সবাই মিলে সিনেমা হলে~ ২০
কান্তিরঞ্জন দে
সিনেমায় উৎসব।। উৎসবের সিনেমা
উৎসবের মরশুম এখনও চলছে । তাই সিনেমায় বাঙালির পুজো- পার্বণ, উৎসব কিভাবে এসেছে সে নিয়ে আরও দু- চার কথা বলাই যায় ।
১৯১৯-এ প্রথম বাংলা পূর্ণাঙ্গ কাহিনীচিত্রের জন্ম । আর এই সময় থেকেই বাংলা ( এবং ভারতীয় ) সিনেমা ধর্মভিত্তিক গল্প এ পুজো- পার্বণ , বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব এবং লোক কাহিনী , পুরাণ ও পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে সিনেমা বানানোর রমরমা বাড়তে থাকে । এর কারণ কি ? কারণটা খুব সোজা ।
১) এই সব গল্প নিয়ে ছবি বানালে দর্শকদের ছবির গল্পটা জানা থাকে । ফলে , দর্শককে চট করে সিনেমা হলে টেনে আনা যাবে । ২) ধর্ম এবং ধর্মীয় গল্প বাঙালি ( এবং ভারতীয় ) জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে দর্শক মহলে সিনেমাগুলি দেখার একটা আগ্রহ সবয়সময়েই থাকবে । ৩) সিনেমায় গল্প বলার ক্ষেত্রে আবেগ একটা বড় উপাদান । আর ধর্মীয় গল্পগুলোতে আবেগের ঘনঘটার কোনও খামতি নেই । সুতরাং গল্পে একটা নাটকীয়তা তৈরি করা তুলনামূলকভাবে সহজ । ৪) সিনেমায় মানুষ বিস্মিত হতে ভালোবাসে । আজও সিনেমায় কোনও এক রকমের চমক থাকলে দর্শকের দৃষ্টি চট করে আকর্ষণ করা সহজ হয় । সেদিক থেকে ধর্মীয় এবং পৌরাণিক কাহিনীগুলো একেবারে আইডিয়াল । সিনেমার আদিকালে , সেই দুর্বল কারিগরির যুগেও পর্দায় চমক লাগানো নানারকম কারিকুরি ( আজকালকার ভাষায়, যাকে বলে স্পেশাল এফেক্টস্ ) দেখানোর অঢেল সুযোগ পাওয়া যায় । যেমন---- রাম রাবণের যুদ্ধে তীর ছোঁড়াছুড়ি , কিংবা দেবদেবীর অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড ।
ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলা ( এবং ভারতীয় ) সিনেমায় দেবী দুর্গা , মা- কালী , মা লক্ষ্মী , শ্রীকৃষ্ণ , মহাদেব- শিব, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে অজস্র সিনেমা তৈরি হতো । আজকাল পৌরাণিক সিনেমার ধারা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়লেও , একেবারে অবলুপ্ত হয়ে গেছে , এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না ।
আগেই বলেছি , সিনেমা দেখা ব্যাপারটা নিজেই একটা উৎসবের সমান । ফলে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সিনেমা বানালে ভক্ত দর্শকদের আনুকূল্যে সে সমস্ত ছবি বক্স অফিসে রমরমিয়ে চলত । প্রযোজকের নিশ্চিত মুনাফা , আর পরিচালকের মানসিক শান্তি নিশ্চিত জুটে যেত । এই ধরণের ছবিগুলো হলে রিলিজ হতো মূলত উৎসবের মরশুমেই । সিনেমা হয়ে উঠত উৎসবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
উৎসবের সময় লোকের হাতে দু-চারপয়সা বেশি থাকে । ফলে এই ধরণের ছবি দেখাটা অধিকাংশ দর্শকের কাছে উৎসব উদযাপনের জরুরী অংশ হয়ে উঠত ।
বেশি দূরে যাবার দরকার নেই। সত্যজিৎ রায় সহ বহু বিখ্যাত পরিচালকই খ্যাতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবার পরেও চাইতেন , তাদের সিনেমাগুলো যেন পুজোর সময়ে হলে রিলিজ করে । তাহলে দর্শক সংখ্যা অনেক বেশি বেশি করে পাওয়া যাবে ।
বাংলায় উৎসবের মরশুম ভাদ্র- আশ্বিন মাসে , শরৎকালে দূর্গাপুজোর সময় শুরু হয়। চলে একেবারে সেই ইংরিজি নতুন বছর পেরিয়ে সেই দোল- উৎসব পর্যন্ত । এই সময় শরৎ- হেমন্ত- শীত- বসন্ত কাল পর্যন্ত আবহাওয়াও থাকে অত্যন্ত চমৎকার । ফলে মানুষের মেজাজ মর্জি এই সময় অনেকটা হাল্কা থাকে
সে কারণেই , আজও বাংলা সিনেমার ছোটবড়ো নির্বিশেষে সমস্ত প্রযোজক , ডিস্ট্রিবিউটর এবং হল মালিকেরা চান , তাদের ছবিগুলো যেন এই উৎসবের মরশুমেই রিলিজ করে ।
সে কারণেই , একদা বাংলাভাষায় দূর্গা , লক্ষ্মী , কালী , কৃষ্ণ , রামকৃষ্ণ , শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে অজস্র , অসংখ্য সিনেমা তৈরি হয়েছে । ভক্তিমান দর্শক আনন্দ পেয়েছেন । প্রযোজক লাভের কড়ি ঘরে তুলেছেন । বাংলা ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রি সচ্ছলতার মুখ দেখেছে ।
এতে কি ইণ্ডাস্ট্রি সচল থাকলেও এর ফলে বাংলা সিনেমা কি সমৃদ্ধ হয়েছে ?? রুচিশীল , সংবেদনশীল , শিক্ষিত বাঙালি এ প্রশ্ন তুলতেই পারেন । এক কথায় এর উত্তর হল----- না । কারণ , সিনেমা এই অলৌকিক ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ছবি করতে গিয়ে অনেক সময়েই তার স্বধর্ম থেকে চ্যূত হয়েছে । এমন কি , অনেক সময় সে রুচিসম্পন্ন সাহিত্য থেকেও অনেকটা দূরে সরে গেছে ।
আমরা সাহিত্য এবং সিনেমার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে বলতে উৎসব প্রসঙ্গে চলে এসেছিলাম । আগামী সপ্তাহে আবার সিনেমা ও সাহিত্য বিষয়ে ফিরে যাবার ইচ্ছে আছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন