রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৩

হে আমার স্বদেশ- ৫০ ।। সন্তোষ কুমার কর্মকার ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das, He Amar Swadesh

হে আমার স্বদেশ- ৫০

সন্তোষ কুমার কর্মকার

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das



  লেখক পরিচিতি-- সন্তোষ কুমার কর্মকার একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং অনুবাদক।বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ১৯৫৩ সনে শ্রীকর্মকারের জন্ম হয়।পিতা কানাইলাল কর্মকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা অসমের বরপেটায়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রচিত উপন্যাস গুলি যথাক্রমে গৃহভূমি, শঙ্খ ধ্বনি, পদাতিক, সুবর্ণরেখা,অ মোর আপোনার দেশ, কালান্তরর কথকতা, শিপার সন্ধানত, ইত্যাদি। ছোটগল্প,বেশ কিছু শিশু উপন্যাস এবং অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।২০২১ সনের এপ্রিল মাসে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।১৯৯৬ সনে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, ১৯৯৮ সনে অসম সাহিত্য সভার সীতানাথ ব্রহ্ম পুরস্কার এবং ২০২০ সনে সাহিত‍্যাচার্য সৈয়দ আব্দুল মালিক উপন্যাসশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ।

আলোচ্য উপন্যাস ' হে আমার স্বদেশ' (অ’ মোর আপোনার দেশ) অসমের অন্যতম সাহিত্যিক, ঠাকুর পরিবারের জামাই, সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই উপন্যাসে বেজবরুয়ার চেতনায় কীভাবে জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরিত হয়েছিল, বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বেজবরুয়ার জাতীয়তাবাদের তুলনা, ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে ভারত তথা অসমের নবজাগরণের উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী বেজবরুয়ার সংগ্রাম, অসম বাংলার সাংস্কৃতিক সমন্বয় আলোচিত হয়েছে।এই উপন্যাসের চরিত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ,প্রজ্ঞাসুন্দরী ,অন‍্যদিকে অসমের হেমচন্দ্র গোস্বামী, গুণাভিরাম বরুয়া,চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা -উনবিংশ শতকের অসম বাংলার অনেক স্বনামধন্য পুরুষই উপন্যাসের পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি শ্রীমতী কর্মকার উপন্যাসটির প্রায় আড়াইশো পাতার মতো অনুবাদ করেছিলেন।তবে আমি প্ৰয়োজন অনুসারে উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে একেবারে প্রথম থেকে অনুবাদ করেছি। বলাবাহুল্য শ্রীমতী কর্মকারের অনুবাদ আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। এই সুযোগে আমি তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে দৈনিক বাংলা পত্রিকা(অন লাইন)উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করতে আগ্ৰহী হওয়ায় তাদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

 (৫০)

  ১৯৩৩ সনের ৫ নভেম্বর। বহুদিনের পরিচিত বুড়ো পিয়ন রতন মুন্ডা সুন্দর এনভেলপে ভরানো একটা চিঠি দিয়ে গেল।লক্ষ্মীনাথ এনভেলপে লেখা কথাটা পড়ে বুঝতে পারলেন এটা বরোদা রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের কমিশনারের কাছ থেকে এসেছে।চিঠিটা খুলে পড়লেন। বিষয়বস্তু হল আগামী ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখ বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেবার জন্য শ্রীযুত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়াকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের ভালো লেগে গেল।তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করে সেদিনই বরোদায় চিঠি পাঠালেন।অবশ্য এই ধরনের আমন্ত্রণ পাওয়ার মূলে বড়ো জামাই সত্যব্রত মুখার্জির একটা ভূমিকা রয়েছে।গত বছর দীপিকা ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করার জন্য লক্ষ্মীনাথ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার জন্য নতুন কোনো পরিবেশে গিয়ে তাঁর বিশ্রাম নেওয়াটা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। তাই ডিসেম্বরের শেষের দিকে বরোদায় গিয়ে পরের বছর জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সেখানে কাটিয়েছিলেন। বরোদার রাজ্য সরকারের অন্যতম প্রধান সত্যব্রত মহারাজা সরাবজি রাও গায়কোয়ারকে শ্বশুর সাহিত্যিক লক্ষ্মীনাথের বৈষ্ণব দর্শনের পাণ্ডিত্যের বিষয়ে সবিশেষ জানিয়েছিলেন।গতবার বরোদায় থাকার সময়ে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে মহারাজা তাকে লক্ষ্মীবিলাস রাজপ্রাসাদে আয়োজন করা হোক সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন দুজনের মধ্যে সৌজন্য সুলভ আলোচনা হয়েছিল। আলোচনা করার পরে মহারাজা লক্ষ্মীনাথের ধর্মীয় জ্ঞান আর পাণ্ডিত্যের অভ্যাস পেয়েছিলেন। তার জন্যই বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে বক্তৃতা দেবার জন্য তাকে মহারাজার এই বিনম্র-আমন্ত্রণ।

  এরকম একটি সম্মানীয় আমন্ত্রণের কথা জেনে প্রজ্ঞাও খুশি হল। বক্তৃতাটা যাতে সারগর্ভ এবং উচ্চমানের হয় তার জন্য তিনি স্বামীকে উৎসাহিত করলেন। সাধারণ বক্তৃতা নয়। বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস। বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের সনাতন ধর্মের কথা আছে, ভারতীয় দর্শনের কথা আছে।তাছাড়া বরোদা রাজ্যে বক্তৃতা দিতে হবে ইংরেজিতে। লক্ষ্মীনাথ পড়ার ঘরে বসে বক্তৃতার জন্য উপাদান সংগ্রহ করে ইংরেজিতে লিখতে শুরু করলেন। লেখার পরে সংশোধন পরিমার্জন করার সময় বেশ কিছু কাটাকুটি হল ।অসীম ধৈর্যে সেই সব দেখে প্রজ্ঞা তার সুন্দর হাতের লেখায় বক্তৃতাটি লিখে দিল। অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে দীর্ঘ বক্তৃতা প্রস্তুত করে প্রজ্ঞাকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীনাথ সম্বলপুর থেকে দুই ডিসেম্বর যাত্রা করে চার ডিসেম্বর তারিখে বরোদা পৌছালেন।

 অরুণার বিয়ের পরে জামাই সত্যব্রত হয়ে পড়েছে লক্ষ্মীনাথের আদরের বাবাজীবন ।সম্পর্কটা এত আন্তরিক হয়ে পড়েছে যে এখন তারা শ্বশুর জামাই নন, একে অপরের বন্ধু। নাতি নাতনিদের জন্মের পরে সম্পর্কটা আরও গভীর হয়ে পড়েছে। নাতি স্বরূপের সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের সম্পর্কটাও বড়ো মধুর। আসলে দীপিকা ক্রিশ্চান হওয়ার পরে লক্ষ্মীনাথ তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে এখানে এসেছিলেন। এখানে এসে চার বছরের বালক স্বরূপের সঙ্গে খেলাধুলা করে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়ে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে এমনকি রাতে তাকে নিয়ে ঘুমানো পর্যন্ত তিনি অন্তরে অনবরত অনুভূত হয়ে থাকা যন্ত্রণাটা অনেকখানি কমিয়ে এনেছিলেন।

 গতবার স্বরূপের সঙ্গে হওয়া কথাগুলি এখনও লক্ষ্মীনাথের মনে পড়ে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার বাবা কে?’ সে উত্তর দিয়েছিল, ‘সত্যব্রত মুখার্জি।’ ‘তোমার নাম কি?’ স্বরূপ প্রথমে বলেছিল, ‘স্বরূপ কুমার বেজবরুয়া।’ তারপর নিজেই নিজেকে শুধরে নিয়ে সে বলেছিল, ‘স্বরূপ কুমার মুখার্জি।’

 দুপুরের ভাত খাওয়ার পরে গান গেয়ে লক্ষ্মীনাথ তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করার কথাটাও মজার। দুদিন এভাবে ঘুম পাড়ানোর পরে দাদুকে ঘুমোতে বলে স্বরূপ তার ছোটো ছোটো হাত দিয়ে দাদুর পিঠে চাপর মেরে ঘুম পাড়াতে দেখে লক্ষ্মীনাথের সে কি আনন্দ। তাছাড়া এই বয়সে স্বরূপ কঠিন কঠিন শব্দগুলি বেশ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে পারে। সত্যিই স্বরূপ বড়ো বুদ্ধিমান।

 এখানে এসে এবারও লক্ষ্মীনাথ স্বরূপের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।প্রথম দুটো দিন কীভাবে যে কেটে গেল বুঝতেই পারলেন না। এদিকে তার ওপরে একটা গুরু দায়িত্ব পড়েছে। সম্বলপুর থেকে বক্তৃতাটা প্রস্তুত করে এনেছেন যদিও সভাকক্ষে স্বচ্ছন্দে পাঠ করা ছাড়াও শ্রোতাদের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যাতে সঠিক উত্তর দিতে পারেন সেসবও ভাবতে হবে। তার জন্য লক্ষ্মীনাথ লিখিত বক্তৃতাটা আবার পড়লেন। বক্তৃতাতে প্রকাশ করা মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টা নিয়ে ভাবলেন।

  বক্তৃতা অনুষ্ঠিত করার জন্য রাজ্যের শিক্ষা কমিশনার বিজ্ঞপ্তি জারি করলেন। মাধ্যমিক স্কুলের প্রেক্ষাগৃহে সম্বলপুরের শ্রীযুত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া মহোদয় ‘বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস’ বিষয়টির ওপরে বক্তৃতা প্রদান করবেন। নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা আগেই শিক্ষা কমিশনের পাঠানো গাড়িতে লক্ষ্মীনাথ সপরিবারে সভাস্থলে উপস্থিত হলেন। ইতিমধ্যে প্রেক্ষাগৃহে বরোদার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসন গ্রহণ করেছেন। মহারাজা গায়কোয়াড় ছাড়া দেওয়ান স্যার ভিটি কৃষ্ণ মাছারি, বরোদার উচ্চপদস্থ অফিসার সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়, শিক্ষা বিভাগের কমিশনাবিকে ভাটে, চিফ সেক্রেটারি মিঃ মানে পাটিল,ধর্মাধিকার মিঃনাদকার্নি,বরোদা কলেজের অধ্যাপক মন্ডলী, স্টেটের কর্মচারী ইত্যাদি অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছেন।

 শুরুতে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় শ্রোতাদের সামনে আমন্ত্রিত বক্তা লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়াকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

  লিখে আনা বক্তৃতার লিপি নিয়ে মহারাজা, রাজসভার সদস্যদের এবং রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সবিনয়ে নমস্কার জানিয়ে লক্ষ্মীনাথ বক্তৃতা শুরু করলেন। মাতৃভাষায় অভ্যস্ত যদিও ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে লক্ষ্মীনাথের অসুবিধা হল না। তাঁর ভাষা সরল সহজবোধ্য। তাছাড়া ধর্মদর্শনের জটিল ভাব গুলি দ্ব্যর্থকতাহীন ভাবে তুলে ধরার জন্য লক্ষীনাথের বক্তৃতা উপস্থিত শ্রোতামন্ডলীর কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়ে পড়ল।

  বিভিন্ন ধর্ম সংস্কারকের হাতে বৈষ্ণব ধর্মের কীভাবে ক্রম বিবর্তন হয়েছিল সেইসব উল্লেখ করে লক্ষ্মীনাথ হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিকভাবের বিষয়ে ব্যাখ্যা তুলে ধরলেন। তারপরে দক্ষিণ ভারতের বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশের বিষয়ে তিনি বললেন শঙ্করাচার্য,রামানুজাচার্য এবং মাধবাচার্য এই তিনজন ভারতের বৈদান্তিক পন্থার শ্রেষ্ঠ টীকাকার।এই তিনজনই উপনিষদের অভ্রান্ততা স্বীকার করেছেন,কেবল এর অর্থ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তিনজন মুনির মতবাদে মতভেদ রয়েছে

  …দক্ষিণে যাওয়া আলো আর ব্রাহ্মণ কটুকিরা দক্ষিণ ভারতে সর্বপ্রথম বৈষ্ণব ধর্মের বীজ বপন করেছিল তারা বৈষ্ণব ধর্মের ভাবাবেগ এর উপরেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছিল আর সেই সব জায়গার মানুষের তারা বৈষ্ণব গীত রচনা করেছিল।

 তারপরে লক্ষ্মীনাথ অসমের বৈষ্ণব ধর্মের প্রসঙ্গে বললেন,আমার দেশ ভারতের উত্তরপূর্বের অসম।অতীত গৌরব থেকে পিছিয়ে পড়ার জন্যই বর্তমানে আমার দেশ ভারতের অন্যান্য প্রান্তের অধিবাসীদের কাছে অজ্ঞাত হয়ে পড়েছে। আমাদের অসমে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তন করেন শ্রীশঙ্করদেব। অতীতে আমাদের এই দেশের নাম ছিল প্রাগ জ্যোতিষপুর।খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছর আগে যখন সমুদায় নিম্ন বঙ্গ (সম্ভবত) সাগরের গর্ভে, তখনও প্রাগজ্যোতিষপুর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী রাজ্য ছিল। প্রাগজ্যোতিষের কথা রামায়ণ, মহাভারত পুরাণ ইত্যাদিতে উল্লেখ রয়েছে। নিম্নবঙ্গ মনুষ্য জাতির বসতির উপযোগী হওয়ার আগেই বিদর্ভ এবং মগধ থেকে আর্যরা কামরূপে আসে।সেদিনের এই প্রাগজ্যোতিষপুরই হল আজকের এই কামরূপ। 

 …সপ্তম শতকে চীন দেশের বিখ্যাত পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতের বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করার সঙ্গে কামরূপে গিয়েছিলেন। তার পরিভ্রমণের কয়েক শতক পরে ও কামাখ্যা বৌদ্ধের বজ্রায়ন পন্থার প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল এই পন্থাকে সহজীয়া পন্থা বলা হত।কিন্তু বৌদ্ধ তান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে কিছু ভ্রষ্টাচার সংযুক্ত করা হয়েছিল। তার জন্যই কামরূপ কামাখ্যা তন্ত্র-মন্ত্রের দেশ বলে প্রচার লাভ করেছিল। এই পদ্ধতির ভ্রষ্টাচার গুলি দূর করার জন্যই সে সংকরদের পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে অসমে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার আরম্ভ করে। তারপরে তার সহযোগী এবং সুযোগ্য শিষ্য মাধবদেব এবং দামোদরদেব বৌদ্ধ তান্ত্রিক পদ্ধতি গুলি দমন করে নব বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে সক্ষম হন।'

পরিসমাপ্তিতে লক্ষ্মীনাথ বললেন,' মহাপুরুষ শংকরদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্ব সংঘাত দূর করার অর্থে সাগরের নিচ থেকে মনি কাঞ্চন তুলে বৈষ্ণব ধর্মের নীতি আদর্শের বিন্যাস করেছেন। শ্রী শংকরদেব প্রবর্তন করা বৈষ্ণব ধর্ম সহজ– সরল, সর্বজনবোধ্য। এই ধর্মই জাতি ধর্ম বিচার করে না, ধনী দুঃখীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করোনা এই ধর্মে বিশ্বাসী সমস্ত শ্রেণীর মানুষ একসঙ্গে বসে পরমব্রহ্মের উপাসনা করে।'

বক্তৃতার শেষে শ্রোতা মন্ডলী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়াকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জানাল। মহারাজ গাইকোয়াড় এতটাই মুগ্ধ হলেন যে নিজের আসন থেকে উঠে এসে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে করমর্দন করে তার পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন । তিনি লক্ষ্মীনাথকে কিছুদিন থেকে আরও একটি বক্তৃতা প্রদান করার জন্য অনুরোধ জানালেন। কেবল তাই নয়, লক্ষ্মীনাথের ভার্সনটা ছাপানোর জন্য এবং তাকে রাজ অতিথি করার জন্য শিক্ষা বিভাগের কমিশনারকে নির্দেশ দিলেন। লক্ষ্মীনাথ জাতে আরামে স্বচ্ছন্দে বড়দার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াতে পারেন তার জন্য মহারাজা একটা মোটরগাড়ি দিলেন। কিন্তু বরোদায় বড় জামাই সত্যব্রত থাকতে তিনি কীভাবে রাজ অতিথি হন? 

নির্ধারিত সময়ে লক্ষ্মীনাথ বক্তৃতা আরম্ভ করলেন। শ্রোতার সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি হওয়ার জন্য আগের চেয়ে অধিক আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেরকমই প্রাঞ্জল ভাষায় লক্ষ্মীনাথ শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলার তাত্ত্বিক দিক চাই তুলে ধরলেন। শুরুতে তিনি কাম এবং প্রেম ,মানব দেহে কাম এবং প্রেমের প্রভাব, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির মাহাত্ম্য, গুপিদা সম্মুখীন হওয়া কঠিন পরীক্ষা, কৃষ্ণকে না পেয়ে গোপিনীরা প্রাণ ত্যাগ করার পণ, পরন স্পর্শ করার পরে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের ছাড়তে না পারার দৃশ্য, কাম ভাব ছেড়ে গোপিনীদের মনে নিষ্কাম প্রেম ভাবের উদয়, হৃদয়ের আকুলতায় প্রেমের উন্মাদনা, অবশেষে অনিন্দ্য সুন্দর রূপ নিয়ে গোপিনীদের সামনে শ্রীকৃষ্ণেৰ প্রকট হওয়া, ব্রহ্ম অনুভূতিতে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার আনন্দময় মিলন ইত্যাদি সুললিত ভাষায় বর্ণনা করলেন। তারপরে লক্ষীনাথ বললেন,' শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে নিত্য লীলা এবং দ্বারকায় সংসার লীলা করেছিল। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে নিষ্কাম প্রেমের বিকাশ ঘটিয়েছিল। ফলস্বরূপ, বৃন্দাবনে কোনো শোকসন্তাপ ছিল না। এমনকি পাক পাখালি একটিৰ ও অপকার হয়নি। তাছাড়া একদল ভাবার মত বৃন্দাবনে অনুষ্ঠিত হওয়া রাসলীলা অশালীন বা অশ্লীল নয়। রাস হল পরম ব্রহ্মের( পরমাত্মা) সঙ্গে জীবের আনন্দময় আত্মিক( জীবাত্মার) মিলন।'

এতটুকু বলতেই সভায় উপস্থিত শ্রোতারা বিমুগ্ধ হয়ে হাততালি দিয়ে লক্ষ্মীনাথকে অভিনন্দন জানাল। কৃষ্ণ চেতনার অমল উপলব্ধিতে বয়স্ক শ্রোতাদের হৃদয়ে এই ধরনের আবেগের সৃষ্টি হল যে তাদের চোখে আনন্দাশ্রু দেখা দিল। শেষে বক্তৃতার সমাপ্তিতে লক্ষ্মীনাথ বললেন,' আমাদের পুরাণগুলি পঞ্চম বেদ কিছু সৃষ্টি করেছে। সেই বেদগুলির ভেতরে ভাগবত সৰ্বোৎকৃষ্ট। তার জন্য ভাগবতকে'অখিল ভূতিসাৰে বলা হয়। বৈষ্ণবদের জন্য অন্তিম কথা হল 'কৃষ্ণ'। যজ্ঞ, যোগ,ব্রত, জ্ঞান-যোগ কর্ম-যোগ ভক্তি যোগেও' কৃষ্ণ' অন্তিম কথা। কৃষ্ণ এবং কৃষ্ণ নামের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কৃষ্ণ নাম ধর্মই হল আজকের এই কলি যুগের ধর্ম। তাই,

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণৈব কেবলম।

কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিৰন্যথা।।

তাই আসুন আমরা আমাদের হৃদয়ের সমস্ত পবিত্রতা নিয়ে এবং নিঃস্বার্থভাবে কৃষ্ণের নাম নিই এবং এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের সৃষ্ট সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জন্য আত্মনিয়োগ করি আসুন।'

দ্বিতীয় বার বক্তৃতা শ্রবণ করে মহারাজা গাইকোয়াৰ বেশি করে অভিভূত হয়ে পড়লেন। পুনরায় লক্ষ্মীনাথ কে আর ও দুদিন থেকে অন্য একটি বক্তৃতা দেবার জন্য অনুরোধ জানালেন। কিন্তু এই ধরনের ষাঁড়গর্ভ বক্তৃতা প্রস্তুত করায় অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। এদিকে সেই ধরনের কোনো গ্রন্থাগাৰ ও এখানে নেই। তাছাড়া তিনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার জন্য লক্ষ্মীনাথ মহারাজার এবারের অনুরোধটা রক্ষা করতে পারলেন না। তথাপি পরের দিন গাইকোয়ার লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সম্মানার্থে বৰোদার লক্ষ্মীবিলাস রাজপ্রাসাদে একটি চা পার্টির আয়োজন করলেন।

দুটি বক্তৃতা দেবার পরে লক্ষীনাথের সুনাম ইতিমধ্যেই এতটা ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল যে অল ইন্ডিয়া করে অরেটৰিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনেৰ গুজরাট শাখা বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। ঔষধপত্র খেয়ে লক্ষ্মীনাথ ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন । অন্যদিকে বক্তৃতার বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতার পেয়ে লক্ষ্মীনাথ এই আমন্ত্রণটা স্বীকার করলেন । বক্তৃতা দেবার দিন ধার্য করা হল জানুয়ারির ১০ তারিখ

(১৯৩৪) । বিষয়টা হল,'কাউহাৰ্ড অফ বৃন্দাবন'--- 'বৃন্দাবনের রাখাল'।

নিজে বিষয় নির্বাচন করার জন্য লক্ষ্মীনাথের আধ্যাত্মিক চেতনায় অন্য একভাবেৰ দোলা লাগল। আগেরবার বৰোদায় ' শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা' বক্তৃতা দেবার জন্যই তার আধ্যাত্মিক চেতনার বিস্তার ঘটেছিল। এবারও প্রজ্ঞা এবং রত্নার সঙ্গে আহমাদাবেদে গিয়ে হংসরাজ প্রাগজি হলে বক্তৃতা যাবার সময় তিনি বৈষ্ণবভাবরসে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। বক্তৃতার শুরুতে তিনি বললেন,' বরোদায় আসার পর থেকে আমি' কৃষ্ণময়' হয়ে পড়লাম। বৰোদা বৃন্দাবনকে বুকে এবং মথুরাম মথুরাকে পাশে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের অফুরন্ত লীলার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে ।'

অর্থাৎ এবারের বক্তৃতায় লক্ষ্মীনাথ বৈষ্ণব ধর্মের তাত্ত্বিক দিকটি ব্যাখ্যা করলেন না। বৈষ্ণব ধর্মের অরাধ্য পুরুষ শ্রী কৃষ্ণের মানবীয় লীলা গুলি কথা সর্বসাধারণের বুঝতে পারার মতো ব্যক্ত করলেন। তিনি বোঝাতে চেষ্টা করলেন, মানব চরিত্রে মানবীয় গুণের বিকাশ করাটাই হল বৈষ্ণব ধর্মচর্চার মূল কথা।

তারপরে লক্ষ্মীনাথ সমস্ত মানবীয় গুণের আধার শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা কৈশোর লীলা রাধার সঙ্গে লীলা অসুর দমন লীলা ইত্যাদি বর্ণনা করে সমাপ্তিতে বললেন,' আমাকে আহমেদাবাদের মতো একটি নগরে বক্তৃতা যাবার সুযোগ দেওয়ায় আপনাদের অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনাদের এই নগর ভারতের মানুষের জন্য যেভাবে কাপড়ের যোগান দিয়ে চলেছে, এভাবে আপনাদের এই ধরনের মহৎ প্রচেষ্টার জন্য এই সমস্ত সভা বক্তৃতার অনুষ্ঠানে মাধ্যমে মানবীয় ধর্ম এবং জ্ঞানের সম্প্রসারণ হচ্ছে। ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের মানুষের মধ্যে মিলন হওয়ার জন্য এই ধরনের সভার বড়ো প্রয়োজন।'

বৰোদায় 'বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস',' শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা' এবং আহমেদাবাদে ' বৃন্দাবনের রাখাল' বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে লক্ষ্মীনাথ দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে অসমের নাম উজ্জ্বল করলেন তারপরে কুড়ি জানুয়ারি তারিখে তার সম্বলপুরে ফিরে যাওয়ার দিন ধার্য করা হল।

রেলের টিকিট কাটার দিন থেকেই লক্ষ্মী নাথের খারাপ লাগতে লাগল। সম্বলপুর গিয়ে কীভাবে কী করবেন, কীভাবে ঘর সংসার চালানোর উপায় বের করবেন… এটা তাকে বিশেষ চিন্তায় ফেলল । বার্ড কোম্পানির চাকরি ছেড়ে যে কাঠের ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, ব্যাবসাটা ভালোভাবে জমে উঠেনি। সম্বলপুরের বাড়িটা বন্ধকে রেখে টাকা ধার করে ব্যাবসাতে লাগিয়েও লাভ হয়নি । কাঠের ব্যবসায়ী রূপে তিনি নিজেকে সম্বলপুরে এখন ও সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। মাঝখানে ব্যাবসার অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়েছিল যে হতাশায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি অরুণাকে লিখেছিলেন,' মা অরুণা, বিজনেস একেবারেই খারাপ। ডিপোতে কাঠের গাদা, অথচ বিক্রি নেই। এদিকে খরচ বেড়েই চলেছে। ভাবছি তোমার কাছে গিয়ে শুয়ে শুয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেব। মা, তুমি আমাকে এক মুঠো খেতে দিও, আর সব ছেড়ে দেব। তোমাদের বাড়ির নিচের তলায় একটা ছোটোখাটো ঘর দিও, শোবার জন্য একটা দরিয়ার খাটিয়া হলেই হবে।'

দ্বিতীয়ত, কিছুদিন ধরে বিশেষ করে, দীপিকা ক্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা নেবার পর থেকে লক্ষ্মীনাথের অন্তরে এক ধরনের অবোঝ শূন্যতা বাসা বেঁধেছে। ঘরে প্রজ্ঞা তার যত্ন নেয়, প্রজ্ঞাৰ সেবা যত্ন এবং আকুলতায় ভরা ভালোবাসা আন্তরিকতা তার বেঁচে থাকার শক্তি, তথাপি মেয়েদের কোন একজন না থাকায় বাড়িটা বড়ো ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। তার জন্যই আগের মতো লেখালেখিতে মগ্ন হতে পারেন না ।'বাঁহী'ৰ জন্য সাধারণ দুই একটি প্রবন্ধ ছাড়া পরিকল্পনা নিয়ে সৃষ্টি মূলক কোনো লেখা হাতে নিতে পারেন নি।

তার চেয়েও বড় কথা, এখন — এই বৰোদাতে এসে, বৰোদার মহারাজের তৃতীয় অনুরোধটি রক্ষা করতে না পারার দিন লক্ষ্মীনাথ নিদারুণভাবে অনুভব করলেন যে তিনি সত্যি বুড়ো হয়েছেন। তাই এরপরে সম্বলপুরে ফিরে গিয়ে তিনি আগের মত চলতে পারবেন বলে মনে হয় না।

তথাপি বিদায়নেবাৰ আগেৰ দিন পর্যন্ত লক্ষ্মীনাথ নাতি-নাতনি মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে আনন্দ করে কাটালেন। নাতি স্বরূপকে নিয়ে তিনি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন। শ্লেট নিয়ে বসে স্বরূপ যে নিজেই মোটরগাড়ি, রেল ইঞ্জিন পাখি মাছ মানুষের ছবি আঁকেন এবং কারো সাহায্য না নিয়ে বই পড়ে, পড়াশোনাতে তার যেমন আগ্রহ –একাগ্রতা… লক্ষ্মীনাথ মনে করেন, এটা বুদ্ধিতে সে একদিন এত বড়ো হবে যে হাজার হাজার মানুষকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। আর লক্ষ্মীনাথের আশা, স্বরূপ পিতৃকুল মাতৃকুল উজ্জ্বল করবে।

বরোদা থেকে বিদায় নেবার আগের দিন। অফিস থেকে বাড়িতে এসে সত্যব্রত দেখলেন বাংলোর বাইরে ফুলবাগানের মধ্যে সবুজ ঘাসে লক্ষ্মীনাথ স্বরূপের সঙ্গে খেলাধুলা করছেন। এত প্রতিভা, অসমিয়া সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য সমগ্র অসমবাসী তাকে মাথার মুকুট করে রেখেছে, প্রতিভাদীপ্ত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানের জন্য অর্থ অসমের বাইরে এই বরোদা এবং আহমেদাবাদে ও সর্বজনের দ্বারা বন্দিত হয়েছেন— সেই ব্যক্তি এভাবে ছোটো হয়ে চার বছরের স্বরূপের সঙ্গে খেলাধুলার দৃশ্যটি দেখে সত্যব্ৰতের খুব ভালো লাগল। তুমি অনুভব করলেন, ছেলের শারীরিক মানসিক বিকাশের জন্য শ্বশুর মশায়ের সান্নিধ্যের খুবই প্রয়োজন । শ্বশুর মশাই এখানে তাদের সঙ্গে থাকলে স্বরূপ উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে মনুষ্যত্ব গুণের অধিকারী হতে পারবে। এই কথাটা মনে রেখেই একসঙ্গে বিকেলের চা জল পান খেতে বসে সত্যব্রত বলল—' বাবা মাকে নিয়ে সম্বলপুর যাবেন। সম্বলপুর গিয়ে এই বয়সে কাঠের ব্যবসা করাটা আপনার পক্ষে জুলুম হবে। তাই বলছিলাম, আপনারা এখানে আমাদের সঙ্গেই থাকুন।' 

অরুণা বলল,' হ্যাঁ পাপা ,তোমরা আমাদের এখানেই থাক। সবাই একসঙ্গে থাকলে সত্যিই ভালো লাগবে।'

' হ্যাঁ দাদু—।' স্বরূপ বলে তোমরা থাকলে খুব মজা হবে।'

লক্ষ্মীনাথের অন্তরটা স্নেহ মমতার অমল অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে পড়ল। তিনি নাতি স্বরূপের সজীব মুখটির দিকে তাকালেন, দেখলেন লাল বল নিয়ে খেলতে থাকা ফুলের মতো কোমল নাতনির দিকে, দেখলেন মাতৃত্ব ভাবে অনুপমা কন্যা অরুণার দিকে, তারপরে বুদ্ধি জ্ঞানে প্রবীণ বলে মনে হওয়া জামাই সত্যব্রতের দিকে তাকালেন। সবাই তাঁর আপন, সবাই তাঁর পরম আত্মীয়। সবাই একসঙ্গে মায়া মমতায় সহবাস সত্যিই আনন্দময়। কিন্তু সেটা কি সম্ভব?

' সত্যব্রত সম্বলপুরের কাঠের ব্যাবসা ছেড়ে আমরা তোমাদের এখানে থাকাটা তো আনন্দের কথা। কিন্তু কাঠের ব্যাবসা করেই তো এত বছর চললাম। এখন এই ব্যাবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে শান্তি পাব না।'

অরুণা বলল,' পাপা তোমার বয়স হয়েছে। এখন তোমার আগের শরীর নেই। এই শরীর নিয়ে ব্যাবসা করা তো দূরের কথা, সম্বলপুরে থাকাটাও তোমাদের উচিত হবে না। আমরা ওখানে কেউ থাকছি না, অসুখ-বিসুখে কে তোমাদের দেখবে?'

লক্ষ্মীনাথ বললেন,' বয়স হয়েছে যখন অসুখ-বিসুখ তো। তা এত চিন্তা করিস না ,মা । আমার সঙ্গে তোর মাও থাকবেন । আমরা কোনোমতে চালিয়ে নেব। কিন্তু সত্যব্রত, তোমার যে হাঁপানির ধাত। তুমি সুস্থ থেকো। আমার থেকে তোমার সুস্থ থাকাটা বেশি দরকার।'

'ও কথা কেন বলছেন, বাবা? বয়স হয়েছে বলে আপনার জীবনের মূল্য কি কম?' শ্রদ্ধা মিশ্রিত কাতরতার সঙ্গে সত্যব্রত বলল,' এখন আপনি অসমের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ। বরোদায় এসে বৈষ্ণব ধর্মদর্শনের ওপরে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে আপনি তো রাষ্ট্রীয় পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। আপনার জীবনের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারন একজন রাজভক্ত কর্মচারীর জীবনের তুলনা হয়? বাবা, আমার একান্ত অনুরোধ— মাকে নিয়ে আপনি আমাদের এখানেই থাকুন। এখানে থেকে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার প্রসারের জন্য আর ও কাজ করুন।'

' সত্যব্রত, তোমার দিকে তাকালে আমার জীবনের সমস্ত ব্যর্থতা সব অপূর্ণতা পূর্ণ হয়ে আসে। রত্নার জামাই রোহিণী ও তোমার মতোই। রত্না রোহিনী ও আমাদের ওদের সঙ্গে রাখতে চায়। পুত্র সন্তানের পিতা হতে পারিনি— শেষ পর্যন্ত, মানে অসুখে বিসুখে যখন একেবারে অচল হয়ে পড়ব, তখন তো তোমাদেরই শরণাপন্ন হতে হবে। তথাপি ,তোমার মায়ের হাত ধরে যতদিন নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি, চলতে দাও—।'

লক্ষ্মীনাথের কণ্ঠস্বর গম্ভীর হয়ে পড়ল।

সত্যব্রত কোনো কথা বলতে পারলেন না। করুণভাবে শ্বশুরের নিৰ্জীব মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

' তারপর বৈষ্ণব ধর্ম– দর্শনের প্রচারের কথা বললেন—।' কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্মীনাথ বললেন,' সত্যব্রত, বৈষ্ণব ধর্ম হল মানবীয় দর্শন। বৈষ্ণব ধর্ম মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করে, মানবতার জয় গান গায়। আমাদের মহাপুরুষ শংকরদের মানবতা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ও ধর্ম এবং সংস্কৃতি দিয়ে এই ধর্মের মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার জন্য এই ধর্ম এত শক্তিশালী এবং এই যুগের জন্য এতটাই প্রাসঙ্গিক যে এর প্রচার– প্রসারের প্রয়োজন নেই।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...