বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস, Homen Bargohain

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস





তিন 

জন্ম এবং শৈশবকাল

 আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব বিখ্যাত নগরগুলির ভেতরে একটি হল বোস্টন।  জন উইনথ্রপ  নামের একজন ধনী ব্যবসায়ী তার কোম্পানির সদর কার্যালয় হিসেবে ১৬৩০ সনে নগরটি প্রতিষ্ঠা করে। শহরটি শুরু  থেকেই জ্ঞানচর্চার একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সঙ্গে এটা ব্যাবসা-বাণিজ্যেরও একটি বড়ো কেন্দ্র ছিল। বোস্টনের ধন কুবেররা  সাহিত্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির উন্নতির জন্য অকাতরে ধন খরচ করতেন। ফলে নগরটি আমেরিকার এথেন্স হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ প্রাচীন গ্রিসে এথেন্স যেভাবে জ্ঞান চর্চা এবং সাহিত্য সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র ছিল, আমেরিকায় সেই জায়গা নিয়েছিল বোস্টন। সর্বসাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে না পারা উঁচু স্তরের পন্ডিতদের আমেরিকানরা বোস্টন ব্রাহ্মণ বলে ক্ষেপায়। আমেরিকানরা শহরটিকে কী চোখে দেখে সে কথা এই একটিমাত্র কথা থেকেই বুঝতে পারা যায়। বর্তমানকালে বোস্টন চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও একটি প্রধান গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বোস্টনের হার্বাড মেডিকেল স্কুলের খ্যাতি বিশ্বজোড়া।

  এই বোস্টন শহরে ১৭০৬ সনের ১৭ জানুয়ারি  বেঞ্জামিনের জন্ম হয়েছিল। তার পিতা জোশিয়া ফ্রাঙ্কলিনের চর্বি থেকে সাবান এবং মোমবাতি তৈরি করার  ব্যাবসা ছিল ।সেই সমস্ত জিনিস বিক্রি করার জন্য তার নিজস্ব একটি দোকান ছিল। কিন্তু তার উপার্জনের তুলনায় খাবার লোকের সংখ্যা ছিল বেশি। তিনি দুবার বিয়ে করেছিলেন। প্রথম পত্নীর দিক থেকে সাত  এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর দিক থেকে দশ—মোট ১৭ জন ছেলেমেয়ে ছিল। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তার আত্মজীবনীতে লিখে রেখে গেছেন বাবার সঙ্গে একসাথে টেবিলে খেতে বসার সময় তেরো জন ভাই বোনকে একসঙ্গে দেখার কথা তার ভালোভাবে মনে আছে।

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন পিতার দ্বিতীয় পক্ষের অষ্টম সন্তান। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হলে ছেলেমেয়েদের অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় সত্যি, কিন্তু কিছু সুবিধা যে রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। বড়ো পরিবারে একে অপরের জন্য কিছু ত্যাগ করতে হয়,অনেক অসুবিধা বিনা আপত্তিতে সহ্য করতে হয়। ফলে স্নেহ ভালোবাসা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষমতা এবং সহনশীলতা ইত্যাদি গুণগুলি গড়ে ওঠে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন শৈশব থেকেই এই গুণগুলি আয়ত্ব করেছিলেন। তিনি শান্ত স্বভাবের ছিলেন এবং বাড়ির পরিবেশ  তাকে  মিতব্যয়ী হতে শিখিয়েছিল।

 জোসিয়া ফ্রাঙ্কলিনের সতেরোটি ছেলে মেয়ের মধ্যে দশটি ছিল ছেলে, বাকি সাতটি মেয়ে। ছেলেগুলির মধ্যে বেঞ্জামিনই ছিল সবচেয়ে ছোটো। জোসিয়া ফ্রাঙ্কলিন তার নয়টি ছেলেকে বিভিন্ন ব্যাবসা-বাণিজ্যে শিক্ষানবিশ হিসেবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, কিন্তু ছোটো পুত্র বেঞ্জামিনকে তিনি করতে চেয়েছিলেন গির্জার যাজক। সেই উদ্দেশ্যে একটি গ্রামার স্কুলে বেঞ্জামিনের নাম ভর্তি করা হল। তখন তার বয়স আট বছর।

  গ্রামার স্কুলে বেঞ্জামিন মাত্র এক বছর ছিলেন। স্কুলে নাম লেখানোর কিছুদিনের মধ্যে তিনি শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।কেবল তাই নয়, ধীরে ধীরে উন্নতি করে এবং অন্য সমস্ত ছেলেকে পেছনে ফেলে তিনি এক বছরের ভেতরে স্কুলের তিনটি শ্রেণি অতিক্রম করতে সক্ষম হলেন ।কিন্তু মন দিয়ে পড়াশোনা করার জন্য শিক্ষককে তাকে কখনও জোর করতে হত  না বা সেই সময়ের রীতি অনুসারে বেত মেরে শাসন করতে হত না।জ্ঞান হওয়ার পর থেকে লেখাপড়ার প্রতি তার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তিনি নিজেই লিখে রেখে গেছেন— ‘আমি যে কখন পড়তে পারতাম না সে কথা আমার মনেই পড়ে না।’অর্থাৎ অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার দিন থেকে তিনি বই না পড়ে একেবারেই থাকতে পারতেন না। বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করার জন্য তিনি সব সময় একটি প্রবল আগ্রহ অনুভব করতেন। কর্মজীবনে প্রবেশ করার পরে তিনি যখন পড়ার সময় পেতেন না, তখনও তিনি রবিবারকে আলাদাভাবে রাখতেন শুধু বই পড়ার জন্য। 

 বেঞ্জামিন গ্রামার স্কুলে এক বছর সম্পূর্ণ করার পরে পিতা তাকে সেই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনার কথা ভাবলেন। সতেরোটি ছেলেমেয়ে নিয়ে বিরাট সংসারটার  ভরণপোষণ চালানোর মতো তার ক্ষমতা ছিল না। এহেন অবস্থায় বেঞ্জামিনকে ধর্মযাজক করতে হলে যে ধরনের দীর্ঘ উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন তার খরচ বহন করার মতো সঙ্গতি তার ছিল না। গ্রামার স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে বেঞ্জামিনকে ভর্তি করে দেওয়া হল এমন একটি স্কুলে যেখানে কেবল হাতের লেখা এবং গণিতের শিক্ষা দেওয়া হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন জর্জ ব্রাউনেল।শিক্ষক হিসেবে তিনি খুব বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় ছিলেন। জর্জ ব্রাউনেলের স্কুলে বেঞ্জামিন হাতের লেখা সুন্দর করার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা অর্জন করলেন যদিও পার্টিগণিতের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে পারলেন না।

 বেঞ্জামিনের পিতা অবশেষে সেই স্কুল থেকেও বেঞ্জামিনকে ছাড়িয়ে এলে নিজের ব্যাবসায়ের কাজে লাগিয়ে দিলেন। সেই সময়ে বেঞ্জামিনের বয়স ছিল মাত্র দশ  বছর।আগেই বলা হয়েছে যে জোশিয়া ফ্রাঙ্কলিনের ব্যাবসাটা ছিল জন্তুর চর্বি থেকে সাবান এবং মোমবাতি তৈরি করে সেগুলি বিক্রি করা। বেঞ্জামিনকে এখন সাবান এবং মোমবাতি তৈরি করার বিভিন্ন পর্যায়ের কাজে বাবাকে সাহায্য করতে হল।মাঝে মাঝে তাকে দোকানে বিক্রির কাজেও সহায়তা করতে হল। কিন্তু পিতার ব্যাবসায় বেঞ্জামিনের মোটেই আগ্রহ ছিল না। বন্দর শহর বোস্টনে জন্ম হওয়ায় ছেলেটির মন সমুদ্রের প্রতি খুব আকর্ষণ অনুভব করত। অর্থাৎ তার ইচ্ছা ছিল নাবিক হওয়ার। কিন্তু পিতা তাকে নাবিক হওয়ার অনুমতি দিলেন না।

  নাবিক হওয়ার আশা পূরণ হল না যদিও বেঞ্জামিন বাড়ির পাশের নদী এবং পুকুরে সাঁতার কেটে এবং নৌকা বেয়ে শৈশবকে আনন্দময় করে তুলেছিল। নেতা হওয়ার গুণ নিয়েই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন; সেই জন্য শৈশবের সমস্ত খেলাধুলা এবং দুঃসাহসিক অভিযানে তিনি ছিলেন সমবয়সী ছেলেদের নেতা। কোনো বিপদে পড়লেই ছেলেগুলি উদ্ধারের উপায় বের করার জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। 

 শৈশবে কোন ছেলেই বা একটু-আধটু দুষ্টুমি করে না?বেঞ্জামিনও নিশ্চয় করতেন। তারই একটা উদাহরণ তিনি নিজের আত্মজীবনীতে দিয়ে গেছেন।

  বেঞ্জামিনের মাছ ধরার খুব শখ ছিল। তাদের বাড়ির পাশে একটা পুকুর ছিল। পুকুরটা জলে যখন উপচে পড়ত তখন সেখানে মাছ ধরার জন্য বেঞ্জামিন এবং তার সঙ্গীরা পুকুরের পারে গিয়ে দাঁড়ায়। ছেলেদের নাড়াচাড়ায় পুকুরটার তীরে এক হাঁটু কাঁদা হয়। খারাপকে ভালো করা, অসুবিধা গুলি দূর করে সুবিধা সৃষ্টি করে নেওয়া—- অতি কম বয়স থেকেই  এটা ছিল বেঞ্জামিনের মানসিকতার একটি বৈশিষ্ট্য। এক হাঁটু কাদায় দাঁড়িয়ে মাছ ধরতে লাগার কথাটা বেঞ্জামিন সহ্য করতে পারল না। সেই জন্য পুকুরপারে একটা পাকা ঘাট তৈরি করার কথা তিনি ভাবলেন। পুকুরটা থেকে একটু দূরে একজন মানুষ একটা নতুন ঘর তৈরি করতে শুরু করেছিল। তার জন্য অনেক পাথর জমা করা হয়েছিল। তার সঙ্গীরা বিকেলে মিস্ত্রীরা না থাকার সুযোগ নিয়ে পাথরগুলি বহন করে এনে পুকুরের তীরে পাকাঘাট তৈরি করল।।পরের দিন সকালে মিস্ত্রিরা কাজ করতে এসে পাথরগুলি না দেখে চেঁচামেচি শুরু করল। অপরাধীকে ধরতে বেশি সময় লাগল না। ছেলেগুলির পিতারা যাকে যেখানে শাস্তি দেবার দিল।বেঞ্জামিন নিজের পিতাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে পুকুরে একটা পাকা ঘাট প্রত্যেকের জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল এবং তারা একটা ভালো কাজ করেছিল। কিন্তু পিতা এই কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে যে কাজ সৎ উপায়ে করা হয় না সেই কাজ কখনও অন্যের উপকার করতে পারেনা। পিতার এই কথাটা বেঞ্জামিনের মনে চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছিল। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...