শিলাবতী অববাহিকার ইতিহাস ও কৃষ্টি॥
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
॥ আজ শেষপর্ব॥
শীলাবতী অববাহিকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকারী এরকমই আর একটি মেলা হল ভেদুয়া গ্রামের ভেদুয়াসিনির মেলা। সন্ধিপুর থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম উত্তরবিল ও ভেদুয়া গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে এই মেলাটি বসে। হিন্দুদের দেবতা কিন্তু মেলাটির যাবতীয় আয়োজন করে এই দুই গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়। ভেদুয়াসিনি বনদেবী। এর পুজো করেন নেকড়াইশোল গ্রামের লায়েক সম্প্রদায়। কিন্তু মেলাটি পরিচালনা করেন মুসলমান ভাইয়েরা। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলাটি বসে, চলে তিন-চারদিন ধরে। হিন্দুর দেবতাকে মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করছেন মুসলমানেরা। যা শীলাবতী অববাহিকাকে মহিমান্বিত করেছে। এরকমই আর একটি চিত্র দেখি শীলাবতী নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে রঘুনাথপুর গ্রামে। এখানে মুসলমানের পীরকে রক্ষা করছেন হিন্দু ভাইয়েরা। যা এক অনন্য নজির। শীলাবতী অববাহিকাতেই বুঝি এমন দৃষ্টান্ত মেলে।
শীলাবতী অববাহিকার ভৌগোলিক অবস্থান যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনই এর গতিবিধিও অত্যন্ত বিচিত্রতায় ভরা। বলা যেতে পারে আশ্চর্য রকমের সুন্দর। এই নদীর প্রচুর বাঁক। আর প্রতি বাঁকে বাঁকে গড়ে উঠেছে জনপদ এবং সেখানেই রয়েছে সেই এলাকার মানুষজনের গড়ে ওঠা কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। কালের স্রোতে অনেক এলাকাই নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে ভাঙাগড়ার খেলা খেলতে সে এগিয়ে চলেছে। বয়স্ক এবং প্রবীণ মানুষদের মুখে শুনেছি এখনকার যে শীলাবতী আমরা দেখছি অন্য পাশ দিয়ে বয়ে যেত। একদিক ভেঙেছে, অন্যদিক গড়েছে। কোথাও আবার ভাঙন হয়েছে দু’দিকেই। ফলে চাষযোগ্য জমিও অনেক শীলাবতীর গর্ভে তলিয়ে গেছে। গড়বেতা এলাকায় এই নদী যতখানি চওড়া-যত পূর্বদিকে অর্থাত্ ঘাটালের দিকে এগিয়ে গেছে তত তার প্রসারতা কমেছে। চন্দ্রকোণা-ঘাটাল সড়কে বাঁকার কাছে এই নদী যথেষ্টভাবেই সরু। তাই বলে বর্ষাকালে এর বিধ্বংসী রূপ কম নয়। ভরা বর্ষায় সে বীভত্সল রকমের ভয়ঙ্করী চেহারা
নেয়। ঘাটালের যে নতুন বাসস্ট্যান্ড তা প্রায় শীলাবতী নদীর পাড় ঘেঁষেই। এখানকার শীলাবতীতে জোয়ার আসে। স্বাভাবিকভাবেই ঘাটালের শিল্প-সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি শীলাবতীকে কেন্দ্র করেই। গড়বেতার গনগনি ডাঙা যেমন শীলাবতী তীরবর্তী একটি উল্লেখযোগ্য স্থান, তেমনি ঘাটালেও একেবারে শীলাবতী নদীর উপরে একটি দর্শনীয় বস্তু আছে তা হল
‘ভাসাপোল’। এই ভাসাপোল এখানকার যোগাযোগের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আগেই বলেছি ঘাটাল একটি বন্যাপ্রবণ এলাকা। শীলাবতীর বন্যায় প্রায় প্রতি বছর প্লাবিত হয়ে পড়ে। শীলাবতীর বুকে অবস্থিত এই ভাসাপোলটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ভাসাপোল কখনো ডুবে যায় না। শীলাবতীর জল যত বাড়ে ভাসাপোলও তত উপর দিকে উঠতে থাকে। যার ফলে লোকজনের পারাপার হতে অসুবিধা হয় না। ঘাটাল শহরের দু’প্রান্তকে সংযোগ স্থাপনে রক্ষা করে চলেছে এই ভাসাপোল। কতকগুলি নৌকাকে এক করে তার উপর পাটাতন দিয়ে তৈরি এই ভাসাপোল। আর সবসময় জলের উপর এই পোল ভেসে থাকে বলে এর নাম হয়েছে ভাসাপোল। এটি ঘাটাল শহরের একটি ঐতিহ্য।
শুধু ঘাটাল কেন-কোমরপুর, দেউলবেড়িয়া, ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোণা সব এলাকাগুলিই শীলাবতী অববাহিকায়। চন্দ্রকোণার রাজা চন্দ্রকেতুর সঙ্গে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজার সন্ধি স্থাপিত হয়েছিল সন্ধিপুর গ্রামে-যা শীলাবতী অববাহিকায়। এরকম অজস্র ঘটনার নীরব সাক্ষী শীলাবতী নদী। যে কোনো নদী সেই এলাকার জনমানসে বিরাট একটা ছাপ ফেলে। শীলাবতীও তার ব্যতিক্রম নয়। এলাকার গ্রাম-শহর-নগর জীবনের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। জড়িয়ে গেছে মানুষের সুখ-দু:খে। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের সৃষ্টির অনবদ্য উপাদান হয়ে উঠেছে। এই প্রবন্ধের লেখকেরও অনেক গল্প, উপন্যাস ও কবিতার উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে এই শীলাবতী নদী। এই লেখকের সেরকমই একটি কবিতা হল -
শীলাবতী
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
আমাদের শীলাবতী প্রিয় ছোটো নদী
কুলুকুলু রব তুলে বয় নিরবধি।
বোশেখ মাসেতে দেখি হাঁটু ভরা জল
তার’পরে খেলা করে শিশুরা সকল।
শ্রাবণে সে ফেঁপে ওঠে, ডেকে আনে বান
ঘোলাজল স্রোতবুকে গেয়ে যায় গান।
ছোটো ছোটো ডিঙাগুলি ফিরে পায় প্রাণ
ভাটিয়ালি সুর বাঁধে গাঁয়ের কিষাণ।
শরতের কাশফুল হাসে দুই তীরে
তার সে মধুর ছায়া দোল খায় নীরে।
অপরূপ সেই ছবি, কী অসাধারণ!
দেখে মন ভরে যায়, জুড়ায় নয়ন।
ফাগুনে চাঁদের হাসি পড়ে বালুচরে
যেন সোনা রাশরাশ আলো মেখে ঝরে।
বাতাসের সাথে কথা করে কানাকানি
কত কথা, কী যে কথা কী জানি কী জানি!
সে যে বড়ো আমাদের আপনার জন
সুখেদুখে মিশে আছে মায়ের মতন।
মধুর পরশ পাই তার কাছে গেলে
এমন শান্তি কোথাও আর নাহি মেলে।
১৮
যে শীলাবতীকে নিয়ে আমাদের এত গর্ব, এত অহঙ্কার সেই শীলাবতীর বর্তমান রূপ কেমন? কেমন আছে আমাদের সাধের শীলাবতী? উত্তরে বলতে হয় শীলাবতীর বর্তমান অবস্থা মোটেই ভালো নয়। সে ভালো নেই। একসময় যে শীলাবতী রীতিমতো প্রাণচঞ্চলা ছিল, বেগবতী ছিল সে আজ কেমন যেন নিষ্প্রাণ, স্রোতহীন। বর্ষার ক’মাস ছাড়া শীলাবতীর বুকে এখন আর জল গড়ায় না। বছরের ছ’মাস জল থাকে, ছ’মাস জল থাকে না। বলা যেতে পারে শীলাবতী এখন বন্ধ্যাদশা লাভ করেছে। আর এই বন্ধ্যাদশা যত সময় যাচ্ছে তত প্রকট হচ্ছে। কোনো কোনো বছর ভরা শ্রাবণেও শীলাবতী খরা থাকে। বুকে তার এক ফোঁটা জল গড়ায় না। যাকে বলে একেবারে শুকনো-খটখটে। বুকে তার শুধু ধূ ধূ সাদা বালুকরাশি। শীলাবতী রীতিমতো মজে গেছে। একসময় এই শীলাবতী নদী থেকে প্রচুর সুস্বাদু মাছ মিলত। অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করত এই শীলাবতী থেকে মাছ ধরে। আজ সেই সব যেন ইতিহাস হতে চলেছে। সারা বছর যদি নদীতে জলই না থাকল তবে মাছ জন্মাবে কী করে? শুধু মাছ কেন? বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপের অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত। ‘মাছরাঙা ঝুপ করে’ আর জলে এসে পড়ছে না। হাঁসের দল চরে বেড়াচ্ছে না, পানকৌড়ি ডুবসাঁতার দিচ্ছে না। এককথায় নদীটার পুরো পরিবেশ এবং তার ইকোসিস্টেমটাই গেছে বদলে। যা আমাদেরকে এক চরম সর্বনাশের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে শিহরিত করছে।
শীলাবতীর এই বন্ধ্যাদশার জন্য জীবকুলের উঠেছে নাভিশ্বাস। চাষিরা চাষের ক্ষেতে জল দিতে পারছে না, গবাদি পশুরা না পাচ্ছে গা ডোবার জল। গ্রামের মেয়েদের কাছে নদীটা হল সই। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা চিরকালের বন্ধু। নদীর বুকে জল না থাকায় সে বন্ধুত্ব কবেই শেষ হয়ে গেছে। পোয়াতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি।
তবু শীলাবতী শীলাবতীই। অনেক সুখ-দু:খের সাথি হয়ে সে যুগের পর যুগ বয়ে চলেছে। অনেক ইতিহাস সে সৃষ্টি করেছে। আরও অনেক যুগ নিশ্চয় বয়ে যাবে। ভবিষ্যতে আরও অনেক নতুন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। জনশ্রুতি অনুযায়ী শূদ্র কন্যা শীলাবতী অনেক পথ অতিক্রম করে, অনেক ঘাট পেরিয়ে একদিন গঙ্গার স্রোতে মিলিত হয়েছিল। এই ইতিহাস এতটাই দীর্ঘ তাকে সম্যকভাবে তুলে ধরার কাজটা রীতিমতো কঠিন ও দুরূহ। তবু চেষ্টা করেছি, তবে তা অতি সামান্যই, নিতান্তই নগণ্য। আগামীদিনে হয়তো আরও কেউ কেউ এগিয়ে আসবেন শীলাবতী অববাহিকার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে পূর্ণরূপে তুলে ধরার মহান দায়িত্ব নিয়ে-তাদের জন্য আগাম শুভেচ্ছা রইল আমার।
|| সমাপ্ত ||
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
॥ আজ শেষপর্ব॥
শীলাবতী অববাহিকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকারী এরকমই আর একটি মেলা হল ভেদুয়া গ্রামের ভেদুয়াসিনির মেলা। সন্ধিপুর থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম উত্তরবিল ও ভেদুয়া গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে এই মেলাটি বসে। হিন্দুদের দেবতা কিন্তু মেলাটির যাবতীয় আয়োজন করে এই দুই গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়। ভেদুয়াসিনি বনদেবী। এর পুজো করেন নেকড়াইশোল গ্রামের লায়েক সম্প্রদায়। কিন্তু মেলাটি পরিচালনা করেন মুসলমান ভাইয়েরা। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলাটি বসে, চলে তিন-চারদিন ধরে। হিন্দুর দেবতাকে মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করছেন মুসলমানেরা। যা শীলাবতী অববাহিকাকে মহিমান্বিত করেছে। এরকমই আর একটি চিত্র দেখি শীলাবতী নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে রঘুনাথপুর গ্রামে। এখানে মুসলমানের পীরকে রক্ষা করছেন হিন্দু ভাইয়েরা। যা এক অনন্য নজির। শীলাবতী অববাহিকাতেই বুঝি এমন দৃষ্টান্ত মেলে।
শীলাবতী অববাহিকার ভৌগোলিক অবস্থান যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনই এর গতিবিধিও অত্যন্ত বিচিত্রতায় ভরা। বলা যেতে পারে আশ্চর্য রকমের সুন্দর। এই নদীর প্রচুর বাঁক। আর প্রতি বাঁকে বাঁকে গড়ে উঠেছে জনপদ এবং সেখানেই রয়েছে সেই এলাকার মানুষজনের গড়ে ওঠা কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। কালের স্রোতে অনেক এলাকাই নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে ভাঙাগড়ার খেলা খেলতে সে এগিয়ে চলেছে। বয়স্ক এবং প্রবীণ মানুষদের মুখে শুনেছি এখনকার যে শীলাবতী আমরা দেখছি অন্য পাশ দিয়ে বয়ে যেত। একদিক ভেঙেছে, অন্যদিক গড়েছে। কোথাও আবার ভাঙন হয়েছে দু’দিকেই। ফলে চাষযোগ্য জমিও অনেক শীলাবতীর গর্ভে তলিয়ে গেছে। গড়বেতা এলাকায় এই নদী যতখানি চওড়া-যত পূর্বদিকে অর্থাত্ ঘাটালের দিকে এগিয়ে গেছে তত তার প্রসারতা কমেছে। চন্দ্রকোণা-ঘাটাল সড়কে বাঁকার কাছে এই নদী যথেষ্টভাবেই সরু। তাই বলে বর্ষাকালে এর বিধ্বংসী রূপ কম নয়। ভরা বর্ষায় সে বীভত্সল রকমের ভয়ঙ্করী চেহারা
নেয়। ঘাটালের যে নতুন বাসস্ট্যান্ড তা প্রায় শীলাবতী নদীর পাড় ঘেঁষেই। এখানকার শীলাবতীতে জোয়ার আসে। স্বাভাবিকভাবেই ঘাটালের শিল্প-সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি শীলাবতীকে কেন্দ্র করেই। গড়বেতার গনগনি ডাঙা যেমন শীলাবতী তীরবর্তী একটি উল্লেখযোগ্য স্থান, তেমনি ঘাটালেও একেবারে শীলাবতী নদীর উপরে একটি দর্শনীয় বস্তু আছে তা হল
‘ভাসাপোল’। এই ভাসাপোল এখানকার যোগাযোগের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আগেই বলেছি ঘাটাল একটি বন্যাপ্রবণ এলাকা। শীলাবতীর বন্যায় প্রায় প্রতি বছর প্লাবিত হয়ে পড়ে। শীলাবতীর বুকে অবস্থিত এই ভাসাপোলটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ভাসাপোল কখনো ডুবে যায় না। শীলাবতীর জল যত বাড়ে ভাসাপোলও তত উপর দিকে উঠতে থাকে। যার ফলে লোকজনের পারাপার হতে অসুবিধা হয় না। ঘাটাল শহরের দু’প্রান্তকে সংযোগ স্থাপনে রক্ষা করে চলেছে এই ভাসাপোল। কতকগুলি নৌকাকে এক করে তার উপর পাটাতন দিয়ে তৈরি এই ভাসাপোল। আর সবসময় জলের উপর এই পোল ভেসে থাকে বলে এর নাম হয়েছে ভাসাপোল। এটি ঘাটাল শহরের একটি ঐতিহ্য।
শুধু ঘাটাল কেন-কোমরপুর, দেউলবেড়িয়া, ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোণা সব এলাকাগুলিই শীলাবতী অববাহিকায়। চন্দ্রকোণার রাজা চন্দ্রকেতুর সঙ্গে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজার সন্ধি স্থাপিত হয়েছিল সন্ধিপুর গ্রামে-যা শীলাবতী অববাহিকায়। এরকম অজস্র ঘটনার নীরব সাক্ষী শীলাবতী নদী। যে কোনো নদী সেই এলাকার জনমানসে বিরাট একটা ছাপ ফেলে। শীলাবতীও তার ব্যতিক্রম নয়। এলাকার গ্রাম-শহর-নগর জীবনের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। জড়িয়ে গেছে মানুষের সুখ-দু:খে। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের সৃষ্টির অনবদ্য উপাদান হয়ে উঠেছে। এই প্রবন্ধের লেখকেরও অনেক গল্প, উপন্যাস ও কবিতার উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে এই শীলাবতী নদী। এই লেখকের সেরকমই একটি কবিতা হল -
শীলাবতী
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
আমাদের শীলাবতী প্রিয় ছোটো নদী
কুলুকুলু রব তুলে বয় নিরবধি।
বোশেখ মাসেতে দেখি হাঁটু ভরা জল
তার’পরে খেলা করে শিশুরা সকল।
শ্রাবণে সে ফেঁপে ওঠে, ডেকে আনে বান
ঘোলাজল স্রোতবুকে গেয়ে যায় গান।
ছোটো ছোটো ডিঙাগুলি ফিরে পায় প্রাণ
ভাটিয়ালি সুর বাঁধে গাঁয়ের কিষাণ।
শরতের কাশফুল হাসে দুই তীরে
তার সে মধুর ছায়া দোল খায় নীরে।
অপরূপ সেই ছবি, কী অসাধারণ!
দেখে মন ভরে যায়, জুড়ায় নয়ন।
ফাগুনে চাঁদের হাসি পড়ে বালুচরে
যেন সোনা রাশরাশ আলো মেখে ঝরে।
বাতাসের সাথে কথা করে কানাকানি
কত কথা, কী যে কথা কী জানি কী জানি!
সে যে বড়ো আমাদের আপনার জন
সুখেদুখে মিশে আছে মায়ের মতন।
মধুর পরশ পাই তার কাছে গেলে
এমন শান্তি কোথাও আর নাহি মেলে।
১৮
যে শীলাবতীকে নিয়ে আমাদের এত গর্ব, এত অহঙ্কার সেই শীলাবতীর বর্তমান রূপ কেমন? কেমন আছে আমাদের সাধের শীলাবতী? উত্তরে বলতে হয় শীলাবতীর বর্তমান অবস্থা মোটেই ভালো নয়। সে ভালো নেই। একসময় যে শীলাবতী রীতিমতো প্রাণচঞ্চলা ছিল, বেগবতী ছিল সে আজ কেমন যেন নিষ্প্রাণ, স্রোতহীন। বর্ষার ক’মাস ছাড়া শীলাবতীর বুকে এখন আর জল গড়ায় না। বছরের ছ’মাস জল থাকে, ছ’মাস জল থাকে না। বলা যেতে পারে শীলাবতী এখন বন্ধ্যাদশা লাভ করেছে। আর এই বন্ধ্যাদশা যত সময় যাচ্ছে তত প্রকট হচ্ছে। কোনো কোনো বছর ভরা শ্রাবণেও শীলাবতী খরা থাকে। বুকে তার এক ফোঁটা জল গড়ায় না। যাকে বলে একেবারে শুকনো-খটখটে। বুকে তার শুধু ধূ ধূ সাদা বালুকরাশি। শীলাবতী রীতিমতো মজে গেছে। একসময় এই শীলাবতী নদী থেকে প্রচুর সুস্বাদু মাছ মিলত। অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করত এই শীলাবতী থেকে মাছ ধরে। আজ সেই সব যেন ইতিহাস হতে চলেছে। সারা বছর যদি নদীতে জলই না থাকল তবে মাছ জন্মাবে কী করে? শুধু মাছ কেন? বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপের অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত। ‘মাছরাঙা ঝুপ করে’ আর জলে এসে পড়ছে না। হাঁসের দল চরে বেড়াচ্ছে না, পানকৌড়ি ডুবসাঁতার দিচ্ছে না। এককথায় নদীটার পুরো পরিবেশ এবং তার ইকোসিস্টেমটাই গেছে বদলে। যা আমাদেরকে এক চরম সর্বনাশের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে শিহরিত করছে।
শীলাবতীর এই বন্ধ্যাদশার জন্য জীবকুলের উঠেছে নাভিশ্বাস। চাষিরা চাষের ক্ষেতে জল দিতে পারছে না, গবাদি পশুরা না পাচ্ছে গা ডোবার জল। গ্রামের মেয়েদের কাছে নদীটা হল সই। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা চিরকালের বন্ধু। নদীর বুকে জল না থাকায় সে বন্ধুত্ব কবেই শেষ হয়ে গেছে। পোয়াতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি।
তবু শীলাবতী শীলাবতীই। অনেক সুখ-দু:খের সাথি হয়ে সে যুগের পর যুগ বয়ে চলেছে। অনেক ইতিহাস সে সৃষ্টি করেছে। আরও অনেক যুগ নিশ্চয় বয়ে যাবে। ভবিষ্যতে আরও অনেক নতুন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। জনশ্রুতি অনুযায়ী শূদ্র কন্যা শীলাবতী অনেক পথ অতিক্রম করে, অনেক ঘাট পেরিয়ে একদিন গঙ্গার স্রোতে মিলিত হয়েছিল। এই ইতিহাস এতটাই দীর্ঘ তাকে সম্যকভাবে তুলে ধরার কাজটা রীতিমতো কঠিন ও দুরূহ। তবু চেষ্টা করেছি, তবে তা অতি সামান্যই, নিতান্তই নগণ্য। আগামীদিনে হয়তো আরও কেউ কেউ এগিয়ে আসবেন শীলাবতী অববাহিকার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে পূর্ণরূপে তুলে ধরার মহান দায়িত্ব নিয়ে-তাদের জন্য আগাম শুভেচ্ছা রইল আমার।
|| সমাপ্ত ||
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন