ডুয়ার্স ভূমির কথন।। পর্ব ছয়। নিলয় মিত্র
"বাহা"সাঁওতাল জনজীবনে অতি পবিত্র ধর্মীয় উৎসব।বাহা বসন্ত ঋতুর উৎসব।এই
উৎসবের না হওয়া পর্যন্ত এই
সম্প্রদায়ের মানুষেরা মহুয়া ফুল খায়না।মেয়েরা মাথায় শাল ফুল পড়েনা।প্রকৃত পক্ষে
শাল গাছের প্রতি স্রোধ্যা জানানোর উদ্যেশেই তাদের এই উৎসব হয়ে থাকে।
জাহের এরা পূজার থানে নির্দিষ্ট জায়গাতেই আয়োজন
করা হয় এই পূজা উৎসবের। এই উপলক্ষে জাহের থানে শাল খুঁটি দিয়ে অন্যান্য দেবতার প্রতীক হিসেবে ছোট
ছোট কয়েকটি চালাঘর তৈরি
করেন।সাধারণত যুবক ছেলেরাই জংগল শাল গাছ কেটে আনে এবং চালাঘর তৈরি করতে সহযোগিতা করে
চালাঘর তৈরির পুর পুরোহিত বা নায়েক পূজার জায়গাটিকে পরিষকার পরিছন্ন করেন।গোবর দিয়ে পুজোর জায়গাটি নিকানো হয়।চালের গুঁড়ো দিয়ে পুজোর জায়গায় আল্পনা দেওয়া হয়।
এই বাহা পুজো উৎসব উপলক্ষে পুরোহিতকে কিছু নিয়মকানুন অবশ্যই পালন করতে হয়।পূজার পূর্বরাত্রে তিনি মাটিতে শয়ন করেন। মাদুর কিংবা খাটিয়াতে শয়ন
করেননা।স্নান করে নতুন কলসিতে জল আনতে হয় পূজার জন্য।পূজার জন্য দেবতার আসন প্রস্তুত করেন।
পূজার উপকরণ হিসেবে ফল মূল ও পূজার নানা সামগ্রী তিনি কুলোতে সাজিয়ে রাখেন।শিকারের অস্ত্রে সিঁদুর মাখিয়ে রাখেন।এইসব কাজে
পুরোহিতকে সহযোগিতা করার জন্য অবশ্যই ও-বিবাহিত সাঁওতাল যুবক থাকে। পূজা উপলক্ষে পুরোহিত বা নায়েককে বাড়ি থেকে সবাই মিলে গান করতে করতে পূজা স্থানে নিয়ে যায়।
জাহের স্থানে পুরোহিত মন্ত্র
পাঠ সহ দেবতার স্মরণ করেন। পূজা আরম্ভের প্রথমে
মহুয়ার নির্মাল্য দেওয়া হয়।পুজোতে মোরগ উৎসর্গ কোরার রীতি আছে।দেবতাদের রক্ত পান করতে
দেওয়া হয়।পুরোহিত দেবতাদের কাছে গ্রামের সকলের কল্যাণের জন্য আবেদন জানান।পূজা শেষে
পূজার উৎসর্গীকৃত পশু পাখির মাংস দিয়ে খিচুরি তৈরী হয়।উপস্থিত সবাই প্রসাদ গ্রহণ করেন।পূজা শেষে পূজার জায়গা জল দিয়ে ধুয়ে পরিষকার করা হয়।জাহের থানে পূজার কাজ
শেষ করার পর পুরোহিত বা
নায়েক কলোতে করে ফুল নিয়ে প্রত্যেক বাড়িতে বিতরণ
করেন।এই সময় গ্রামের মেয়ে বউরা পুরোহিতের পা ধুয়ে তেল মাখিয়ে দেন এবং পুরোহিতের কাছ থেকে শাল ফুল গ্রহন করেন।এরপর থেকেই সেই বছরের জন্য মেয়েরা শাল ফুল ব্যবহার করতে পারেন।সবাই আনন্দে
মেতে ওঠে।পুরোহিতের বাড়িতে নৃত্য গীত হয়।ছেলেরা
মাদল বজায়, মেয়েরা নৃত্যে অংশ নেয়।এই ভাবেই তারা পবিত্র শাল গাছের উদ্যেশ্যে
"বাহা" উৎসব পালন করেন। শাল গাছকে তারা সত্য সনধানী হিসেবে সম্মান করেন।গ্রামের প্রান্তে শাল গাছ কে কেন্দ্র করে তাদের জাহের থান তৈরি হয়।বাহা
উৎসবের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সাধারণত দু দিন ব্যাপী
পালিত হয় এই বাহা উৎসব
পূজা।প্রথম দিনে স্নান,দ্বিতীয় দিনে শাল কুঞ্জের জাহের থানের প্রকৃতি দেবী,জাহের এরা-র প্রতি অর্ঘ দান।এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই গ্রামের
ছেলে মেয়েরা পরস্পরের গায়ে জল ছিটায়।জল ছিটানোর মধ্য দিয়ে পূর্বের সব মনঃক্ষুণ্ণতা মিটে যায়।ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে
আনন্দে মেতে ওঠেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন