স্মৃতি কথা
এই আমি চরিত্র
নীলাঞ্জন কুমার
( গত মাসের পর)
বোধ আসার পর বাবা নামক মানুষটিকে দেখেছি, তার ভেতরে কিছু প্রগতিশীলতা থাকলেও , কিন্তু বেশ রক্ষণশীলও ছিলো । পারিবারিক দিক থেকে তার যাতে যথেষ্ট মানমর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে তার জন্য সচেতনতা ছিলো প্রচুর । ভালো মনের মানুষটির দেখেছি এক বিশেষ জেদ ও যৎসামান্য বিষয় নিয়ে অহেতুক বদরাগ , যা প্রতিমাসে অন্তত একবার বাড়িতে তান্ডব চালাতো । ফলে বাড়িতে মা বাবার খাওয়াদাওয়া বন্ধ । দোষ না থাকলেও শেষে মাকে সব দোষ মেনে নিতে হত । ফলে মায়ের ক্ষমা প্রার্থনা, নাটকের ইতি । বাবা মেয়েদের বেশ কৌশল করে দমন করতেন। এটি সত্যি মায়ের অসামান্য সাঙ্গীতিক প্রতিভা থাকলেও বাবা সেদিকে ধ্যান দেয়নি । তবে বাবা কিছু বিষয়ে পরিস্কার ছিলো , যেমন খাওয়া দাওয়া বিষয়ে কার্পন্য ছিল না, মাকে নিয়ে যেতেন নিয়মিত সিনেমায় । বহু সিনেমায় গিয়েছি বাবা মায়ের সঙ্গে । মায়ের কোলে বসে দিব্য ঘুমোতাম। ওই সময় উওমকুমারের অভিনয় করা' শিউলি বাড়ি ' আর ' রাজদ্রোহী ' র প্রথমের কয়েকটি সিন এখনো মনে আছে । এই রাজ্যের প্রাচীন গ্রন্থাগার ঋষি রাজনারায়ণ লাইব্রেরিতে নিয়মিত বাবা বই পাল্টাতো , মাকে দেখেছি খুব তাড়াতাড়ি বই শেষ করতে । মায়ের জন্য বাবা ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি থেকেও বই আনতো । বাবা রবিবার অফিসের ছুটির দিনে বিকেলে আমায় সাইকেলের রডে বসিয়ে লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতো, কখনো সখনো বাবার পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে আমায় তারা আদরও করতো । রাজনারায়ণ লাইব্রেরির সঙ্গে বাচ্চাদের জন্য যে পার্ক এখনো আছে, সেই পার্কের দোলনায় বসিয়ে বাবা দোলদোল করে দোলাতো । রাতে বাবা নাটকের রিহার্সালে যেতো । রাত ন ' টা নাগাদ মা আমাকে আর ছোড়দিকে খাইয়ে গ্রামোফোনের গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত । তারপর একদম পরদিন সকাল ।
তমলুক নিয়ে ধ্যানধারণা না থাকলেও মায়ের কাছে যা গল্প শুনেছি আর বাবার ছবি তোলার সখের কারণে তা দেখে জেনেছি আমার তিন কাকা আর চার পিসি সম্পর্কে । রাঙা মানে সবচেয়ে ছোট পিসি আর বড় পিসি ছাড়া কোন পিসিকে আমি দেখিনি । কাকুদের দেখেছি কিন্তু বেশ বড় বেলাতে । যা বুঝেছিলাম, বাবা চাকরিতে বদলি নিয়ে মেদিনীপুর চলে এসেছিল দাদু ও কাকুদের সঙ্গে বিদ্বেষের কারণে । ছোট কাকা মাঝে মাঝে মেদিনীপুর আসতেন দেখা সাক্ষাত করতে । সেজকাকাকে মাত্র একটিবার দেখি তমলুকে একবার বাবার সঙ্গে হায়ার সেকেন্ডারির পর বেড়াতে গিয়ে । ওখানে কাকা হোটেল ব্যাবসা করতেন।
মেজকাকাকে দেখেছি দাদার বিয়ের সময় অর্থাৎ আমার যৌবনে । উনি ছোটবেলায় খুব ভালো ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন সেই সুবাদে রেলে চাকরি পেয়েছিলেন । মা বাবা খুব চাপা ছিলেন তমলুকের বিষয়ে, তবে তবুও জেনেছিলাম সেজ কাকার অসবর্ণ বিয়েকে কেন্দ্র করে বাবা কাকাদের পারিবারিক জটিলতার সূত্রপাত ।
মায়ের দিক থেকেও মামাবাড়ির ক্ষেত্রে তেমন যোগাযোগ দেখিনি, তবে বড়মামা মাঝেমধ্যে আসা যাওয়া করতো। হুগলির শেওড়াফুলিতে খালপাড়ের এক দেবোত্তর সম্পত্তিতে মায়েদের বসবাস ছিল । খুব ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম সে স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করছে । যেমন শীতকালে সামনের মাঠে রোদ পোয়ানো । বড়মামা মেজমামা র যৌথ সংসার তখনও বজায় ছিল । বলতে গেলে একমাত্র বড়মামার বড় ছেলে শুভ্র ( যাকে আমরা রুবুল বলে ডাকি) যে একমাত্র ওই বাড়িতে থাকে তার সঙ্গে হৃদ্যতা আছে, তাও ১৯৯৫ এর পর , যখন উত্তরপাড়ার ভাড়া বাড়িতে
বিয়ের পর বসবাস করছি । অবশ্য এই যোগাযোগের জন্য প্রধানত দায়ী আমার স্ত্রী হাসি । মামাবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগহীনতার কারণ বাবাকে সমুচিত সন্মান না দেওয়া । তাই একসময় মা বারো বছর শ্বশুরবাড়িমুখো হয়নি । এরফলে আমি পারিবারিক বৃত্তের মা বাবা দাদা দিদিদের মধ্যে বড় হতে থাকি ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন