বুধবার, ১ জুলাই, ২০২০

খাঁড়ি পথে ইচ্ছেপাড়ি ...২ || মধুছন্দা মিত্র ঘোষ || ভ্রমণকথা প্রতি বুধবার


খাঁড়ি পথে ইচ্ছেপাড়ি ...|| ভ্রমণকথা প্রতি বুধবার

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ 



পর্ব -  ২

কুমারাকোম 

        ক্ষুরধার প্রকৃতি বিন্যাস আর ছায়া ছায়া আকাশ প্রশ্রয়ে রেখেছে আজ কেরলের কুমারাকোম এলাকাটিকে। বেশীরভাগ পর্যটকই কোট্টায়ামের হোটেলে রাত্রিবাস করে পরের দিন কুমারাকোম বেড়াতে যান। আমাদেরও কুমারাকোম পছন্দ। জানা ছিল ওখানে একটি বিরল বার্ড স্যাংচুয়ার‍্যি আছে। প্রচুর পাখপাখালির আনাগোনা সেখানে। আমরাও কোট্টায়ামের নির্বাচিত হোটেলে রাত্রিবাস করে সকালে হাউসবোটের জলজ অভিজ্ঞতার শরিক হতে রওনা হলাম। যেখানে নৌকারা হাত মেলাচ্ছে, একধাপ ভ্রমণ খুলে যাচ্ছে তার একান্ত ছলাৎছল্‌ নিয়ে। হ্রদ সংলগ্ন জেটি থেকে চমৎকার সব হাউসবোটে জলবিভাজিকা সাঁতরে যাওয়ার বন্দোবস্ত রয়েছে। কোট্টায়াম থেকে খাঁড়ি পথে কুমারাকোমের দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার। এখান থেকে জলসফরে আলেপ্পিও ঘুরে আসা যায়। তবে আমরা আজ যাবো কুমারাকোম। সে জলভ্রমণে ভেম্বানাদের প্রকৃতিদত্ত দৃশ্যই সব ভুলিয়ে দেবে। 
        হাউসবোটে খাঁড়িপথে জলভ্রমণ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এই জলভ্রমণ ভ্রমণপিয়াসী মনে ‘চার চাঁদ লাগিয়ে দেয়’। দুর্ধর্ষ একটি ব্যাকওয়াটার গন্তব্য হল কুমারাকোম পথে পাড়ি দেওয়া। এটি মূলত একটি ছোট দ্বীপের মতো। সনাতনী কেরালার সৌন্দর্যের আঁচ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে গেলে কুমারাকোম নিশ্চয় শ্রেষ্ঠতার দাবি রাখে। কেরলের এইসব অঞ্চলের নদী বা উপনদী সমুদ্রের কাছাকাছি আসার পর বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারনে তাদের গতি কিছুটা ব্যাহত হয়ে যায়। ফলত কখনও সেখানে উদ্বৃত্ত বিশাল জলরাশি খুঁজে নেয় অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গা। সৃষ্টি হয় খাঁড়ি-নালার মতো প্রচুর জলবিভাজিকা। সেখানে জলের প্রবাহ সাগরের জোয়ার-ভাঁটা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জোয়ারের জলে তরতর করে এগিয়ে যায় জলযান। 
        আমাদের জলযানের নাম ‘ইন্দ্রপ্রস্থম’। নামটি বেশ। জেটি থেকে হাউসবোটের প্রবেশপথ পেরোতেই একটা বড় বসার ঘর, সেখানে অনেকগুলি দামি ও আরামপ্রদ সোফাসেট ও সেন্টারটেবিল পেতে রাখা। তারপর সেই বৈঠকখানা পেরিয়ে, টানা প্যাসেজের রেলিং দেওয়া বারান্দার একধারে ব্যাকওয়াটারের বিপুল জলরাশি, অন্যদিকে পর পর পাঁচটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিপাটি দুই শয্যার বিলাসবহুল ঘর। লাগোয়া স্নানাগার। ঘরের মধ্যে শৌখিন সোফা, প্রসাধনী টেবিল, স্টুল, নরম বিছানা। আর ঘরের একদিকে পুরো দেওয়াল জুড়ে কাঁচের জানলা। আপাদমস্তক কাঁচের জানলার ভারি পর্দা সরাতেই দিগন্তজোড়া জলরাশি। প্যাসেজের একদিকে স্টিলের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায় খাবারঘরে। প্রচন্ড একটা ভোঁ দিয়ে আমাদের বিশাল জলযান চলতে শুরু করেছে। পর্দা দুপাশে সরিয়ে বেঁধে রাখি, যেন এতোটুকুও দৃষ্টির আড়ালে না থাকে হ্রদের নিঃসীম লাবণ্য ঘেরা অসাধারন শোভা। দুই পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আরও অনেক বিশাল বিশাল হাউসবোট। কী তাদের রাজকীয় ঠাটবাট। প্রতিটি হাউসবোটই স্থাপত্য নৈপুণ্য শৈলীর অদ্ভুত মিশেল। এই রাজকীয় ময়ূরপঙ্খি জলযানের সুসজ্জিত ডেকে এসে বসতেই, ‘Welcome Drinks’ তথা ‘আমন্ত্রনি পানীয়’ হিসাবে সুদৃশ্য কাঁচের লম্বা গেলাসে মিষ্টি সুস্বাদু ডাবের জল পরিবেশন করা হল। জলযান ধীর গতিতে চলতে থাকে। হাউসবোটের ডেকে বিলাসবহুল সোফায় জ্যুত করে গা এলিয়ে বসি। সেই মুহুর্তে নিজেকে কেমন ‘জমিদারগিন্নি’ মনে হয়। 
        খাঁড়ি পথে ভেসে যেতে যেতে সঙ্গী করে নিচ্ছি দুই পাশের কেরল রাজ্যের গ্রাম্যজীবন। ঘাটে ঘাটে ডিঙি নৌকা বাঁধা। দুই পাড়ে জলে প্রায় নুইয়ে থাকা নারকেল গাছে ছাওয়া বাড়িঘরছায়া মেলে নুইয়ে রয়েছে তার সবুজ ঝালরের মতো পাতাগুচ্ছ। এইসব অঞ্চলে রবার, লবঙ্গ, গোলমরিচ এর আবাদ বেশি। এছাড়া নারকেল, কাজু ইত্যাদির ফলনও বেশ ভালো। ১০টি নদীর জলে পুষ্ট এই হ্রদ, তার মধ্যে মনিমালা, মিনাচিল, পম্বা, মুভাট্টাপুজাহ্‌, পেরিয়ার এবং আচেনকোভিল্‌ নদী উল্লেখযোগ্য। এরনাকুলাম, আলপুঝাহ্‌ ও কোট্টায়াম জেলা পরিবেষ্ঠিত এই হ্রদ। আগেই শুনেছিলাম, কুমারাকোম এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে, প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের নাম। তিনি নাকি এখানকারই কোনও এক গ্রামে বসে লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত তথা পুরস্কৃত উপন্যাস ‘The God of small things’.     
         বিশাল ভেম্বানাদ হ্রদের একদিকে হল কুমারাকোম এবং খাঁড়িপথের একদম অন্য পাড়ে হল আলেপ্পি। পর্যটকরা অনেকেই কুমারাকোম পথেই যান, কারন এই খাঁড়িপথের পাশেই রয়েছে একটি পাখিরালয়। ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ঘেরা ১৪ একর জমি জুড়ে এর বিস্তার। ১৮০ প্রজাতির পাখিদের মৌরুসিপাট্টা এখানে। এই অঞ্চলটি এককালে ব্রিটিশ আধিকারিক জর্জ হেনরি বেকার প্রথম আবিস্কার করেন। তাই এই অঞ্চলটিকে ‘বেকারস এস্টেট’ বলা হয়ে থাকে। বেকার সাহেব সেকালে এই স্থানটি ট্রাভাঙ্কোর রাজার কাছ থেকে কিনে নেন। এবং তিন পুরুষ ধরে জমিদারি বজায় থাকে। স্বাধীনতার পর ল্যান্ড সিলিং অ্যাক্টে পড়ে যায় তাঁর এই জমিদারি। তখন রবার গাছ লাগিয়ে ল্যান্ড সিলিং অ্যাক্ট থেকে অব্যহতি পেয়ে যান। ১৯৭৪ পর্যন্ত তাঁর বংশধরেরা এটি ধরে রেখেছিলেন। তারপর সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। রবার বাগান ও পক্ষীরালয় কেরল সরকার কিনে রিসর্ট নির্মান করে। এখানে পানকৌড়ি, জলমোরগ, পাতিহাঁস, মাছরাঙা, ব্রাম্ভনী চিল, ঈগল, কোকিল, প্যাঁচা, ইত্যাদি দেশজ পাখি এবং মুরহন, ইগ্রেট, সাইবেরিয়ান স্ট্রোক, হেরন, গার্গনে, টিল, অসপ্রে, ক্যাটেল ইগ্রেটস, ডার্টার, মার্স হেরিয়ার, লিটল কর্মোব্যান্টস ইত্যাদি পরিযায়ী পাখিদের জমাটি আড্ডা বসে। ওরা খুঁটে খায় দানা, ঠোঁটে গান নিয়ে। জুন থেকে অগস্ট দেশীয় পাখিদের দেখার মরসুমপরিযায়ী পাখিদের দেখা মেলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে। কুমারাকোম পক্ষীআলয় তথা KTDC ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স থেকে ঝোপঝাড় বেষ্টিত একটি হাঁটাপথ আছে ওখানে রিসর্টের গা বেয়ে। কুমারাকোম পাখিরালয়টি ভেম্বানাদ পাখিরালয় নামেও পরিচিত। খাঁড়িপথে যেতে পাথিরামানল দ্বীপটি হল সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ান পথে আসা পাখিদের স্বর্গরাজ্য। 
        খাঁড়ি পথে চলতে চলতে এখানকার গ্রামীণ জীবনযাত্রার সঙ্গেও ভাব জমে। জল-জঙ্গলই যাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। তুখোড় স্নিগ্ধ নির্জনতা ছেয়ে আছে গ্রামগুলোতে। স্কুলের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা নিজস্ব ডিঙ্গি বেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। এই পথে মাঝেমাঝেই মাথার ওপর বড় সেতু পেরতে হচ্ছে। সেগুলি স্থলপথ। গাড়ি যানবাহন মানুষজন চলাফেরা করছে সেখানে। যখন এখানে থানেরকুক্কুম্‌ বাঁধ নির্মিত হয়নি, তখন সাগরের জল জোয়ারের সময় ক্যানেলে অবাধে চলে আসত। বর্তমানে বাঁধ হওয়ার পরে এই জোয়ারভাটার খেলাটি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলত খাঁড়ির জল এদিকটা আবার কিছুটা স্রোতহীন ও স্থির হয়ে থাকায় জলজ পুষ্প লতা গুল্ম খুব সহজেই বিস্তার পেয়ে সবুজে ছেয়ে গেছে খাঁড়িপথ।  
        হাউসবোট যাত্রার দুধারে নারকেল, কলা, ‘আইনি’ নামের স্থানীয় গাছগুলি ঝুঁকে আছে জলের বুকে। মিনচিল নদী ও ক্যানেলের জন্য জমা জলাভূমে কলা, আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, তেঁতুল, আনারস গাছের ফলন প্রায় প্রতিটি পরিবারের লাগোয়া জমিতে। কোথাও তো পুষ্প লতায় সবুজ ক্যানোপির মতো তৈরি হয়েছে। কোথাও আবার কচুরিপানা ও আগাছায় সেই জায়গাটা আদৌ জলভূমি না স্থলভূমি বোঝার উপায় নেই। কেরালার ভেম্বানাদ হ্রদটি কোচি থেকে কোট্টায়াম হয়ে আলপুজ্জাহ্‌ বা আলেপ্পি পর্যন্ত বিস্তারিত। মালয়ালাম গ্রামীণ মানুষদের দৈনন্দিন সহজ সরল জীবনের রোজনামচা, ব্যাকওয়াটার, ক্যানেল, লেগুন এইসব নিয়েই জলভরা সংসার। কুমারাকোম অনেকগুলি ছোট ছোট দ্বীপের সমষ্টি এবং বিখ্যাত তার হাউসবোট ও বোট ক্রুজের জন্য। রাতে এক জায়গায় নোঙর করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থম। রাতের জলজীবন দেখার আশা বন্ধ হয়ে যায়। ভিজে ভিজে রাত। হাউসবোটের গা চুঁইয়ে মাস্তুলের আলো জলে একা পড়ে আছে। বেবাক নিস্তব্ধ চারদিক। স্তব্ধতারও যে একটা নিজস্ব শব্দ আছে টের পাই

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...