খাঁড়ি পথে ইচ্ছেপাড়ি
মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
পর্ব – ৪
আলপুঝাহ্ বা আলেপ্পি
কেরলের এই জলশহরের রূপেই মুগ্ধ হয়ে লর্ড কার্জন বলেছিলেন, ‘Venice of the East’। সত্যিই যেন আলেপ্পিতে প্রাচ্যের ভেনিস নগরের আদল দেখা যায়, এখানকার অগনিত জলবিভাজিকার জন্য। একদিকে অতলান্ত আরবসাগর। অন্যদিকে ভেম্বানাদ, অষ্টমুড়ি, পুণ্যমুঢ়া নামের তিন তিনটি হ্রদ। আলপুঝাহ্-এ এর নাম ভেম্বানাদ হ্রদ। কুট্টানাড-এ এর নাম পুন্যামুঢ়া হ্রদ এবং কোচিতে এই একই হ্রদের নাম কোচি হ্রদ। নারকেলবিথী ছাওয়া ৬৫ টি খাল এখানে ১২ টি গ্রামকে মাকড়সার জালের মতো সংযুক্ত করেছে কিছু নদী ও নালা ও খাঁড়ির সমন্বয়ে। এইগুলি সবই জলে টইটুম্বুর থাকে সম্বৎসর। মালয়ালাম শব্দ, ‘ALA’ অর্থ হল ‘খাল’ এবং ‘PPUZJHA’ মানে হল নদী। অর্থাৎ বলা যেতে পারে আলপুঝাহ্, একাধারে খাল নদী খাঁড়ি উপহ্রদের মিলমিশে এক আজব জলশহর। আবার মালয়ালাম শব্দ ‘A LAYAAM’ মানে ‘Home’ বা ‘গৃহ’ এবং ‘PPUZHA’ মানে ‘Watercourse’ বা ‘River’ বা নদী। কেরলের বিখ্যাত ক্যানেল-ব্যাকওয়াটার-লেক-লেগুন-বিচ নিয়ে তৈরী এই চমৎকার জলপথ।
আগেই বলেছি, আমি এই ধারাবাহিকে শুধুই কেরলের জলসাম্রাজ্যের গল্প ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথাই শোনাবো। আমার ‘খাঁড়ি পথে ইচ্ছেপাড়ি’ নিয়ে কেট্টুভালম্ ভ্রমণের গল্প। জলপথ এই অঞ্চলে গনপরিবহণে বহুল ব্যাবহৃত হয়। KSTA তথা কেরালা স্টেট ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির সরকারি জলযান আছে স্থানীয় মানুষদের যাতায়াতের জন্য। National Water Way – 3 আলপুঝাহ্র ওপর দিয়ে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি জলযান পরিবহণ ছাড়াও ব্যাক্তিগত লঞ্চ ও ডিঙিনৌকা অহরহ চলাচল করে এই জলপথে। ঘন্টা চুক্তিতেও ভাড়া করা যায় কেট্টুভালম্। আলেপ্পিতে থাকার জন্য ডাঙ্গায় যেমন প্রচুর হোটেল ও হোমস্টে আছে, জলেও রয়েছে হরেক কিসিমের হাউসবোট। দুপাশে নারকেল গাছের ছায়ায় কটেজধর্মী কিছু হোটেল ও ভাসমান রেস্তরাঁ রয়েছে।
লোনা জলের মৃদু সংগীত নিয়ে আলেপ্পির মূল আকর্ষণ এই ব্যাকওয়াটার আর হাউসবোট। প্রায় শ’দেড়েক বিভিন্ন মানের ও দামের হাউসবোট রয়েছে এখানে। আলেপ্পি ব্যাকওয়াটার পথে পুন্যামুঢ়া, মুহাম্মা, কায়িপ্পুরম, পাথিরামানাল, থানিমুক্কম, বুন্দ, কুমারাকোম বার্ড স্যাংচ্যুয়ারি তথা ভেম্বানাদ যাত্রাপথে বিশাল বিশাল এই হাউসবোটগুলো সারাদিনমান জলে জলে টহল করে রাতে পাড়ের কাছে নোঙর করে। প্রথমে যখন বোটে উঠলাম, একটা ঘিঞ্জি খালের মতো। কিছুক্ষণ চলার পরই বিশাল আকার ধারন করলো সেই জল-জগৎ। চলন্ত এই হাউসবোটের ডেকে এসে দাঁড়ালে, কেমন ‘টাইটানিক’ সিনেমার মতো উপলব্ধি হচ্ছিল। দোতলায় লোহার সিঁড়ি বেয়ে উঠে খাবারঘরে বুফে প্রথায় প্রচুর খাবার, ফল, ফলের রস, এবং ফিল্টার কফিও।
একটা দারুণ ‘ভিলেজ ট্যুর’ হয় এই জলযাত্রায়। কেরলের সনাতনী রূপ রস গন্ধ উপভোগ করতে চাইলে এই ‘ভিলেজ ট্যুর’ সত্যি অনবদ্য। আরামকেদারা বিশিষ্ট শিকারা চেপে, মালয়ালামবাসীদের এই জলপথ এবং তার উপযুক্ত ব্যাবহার খুব সুন্দরভাবে অবলোকন করা যায়। গ্রাম্য জনজীবন ও ওদের জীবনযাত্রার স্বাদকে কিছুটা হলেও টের পাওয়া যায়। এই অভিনব ট্যুরটির মেয়াদ সকাল ৭ টা থেকে বিকেল ৫ টা। বিকেলের দিকেও একটা ভিলেজ ট্যুরের ব্যাবস্থা আছে। অভিনব বললাম এই কারনে যে, এখানে কী হয়, সরকারি লঞ্চের সারেঙ তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সকালের জলখাবার খাইয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে দিয়ে বিভিন্ন খাঁড়িপথে ঘোরাবেন। অদ্ভুত জলজীবন ওদের। প্রধান যানবাহন বলতে নৌকা। এবং নৌকাই। আমাদের শহুরে স্কুলের শিশুরা যেমন হৈ হৈ করে স্কুলবাসে বা পুলকারে চেপে স্কুলে যায়, এখানকার ছাত্রছাত্রীরা তেমনই স্কুল-বোটে চেপে স্কুলে যায়। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে ওই নৌকাই। এরা জলজীবনেই অভ্যস্ত। যা কিনা আমরা ডাঙার মানুষেরা ভাবতেই পারবো না, ওদের মতো এই কষ্টকর জীবনযাত্রাকে হাসি মুখে মানিয়ে নিতে। দুপুরে সেই মাঝির বাড়িতেই তাঁদের নিজস্ব দেশজ প্রথায় অতিথিদের মধ্যহ্নভোজের সাধারন আয়োজন থাকে। ভারি যত্নআত্তি করে পরিবেশন করে খাওয়াবেন সেই পরিবারের মানুষজন। মন্দ নয়। স্মৃতিতে থেকে যায় এগুলিই। এই অভিজ্ঞতানির্ভর অনুভূতিটাই তো দূর দেশে বেড়াতে এসে বিরাট প্রাপ্তি। ব্যাস, আর কী চাই।
জলপথে যেতে যেতে আমাদের বিকেলের ট্যুরের পথপ্রদর্শকের কাছে শুনে নিচ্ছিলাম টুকরো ইতিহাসকথা। ১৭৬২ সালে ত্রিবাঙ্কুর রাজার দেওয়ানের হাতেই গড়ে উঠেছিল আলপুঝাহ্। জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে তখন ছিল কিছু ঘরবাড়ি ও ধানজমি। এখানকার কুট্টানাড অঞ্চলকে বলা হয় ‘Rice Bowl of Kerala’। সাগরপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ ফুট নিচে পর্যন্ত এখানে ধান চাষ হয়। ১৯ শতক পর্যন্ত পোতাশ্রয় বা বন্দরনগরী রূপে আলপুঝাহ্র খ্যাতি ছিল। তারপর ২০ শতকের গোড়ায় কোচি বৃহত্তম এক বন্দরনগরী হিসেবে গড়ে ওঠায় কিছুটা গরিমা হারায় আলপুঝাহ্। আরও একটা বিষয় জানলাম ওঁর কাছে, এই আলেপ্পি বা আলপুঝাহ্ হলো ‘ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির আঁতুরঘর’ নামে পরিচিত। কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভি এস অচ্ছুতানন্দন, যিনি নাকি কম্যুনিস্ট পার্টির একজন বিখ্যাত নেতা ছিলেন, তাঁর জন্ম এই জলশহরেই। আমার ব্যাগে সবসময়ের জন্য মজুদ ছোট্ট ডায়েরিতে লিখে রাখি এইসব ইতিবৃত্ত। জল ভেঙে তরতর করে বয়ে চলা নাওয়ে বসে, সব কিছু চিনে চিনে নিচ্ছি। দু চোখ এতটুকু অন্যমনস্ক হওয়ার জো নেই। আশ্চর্য ছবির মতো নিপাট সাজানো স্নিগ্ধতা। চোখ জুড়ানো সবুজ দেখতে হলে কেরলের এই ‘খিড়কিজল’ ভ্রমণের স্বাদ পাওয়া যায় দেদার।
আগেই বলেছি, ব্যাকওয়াটারের দুই ধারে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দিনলিপি ঠারেঠোরে পরখ করতে জলবিহার যেমন চিত্তাকর্ষক তেমনই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভাস্বর হয়ে থাকে। বাড়িঘর থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাকঘর, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, স্বাস্থকেন্দ্রসহ সম্পূর্ণ গ্রাম্যজীবনের লাইফলাইন এই ব্যাকওয়াটার। ‘ঈশ্বরের নিজের দেশ’ বলেই হয়তো ঈশ্বর, এই শহরকে এত সুন্দর করে নিজের হাতে রঙতুলির টান দিয়েছেন। মাঝে প্রশিক্ষণরত একটি ‘স্নেক্বোট’ দেখতে পেলাম। এখানে পম্পা নদীতে স্নেক্বোট রেস, কেরলের একটি অতি বিখ্যাত ও দর্শনীয় প্রতিযোগিতা।প্রতিবছর অগাস্ট মাসের দ্বিতীয় শনিবার পম্পা নদী ও পুন্যামুঢ়া হ্রদে ‘চুন্দন ভাল্লম্’ অর্থাৎ স্নেক্বোট রেস মাতিয়ে তোলে আলেপ্পিকে। শতাধিক চুন্দন ভাল্লম্ নৌকা, ঘোষিত ১ লক্ষ টাকা মূল্যের ‘নেহেরু ট্রফি’ প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়। কণ্ঠে তাদের থাকে চমৎকার ছন্দে গাওয়া ‘ভাঞ্চিপাট্টু’ লোকগান।
জলের মজলিসে কোথা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে সময়ের অনেকখানি। সুর্য তার রূপোলী রঙে ঝিলিক্ দিচ্ছিল জলে। তারপর কখন টুপ্ করে ঝরে গেল রোদ। এই সুরম্য ভ্রমণ একবার শুধু হাতছানি দিয়ে ডাকতেই ভুলে গেছিলাম আমার আগের অন্যান্য সব জলভ্রমণগুলির কথা। আগেও তো ভারতের বিভিন্ন স্থানে নদী, সাগর, হ্রদ, খাঁড়িতে কতো জলবিহার করেছি। আজ কেরলের হাউসবোটের ব্যালকনিতে বসে, দু পাশের অলীক দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে বেজায় নিঃস্ব হতে থাকি। নিজেকে ছুঁয়ে দেখি, আমার নিপাট নিজস্ব ভুবন কেমন ছোট হয়ে গেছে ওই বিশাল জল-বৈভবের কাছটিতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন