ঘুম
চয়ন পাহাড়ী
বুধন লোহারের ঘুম আসেনা।অনিদ্রার রোগী নয় সে।এমনিই ঘুম আসেনা রাতে।হয়তো চিন্তায়, হয়তো বা দুশ্চিন্তায়। কিন্তু এই ঘুম না আসায় তার বিশেষ শারীরিক ক্ষতি হয়নি।কাজের দক্ষতাও কমেনি বলেই মনেহয়।এখনও সে সারাদিনে একশো কুড়ি তিরিশ বস্তা মাল একই ট্রাকে লোড করে দিতে পারে।মালিক আগারওয়ালজি তাকে তো এমনি এমনি এত পছন্দ করে না, কারণ আছে।যারা আগারওয়ালের প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি তে সারাদিন ধরে মালের বস্তা ট্রাক থেকে নামায়, আবার বিকেলে ট্রাকে তুলে দেয় তাদের সর্দার বুধন। বয়স চল্লিশ-পয়তাল্লিশের ভেতরই হবে, তাই আর বেশ কয়েকবছর টানতে পারবে বলেই মনে হয়।
ঘাসের উপর শুয়ে তারাভর্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে কতকিছুই না ভাবছিল বুধন।নিজের গ্রামের কথা, বড়ো হওয়ার কথা।ক্লাস ফাইভেই স্কুল পালিয়ে একটা লরিতে হেল্পারি করতে পাঞ্জাবে পালিয়ে যাওয়া, বছর পনের সেখানেই কাটিয়ে গ্রামে ফেরা।তারপর আবার কয়েক বছর দিল্লির কাছে একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করা।আবার বাড়ি ফেরা।বাড়িতে তদ্দিনে বাবা গত হয়েছে, ছোটভাই ,মা কে দেখেনা। অল্প চাষের জমি ছিল বুধনের বাবার।মায়ের কান্নাকাটি থামাতে আর না পালিয়ে , বুধন ঠিক করল এবার গ্রামেই থাকবে।চাষবাস করবে । বুধনের কপালে সুখ ছিল না কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে ছিল।গ্রামের বন্ধুদের কথায় পড়ে জমানো সব টাকা কিসব স্কীমে জমা করেছিল,ছ'মাসে ডবল ফেরতের আশায়।টাকা আর আসেনি।দুর্দশা ডবল হয়ে ফেরত এসেছে। ইতিমধ্যে মাও খুব অসুস্থ, মা এর কথায় চাপে পড়ে বিয়ে করেছে বছর খানেক আগে।
---বুধন ভাই, ও বুধন ভাই, কি ছাইপাশ ভাবছো, আকাশের দিকে তাকিয়ে?
---তাতে তোর কিরে ঢ্যমনা? যা বলার ফটাফট বল ।
হঠাৎ তার চিন্তায় অযাচিত ছেদ পড়ায় বিরক্ত বুধন খেঁকিয়ে ওঠে।এই নরেশ ছেলেটা বুধনের পাশের গ্রামের।বছর দুয়েক আগেও সাইকেলে ঘুরে ঘুরে গ্রামের মেয়ে- বউ দের কাছে চুড়ি ,বালা ,স্টিলের বাসন বেচত। বছরখানেক হলো বুধন কে ধরে আগারওয়ালের কারখানায় ঢুকেছে। চটপটে ছোকরা একটু আধটু ইলেকট্রিকের কাজ জানে। ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির পয়সা ছোটখাটো সারাইয়ের কাজে বেঁচে যায় আগারওয়ালের, তাই বাড়তি খাতির পায় নরেশ। বুধন কে সে গুরু মানে।
---না মানে বলছিলাম যে রাত অনেক হল, ঘুমিয়ে পড়ো।কাল সকালে তো আবার হাঁটা শুরু, না কি?
---ঠিক হেঁটে নেব রে ছোকরা, এই বুধন লোহার এখনও শক্তি হারায়নি। কত কিলোমিটার বাকি রে? মোবাইলে দেখ না।
---কি যে বলো দাদা, চারদিন তো হাটলাম, একশো কিলোমিটার মতো হলো, আরো এগারোশো বাকি।
---আর কিছুদিন হাঁটলে যদি একটা ট্রাক পাই, কি বলিস?চুপিচুপি বলি শোন, আমার জমানো দুহাজার টাকা আছে, যদি আমার কিছু হয়ে যায় ,তুই নিয়ে নিবি।
---ওসব অলুক্ষুনে কথা বলতে নেই। কী হবে তোমার? কিছু হবে না। গ্রামে ফিরতে হবে না? বৌদি অপেক্ষায় রয়েছে না? আজ কথা হয়েছে?
---নাহ রে। এই বুড়ো বর কিছুই তো দিতে পারে নি। দুবেলা দুমুঠো খাবারও রোজ জোটে না।আমার বোধহয় ওকে বিয়ে করাই উচিত হয়নি। তুই তো ওকে আমার বিয়ের আগে থেকেই চিনতিস তাই না?
---না ,মানে হ্যাঁ। ওই মুখ চেনা আর কী।তিনটে পাড়া পরে থাকতো।অন্য গ্রাম থেকে এসেছিল তার মায়ের সাথে।ঐ পাড়ায় আমার দিদির শ্বশুরবাড়ী, তাই জানতাম।
---আর কী জানতিস ?
---আর কী জানব!! আর কিছুই না ।
--- হ্যাঁ, আর কী জানবি!! আর কত কী বা আমি জানব!
---আচ্ছা, একটা কথা বলো বুধনদা।সরকার আমাদের জন্য কি কিচ্ছু ভাবছে না? কিছু করবে না?তুমি তো অনেকক্ষণ কাল রাতে আমার মোবাইলে খবর শুনলে, কী বুঝলে বলো।
---তোর মোবাইল দেখে অনেক কিছুই বুঝেছি।কিন্তু খবরের ভিডিও দেখে কিছুই বুঝিনি। শুধু বুঝলাম যে আমরা গরীব।আর এখন কয়েকমাসের মধ্যে ভোট থাকলে সব দলের দাদারাই ট্রাক পাঠাতো।আমাদের দাম নেই রে।আমাদের ভোটের আছে।
--- ঠিকই বলেছ। শালা ,সবকটা নেতাই হারামী।খালি ভাষণ আর ভাষণ।কেউ পাত্তা দেয় না। এতদিন যদি হাঁটতেই হয়, খাবো কী?
----ওই জন্যই তো আমার জমানো টাকাটা রেখেছি।তোর আমার চলে যাবে। বাকিদের কথা জানিনা।তোর কাছে যা আছে রেখেদে ।পরে দেখা যাবে।
---গ্রামে ফিরে কী হবে বলতো? কেউ কি খেতে দেবে, কাজ দেবে?মনে তো হয় না, সবারই হাল এক।
---জানিনা রে।আমি সত্যি কিছু জানি না।আর বকিস না। এবার ঘুমোতে দে। পায়ের ফোস্কাটা বেড়েছে।আর পারছি না।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।বারাউরি, মহারাষ্ট্রের একটা ছোটো শহর যেখানকার প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি "আগারওয়াল প্লাষ্টিকস" এর দুই শ্রমিকের মনে অসংখ্য প্রশ্ন যার উত্তর কারুরই জানা নেই।লক ডাউন আরও বাড়তে পারে এই ইঙ্গিতে আর কোনো দ্বিধা না রেখে ওরা তিরিশ জন বেরিয়ে পড়েছে বারাউরি থেকে।যতটা পথ হেঁটে যাওয়া যায়,ওরা হেঁটে ই ফিরতে চাই নিজেদের গ্রামে যা লখনৌ শহর থেকেও প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে। চারদিন হেটে পৌঁছেছে আওরঙ্গাবাদ ।
নিস্তব্ধতা বেশিক্ষণ সহ্য হয় না নরেশের। যতক্ষণ জেগে আছে বকবক করতেই থাকবে। কিন্তু উপরওয়ালার দয়ায় ঘুম গাঢ় তার। ভূমিকম্প হলেও টের পায়না যেন।
---আচ্ছা বুধন দা, তুমি স্টেশনমাস্টার কে কী জিগ্যেস করছিলে বললে না তো।কোনো ট্রেন দিচ্ছে নাকি সরকার আমাদের বাড়ি ফেরার জন্য? অন্তত লখনৌ অব্দি যাওয়ার ট্রেন পেলেও ভালই হতো ,কি বলো?
---তোর নাম বুদ্ধু নরেশ হলেও ঠিক হত।কোনো ট্রেন কোথাও চলছে না, বুঝলি?রেল লাইন ধরে হাঁটলে রাস্তা ভুল কম হয়।তাই জিগ্যেস করছিলাম এই লাইনে পরের স্টেশান গুলো কী আছে।
--- ওহ ,তাহলে এই লাইন ধরে কোনো ট্রেন আসবে না বলো?
---এলেও বা তোর কী? তুই তো নীচে ঢালুতে ঘাসের উপর শুয়ে আছিস। আর ওই গাধা গুলোকেও বলেছি রেল লাইনের উপর শুতে না।কে কার কথা শুনছে!!! বলে কিনা রেলের পাত গুলো বেশ ঠান্ডা, বেশ আরামে ঘুমানো যায়। ওই মোটাবুদ্ধি গুলোকে আর বোঝাতে পারব না।
---হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ।বলছি পোটলা তে কিছু খাবার আছে নাকি? একটা রুটি হলেও হবে, জল আছে আমার কাছে। চার পাঁচ ঢোক খেয়ে নেব।
---এই নে। চারটে রুটি আর তরকারি আছে।নষ্ট করবি না।আর আমার কাগজ পত্র, ব্যাংকের বই আছে, ঘাটবি না।
---একটাই নিচ্ছি গো।ব্যাংকের বই সঙ্গে নিয়ে ঘুরছ। খুব টাকা পয়সা আছে নাকি? হে হে , কি দাদা?
---নাহ রে, হেসে ফেলে বুধন।ওটা আমার আর বউ এর একসাথে ব্যাংকের বই।দুজনের ছবি সাঁটানো আছে স্ট্যাম্প মেরে।টাকাপয়সা তো নেই, মাঝে মাঝে ওই ছবিটাই দেখি।
---বাবা, এই বলছো বাঁচা মরার ঠিক নেই।আবার মনে মনে এত রস! ব্যাপার ই আলাদা।
---বেশি বকিস না। সরকার যদি টাকা দেয়, সেটা তো আর হাতে দেবে না।ব্যাংকের বই খুব দরকার, বুঝলি?
খাওয়া শেষ তো আমার পোটলা দে।বালিশ করে ঘুমাই।
---এই নাও গো দাদা। রুটি খেয়ে যেন একটু শক্তি এলো।ঘুমই বুঝলে। সকালে ডেকে দিও।
এইসব বলে একটা ঢেকুর তুলে ঘুমিয়ে পড়লো নরেশ।আকাশের তারা গুলো যখন প্রায় মিশে যেতে চলেছে শেষ রাতের পাতলা আলোয়,নরেশের সেই ঘুম ভাঙলো এক বিকট শব্দে, প্রচন্ড জোরে বাজতে থাকা মালগাড়ির হর্নের আওয়াজে। ধড়ফড় করে উঠে দেখে বুধন নেই পাশে, তার পোটলাও নেই।ভোররাতে পাগলের মতো চারদিক খুঁজতে থাকলো নরেশ , বুধন লোহার কে।বেশিক্ষণ লাগলো না।একটা বগির তলায় কারুর ডান হাত বেরিয়ে আছে। সে হাত নরেশের চেনা। একটু দূরে ছিটকে আছে একটা আধখোলা পোটলা, তিনটে রুটি, একটু তরকারি আর একটা পাসবইয়ের প্রথম পাতা। দুটো ছবি। স্ট্যাম্প লাগানো।
চয়ন পাহাড়ী
বুধন লোহারের ঘুম আসেনা।অনিদ্রার রোগী নয় সে।এমনিই ঘুম আসেনা রাতে।হয়তো চিন্তায়, হয়তো বা দুশ্চিন্তায়। কিন্তু এই ঘুম না আসায় তার বিশেষ শারীরিক ক্ষতি হয়নি।কাজের দক্ষতাও কমেনি বলেই মনেহয়।এখনও সে সারাদিনে একশো কুড়ি তিরিশ বস্তা মাল একই ট্রাকে লোড করে দিতে পারে।মালিক আগারওয়ালজি তাকে তো এমনি এমনি এত পছন্দ করে না, কারণ আছে।যারা আগারওয়ালের প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি তে সারাদিন ধরে মালের বস্তা ট্রাক থেকে নামায়, আবার বিকেলে ট্রাকে তুলে দেয় তাদের সর্দার বুধন। বয়স চল্লিশ-পয়তাল্লিশের ভেতরই হবে, তাই আর বেশ কয়েকবছর টানতে পারবে বলেই মনে হয়।
ঘাসের উপর শুয়ে তারাভর্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে কতকিছুই না ভাবছিল বুধন।নিজের গ্রামের কথা, বড়ো হওয়ার কথা।ক্লাস ফাইভেই স্কুল পালিয়ে একটা লরিতে হেল্পারি করতে পাঞ্জাবে পালিয়ে যাওয়া, বছর পনের সেখানেই কাটিয়ে গ্রামে ফেরা।তারপর আবার কয়েক বছর দিল্লির কাছে একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করা।আবার বাড়ি ফেরা।বাড়িতে তদ্দিনে বাবা গত হয়েছে, ছোটভাই ,মা কে দেখেনা। অল্প চাষের জমি ছিল বুধনের বাবার।মায়ের কান্নাকাটি থামাতে আর না পালিয়ে , বুধন ঠিক করল এবার গ্রামেই থাকবে।চাষবাস করবে । বুধনের কপালে সুখ ছিল না কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে ছিল।গ্রামের বন্ধুদের কথায় পড়ে জমানো সব টাকা কিসব স্কীমে জমা করেছিল,ছ'মাসে ডবল ফেরতের আশায়।টাকা আর আসেনি।দুর্দশা ডবল হয়ে ফেরত এসেছে। ইতিমধ্যে মাও খুব অসুস্থ, মা এর কথায় চাপে পড়ে বিয়ে করেছে বছর খানেক আগে।
---বুধন ভাই, ও বুধন ভাই, কি ছাইপাশ ভাবছো, আকাশের দিকে তাকিয়ে?
---তাতে তোর কিরে ঢ্যমনা? যা বলার ফটাফট বল ।
হঠাৎ তার চিন্তায় অযাচিত ছেদ পড়ায় বিরক্ত বুধন খেঁকিয়ে ওঠে।এই নরেশ ছেলেটা বুধনের পাশের গ্রামের।বছর দুয়েক আগেও সাইকেলে ঘুরে ঘুরে গ্রামের মেয়ে- বউ দের কাছে চুড়ি ,বালা ,স্টিলের বাসন বেচত। বছরখানেক হলো বুধন কে ধরে আগারওয়ালের কারখানায় ঢুকেছে। চটপটে ছোকরা একটু আধটু ইলেকট্রিকের কাজ জানে। ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির পয়সা ছোটখাটো সারাইয়ের কাজে বেঁচে যায় আগারওয়ালের, তাই বাড়তি খাতির পায় নরেশ। বুধন কে সে গুরু মানে।
---না মানে বলছিলাম যে রাত অনেক হল, ঘুমিয়ে পড়ো।কাল সকালে তো আবার হাঁটা শুরু, না কি?
---ঠিক হেঁটে নেব রে ছোকরা, এই বুধন লোহার এখনও শক্তি হারায়নি। কত কিলোমিটার বাকি রে? মোবাইলে দেখ না।
---কি যে বলো দাদা, চারদিন তো হাটলাম, একশো কিলোমিটার মতো হলো, আরো এগারোশো বাকি।
---আর কিছুদিন হাঁটলে যদি একটা ট্রাক পাই, কি বলিস?চুপিচুপি বলি শোন, আমার জমানো দুহাজার টাকা আছে, যদি আমার কিছু হয়ে যায় ,তুই নিয়ে নিবি।
---ওসব অলুক্ষুনে কথা বলতে নেই। কী হবে তোমার? কিছু হবে না। গ্রামে ফিরতে হবে না? বৌদি অপেক্ষায় রয়েছে না? আজ কথা হয়েছে?
---নাহ রে। এই বুড়ো বর কিছুই তো দিতে পারে নি। দুবেলা দুমুঠো খাবারও রোজ জোটে না।আমার বোধহয় ওকে বিয়ে করাই উচিত হয়নি। তুই তো ওকে আমার বিয়ের আগে থেকেই চিনতিস তাই না?
---না ,মানে হ্যাঁ। ওই মুখ চেনা আর কী।তিনটে পাড়া পরে থাকতো।অন্য গ্রাম থেকে এসেছিল তার মায়ের সাথে।ঐ পাড়ায় আমার দিদির শ্বশুরবাড়ী, তাই জানতাম।
---আর কী জানতিস ?
---আর কী জানব!! আর কিছুই না ।
--- হ্যাঁ, আর কী জানবি!! আর কত কী বা আমি জানব!
---আচ্ছা, একটা কথা বলো বুধনদা।সরকার আমাদের জন্য কি কিচ্ছু ভাবছে না? কিছু করবে না?তুমি তো অনেকক্ষণ কাল রাতে আমার মোবাইলে খবর শুনলে, কী বুঝলে বলো।
---তোর মোবাইল দেখে অনেক কিছুই বুঝেছি।কিন্তু খবরের ভিডিও দেখে কিছুই বুঝিনি। শুধু বুঝলাম যে আমরা গরীব।আর এখন কয়েকমাসের মধ্যে ভোট থাকলে সব দলের দাদারাই ট্রাক পাঠাতো।আমাদের দাম নেই রে।আমাদের ভোটের আছে।
--- ঠিকই বলেছ। শালা ,সবকটা নেতাই হারামী।খালি ভাষণ আর ভাষণ।কেউ পাত্তা দেয় না। এতদিন যদি হাঁটতেই হয়, খাবো কী?
----ওই জন্যই তো আমার জমানো টাকাটা রেখেছি।তোর আমার চলে যাবে। বাকিদের কথা জানিনা।তোর কাছে যা আছে রেখেদে ।পরে দেখা যাবে।
---গ্রামে ফিরে কী হবে বলতো? কেউ কি খেতে দেবে, কাজ দেবে?মনে তো হয় না, সবারই হাল এক।
---জানিনা রে।আমি সত্যি কিছু জানি না।আর বকিস না। এবার ঘুমোতে দে। পায়ের ফোস্কাটা বেড়েছে।আর পারছি না।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।বারাউরি, মহারাষ্ট্রের একটা ছোটো শহর যেখানকার প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি "আগারওয়াল প্লাষ্টিকস" এর দুই শ্রমিকের মনে অসংখ্য প্রশ্ন যার উত্তর কারুরই জানা নেই।লক ডাউন আরও বাড়তে পারে এই ইঙ্গিতে আর কোনো দ্বিধা না রেখে ওরা তিরিশ জন বেরিয়ে পড়েছে বারাউরি থেকে।যতটা পথ হেঁটে যাওয়া যায়,ওরা হেঁটে ই ফিরতে চাই নিজেদের গ্রামে যা লখনৌ শহর থেকেও প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে। চারদিন হেটে পৌঁছেছে আওরঙ্গাবাদ ।
নিস্তব্ধতা বেশিক্ষণ সহ্য হয় না নরেশের। যতক্ষণ জেগে আছে বকবক করতেই থাকবে। কিন্তু উপরওয়ালার দয়ায় ঘুম গাঢ় তার। ভূমিকম্প হলেও টের পায়না যেন।
---আচ্ছা বুধন দা, তুমি স্টেশনমাস্টার কে কী জিগ্যেস করছিলে বললে না তো।কোনো ট্রেন দিচ্ছে নাকি সরকার আমাদের বাড়ি ফেরার জন্য? অন্তত লখনৌ অব্দি যাওয়ার ট্রেন পেলেও ভালই হতো ,কি বলো?
---তোর নাম বুদ্ধু নরেশ হলেও ঠিক হত।কোনো ট্রেন কোথাও চলছে না, বুঝলি?রেল লাইন ধরে হাঁটলে রাস্তা ভুল কম হয়।তাই জিগ্যেস করছিলাম এই লাইনে পরের স্টেশান গুলো কী আছে।
--- ওহ ,তাহলে এই লাইন ধরে কোনো ট্রেন আসবে না বলো?
---এলেও বা তোর কী? তুই তো নীচে ঢালুতে ঘাসের উপর শুয়ে আছিস। আর ওই গাধা গুলোকেও বলেছি রেল লাইনের উপর শুতে না।কে কার কথা শুনছে!!! বলে কিনা রেলের পাত গুলো বেশ ঠান্ডা, বেশ আরামে ঘুমানো যায়। ওই মোটাবুদ্ধি গুলোকে আর বোঝাতে পারব না।
---হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ।বলছি পোটলা তে কিছু খাবার আছে নাকি? একটা রুটি হলেও হবে, জল আছে আমার কাছে। চার পাঁচ ঢোক খেয়ে নেব।
---এই নে। চারটে রুটি আর তরকারি আছে।নষ্ট করবি না।আর আমার কাগজ পত্র, ব্যাংকের বই আছে, ঘাটবি না।
---একটাই নিচ্ছি গো।ব্যাংকের বই সঙ্গে নিয়ে ঘুরছ। খুব টাকা পয়সা আছে নাকি? হে হে , কি দাদা?
---নাহ রে, হেসে ফেলে বুধন।ওটা আমার আর বউ এর একসাথে ব্যাংকের বই।দুজনের ছবি সাঁটানো আছে স্ট্যাম্প মেরে।টাকাপয়সা তো নেই, মাঝে মাঝে ওই ছবিটাই দেখি।
---বাবা, এই বলছো বাঁচা মরার ঠিক নেই।আবার মনে মনে এত রস! ব্যাপার ই আলাদা।
---বেশি বকিস না। সরকার যদি টাকা দেয়, সেটা তো আর হাতে দেবে না।ব্যাংকের বই খুব দরকার, বুঝলি?
খাওয়া শেষ তো আমার পোটলা দে।বালিশ করে ঘুমাই।
---এই নাও গো দাদা। রুটি খেয়ে যেন একটু শক্তি এলো।ঘুমই বুঝলে। সকালে ডেকে দিও।
এইসব বলে একটা ঢেকুর তুলে ঘুমিয়ে পড়লো নরেশ।আকাশের তারা গুলো যখন প্রায় মিশে যেতে চলেছে শেষ রাতের পাতলা আলোয়,নরেশের সেই ঘুম ভাঙলো এক বিকট শব্দে, প্রচন্ড জোরে বাজতে থাকা মালগাড়ির হর্নের আওয়াজে। ধড়ফড় করে উঠে দেখে বুধন নেই পাশে, তার পোটলাও নেই।ভোররাতে পাগলের মতো চারদিক খুঁজতে থাকলো নরেশ , বুধন লোহার কে।বেশিক্ষণ লাগলো না।একটা বগির তলায় কারুর ডান হাত বেরিয়ে আছে। সে হাত নরেশের চেনা। একটু দূরে ছিটকে আছে একটা আধখোলা পোটলা, তিনটে রুটি, একটু তরকারি আর একটা পাসবইয়ের প্রথম পাতা। দুটো ছবি। স্ট্যাম্প লাগানো।
Darun likhecho bhaya
উত্তরমুছুন