সবাই মিলে সিনেমা হলে ( ১৮)
কান্তিরঞ্জন দে
সাহিত্য এবং / অথবা সিনেমা
আগেই বলেছি , বাংলায় সাহিত্য এবং সিনেমা এই দুটো শিল্প মাধ্যমে আজও কিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে । এর কারণ , বাংলা সংস্কৃতির সংসারে সাহিত্য হল বড় ভাই এবং সিনেমা মাধ্যম তার অনুজ । তাই এই দুই মাধ্যমের সম্পর্কটি বুঝতে অনেকেই ভুল করেন ।
প্রথমেই বুঝতে হবে যে সিনেমা প্রয়োজনে সাহিত্য থেকে গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি উপকরণ হিসেবে নেয় ঠিকই , তবে সাহিত্যকে অনুসরণ কিংবা অনুকরণ করবার কোনও দায় সিনেমার নেই । দুটো সম্পূর্ণ আলাদা শিল্প মাধ্যম । দুটোর প্রকাশ রীতি একেবারেই আলাদা । একটা যদি আপেল হয় , অন্যটি কমলালেবু । দুটোই রসালো ফল । ব্যস্ , দুজনের মধ্যে মিল বলতে এটুকুই । আর কিছু নয় ।
সত্যজিৎ রায়ের " পথের পাঁচালী " বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিত্র রূপান্তর মাত্র । হুবহু চিত্র অনুবাদ কখনোই নয় । পথের পাঁচালী প্রায় চারশো পাতার উপন্যাস । অসংখ্য চরিত্র এবং অসংখ্য ঘটনা মিলিয়ে এক মহৎ সাহিত্যকর্ম। " আম আঁটির ভেঁপু " সিগনেট প্রেস প্রকাশিত তারই এক কিশোর পাঠ্য সংক্ষিপ্ত সংস্করণ । সেটিও মাত্র দেড়শো পাতা আয়তনের হলেও তাতেও প্রচুর চরিত্র এবং ঘটনা ।
সত্যজিৎ রায় ওই আম আঁটির ভেঁপু থেকেই সিনেমার জন্য প্রয়োজনীয় চরিত্র এবং ঘটনাগুলোকে সিনেমার উপযোগী করে সাজিয়ে সিনেমার নিজস্ব উপস্থাপন রীতির ব্যাকরণ মেনে পর্দায় হাজির করেছিলেন । উপন্যাসে ইন্দির ঠাকরুণ মারা যান , উপন্যাস শুরুর কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যেই । সত্যজিৎ রায় সিনেমার প্রয়োজনে ( বলা ভালো , সিনেমার নাটকীয়তার প্রয়োজনে ) এই চরিত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখেন আরও বেশ কিছুক্ষণ । এইরকম টুকিটাকি পরিবর্তন সিনেমাটিতে আরও বেশ কিছু ছিল ।
১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট পথের পাঁচালী রিলিজ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে সময় সিনেমার বৈশিষ্ট্য না বোঝা বেশ কিছু সাহিত্য প্রেমিক হৈ চৈ বাঁধিয়ে বসেছিলেন । তাদের অভিযোগ----- সত্যজিৎ পথের পাঁচালীকে বিকৃত করেছেন । ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ রায় যখন রবীন্দ্রনাথের বড় গল্প " নষ্টনীড়" থেকে চারুলতা নির্মাণ তখন তো হৈ হট্টগোল একেবারে তুঙ্গে উঠেছিল । পরিচয় পত্রিকায় লম্বা চিঠি লিখে সত্যজিৎবাবুকে প্রায় পাখি পড়ার মতো করে ব্যাখা করতে হয়েছিল যে , সিনেমায় মূল গল্প কি কি অদলবদল জরুরী ছিল এবং কেন সেগুলো জরুরী ছিল ।
সত্যজিৎ রায় ছাড়াও বাংলার আরও অনেক পরিচালকদের ছবি নিয়েও বিশুদ্ধ সাহিত্য প্রেমিকেরা বিভিন্ন সময়েই আপত্তি তুলতেন । আজকাল অবশ্য এ ব্যাপারটা একটু কমেছে ।
তবুও বলব , আজও বাংলায় সিনেমা মাধ্যমের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য গুলো উপলব্ধি করবার লোক যথেষ্ট কম । বাংলায় সাহিত্য নির্ভর সিনেমা বানানোটাই অনেকটা কমে গেছে । সে কারণেই হয়তো চ্যাঁচামেচিটা কমেছে । যথার্থ সিনেমা রসিক ও বোদ্ধার সংখ্যা খুব একটা যে বেড়েছে , এমন কথা বলা মুস্কিল ।
সাহিত্য নির্ভরতা ছিল , বাংলা সিনেমার পক্ষে সে-ও একরকমের ভালো ছিল । এখন তো সিনেমার নামে বাংলা সিনেমায় বাইরের চাকচিক্যের দিকে যতটা নজর দেওয়া হয় , বিষয়ের গভীরতার দিকে ততটা নজর দেওয়া হয় কি ?
পশ্চিমবঙ্গের ( এবং সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশেরও ) বাংলা সিনেমার নিজস্ব ভাষা খুঁজে নিয়ে , নিজের পায়ে দাঁড়াতে যথেষ্ট দেরি আছে । কত দেরি ? বলা খুব মুস্কিল ।
সব কিছু দেখে শুনে মনে হয় , বর্তমান যুগের বাংলা সিনেমা সাহিত্যের হাত ছেড়ে একসময় পেছন দিকে হাঁটা শুরু করেছিল । ইদানীং আবার সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ।
সামনে এগোচ্ছে কি ? সে কথা জোর বলা খুব মুস্কিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন