মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

স্মৃতি কথা || নীলাঞ্জন কুমার || এই আমি চরিত্র ৩

স্মৃতি কথা । নীলাঞ্জন কুমার


                   এই আমি চরিত্র


                             

                          ।। ৩ ।।

                 ( গত মাসের পর )



বোধ বিষয়টি  বেশ রহস্যজনক । কোন মানুষের জন্মের পর তার কখন প্রকৃত বোধ আসবে তা কারো পক্ষে জানা অসম্ভব  , কারণ আমার জন্মের পর  প্রায় তিন বছর অবধি কোন বোধ না থাকায় বাবা মা দাদা দিদিদের সঙ্গে বোধের মধ্যে দিয়ে পরিচিত হতে হয়  ওই তিন বছর পরেই । জন্মের প্রথম তিন বছর আমি কি কি  করেছিলাম তার সামান্য পরিচয় পেয়েছিলাম বোধের পর মায়ের স্মৃতিচারণ ও স্রেফ কিছু ফোটোর মাধ্যমে । আমাদের   বাবা মা  যে প্রকৃত বাবা মা তাও জানতে হয় আমার জন্মগত ভাবে পাওয়া পরিবারের ভেতর দিয়ে । আর আশ্চর্য তাকে মেনেও নিই!  এর একমাত্র কারণ বাবা মায়ের আচরণ , যা আমাকে ভেতর থেকে বুঝতে বাধ্য করেছে এঁরা আমার জন্মদাতা দম্পতি । ১৯৫৯ সালের ১০ জানুয়ারি  (  সার্টিফিকেটে তাই পাওয়া যাচ্ছে) এই আমি চরিত্রটি পৃথিবীতে আসায় যে জন্ম হয়েছিল তার থেকে অনেক অনেক বেশি বড় মনে করি  যে দিন আমার বোধের জন্ম হয়েছিল । কার্যত বোধের যৌক্তিক দিক দিয়ে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম বাবা মা দাদা দিদি রূপে চরিত্রদের,  সেদিন থেকে আজ অবধি স্মৃতি আমার সঙ্গে আশ্চর্যজনক ভাবে জাগ্রত । যখন বোধ আসে তখন দেখেছিলাম এক লম্বা মতো কিশোর সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাচ্ছে,দুটি মেয়ে কি বলাবলি করছে,  আমার প্রথমে যে বিস্ময় মাখানো প্রশ্ন উঠে আসে,   এরা কে ?  এরপরে এক মহিলা এসে আমায় কোলে নেয় । তাকে আমি নিশ্চিন্তে জড়িয়ে ধরি। আর এক পুরুষের সঙ্গে পরিচিত হই সন্ধ্যায়। আমি বোধের চোখ দিয়ে দেখেছিলাম আমার মা বাবা দাদা দিদি । ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমরা মেদিনীপুর শহরের মীর বাজার এলাকায় হাতিশালার গলির ভেতরে একটি
একতলা বাড়িতে বসবাস করি । এই বাড়িতে স্বামী  , স্ত্রী ও চার ছেলে মেয়ে নিয়ে তমলুক শহরের  থেকে এসে কায়ক্লেশে দিনগুজরান করছেন । বাবার সংসারের প্রতি কিছু উদাসীনতা নিরন্তর যাত্রা থিয়েটারের প্রতি আকর্ষণ বাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিবেশ থাকলেও,  অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সামান্য একজন সরকারি কনিষ্ঠ কেরানির সংসার চালানোর জন্য গৃহকর্ত্রীর প্রাণপাত প্রত্যক্ষ করেছি।
        বোধের পর আমি জানতে পেরেছিলাম মানুষকে চেনা ও মনে করার জন্য নামের প্রয়োজন হয় । এই নাম বিষয়টি বেশ ধাঁধালো , যার নামকরণ হচ্ছে  নাবালকত্বের কারণে তার মতামতের কোন প্রয়োজন থাকে না ।  জন্মের মাস ছয়েক পর অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে পরিবার পরিজন মিলে শিশুটির ওপর একটি ' ভালো নাম ' দাগিয়ে দেয়।পরে তা সরকারি ভাবে খোদিত হয় ও আজীবন ইচ্ছে নয়তো  অনিচ্ছেয়  তাকে বয়ে বেড়াতে হয় । যদিও  নাম পরিবর্তনেরআইন আছে , তবু  ' বাপ মায়ের দেওয়া '  নামের সংস্কার নিয়ে অনেকেই পরিবর্তন করেন না । সেরকম আমারওএকটা ভালো নাম হয়েছিল,  দাদার নাম অশোক- এর মিল রেখে ' অন্ঞ্জন ' । এছাড়া বাড়ির সব থেকে ছোট হওয়ার কারণে বেশ কিছু ডাক নাম জুটেছিল । মামার বাড়ি থেকে ' টোটোন ' , বাবার দেওয়া   আদরের নাম 'বাঘা ' , মায়ের ' খোকন ' ও' বাপি ' । পরবর্তীতে একটি ডাক নাম সকলের কাছে প্রিয় হয়ে গেল ' বাপি '।
            এতগুলো নামধারী কিউট বাচ্চাটি  জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে যখন পৃথিবী দেখছে তখন সে খুঁজে পাচ্ছে বৃষ্টির সময় ভাড়া বাড়ির ছাদ থেকে জল পড়া । সকালে উঠে বাবার বাজার যাওয়া,  এরপর বাড়ি এসে  ভেজানো ছোলা বাদাম খেয়ে ডন বৈঠক আসন ও বারবেল  ভাঁজা , তারপর সাইকেল হাওয়া দেওয়া,  স্নান ও ঠাকুর প্রণাম,  ভাত খেয়ে ধুতি পান্ঞ্জাবী পরে  অফিস যাওয়া ।   দাদার মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে  এইটের ক্লাস করতে যাওয়া ও বিকেলে ফেরা,  দুই দিদি  ( বড়- র নাম কৃষ্ণা , ছোট-র কাবেরী,  দুজনেই বর্তমানে প্রয়াতা ) পড়তে যেত অলিগন্ঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। আমি প্রায় সময়  পৌঁছে যেতাম টলোমলো পায়ে বাড়িওলা গনেশ চাবড়ীর বাড়ি ।  একই কম্পাউন্ডের মধ্যে সব ।  মা আমাকে গনেশ দাদুন বলতে শিখিয়েছিল। দাদুনের ছিল মীরবাজারের বাজারের ভেতরে মুদির দোকান । পরে  ওঁনার ছেলে বাদল কাকু  দোকানটি চালান । তাছাড়া তাঁর দুই মেয়ে যাদের আমি পিসি বলতাম তারা তখনই ছিলেন বিবাহিতা। দিদিমাও আমায় ভীষণ ভালোবাসতো । বেশ সুন্দর এক সাহচর্য গড়ে উঠেছিল আমাদের ওই পরিবারের সঙ্গে । মনে আছে পৌষ সংক্রান্তির দিনে দাদুন আমাদের কাঁসাই নদীর  ধারে মেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন ।  তিনি প্রত্যেক ভিখিরিকে পয়সা দিতেন কখনো দিদিদের কখনো আমার হাত দিয়ে । আমাদের সে কি আনন্দ!  পৌষসংক্রান্তির মেলা মেদিনীপুরের এক বিশেষ মেলা । প্রতি বাড়িতে যেন মহোৎসব!  পাড়ায় পাড়ায় পিঠে পুলির গন্ধে ম ম আর ঘুড়িতে আকাশ ঢেকে যাওয়ার নতুন বোধ এই আমি চরিত্রের কাছে বিশেষ অভিজ্ঞতা ।এই দিন মা দিদিদের লেগে পড়তে দেখেছি পিঠেপুলির আয়োজনে । সকালে মা কুরে রাখতো চার পাঁচটি নারকেল আর গমকল থেকে ভাঙানো হত চালের গুঁড়ো । গমকলে ওই সময় দিন দশেক শুধু ভাঙানো হত চালগুঁড়ি ।খেজুর গুড়ের সঙ্গে সেই নারকেল কোরা গরম করে পুর তৈরি করে আমরা লেগে পড়তাম পিঠে উৎসবে। রাতে সামান্য পিঠে খেয়ে সকালে সবাই মিলে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে খেতে বসতাম খেজুর গুড় দিয়ে  সেদ্ধ পিঠে,  দুধেগুড়ে , পায়েস পিঠে ।  রাতে পিঠে করার সময় মা বাবাকে সাবধান করে দিত , কারণ বাবা পিঠে নষ্ট করে দেওয়ার মন্ত্র জানতো। বাবার কাছে শুনেছি,  বাবা তমলুকে মন্ত্রবলে  অনেকেরই বাড়ির পিঠে নষ্ট করে কুকৃর্তি বাঁধিয়েছিল ।

                                        (  ক্রমশ)

২টি মন্তব্য:

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...