বুধবার, ২০ মে, ২০২০

অণুগল্প || চোখে জল || জয়ন্তী মন্ডল

ভোরের চোখে জল
জয়ন্তী মন্ডল

বাবা !
মা! তাড়তাড়ি এসো। বাবা এসে গেছে!
গিরিবালা কাপড়ের খুঁটটা মাথায় দিয়ে শুয়েছিল।
ক’দিনই দিনরাত শুয়ে আছে গিরিবালা। শুয়ে শুয়ে কেবল বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। একটা ভীষণ ভয় চেপে বসেছে গিরিবালা কে।
কি জানি মানুষটা বাড়ি ফিরতে পারবে তো! দেড় মাস হলে গেল লক ডাউন। যে কটা টাকা ছিল সব শেষ। ফোন রিচার্জ করবে সে টাকাও নেই।
সঙ্গে যারা ছিল তারা কেউ কেউ গাড়ি ভাড়া করে ফিরেছে।
গাড়ি অনেক টাকা চাইছে। মাথা পিছু ছ’হাজার। অনেকেই ফিরতে পারেনি।
মানুষটাই আটকে গেল। কাছাকাছি নয়। মুর্শিদাবাদের নাকাশিপাড়া থেকে দেড় হাজার মাইল পথ উত্তর প্রদেশের বাগমারি। ছেলেটাকে যে পাঠাবো। যাবে কি করে! বাস ট্রেন বন্ধ। আকাশ পাতাল ভেবে কুল কিনারা করতে পারেনি গিরিবালা।
গীতা আবার ডাকে মা!
এতক্ষণ গীতার কোনো কথায় কানে যায়নি গিরিবালার।
এবার গিরিবালা ঘাড়টা খানিক উঁচু করে তাকায়।
মা! তুমি অমন করে এখনো শুয়ে রইলে যে। বাবা এসেছে। ওঠো। ওঠো। বিশ্বাস না হয় দেখবে চলো!
গিরিবালা ধড়পড় করে উঠে বসে আঁচলটা পিঠে ছুঁড়ে উঠে দাঁড়ায়।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে তোর বাবা এসেছে!
এতক্ষণ কি বলছি তোমায়!
বলতে বলতেই দুজনে ছুটে গিয়ে দেখে রামধন উঠোনে দাঁড়িয়ে। তখনো মাথা থেকে বাক্সটা নামায় নি।
গীতাকে দেখে বলে, কোথায় বাক্সটা ধরবি না ছুটলি মাকে ডাকতে।
অমনি গীতা ছুটে গিয়ে বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে দাওয়ার মেঝেতে রেখে বাক্সটা বাবা মেয়েতে ধরে নামাতেই, অমনি রামধন ধপ করে বসে পড়ে উঠোনটাই।
গিরিবালা আর নিজেকে রাখতে পারল না। রামধনকে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। রামধনও গিরিবালার মাথাটা বুকে নিয়ে কেঁদেই চলল খানিকক্ষণ।
কিছুক্ষণ এমন চলার পর গীতা চুড়িদারের ওড়নায় নিজের চোখ মুখ মুছে বলে এভাবে কাঁদলে চলবে। বাবাকে আগে খেতে দাও তো তারপর হবে সব।
ছোটো বারান্দার এককোণে বালতি থেকে জল ঢালতে ঢালতে গীতা রামধনের পা দুটো দেখে চমকে ওঠে বলে, বাবা! পায়ে এত রক্ত! এত ছোড়া! এসব কি করে?
রামধন বলে এত দূরের পথ হেঁটে এসেছি। কত বন জঙ্গল পেরিয়ে আসা।
গীতা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে তুমি হেঁটে এসেছ! এটা কি করে সম্ভব!
সম্ভব! কত দিন অপেক্ষা করছি। যে কটা টাকা ছিল তাও শেষ হয়ে গেল। এবার উপায় কি! অগত্যা শেষ সম্ব্ল এই দুটো হাত আর দুটো পা। তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পায়ে হাঁটছি আর খিদে পেলে হাত দুটো দিয়ে ভিক্ষে চাইছি। কেউ দিচ্ছে আবার কেউ তাড়িয়ে দিচ্ছে।
রামধন একটা বিরাট শ্বাস ছেড়ে বলল, এত কষ্ট করেও এলাম বলে তো তোদের সঙ্গে দেখা হোল। নইলে আর দেখাই হতো না। না খেয়ে মরে পড়ে থাকতাম পথের ধারে।
গীতা বাবার পা দুটো ধুতে ধুতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে, বাবা আমরাও যে তোমার জন্য কি করে কাটাচ্ছি এই দেড় মাস।
হাত পা ধুয়ে রামধন রেশনের মোটা চালের ভাত আর আলু সেদ্ধটা নিমেষে শেষ করে বলে আর একটু ভাত আছে মা?বড্ড খিদে পেয়েছিল।
গীতা তাড়াতাড়ি ভাত দেবার জন্য উঠতেই দেখে তখনো ও বিছানায় বসে। বাইরের দিকে তাকায়। তখনো সকাল হয় নি। আবছা অন্ধকার। কোথায় বাবা! টালির ঘরটার একটুকরো দোরে মা তখনো কাপড়ের খুঁট পেতে শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে।
মুঠো ফোনটা বেজে উঠল। এমন অসময়ে ফোন বেজে উঠতেই ভয়ে ভয়ে ফোনের কলটার দিকে তাকাল গীতা। একটা অচেনা নম্বর!
তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরল গীতা।
ও পার থেকে হিন্দিতে ভেসে এল, আপ রামধন সর্দারের কোন হ্যায়?
গীতার হিন্দি তেমন আসে না। তবে ভালোই বুঝতে পারে।
ওপারের কথা শুনে গীতা তাড়াতাড়ি ফোনটা বাম হাত থেকে ডান হাতে নিয়ে বলে আমি রামধন সর্দারের মেয়ে বলছি। আপনি কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন? আমার বাবা ভালো আছে তো। প্লিজ বাবাকে একবার দিন না ফোনটা। বাবার সঙ্গে একবার কথা বলব।
ওদিক থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এল, আপকা পিতাজি রামধন সর্দারকো লরি আয়ক্সিডেন্ট সে মত হুয়া। ডেডবডি লরি পর উনকা ঘর মে ভেজ দিয়া গ্যয়া।
   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...