দুর্গাপূজার লোকাচার
(৫)
দূর্গাপুজা যে আদিতে শস্যদেবী (বৃক্ষলতা০ র পূজা ছিল তার
আরো একটি প্রমাণ হল দশমীর বিসজনান্তে
দশমীর বিসজনান্তে একটি
কুলাচার যা অপরাজিতা পূজা নামে পরিচিত।
দশমীর ঘট বিসর্জনের পর ঈশান
কোণে অষ্টাদলপদ্ম অঙ্কিত
করে তার উপর একটি নীল
অপরাজিতার লতাকে স্থাপন
করে তার পূজা করা হয়।
দুর্গার সমাপন্তে দেবী অপরাজিতার
কাছে পূজার যাবতীয় ত্রুটি নিরসনের জনয ক্ষমাভিক্ষা ও বিজয়
প্রার্থনা করা হয় - “অপরাজিতা রুদ্রলতা করতু বিজয়ং মম।“ পুজার পর লতাটি
বাহুতে বাঁধার প্রথা আছে। আবার
কোথাও কোথাও লতাটিকে
খন্ড খন্ড করে হরিদ্রাসিক্ত বস্ত্রে
বেঁধে হলুদসূত্র দ্বারা
বাহুতে পরার চল আছে।
এই বিধানটি কালিকাপূরাণোক্ত ।
সেখানে দেবী অপরাজিতার
ধ্যান মন্ত্র ও উদ্ধৃত হয়েছে—
“নীলোৎপলদলশ্যামাং
ভূজগাভরণজ্জ্বলাম্। বালেন্দুমৌলিনীং
দেবীং নয়নত্রিয়ান্বিতাম্।।
শঙ্খ চক্রধরাং দেবীং
বরদাং ভয়নাশিনিম্। পীনোত্তুঙ্গ স্তনা
শ্যামাং বরপদ্মসুমালীনিম্।।“
বিভিন্নপুরাণেও দেবী
অপরাজিতার কথা পাওয়া যায়।
‘মৎস্যপুরাণ থেকে জানা যায় যে অন্ধকারসুরের
রক্তপান করার জন্য মহাদেব দেবী
অপরাজিতাকে সৃষ্টি করেছিলেন। আবার বামনপুরান মতে দেবী মহর্ষি গৌতম ও অহল্যার কন্যারুপে আবির্ভুত হন এবং দেবী
সতীর সখীত্ব লাভ করেন।
বরাহ পুরাণ অনুসারে মহিষাসুরের
সঙ্গে দেবী দূর্গার যুদ্ধ চলাকারে
ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিবের চক্ষু থেকে
জয়া, বিজয়া, জয়ন্তী ও অপরাজিতা এই চার সহচারী
দেবীর জন্ম হয়েছিল। আবার
দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী তে দেবী অপরাজিতা কে
চৌষট্টি যোগিণিগ্ণের অন্যতমা হিসাবে বর্ণ্না করা হয়েছে। পৌরাণিক উল্লেখ
থাকলেও অপরাজিতা পূজা
একান্তই লৌকিক। এই সকল
পৌরাণিক অভিক্ষেপ অর্বাচীন। পূজাটির
বিধিতে লৌকিক দারনা
ও ভাবনার প্রকাশ সুপষ্ট।
দুর্গাপূজাতে পশুবলির
বিধান আছে। শ্রী শ্রী চন্ডীর দ্বাদশ
অধ্যায়ের ভগবতী বাক্যে বলা হয়েছে –
“সর্ব মমৈর্ত ন্মাহাত্ম্যং সম সন্নিধিকারকল্ম।
পশুপুষ্পার্ম্যধুপৈওশ্চ
গন্ধদীপেন্তসোভমৈঃ।।“
‘কালিকাপুরাণের’ ৬৭ তম অধ্যায়ের বলিদানের বিস্তারিত
বিবরণ দৃষ্ট হয়।
সেখানে বলা হয়েছে নরবলিত দেবী
উপাসকের প্রতি সহস্রবৎসর, মহিধবলিত দশ বৎসর , ছাগ/ মেষ বলিতে
ক বৎসর কুষ্মানাদি (চালুকমড়ো, শম্পা
ইক্ষুদন্ড, বাতাবি ইত্যাদি) বলিদান
দেবী সাধকের প্রতি একমাস
প্রসন্ন থাকেন।
‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে ‘ ও নরবলির
প্রসস্তি লক্ষ্য করা যায় –
নরবলি পেলে দেবী
সহস্র বৎসর।
পূজকের প্রতি থাকে তুষ্ট নিবন্তর।।‘
দূর্গাপূজায় মহানবমী তিথি
ও সন্ধিক্ষনে বলিদান করা হয়ে
থাকে। মহাষ্টিমী তিথিতে বলিদান
নিষিদ্ধ। তবে কোথাও
কোথাও কুলানুচার বশতঃ তেও বলিদান হয়।
কেশপুরের আড়ঢ়াগড়ে কবি কঙ্কন মুকুন্দচক্রবর্তীর আশ্রয়ডাটা বাঁকুড়া
রায়ের বংশে মহাষ্টমী তিথিতে আটটি বলিদান
হয়। নরবলির প্রতিকল্প রূপে
কোথাও কোথাও চালুকমুড়ো,
পিটুলের নরমুর্তি চোলের
গুঁড়ো কে জলে ভিজিয়ে মন্ড
করে নরমূর্তি তৈরী করা হয়) কে মানকচুর
পাতায় মুড়ে বলি দেওয়া
হয়, একে শত্রুবলি বলা হয়। আবার
কোথাও কোথাও বৈষ্ণবমতানুসারে ঘনীভূত
ক্ষীরের ছাগশিশু প্রস্তুত
করেও বলিদান করা হয়। বলিদানের পর সত্তর রক্ত মৃন্ময়পাত্রে
সৈন্ধবলবন, বন্দলী, শর্করা ও মধু
সংযুক্ত করে দৈবীর বাসপার্শ্বে স্থাপিত হয়।
বর্তমানে বলিদান শাস্ত্রীয় বিধি বলে
প্রতীয়মান হলেও মূলে এটি আদিম
লোকাচারজাত। আদিম যুগ থেকেই মানুষ
উৎর্বরতা শক্তির বৃদ্ধি, বিপদ আপদ
থেকে মুক্তির জন্য এবং
অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে বলিদান করে আসছে। হরপ্পা থেকে প্রাপ্ত একটি
শিলের একপাশে এক দেবীমুর্তী
ও তার বিপরীত পাশে নরবলির চিত্র খোদিত আছে।
গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের
বিবরণ থেকেও জানা যায় যে খ্রীষ্টজন্মের কয়েক শতাব্দী
পূর্ব থেকেই ভারতে
নরবলির প্রচলন ছিল। এই সব তথ্য
প্রমাণ করে ভারতীয় সভ্যতার প্রায়
উন্মেষলগ্ন থেকেই বলিদান প্রথা প্রচলিত । ফ্রেজার প্রমুখ
পণ্ডিতগণ আদিম লৌকিক প্রথা হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন।
দুর্গাপুজায় পালনীয় বলিদান সম্পর্কেও এই কথাটি প্রযোজ্য।
চালুকমড়ো নরবলির পরিবর্ত বলে আজও বহুবিধবা এটি
ভক্ষণ করেন না - এ প্রথাও লৌকিক।
চলছে ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন