রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৪

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Basudev Das

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





দুই 

 সাহিত্যের একটি প্রধান শাখা হল জীবনী।মহৎ এবং প্রসিদ্ধ লোকদের জীবন কাহিনি জানার জন্য সমস্ত জ্ঞানপিপাসু মানুষ আগ্রহ অনুভব করে কারণ মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে প্রধানত এই সমস্ত মানুষেরাই। রালফ ওয়াল্ডো এমারসন ( ১৮০৩–৮২) নামে প্রসিদ্ধ আমেরিকান দার্শনিক একজন এমনকি এ কথাও বলতে চান যে ইতিহাস বলে কোনো জিনিস নেই আছে কেবল জীবনী। মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতিতে যতগুলি মূল্যবান এবং যুগজয়ী সম্পদ আছে সেই সমস্ত কিছুই সৃষ্টি করেছে প্রতিভাবান এবং চরিত্রবান লোকেরা তাদের জীবন জোড়া সাধনার দ্বারা। তাদের জীবন কাহিনি হল ক্রমোৎকর্ষের  পথে এগিয়ে চলা মানুষের যুগ যুগের সাধনার কাহিনি।

  কিন্তু কেবল জ্ঞান অর্জন করাটাই জীবনচরিত পড়ার একমাত্র বা প্রধান উদ্দেশ্য হতে পারে না। বেশিরভাগ মানুষই জীবনচরিত পড়ার জন্য আগ্রহ অনুভব করার একটি প্রধান কারণ হল এই যে মহৎ এবং বিখ্যাত লোকের জীবনী পড়ে মানুষ নিজের জীবনটা গড়ার জন্য নানা প্রকারের শিক্ষা আহরণ করতে পারে। অবশ্য একটা কথা ঠিক যে এলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনী পড়ে কেউ তাকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে দ্বিতীয় একজন আইনস্টাইন হওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা কারণ আইনস্টাইনের সমকক্ষ মহাবিজ্ঞানী হওয়ার বিধিদত্ত অসামান্য প্রতিভার প্রয়োজন। একজন মহান চিত্রকর দার্শনিক শিল্পীর জীবনী পড়ে কেউ সেই রকম উচ্চ স্তরের চিত্রকর দার্শনিক বা সুরকার হওয়ার আশা করতে পারে না।তার জন্য বিরাট প্রতিভার প্রয়োজন। খুব কম মানুষই সেরকম প্রতিভা নিয়ে জন্মায়।কিন্তু প্রতিভাবান লোকের জীবনী পড়ে সাধারণ মানুষ নিজের সাধারণ জীবন গড়ার জন্য নানা মূল্যবান শিক্ষা আহরণ করতে পারে কারণ যে কোনো মহৎ কর্ম সম্পাদন করার জন্য বা বিপুল খ্যাতি অর্জন করার জন্য কেবল প্রতিভাই যথেষ্ট নয়,প্রতিভার সঙ্গে প্রয়োজন হয় পরিশ্রম, শক্তি, আত্মসংগ্রাম,‌ অধ্যবসায় এবং সংকল্প ইত্যাদি অন্যান্য নানা গুণের।জীবনের যেকোনো কর্ম ক্ষেত্রে কৃতকার্যতা অর্জন করার জন্য এই গুণগুলির প্রয়োজন হয়। বড়ো মানুষের লক্ষ্য বড়ো এবং ছোটো মানুষের লক্ষ্য ছোটো হতে পারে কিন্তু ওপরে উল্লেখ করা সহজ গুণগুলি আয়ত্ত  না করা পর্যন্ত কেউ নিজের লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে না। সেই জন্য সমস্ত ধরনের মহৎ এবং প্রসিদ্ধ লোকের জীবনী পড়েই সাধারণ মানুষও নানা প্রকারে উপকৃত হতে পারে।

  কিন্তু এরকম একজন মানুষের জীবনী যদি ছাত্র-ছাত্রীরা কম বয়সে পড়ার সুযোগ পায় যে মানুষটির জন্ম হয়েছিল তোমার আমার মতো খুবই সাধারণ দুঃখী পরিবারে, যে মানুষটি স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত করার সুযোগ পেল না, যে মানুষটিকে পথ দেখানোর মতো কেউ ছিল না, যে মানুষটিকে যুবক বয়স থেকেই নিজের পায়ের ওপরে দাঁড়াতে হয়েছিল, যে নিজের জীবন কালে তিনি সমগ্র পৃথিবীর ভেতরে একজন অতি বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী মানুষ হয়ে উঠেছিলেন এমনকি তার মৃত্যুর দুশো বছর পরেও আমরা প্রত্যেকেই তার নৈতিক প্রভাব অনুভব করছি তাহলে এরকম একজন মানুষের জীবনী পড়ে কম বয়সের ছেলে মেয়েরা নিজের জীবনগুলিকে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং প্রেরণা আহরণ করাটা অনেক গুনে বেশি সহজ হবে না কি?

  এরকম একজন মানুষ ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।

  বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিজেকে কীভাবে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তার একটি উদাহরণ এখানে দিয়ে রাখি।

  নিজের স্বভাব চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তির ক্রমে ক্রমে বিকাশ সাধন করে নিজেকে একজন আদর্শ এবং সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাটাই ছিল জীবনের একটি প্রধান সাধনা। এর জন্য তিনি কারও সাহায্য চাননি। তিনি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করেছিলেন কেবল নিজের ওপরে অর্থাৎ নিজের সৎ উদ্দেশ্য এবং দৃঢ় সংকল্পের ওপরে। যুবক বয়সে একবার তিনি ঠিক করলেন যে তিনি সুপরিকল্পিত এবং প্রণালীবদ্ধভাবে নিজের নৈতিক চরিত্র নিখুঁতভাবে গড়ে তুলবেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি একটি বিশেষ নৈতিক গুণ বা সহজ অভ্যাসের অনুশীলন করার জন্য এক একটি সপ্তাহ ঠিক করে নিলেন। অর্থাৎ একটি সপ্তাহে তিনি কেবল একটি সহজ গুণের অনুসরণ করে সেটি নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করবেন। সঙ্গে তিনি নিজের স্বভাবে থাকা দোষগুলির শোধন করার জন্য বা সেই সব দূর করার জন্য চেষ্টা করবেন। সপ্তাহের শেষে তিনি নিজেই নিজের পরীক্ষা নেবেন অর্থাৎ তিনি নিজের সাধনায় কতটা সিদ্ধিলাভ করেছেন তার একটি খতিয়ান নেবেন।। উদাহরণস্বরূপ তিনি ঠিক করলেন যে একটি সপ্তাহে তিনি সময়ের কাজ সময়ে শেষ করার অভ্যাস করবেন। আলস্যের বশবর্তী হয়ে তিনি কোনো একটা কাজই ফেলে রাখবেন না। পরীক্ষক যেভাবে অংকের উত্তরের খাতা পরীক্ষা করে শুদ্ধ উত্তরের জন্য পুরো নাম্বার এবং অশুদ্ধ উত্তরের জন্য শূন্য দেয় বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনও ঠিক তেমনই সময়ে করা প্রতিটি কাজের জন্য নিজেকে পুরো নাম্বার এবং আলস্যের বশবর্তী হয়ে ফেলে রাখা প্রতিটি কাজের জন্য শূন্য দিলেন। এভাবে সপ্তাহের পরে সপ্তাহ ধরে চলতে থাকল নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা।

  এতটা পড়ার পরে কারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকতে পারে না যে আমরা প্রত্যেকেই নিজের জীবনটা গড়ার  জন্য আদর্শ হিসেবে নিতে পারা একজন অতি  উপযুক্ত মানুষ হলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন তার যুগের একজন শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক, সাংবাদিক, সমাজ সংস্কারক এবং লেখক। এতগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হওয়া বা খ্যাতি অর্জন করা মানুষ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ছাড়া আরও অনেক নিশ্চয়ই আছেন কিন্তু বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যুর দুশো বছর পরেও তার নৈতিক প্রভাব আজও যত জীবন্ত হয়ে রয়েছে তার সমতুল্য দ্বিতীয় একটি উদাহরণ সত্যি খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমেরিকার প্রতিটি ছেলে-মেয়ের নয়-দশ বছর বয়সে পা দেওয়ার সময় থেকেই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি জানা হয়ে যায়। অসমিয়া মানুষ যেভাবে কথায় কথায় ডাকের বচন আওড়ায় ঠিক সেভাবে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আজ থেকে দুশো বছর আগে লিখে রেখে যাওয়া অনেক নীতি উপদেশ আমেরিকার মানুষের মুখেমুখে ঘুরে বেড়ায়। অনুবাদের মাধ্যমে সেই নীতি উপদেশ গুলি পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরাও অনেকেই হয়তো নিজের অজান্তেই  তার অনেক নীতি উপদেশ মেনে চলেছি। তার মহৎ জীবনের পরিচিতি আজও কীভাবে অগণন মানুষকে পথ দেখিয়ে চলেছে তার প্রমাণ হিসেবে আর মাত্র একটা উদাহরণ দিলেই বোধহয় যথেষ্ট হবে। ওয়াল্ট ডিজনির অমর সৃষ্টি মিকি মাউসের নাম না শোনা বা কার্টুন ছবি না দেখা মানুষ আজকের পৃথিবীতে খুব কমই পাওয়া যাবে। মিকি মাউসের নামটাই বলে যে সে হল একটি ইঁদুর। সেই ইঁদুরটিকে মুখ্য চরিত্র হিসেবে নিয়ে ওয়ার্ল্ড ডিজনি এরকম অনেক কার্টুন কথা ছবি নির্মাণ করেছিলেন, সেই চরিত্রগুলি দেখে সমগ্র পৃথিবীর ছেলে বুড়ো প্রত্যেকেই নির্মল আনন্দ এবং নৈতিক শিক্ষা লাভ করে। আজ থেকে প্রায় দুই কুড়ি বছর আগে এরকম একটি কার্টুন ছবি নির্মাণ করেছিলেন-- যার নাম ছিল ‘বেন এন্ড মী’(Ben and Me)। ছবিটিতে মিকি মাউস নিজের চারপাশে এক ঝাঁক ইঁদুরের বাচ্চা বসিয়ে নিয়ে ওদেরকে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবনের কাহিনি বলে চলেছে।উঠে আসা ছেলেমেয়েদের চোখের সামনে আদর্শ জীবনের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার জন্য আজও এভাবে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কিনের জীবনের কাহিনি বলা হয়ে থাকে। জীবনে সৎ এবং সফল হওয়ার  আকাঙ্ক্ষা করা সমস্ত মানুষের কাছেই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আদর্শ হতে পারার একটি প্রধান কারণ হল এটাই যে দুঃখী পরিবারে একটি সাধারণ ছেলে হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তিনি কেবল নিজের চেষ্টা এবং দৃঢ় সংকল্পের দ্বারাই নিজেকে তিল তিল করে গড়ে অসাধারণ মানুষ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। 

  হ্যারল্ড উইলসন  নামের একজন ইংরেজ লেখক  তার The Age of Reason নামের বইয়ের আঠারো শতকের  পাশ্চাত্য জগতে নেতৃস্থানীয় দার্শনিক রাষ্ট্রনেতা এবং লেখকদের জীবন এবং কর্মের পরিচয় দিয়েছেন। তার নির্বাচনে আঠারো শতকের  নেতৃ স্থানীয়  ব্যক্তিদের ভেতরে  একজন হলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। বইটিতে  বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের  বিষয়ে  লেখা প্রবন্ধটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে The Simple Man   অর্থাৎ সহজ সরল মানুষ।। কিন্তু লেখক প্রবন্ধটি শেষ করেছেন এরকম একটি বাক্যে –‘তিনি যে কেবল একজন মহান নাগরিক ছিলেন তা নয় তিনি ছিলেন একজন অতি মহৎ মানুষ।’

  একজন সহজ সরল মানুষ কীভাবে নিজের চেষ্টা এবং সাধনার বলে অতি মহৎ মানুষে পরিণত হল সেই কাহিনিটি আমি এখানে সংক্ষিপ্ত করে বলতে চাইছি। 










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...