছাত্র হয়ে থাকার সময় সিনেমাটা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। মোটকথা এইচ জি ওয়েলস তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনার সাহায্যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার অনেক সম্ভাব্য প্রগতি আগে থেকেই অনুমান করতে পারতেন, আর তাঁর বিজ্ঞান ভিত্তিক উপন্যাস গুলিতে অনাগত ভবিষ্যতের ছবির জীবন্ত রূপটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই জন্য তিনি একজন আধুনিক প্রফেট রূপে পরিচিত হয়ে পড়েছিলেন।
ওয়েলসের দ্বিতীয় ধরনের উপন্যাসের উপজীব্য তথা বিষয়বস্তু ছিল আধুনিক মানুষের নানাবিধ জটিল সমস্যা; বিশেষ করে মানবিক সম্পর্কের জটিলতা। তাঁর এই শ্রেণির উপন্যাসের ভেতরে Kipps এবং Tom Bungay সমধিক প্রসিদ্ধ। কোনো কোনো সমালোচকের মতে এই শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্ধেক ডজন উপন্যাসের মধ্যে একটি হল ওয়েলসের Tom Bungay.
সর্বসাধারণ পাঠকের জন্য ওয়েলসের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় বইটি হল An Outline of the History of the World। উইল ডুরান্ট প্রতিটি শিক্ষিত মানুষের অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচিত যে একশোটি গ্রন্থের তালিকা প্রস্তুত করেছেন সেই একশোটি গ্রন্থের মধ্যে একটি হল ওয়েলসের An Outline of the History of the World। গ্রন্থটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে ওয়েলসের জীবনীকার লভেট ডিকসন লিখেছেন–' পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আগে থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত সময় জুড়ে লেখা সাতশ পঞ্চাশ হাজার শব্দের এই গ্রন্থটি একজন মাত্র মানুষ এক বছরে লিখে শেষ করেছিলেন। এই গ্রন্থটি ওয়েলসের জ্ঞান আহরণের শক্তি, সেই জ্ঞানকে সুবিন্যস্ত করতে পারার ক্ষমতা এবং সর্বোপরি সুদীর্ঘ সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম করতে পারা শক্তির চিরস্থায়ী কীর্তিস্তম্ভ হয়ে থাকবে।'
এই তিন ধরনের সাহিত্য কর্মের জন্যই ওয়েলসকে আধুনিক যুগের একজন প্রভাবশালী লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর আরও একটি গ্রন্থ পড়ে খুব খুশি হয়েছিলাম এবং বইটির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। An Experiment With Living নামের এই গ্রন্থটি ছিল ওয়েলসের আত্মজীবনী। আমি কটন কলেজের ছাত্র হয়ে থাকার সময় কলেজ লাইব্রেরি থেকে বইটি এনে পড়েছিলাম। এখন লাইব্রেরিতে বইটি আছে কিনা সে কথা আমি জানিনা। কটন কলেজ লাইব্রেরির যে সমস্ত বইয়ের নাম আমি আমার বিভিন্ন রচনায় উল্লেখ করেছি সেইসব বই গুলির বেশিরভাগই এখন লাইব্রেরিতে পাওয়া যায় না বলে এখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে জানিয়েছে। কটন কলেজের লাইব্রেরি থেকে এত দ্রুত বইগুলি হারিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি।
এইচ জি ওয়েলস ছিলেন সমাজবাদী। ব্রিটেনে যে ধরনের সমাজবাদের আদর্শ গড়ে উঠেছিল সেই সমাজবাদে তিনি মানুষের মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৯৩৪ সনে ওয়েলস দ্বিতীয়বারের জন্য সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ করতে যান। সেই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী মুষ্টিমেয় লেখক কয়জনের ভেতরে একজন ছিলেন ওয়েলস। অন্যদিকে,সেই সময়ই সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বময় কর্তা জোসেফ স্টালিন ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতা। মস্কোতে গিয়ে উপস্থিত হওয়ার একদিন পরে ওয়েলস স্টালিনের সঙ্গে দেখা করে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি ব্রিটেনের The New Statesman and Nation নামের খবরের কাগজ ২৭ অক্টোবর (১৯৩৪) সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়েলস ব্যক্ত করা মতামতের স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে একটি দীর্ঘ উত্তপ্ত বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। বিতর্কটিতে ওয়েলসের বিরোধিতা করা লেখক তথা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ্ব এবং আর্নেস্ট টলার।( বার্নার্ড শ্ব এবং ওয়েলসের বৌদ্ধিক সংঘাত তথা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসের একটি মুখরোচক অধ্যায়ে পরিণত হয়েছিল)। ওয়েলসকে সমর্থন করার জন্য এগিয়ে এসেছিল জে এম কেইনসের মতো বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ। বিভিন্ন বই এবং প্রবন্ধে আমি এই বিখ্যাত বিতর্কটির উল্লেখ পড়তে পেয়েছিলাম যদিও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ওয়েলস এবং স্টালিনের কথোপকথনটা আমি পড়ার সুযোগ পেলাম এই সেদিন মাত্র – মাত্র এক সপ্তাহ আগে। আধুনিক যুগের প্রফেট রূপে পরিচিত ওয়েলস ১৯৩৪ সনেই, অর্থাৎ কমিউনিজম এবং সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব তুঙ্গে উঠার সময়টুকুতে কমিউনিজমের কীরকম ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন তার কিছু ইঙ্গিত এই সাক্ষাৎকারটিতে রয়েছে।' আমার অসম' এর পাঠকদের মনে কৌতুহল জাগানোর জন্য স্টালিন এবং ওয়েলসের মধ্যে হওয়া কথোপকথনের আংশিক আভাস অতি সংক্ষিপ্ত রূপে নিচে দেওয়া হল।
প্রথমেই একটি কথা বলে নেওয়া দরকার যে স্টালিনের প্রতি ওয়েলস পোষণ করেছিলেন বিশেষ শ্রদ্ধার মনোভাব। ওয়েলসের চোখে স্টালিন ছিলেন একজন ক্ষমতালোভী, স্বৈরাচারী এবং মতান্ধ একনায়ক, কিন্তু স্টালিনের চরিত্র নিষ্কলঙ্ক বলে ওয়েলস বিশ্বাস করেছিলেন। এছাড়া ওয়েলসের মতে সেই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দুজন রাষ্ট্রনেতার ভেতরে একজন ছিলেন স্টালিন। অন্যজন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট। অন্যদিকে, ওয়েলসের বিশ্বজোড়া খ্যাতি এবং প্রভাবের খবর নিশ্চয় স্টালিনের কানে গিয়েছিল।(স্টালিন ছিলেন বইয়ের পোকা); ওয়েলসের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেই স্টালিন তাকে important public man বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও দুই জনই বেশিরভাগ কথায় এক মত হতে পারেন নি। উদাহরণস্বরূপ ওয়েলস বিশ্বাস করেছিলেন যে রুজভেল্টের New Deal নীতি পুঁজিবাদের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল এবং দেশটিকে সমাজবাদী অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সমাজবাদী অর্থনীতি মানেই হবে পরিকল্পিত অর্থনীতি– যার চালিকাশক্তি হবে রাষ্ট্র। ওয়েলসের কথা বিশ্বাস করতে হলে বলতে হবে যে রুজভেল্ট এবং স্টালিন দুজনে পৃথক বিন্দু থেকে যাত্রা আরম্ভ করা সত্ত্বেও দুইজন একই গন্তব্যস্থলে গিয়ে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল । কিন্তু স্টালিন ওয়েলসের কথা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বললেন যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়ার গন্তব্যস্থল সম্পূর্ণ পৃথক । স্টালিনের মতে রুজভেল্টের New Deal কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনকামী নতুন অর্থনৈতিক নীতি নয়; তা হল কেবল পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত বিকার সৃষ্টি করা অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার পাবার জন্য অবলম্বন করা একটা সাময়িক কৌশল মাত্র। এই ধরনের সাময়িক কৌশল পুঁজিবাদের সংকট কখনও স্থায়ীভাবে দূর করতে পারেনা।
স্টালিনের কথা শুনে ওয়েলস জোর দিয়ে বললেন যে রুজভেল্টের New Deal এর কার্যকরী পরিণাম অতি শক্তিশালী হওয়া বলে তিনি বিশ্বাস করেন এবং সঙ্গে তিনি এই কথাও বিশ্বাস করেন যে New Deal এর মূল আদর্শ হল ( এংলো স্যাক্সন অর্থে) সমাজবাদী আদর্শ। কিন্তু ওয়েলসের এই যুক্তি মানতে স্টালিন কোনো মতেই রাজি নয়, কারণ তার মতে রাষ্ট্র অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে পুঁজিবাদী অর্থনীতি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকা পর্যন্ত সমাজবাদী অর্থনীতি প্রবর্তন করা কখনও সম্ভব নয়।
এখানে ওয়েলস একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। সমাজবাদ তথা সাম্যবাদে ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়ে বলে একটা ধারণা প্রচলিত আছে। ওয়েলস বললেন যে সমাজবাদ এবং ব্যক্তিবাদ কালো এবং সাদার মতো বিপরীত ধর্মী বস্তু হতে পারে না। এই দুটির মধ্যে থাকতে পারে অনেক মধ্যবর্তী পর্যায়। ব্যক্তিবাদ কখনও দস্যুতার নামান্তর হতে পারে, কিন্তু অনুশাসন এবং সু-সংগঠনের বলে সেটাই কখনও হয়ে পড়তে পারে সমাজবাদের সমতুল্য। পরিকল্পিত অর্থনীতি কার্যকরী করতে হলে যে জিনিসের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল অর্থনীতির সংগঠকদের দক্ষতা এবং অনুশাসন। সংগঠন ছাড়া সমাজবাদ কখনও সম্ভব হতে পারে না।
ব্যক্তিবাচক সমাজবাদের সম্পর্কে বক্তব্য সমর্থন করে স্টালিন বললেন যে ব্যক্তিবাদ এবং সমাজবাদের সংঘর্ষ অনিবার্য বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। তার মতে একমাত্র সমাজবাদী সমাজই ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে । কিন্তু ব্যক্তি এবং সমাজের সংঘাত অনিবার্য না হলেও শোষক ধনী শ্রেণি এবং শোষিত শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার কোনো উপায় নেই। শোষক এবং শোষিতের স্বার্থ এত বিপরীতমুখী যে সেই দুটির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা অসম্ভব।
মানব সমাজকে ধনী এবং দরিদ্র– কেবল এই দুটো শ্রেণির মধ্যে ভাগ করতে ওয়েলস কিন্তু রাজি হলেন না। তাঁর মতে পশ্চিমের দেশগুলিতে এই রকম অনেক ধনী মানুষ রয়েছে – মূলধন উপার্জন করা লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি করাটাই যাদের জীবনের একমাত্র বা প্রধান উদ্দেশ্য নয়। এইরকম অনেক দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তিবিদ এবং অর্থনীতির সংগঠক রয়েছেন যারা লাভ অর্জন করা ছাড়াও অন্য কিছু একটা করতে চায়। তারা পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারেন এবং তার পরিবর্তন সাধন করতে চান। কিন্তু তারা তথাকথিত শ্রেণিসংগ্রাম অনিবার্য বলে কখনও বিশ্বাস করেন না।
ধনী এবং দরিদ্রের বাইরেও আরও একটি মধ্যবর্তী শ্রেণি –‘টেকনিকেল ইন্টেলেজিন্সিয়া’ -থাকার কথা স্টালিনও স্বীকার করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক সৎ এবং আদর্শবাদী মানুষ থাকার কথা মেনে নিতেও তিনি রাজি হলেন।কিন্তু তিনি এই কথা জোর দিয়ে বললেন যে মানব-সমাজকে সর্বপ্রথমে ধনী এবং দরিদ্র,সম্পদের অধিকারী এবং সর্বহারা ,শোষক এবং শোষিত -এই দুটি শ্রেণিতে ভাগ করে নিতেই হবে।এই দুটি শ্রেণির মধ্যে হওয়া সংঘর্ষে মধ্যবর্তী শ্রেণিটি কখনও ধনীর পক্ষ নেয়,কখনও দারিদ্রের পক্ষ নেয়,অনেক সময় তারা নিরপেক্ষ হয়ে থাকে।কিন্তু শ্রেণি-সংগ্রাম চলতে থাকবেই,আর তার চূড়ান্ত পরিণাম নির্ণয় করবে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি।
স্টালিনের শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্ব বা তার অনিবার্যতা মেনে নেবার জন্য ওয়েলস কোনোমতেই রাজি হলেন না।তাঁর মতে পুঁজিপতিদের মধ্যে এরকম অনেক মানুষ আছে যারা কেবল লাভের আশাতেই কাজ করে না। অনেক পুঁজিপতির সাংগঠনিক দক্ষতা এবং ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা এত বেশি বৃ্দ্ধি পেয়েছে যে তাদের থেকে সোভিয়েট রাশিয়াও শিক্ষা নিতে পারে।কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হল এই যে ব্যক্তিগত মুনাফার ভিত্তিতে গড়ে উঠা ব্যবস্থাটা ক্রমশ ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে;এরকম অবস্থায় পুঁজিবাদী এবং সমাজবাদী বিশ্বকে সংঘর্ষের পথে ঠেলে দেবার পরিবর্তে বিশ্বের সবগুলি গঠনমূলক আন্দোলন এবং শক্তিকে একত্রিত করার চেষ্টা করাটা্ই অধিক বাঞ্ছনীয় হবে।
ওয়েলসের কথা শুনে স্টালিন প্রথমেই এই কথা স্বীকার করে নিলেন যে সোভিয়েত রাশিয়া পুঁজিপতিদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করেছে। কিন্তু পুঁজিপতিরা যে লাভের লোভ পরিহার করে নিঃস্বার্থ সমাজ সেবকের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে একথা মেনে নিতে তিনি রাজি হলেন না। তাঁর মতে পুঁজিপতিরা মুনাফার সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের তার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। পুঁজিপতিদের বাদ দিয়ে আরও একটি মধ্যবর্তী শ্রেণি আছে – টেকনিকেল ইন্টেলে জিন্সিয়া তথা কারিগরি বুদ্ধিশালী লোকেরা– যাদের উপরে সম্পূর্ণ ভরসা করা যায় না। অক্টোবর বিপ্লবের পরে তাদের অনেকেই বিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল; নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে কমিউনিস্টদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে তাঁরা অস্বীকার করেছিল। অবশ্য কিছুদিন পরেই নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে তারা নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ার কাজে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এল। এইসব অভিজ্ঞতা থেকে একটা শিক্ষাই পেতে পারি আর সেটা হল এই যে পৃথিবীটার পরিবর্তন করতে হলে রাজনৈতিক ক্ষমতা না হলেই নয়। ওয়েলস এই কথাটা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেন বলে স্টালিন অভিযোগ করলেন। হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলে সর্বাধিক সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেউ পৃথিবীটার পরিবর্তন করতে পারে না। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকতে হবে কার হাতে? তা থাকতে হবে একটি বৃহৎ শ্রেণির হাতে– যে শ্রেণিকে একদিন পুঁজিপতি শ্রেণির স্থান নিতে হবে। সেই শ্রেণিটি হল শ্রমিকশ্রেণি। কারিগরি লোকদের সহায় সহযোগিতা নিশ্চয় নিতে হবে, কিন্তু সেইসব লোক কখনও একটি স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারে না।
স্টালিনঃ পৃথিবীর রূপান্তর সাধন হল একটি বৃহৎ , জটিল এবং কষ্টকর প্রক্রিয়া। এই বৃহৎ কাজের জন্য একটি বৃহৎ শ্রেণির প্রয়োজন। বড় জাহাজ বের হয় দীর্ঘ সমুদ্র–যাত্রায়।
ওয়েলসঃ কথাটা ঠিক। কিন্তু দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার জন্য একজন ক্যাপ্টেন এবং একজন নেভিগেটরেরও প্রয়োজন আছে।
স্টালিনঃ সে কথা সত্যি। কিন্তু দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার জন্য সর্বপ্রথমে যে জিনিসের দরকার তা হল একটি বড় জাহাজ। জাহাজহীন নেভিগেটরের কাজ কি? তিনি একজন কাজকর্মহীন বেকার।
ওয়েলসঃ কিন্তু আপনি বলা বড় জাহাজটি হল মানব- সমাজ; তা একটি জাহাজ নয়।
ওয়েলস একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করে স্টালিনকে জিজ্ঞেস করলেন–' মিঃ স্টালিন , ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিপ্লবের বিষয়ে আপনি যত কথা জানেন সেরকম জানা মানুষ খুব কমই আছে। জনতা নিজে নিজে কখনও জেগে উঠে কি? এটা একটি প্রমাণিত সত্য নয় কি যে সব সময় একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীই বিপ্লব করে?
ওয়েলসের এই কথাটা অস্বীকার করা স্টালিনের পক্ষে সম্ভব হল না। তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবার জন্য একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রয়োজন। কিন্তু তিনি এর সঙ্গে এই কথাও যোগ করে দিলেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অন্তত নিষ্ক্রিয় সমর্থনের ওপরে নির্ভর না করে সবচেয়ে প্রতিভাশালী, পরিশ্রমী এবং শক্তিশালী সংখ্যালঘুর পক্ষেও সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সপক্ষে প্রচার অভিযান চালিয়েছিল। ওয়েলস অনুভব করেছিলেন যে কমিউনিস্টদের এই কার্য অত্যন্ত ভুল হয়েছে। এক সময়ে বিভিন্ন দেশে যখন অত্যাচারী একনায়কের স্বৈরাচার চলেছিল, তখন হয়তো সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সপক্ষে চালানো প্রচার অভিযানের কিছু যুক্তি ছিল। কিন্তু সেই পুরোনো ব্যবস্থা এখন নিজে নিজেই ভেঙ্গে পড়েছে। আধুনিক পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানের উপরে জোর না দিয়ে বেশিকরে জোর দেওয়া উচিত দক্ষতা, যোগ্যতা এবং উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির ওপরে। সশস্ত্র বিদ্রোহের স্বপক্ষে কমিউনিস্টরা চালানো প্রচারকার্য পশ্চিমের গঠনমূলক মনোভাবাপন্ন লোকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
স্টালিন ও একটা কথা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে; সেই সবের অবক্ষয় আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু তিনি ওয়েলসকে এ কথাও মনে করিয়ে দিলেন যে ধ্বংসমুখী পুরোনো ব্যবস্থাটিকে রক্ষা করার জন্য এবং বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিত্যনতুন প্রচেষ্টাও আরম্ভ হয়েছে। তাছাড়া পুরোনো ব্যবস্থাটা নিজে নিজে ভেঙে পড়েনি। একটা সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার জায়গায় নতুন একটি ব্যবস্থার উত্থান ঘটানোটা একটা বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া– যার সঙ্গে জড়িত হয়ে রয়েছে শ্রেণি- সংঘর্ষ। পুঁজিবাদ পচতে শুরু করেছে সত্যি; কিন্তু এটা একটা পচা কাজ নয় যে এটা নিজে নিজে ভেঙে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে। একটি সমাজ ব্যবস্থার জায়গায় অন্য একটি সমাজ ব্যবস্থা স্থাপন করতে হলে বিপ্লবের প্রয়োজন হয়, আর বিপ্লব হল একটি যন্ত্রণাময় নিষ্ঠুর সংগ্রাম, জীবন-মরণ সংগ্রাম। তাছাড়া শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাওয়া পুরোনো ব্যবস্থার আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য নতুন ব্যবস্থাকে সদা সতর্ক হয়ে থাকতে হয়। কমিউনিস্ট হিংসাকে আদর্শ পন্থা বলে বিবেচনা করে না, কিন্তু হিংসার উত্তর দিতে হবে হিংসার দ্বারাই। উদাহরণস্বরূপ ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে অহিংসা কখনও কার্যকরী হতে পারে না ।
স্টালিনের যুক্তিতে ওয়েলস সম্পূর্ণ ভরসা করলেন না। তিনি পুনরায় স্টালিনকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে পুঁজিবাদী বিশ্বে যে প্রতিক্রিয়াশীল হিংসা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে সংঘটিত দুর্বৃত্তের দৌরাত্ম্যের রূপ লাভ করেছে তার বিরুদ্ধে পুরোনো ধরনের গোঁড়া সমাজবাদী হিংসা প্রয়োগ করে কোনো লাভ হবে না । বরং সমাজবাদীরা আইনের আশ্রয় নিয়ে এবং পুলিশের সাহায্যে সেরকম প্রতিক্রিয়াশীল হিংসার প্রতিরোধ করার জন্য চেষ্টা করাটা বেশি সমীচীন হবে ।
কিন্তু স্টালিন কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ওয়েলসকে ঘুরিয়ে এই কথা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে ভগ্নপ্রায় তথা মুমূর্ষ সমাজ ব্যবস্থাও স্বইচ্ছায় ইতিহাসের মধ্য থেকে প্রস্থান করতে চায় না। সতেরো শতকে ইংল্যান্ডে পুরোনো সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া অনেকে অনুভব করেছিল; কিন্তু তাকে ধরাশায়ী করার জন্য ক্রমওয়েলকে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছিল। জারের রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থা অনেকদিন ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল । কিন্তু তাকেও উৎখাত করার জন্য বিপুল রক্তপাত ঘটাতে হয়েছিল। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে স্টালিনের মতে শক্তি প্রয়োগ ছাড়া যেভাবে নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় না, ঠিক সেইভাবেই সেই সমাজব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য শক্তি প্রয়োগ অপরিহার্য ।
স্টালিনের যুক্তি শুনে ওয়েলস বললেন– শক্তি প্রয়োগ যে করতে হয় সে কথা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু আমি ভাবি যে প্রচলিত আইন যে সমস্ত সুযোগ করে দেয় সেইসবের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করে, অর্থাৎ সেইসবের সঙ্গে যথাসম্ভব নিজেকে খাপ খাইয়ে সংগ্রামের রূপ নির্ধারণ করার জন্য চেষ্টা করা উচিত। প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণ থেকে সেই আইনগুলিকে রক্ষা করা উচিত। পুরোনো ব্যবস্থাটিকে উপর্যুপরি আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলার কোনো দরকার নেই, কারণ তারা নিজে নিজেই ভেঙ্গে পড়ছে। সেই জন্যই আমি ভাবি যে পুরোনো ব্যবস্থা এবং আইনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ এখন অচল এবং পুরোনো কালীন হয়ে পড়েছে। আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা নিচে দেওয়া অনুসারে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ করতে চাইঃ প্রথম, আমি শৃংখলার পক্ষপাতী; দ্বিতীয়, বর্তমানের ব্যবস্থা যতদূর পর্যন্ত শৃঙ্খলা সুনিশ্চিত করতে পারে না ততদূর পর্যন্ত আমি বর্তমানের ব্যবস্থার বিরোধিতা করি; তৃতীয়, সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য যে সমস্ত শিক্ষিত মানুষের সহায় সমর্থনের দরকার হবে তাদের শ্রেণিসংগ্রামের আদর্শ প্রচারে সমাজবাদ থেকে দূরে ঠেলে দেবে।
শিক্ষিত মানুষের প্রসঙ্গে স্টালিন ওয়েলসকে জিজ্ঞেস করলেন–' আপনি যে শিক্ষিত মানুষের কথা বলছেন, কী ধরনের শিক্ষিত মানুষের কথা মনে রেখে আপনি এই কথা বলছেন? সতেরো শতকের ইংল্যান্ডে এই শিক্ষিত মানুষগুলিই পুরোনো ব্যবস্থার স্বপক্ষে দাঁড়ায়নি কি? আঠারো শতকের শেষে ফ্রান্সে এবং অক্টোবর বিপ্লবের সময় রাশিয়াতে এই শিক্ষিত মানুষ গুলি কার পক্ষে ছিল? আসলে শিক্ষা হল একটা অস্ত্র, তার ব্যবহার কীরকম ফল দেবে সেটা নির্ভর করবে অস্ত্রটা যে ব্যবহার করবে তার ওপর। কোনো সন্দেহ নেই সর্বহারা এবং সমাজবাদের জন্য শিক্ষিত মানুষের দরকার হবে। সমাজবাদ স্থাপন করার কাজে গজমূর্খ সর্বহারাকে সহায় করতে পারেনা। কিন্তু শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও প্রকারভেদ আছে। আমরা কোন শিক্ষিত মানুষগুলির কথা বলছি সে কথাও চিন্তা করে দেখতে হবে।'
এতক্ষণ স্টালিন ওয়েলসের প্রতিটি যুক্তির বিরোধিতা করে থাকলেও একটা কথায় কিন্তু ওয়েলসের সঙ্গে একমত হতে তিনি বাধ্য হলেন। ওয়েলস বলেছিলেন যে শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত বিপ্লব হতে পারে না। নিজের কথার সমর্থনে ওয়েলস দুটো ঐতিহাসিক উদাহরণ দিলেন। জার্মানি পুরোনো শিক্ষা- ব্যবস্থায় হাত না দেওয়ার ফলে দেশটা কখনও রিপাবলিক হতে পারল না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য ব্রিটিশ শ্রমিক দল সাহস দেখাতে পারেনি।
স্টালিন ওয়েলসের সেই কথার সঙ্গে একমত হয়ে বললেন–' এখন আপনি কিছুক্ষণ আগে বলা তিনটি কথার উত্তর দিতে আমাকে অনুমতি দান করুন।
প্রথম, বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন একটি বিরাট সামাজিক শক্তি। সেই শক্তিটা হল শ্রমিক শ্রেণি।
দ্বিতীয়, মূল শক্তিটার সঙ্গে একটা সহায়ক শক্তির দরকার। সেই সহায়ক শক্তিটাকে কমিউনিস্টরা পার্টি বলে। এই পার্টিতে থাকে বুদ্ধিমান শ্রমিকরা এবং শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত কারিগরি শ্রেণির লোকরা। শিক্ষিত শ্রেণি তখন শক্তিশালী হয়- যখন তারা শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির বিরুদ্ধে গেলেই শিক্ষিত শ্রেণি দুর্বল শূন্যতায় পর্যবসিত হয়।
তৃতীয়, পরিবর্তনের অস্ত্র হিসেবে রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন হয়, নতুন রাজনৈতিক শক্তি নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং নতুন শৃঙ্খলা স্থাপন করে। সেই নতুন শৃঙ্খলা হল বৈপ্লবিক শৃঙ্খলা।
ওয়েলস স্টালিনকে বলেছিলেন যে তার প্রথম পছন্দ হল শৃঙ্খলা। কিন্তু স্টালিন কেবল সেই ধরনের শৃঙ্খলা চান, যে শৃঙ্খলা শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের পরিপন্থী নয়। স্টালিন ওয়েলসের এই ধারণা ভ্রান্ত বলে খন্ডন করতে চেষ্টা করলেন যে কমিউনিস্টরা খুব হিংসা- প্রিয়। শাসকশ্রেণীর যদি শ্রমিকশ্রেণিকে স্ব-ইচ্ছায় নিজের জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি হয়, তাহলে হিংসার পথ পরিহার করতে কমিউনিস্টদের কোনো আপত্তি নেই কিন্তু ইতিহাসে সেরকম ঘটনা ঘটার কোনো নজির নেই।
ওয়েলসের সঙ্গে দীর্ঘ কথা বলে স্টালিনের মনে একটা ধারণা হয় যে ওয়েলস বিপ্লবের চেয়ে সংস্কারের উপর বেশি জোর দিচ্ছে, বা দুটিকেই সমার্থক করে ফেলছে। সংস্কার এবং বিপ্লবের পার্থক্য ব্যাখ্যা করে স্টালিন ওয়েলসকে বলেন–' নিচ থেকে আসা জনগণের চাপে পড়ে বুর্জোয়া শ্রেণি কখনও আংশিক সংস্কারের দাবি মেনে নেয়; কিন্তু প্রচলিত আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থার আঘাত লাগতে দেয় না। তারা বিশ্বাস করে যে শ্রেণি- শাসন অব্যাহত রাখার জন্য জনগণকে কিছু কনসেশন দেওয়া দরকার। এটাই হল সংস্কারের মূল কথা। কিন্তু অন্যদিকে, বিপ্লবের অর্থ হল একটি শ্রেণি থেকে অন্য একটি শ্রেণিতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সেই জন্যই কোনো সংস্কারকে বিপ্লবের আখ্যা দেওয়া যায় না।'
স্টালিনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ওয়েলস সোভিয়েত রাষ্ট্রের কিছু প্রশংসা করে বলেন–' আমি মাত্র গতকালই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু আমি ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যবান পুরুষ এবং নারীর মুখগুলি দেখতে পেয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ ইতিমধ্যে করা হয়েছে।১৯২০ সনের অবস্থার সঙ্গে এখনকার অবস্থার পার্থক্যটা সত্যিই বিস্ময়কর।
স্টালিনঃ আরও অনেক কাজ করতে পারা যেত– যদি বলশেভিকরা আরও কিছু বুদ্ধিমান হত।
ওয়েলসঃ ওহো , আমি সে কথা মানিনা। বলশেভিকরা নয়, মানুষ নামের প্রাণীটা যদি আরও অল্প বুদ্ধিমান হত…। নিখুঁত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে সমস্ত গুণের দরকার সেই সব মানুষের মস্তিষ্কে নেই। মানুষের মগজ পুনর্গঠন করার জন্য একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা আবিষ্কার করতে পারলে সেটা সত্যিই একটি ভালো কথা হত।'(হাসি)
----------------
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন