সবাই মিলে , সিনেমা হলে ~৮
কান্তিরঞ্জন দে
পাড়ায় পাড়ায় পথসিনেমা ।।
অন্যপ্রসঙ্গে যাবার আগে সিনেমা দেখানো নিয়ে অত্যন্ত জরুরী আরও দু-চারকথা বলে নিই ।
বর্তমানে সিনেমা দেখা ও দেখানোর ব্যবস্থা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে বলে , মাধ্যম হিসেবে সিনেমার শক্তি কিন্তু বিন্দুমাত্র কমে নি । উল্টে বেড়েছে । এ যেন , "পঞ্চশরে দগ্ধ করে , করেছ এ কি সন্ন্যাসী ? / বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে ।" ব্যাপারটা খুলে বলি -----
সিনেমা তৈরির উপকরণ কিন্তু এখন আক্ষরিক অর্থে আমাদের হাতের মুঠোয় । ক্যামেরা আমাদের হাতের মুঠোয় । সিনেমা সম্পাদনা-র সফ্টওয়্যার এখন ঘরে ঘরে টেবিলে টেবিলে , ডেস্কটপ অথবা ল্যাপটপ কম্পিউটারে । নতুন প্রজন্মের সিনেমা তৈরি করিয়ে ছেলেমেয়েরা কিন্তু এর সুযোগ নিতে পারেন । ছোট ছোট ছবি করছেনও অনেকেই । লিটিল ম্যাগাজিন বার করা , কিংবা গানের দল ( ব্যাণ্ড ) খুলে ফেলার মতো , সিনেমা তৈরির দলগত কিংবা একক সুযোগ এখন অত্যন্ত সুলভ ।
কিন্তু সেগুলো পরিবেশন করবেন কোথায় ? দেখাবেন কিভাবে ? সবাইকে কি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পেছনে দৌড়বেন ? সে দৌড়ন । কিন্তু তার পাশাপাশি আরও একটি চমৎকার উপায় আছে।
চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত থিয়েটার ছিল উত্তর কলকাতার স্টার , বিশ্বরূপা ( শ্রীরঙ্গম ) , কিংবা মিনার্ভা সহ অন্যান্য বাণিজ্যিক মঞ্চের হাতে বন্দি । গণনাট্য প্রযোজিত " নবান্ন " এসে থিয়েটারকে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছিল । কলকাতা মঞ্চের পাশাপাশি নবান্ন গ্রামে গঞ্জে মাঠে ঘাটে প্রচুর অভিনীত হয়েছিল ।
প্রথমে গণনাট্য এবং পরে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের হাত ধরে নাটক ব্যাপারটা ক্রমশ জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে , পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে । বাণিজ্যিক মঞ্চে কম সে কম তিন-চার ঘন্টাব্যাপী নাটক সংক্ষিপ্ত হতে হতে একদিন মন্মথ রায়-এর হাত ধরে একাঙ্ক নাটকে রূপান্তরিত হয় । দুই বাংলাতেই একাঙ্ক নাটক বিষয়ে ও উপস্থাপনায় বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ।
তারই হাত ধরে আসে , পথনাটিকা বা স্ট্রিট থিয়েটার । উৎপল দত্তের মতো জনপ্রিয় নাট্যকার-পরিচালক- অভিনেতা পর্যন্ত অসংখ্য মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি প্রায় পঞ্চাশটি পথনাটিকা লেখেন এবং পাড়ায় অভিনয় করে বেড়ান ।
সত্তর দশকের গোড়ায় বাদল সরকার তো পথনাটিকাকে একটি আন্দোলনেরই চেহারায় পৌঁছে দেন। তাঁর দলের নাম ছিল --- শতাব্দী । আর , আন্দোলনটির নাম ছিল --- থার্ড থিয়েটার মুভমেন্ট ।
বাদলবাবু তাঁর দলের সদস্যদের নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন পার্কে , বিভিন্ন কলেজের উঠোনে , মহাবোধি সোসাইটি-র দোতলার হলঘরে কিংবা স্রেফ বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে শহরের পাড়ায় পাড়ায়, পথের মোড়ে তাঁর পথনাটিকা গুলোর অভিনয় করে বেড়াতেন । অভিনয় শেষে দর্শকদের সামনে গামছা অথবা চাদর মেলে ধরতেন।
দর্শনী যা সংগ্রহ হতো , তাই দিয়ে সেদিনের প্রদর্শনীর খরচ উঠে যেত।
অথচ, বাদল সরকার পেশায় ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন টাউন প্ল্যানার- ইঞ্জিনিয়ার । তাঁর লেখা নাটক শম্ভু মিত্রের ' বহুরূপী 'নাট্যদল ছাড়াও , পশ্চিমবাংলা , সারা ভারত এবং বাংলাদেশের অসংখ্য নাট্যদল দীর্ঘকাল মঞ্চস্থ করেছে ।
বাদল সরকার প্রবর্তিত পথনাটিকা বা স্ট্রিট থিয়েটার আজও জোরদার প্রতিবাদী আন্দোলনের একটি পথ ।
সময় সমাজ এখন অনেক বদলে গেছে । কিন্তু , মনের কথা , সমাজের কথা বলবার প্রয়োজন তো ফুরোয় নি । কোনওদিন কি ফুরোয় ?
তাই ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর সহজলভ্য সিনেমা তৈরি এবং প্রদর্শনের এই সুযোগে নতুন যুগের ছেলেমেয়েদের নেওয়া উচিত । গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক - রাজনৈতিক বিষয়ে ছোট ছোট গল্প তৈরি করে কাহিনীচিত্র এবং নানা বিষয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করবার সম্ভাবনা এখন বিপুল ।
জেলায় জেলায় , পাড়ায় পাড়ায় এ রকম গ্রুপও অনেক তৈরি হয়েছে/ হচ্ছে বলে , খবর পাই । যেমন ----- কলকাতার পিপলস্ ফিল্ম কালেক্টিভ কিংবা হিন্দমোটর- উত্তরপাড়ার ' জীবনস্মৃতি ' সংগঠন ।
পথ সিনেমা বানাবার নতুন পথ খুলে গেছে । নতুন প্রজন্ম কি তার সুযোগ নেবেন ?
কান্তিরঞ্জন দে
পাড়ায় পাড়ায় পথসিনেমা ।।
অন্যপ্রসঙ্গে যাবার আগে সিনেমা দেখানো নিয়ে অত্যন্ত জরুরী আরও দু-চারকথা বলে নিই ।
বর্তমানে সিনেমা দেখা ও দেখানোর ব্যবস্থা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে বলে , মাধ্যম হিসেবে সিনেমার শক্তি কিন্তু বিন্দুমাত্র কমে নি । উল্টে বেড়েছে । এ যেন , "পঞ্চশরে দগ্ধ করে , করেছ এ কি সন্ন্যাসী ? / বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে ।" ব্যাপারটা খুলে বলি -----
সিনেমা তৈরির উপকরণ কিন্তু এখন আক্ষরিক অর্থে আমাদের হাতের মুঠোয় । ক্যামেরা আমাদের হাতের মুঠোয় । সিনেমা সম্পাদনা-র সফ্টওয়্যার এখন ঘরে ঘরে টেবিলে টেবিলে , ডেস্কটপ অথবা ল্যাপটপ কম্পিউটারে । নতুন প্রজন্মের সিনেমা তৈরি করিয়ে ছেলেমেয়েরা কিন্তু এর সুযোগ নিতে পারেন । ছোট ছোট ছবি করছেনও অনেকেই । লিটিল ম্যাগাজিন বার করা , কিংবা গানের দল ( ব্যাণ্ড ) খুলে ফেলার মতো , সিনেমা তৈরির দলগত কিংবা একক সুযোগ এখন অত্যন্ত সুলভ ।
কিন্তু সেগুলো পরিবেশন করবেন কোথায় ? দেখাবেন কিভাবে ? সবাইকে কি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পেছনে দৌড়বেন ? সে দৌড়ন । কিন্তু তার পাশাপাশি আরও একটি চমৎকার উপায় আছে।
চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত থিয়েটার ছিল উত্তর কলকাতার স্টার , বিশ্বরূপা ( শ্রীরঙ্গম ) , কিংবা মিনার্ভা সহ অন্যান্য বাণিজ্যিক মঞ্চের হাতে বন্দি । গণনাট্য প্রযোজিত " নবান্ন " এসে থিয়েটারকে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছিল । কলকাতা মঞ্চের পাশাপাশি নবান্ন গ্রামে গঞ্জে মাঠে ঘাটে প্রচুর অভিনীত হয়েছিল ।
প্রথমে গণনাট্য এবং পরে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের হাত ধরে নাটক ব্যাপারটা ক্রমশ জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে , পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে । বাণিজ্যিক মঞ্চে কম সে কম তিন-চার ঘন্টাব্যাপী নাটক সংক্ষিপ্ত হতে হতে একদিন মন্মথ রায়-এর হাত ধরে একাঙ্ক নাটকে রূপান্তরিত হয় । দুই বাংলাতেই একাঙ্ক নাটক বিষয়ে ও উপস্থাপনায় বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ।
তারই হাত ধরে আসে , পথনাটিকা বা স্ট্রিট থিয়েটার । উৎপল দত্তের মতো জনপ্রিয় নাট্যকার-পরিচালক- অভিনেতা পর্যন্ত অসংখ্য মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি প্রায় পঞ্চাশটি পথনাটিকা লেখেন এবং পাড়ায় অভিনয় করে বেড়ান ।
সত্তর দশকের গোড়ায় বাদল সরকার তো পথনাটিকাকে একটি আন্দোলনেরই চেহারায় পৌঁছে দেন। তাঁর দলের নাম ছিল --- শতাব্দী । আর , আন্দোলনটির নাম ছিল --- থার্ড থিয়েটার মুভমেন্ট ।
বাদলবাবু তাঁর দলের সদস্যদের নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন পার্কে , বিভিন্ন কলেজের উঠোনে , মহাবোধি সোসাইটি-র দোতলার হলঘরে কিংবা স্রেফ বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে শহরের পাড়ায় পাড়ায়, পথের মোড়ে তাঁর পথনাটিকা গুলোর অভিনয় করে বেড়াতেন । অভিনয় শেষে দর্শকদের সামনে গামছা অথবা চাদর মেলে ধরতেন।
দর্শনী যা সংগ্রহ হতো , তাই দিয়ে সেদিনের প্রদর্শনীর খরচ উঠে যেত।
অথচ, বাদল সরকার পেশায় ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন টাউন প্ল্যানার- ইঞ্জিনিয়ার । তাঁর লেখা নাটক শম্ভু মিত্রের ' বহুরূপী 'নাট্যদল ছাড়াও , পশ্চিমবাংলা , সারা ভারত এবং বাংলাদেশের অসংখ্য নাট্যদল দীর্ঘকাল মঞ্চস্থ করেছে ।
বাদল সরকার প্রবর্তিত পথনাটিকা বা স্ট্রিট থিয়েটার আজও জোরদার প্রতিবাদী আন্দোলনের একটি পথ ।
সময় সমাজ এখন অনেক বদলে গেছে । কিন্তু , মনের কথা , সমাজের কথা বলবার প্রয়োজন তো ফুরোয় নি । কোনওদিন কি ফুরোয় ?
তাই ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর সহজলভ্য সিনেমা তৈরি এবং প্রদর্শনের এই সুযোগে নতুন যুগের ছেলেমেয়েদের নেওয়া উচিত । গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক - রাজনৈতিক বিষয়ে ছোট ছোট গল্প তৈরি করে কাহিনীচিত্র এবং নানা বিষয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করবার সম্ভাবনা এখন বিপুল ।
জেলায় জেলায় , পাড়ায় পাড়ায় এ রকম গ্রুপও অনেক তৈরি হয়েছে/ হচ্ছে বলে , খবর পাই । যেমন ----- কলকাতার পিপলস্ ফিল্ম কালেক্টিভ কিংবা হিন্দমোটর- উত্তরপাড়ার ' জীবনস্মৃতি ' সংগঠন ।
পথ সিনেমা বানাবার নতুন পথ খুলে গেছে । নতুন প্রজন্ম কি তার সুযোগ নেবেন ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন