বুধবার, ৮ মার্চ, ২০২৩

স্মৃতিকথা- ২৮ ।। এই আমি চরিত্র ।। নীলাঞ্জন কুমার

 স্মৃতি কথা- ২৮


                        এই আমি চরিত্র


                          নীলাঞ্জন কুমার

                        ( গত মাসের পর)




                               ।। ২৮।।

থার্ড ইয়ারে উঠে কলেজে সত্যি সত্যি দাদা বনে গেলাম । তখন নিজের বাড়ি ছাড়াও আর একটি বাড়ি হল আমার। সেটি মেদিনীপুর কলেজ । প্রচুর বন্ধু,  অধ্যাপকদের  ভালোবাসা ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে আমি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম । এছাড়া আর দুটি জায়গা হল আমার পড়ার মহল তা মেদিনীপুর কলেজের সামনে মনীষা বুক স্টল  ( যেখানে সি পি আই  দলের বই ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বই বিক্রি হত, বর্তমানে উঠে গেছে)  ও মল্লিক পুস্তকালয় । পুস্তকালয়ের মালিক বিনয় মল্লিক আমায় ভালোবাসতেন । অমায়িক এই ভদ্রলোক  প্রশ্রয় দিতেন পড়ার বিষয়ে। প্রচুর বই পড়তাম ওখানে  । কিছু কিনতাম সস্তা দেখে । তখন পয়সা কোথায়!  বাড়ি থেকে সামান্য কিছু পেতাম । তাই জমিয়ে কেনা  । সে সময় সিগারেটের নেশা শুরু হল। শুরুটা দাদাগিরি দেখানোর কারণে । পরবর্তীতে নেশা । মাঝেমধ্যে  বিড়ি টানতাম পয়সার অভাবে। বাবা খেত ক্যাপস্টান পাউচ।এখন সেই পাউচ আর দেখিনা । ওই প্যাকেটে থাকতো সিগারেট পাকাবার সাদা পাউচ আর একটা প্লাস্টিকে তামাক । ওই কাগজে তামাক নিয়ে পাকিয়ে থুতু দিয়ে এঁটে নিলেই সিগারেট।তারপর আরাম দিয়ে টান । কি সুন্দর তার গন্ধ! আমি চুরি করে বাবার প্যাকেট থেকে  তামাক নিয়ে লুকিয়ে টানতাম । কি যে আনন্দ হতো! সেই সময় আমার আর এক বন্ধু জুটলো , তার নাম সঞ্জয় চক্রবর্তী । সঞ্জয়ের বাবা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কাজ করতেন মেদিনীপুরে। পরে তিনি উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে বদলি হলে সঞ্জয় এখানে রাজাবাজারের একটি মেসে থেকে পড়াশোনা করতো । ওই জায়গাও আমার আড্ডাস্থল হয়ে উঠলো । প্রতি বিকেলেওখানে আড্ডা জমতো । সঙ্গে সঙ্গী হতো আমার আর এক বন্ধু মানস দে  , ওর বাড়ি ছিল শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে চাঁদড়া তে। মানস কবিতা লিখতো অসীমানন্দ নামে । ও পড়ার জন্য থাকতো মেদিনীপুরের মানিকপুর এলাকায় ঘর ভাড়া করে । সঞ্চয় ও লিখতো,  ওর একটা ছোট্ট কবিতা আমার এখনও মনে আছে: ' টুপটাপ চুপচাপ ঝরছে রক্ত/  কর্দম পিচ্ছিল মুষ্টিক শক্ত/  জাতপাত শেষ কাত/  বুকটায় কব্বর/  জাত যাক পাত যাক/  মিট্টিটা জব্বর । '
     থার্ড ইয়ারে উঠে বুঝলাম পড়াশোনার চাপ কতটা । সঞ্চয় আর গুরুদাস আমায় পড়াশোনাতে সাহায্য করতো । তবে মন যে উড়ুক্কু হরিদাস ! শুধু কবিতা কবিতা গান গান । মাঝে মধ্যে মনে আঁকা দোলা দিত । ছোট ছোট সাদা কাগজে আঁকতাম । সে কি আঁকা!  এখন ভাবলে লজ্জা পাই   । বুঝতে পারলাম আঁকা আমার কপালে নেই । তবে মেদিনীপুরেআর্ট একাডেমি আর শিল্পীচক্র নামে দুটি ছবি আঁকার সংগঠনে মাঝে মধ্যে  প্রদর্শনী হতো । আমি যেতাম । একবার লিখিত বক্তব্য রেখেছিলাম । এ সময় আমার পা মেদিনীপুরের থেকে বাইরে যেতে উঠে পড়ে লাগলো ।মাথায় তখন কলকাতা,  কবিতা গান। যে কোন ভাবে কলকাতা যেতে হবে। একদিনে গিয়ে সেইদিন ফিরতে হবে । কারণ মা বাবার কড়া শাসন বাইরে রাত কাটানো চলবে না । সন্ধ্যা হলেই পড়তে বসতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি । খুব ইচ্ছে হত আমি শহীদ মিনার থেকে বসে বসে ভিক্টোরিয়া দেখতে দেখতে কবিতা লিখি । সে কি উদ্দাম আগ্রহ!  সুযোগ জুটে গেল, কলকাতাতে যোগেন দেবনাথের বাংলা ফিজিওলজি বই আনাব মিথ্যে কারণ দেখিয়ে ভোরে চললাম কলকাতা । সকাল ৬টার সময় মেদিনীপুর শহর থেকে হাটিয়া এক্সপ্রেসে চড়ে খড়্গপুর  ( তখন মেদিনীপুরের থেকে হাওড়া যাবার ট্রেন হয়নি) তারপর খড়গপুর হাওড়া ল্যোকাল ট্রেন ধরে হাওড়া স্টেশন। পৌঁছে গেলাম সকাল দশটা নাগাদ । বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি দশ টাকা । আসা যাওয়া ট্রেন ভাড়া ৪টাকা ৮০ পয়সা । আসা ও যাওয়ার ট্রেনে চা আর বাদাম ভাজা বাবদ ৪০ পয়সা । সে কি অসাধারণ চা! এখনো মুখে লেগে আছে । আর দশ পয়সায় যে বাদাম ভাজা দিত হকার তাতে পেট ভরে যেত । হাওড়াতে নেমে ২৫ পয়সার লুচি তরকারি ।চারটি লুচি আর আলুর তরকারি । তরকারি চাইলে পাওয়া যেত । তারপর পায়ে হেঁটে হাওড়ার ব্রিজ পেরিয়ে লোককে জিজ্ঞাসা করতে করতে  প্রায় আধা ঘন্টার ভেতরে কলেজ স্ট্রিটের পাতিরামের দোকান । সেখানে ঘন্টা তিনেক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিটল ম্যাগাজিন পড়লাম । তারপর কলেজ স্ট্রিটেরএক হোটেলে ৩ টাকা  ৫ পয়সা দিয়ে মাছ ভাত খেলাম। এরপর সারা কলেজ স্ট্রিট ঘোরাঘুরি করে আবার হেঁটে হাওড়ায় ট্রেন ধরে বাড়ি । বাড়িতে ফিরে এলাম রাত আটটা নাগাদ । পরবর্তীতে মাসে দুবার কলকাতা যাওয়া রুটিন হয়ে গেল ।
                                                   ( চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...