প্রশ্নবিলাস
অর্হণা পূর্বা শইকীয়া
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সমস্যাটা বোধহয় পরিবর্তনকে স্বীকার করতে না পারাটা।বছরে একটা হলেও নির্ণায়ক মুহূর্ত থাকবেই।তবে তখনই সমস্যাটার সৃষ্টি হয়।ছোটো মগজটাতে যখন বড়ো বড়ো প্রশ্ন ঠেলা-ধাক্কা করে,আর কিছু না হলেও নিশ্চয় দার্শনিক হতে পারব বলে মনে মনে সান্ত্বনা লাভ করি।উত্তরের মুখ না দেখা পর্যন্ত মগজের দেওয়ালে আঘাত করতে থাকাটাই হল প্রশ্নের নিয়তি।কিন্তু কথাটা আমার একেবারেই ভালো লাগে না।এই প্রশ্নজনিত গম্ভীরতার সামনে যেন থলথলে মগজের ওজন কমিয়ে ভাসিয়ে রাখা ‘সেরিব্বি স্পাইনেল ফ্লুইড’এর প্লাবিতাও অসহায়।
‘সবসময় ঘরের ভেতর বসে থাকিস কেন?’-কলজেয় শেল বেঁধার মতো কণ্ঠে মা বলল-‘একটু টিভি দেখতে পারিস না?
‘দাঁড়াও তো কিছু একটা ভাবছি’-আমি প্রায় নিজের মনে বিড়বিড় করে বললাম।
কী আর এমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা ভাবতে থাকিস?’
‘উঃবাবা যা কণ্ঠস্বর’বলে আমি মনে মনে ভেবে খিলখিল করে হেসে ফেললাম।
মায়ের একটা বড়ো গুণ হল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা না করে চলে যাওয়াটা।প্রশ্নটা উত্থাপন করাই হয়তো তার কাছে একটা আনুষ্ঠানিকতা এবং দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অবকাশ পাওয়া মুহূর্ত।উত্তরের গুরুত্ব মায়ের স্বর্গসম জগতটাতে হয়তো নেই-মুহূর্তের মধ্যে এটা ভেবে আমি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে পড়লাম।কেন না সেই সময় আমি কিছু বিশৃঙ্খল কথাবার্তা ভাবছিলাম,যাকে ভাবের শৃঙ্খল পরাতে আমি অপারগ।এটাই নিহিলিজম বা নাস্তিবাদ নাকি?জীবনটার দেখছি কোনো অর্থই নেই,এই আঠারো বছর একই কাজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে চলেছি।চিন্তার বুলেট ট্রেন গুলি একে অপরকে ধাক্কা মারার অবস্থা।তিন মাসের অনাকাঙ্খি্ত ছুটি জুটে যাবার ফলেই এরকম মনে হচ্ছে নাকি?গান শুনতেও ভালো লাগে না,সিনেমাগুলিও বিরক্তিকর।বই পড়তেও যদি বিরক্তি বোধ হয়,তাহলে সত্যি সত্যিই জীবনটাকে অর্থহীন মনে করব।
‘এসব এখন আর আমাদের ধরে রাখতে পারে না’-অস্থির মনের কথাগুলি খুলে বলার সময় দাদা তো এভাবেই উত্তরটা দিল।এটা তো খাপছাড়া ভাবে সমাধান।এবার নিজেই উত্তর খুঁজে বেড়ানোর সমস্যার সৃষ্টি হল। মনোরঞ্জন ও কি বাধা হতে পারে?
‘তোমার টেবিলে ওটা গীতা নাকি?-আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।
বাবার চোখদুটি ছোটো ছোটো,পুরুষ মুরগির মতো ঘূর্ণ্যমান।বাবা দৃঢ়তার সঙ্গে কৃ্ত্রিম গম্ভীর একটা গর্জন করে বলল –‘হ্যাঁ,ওটা গীতা।তা দিয়ে তোর কী দরকার?’
বাবা নাস্তিক নন,ধার্মিক বলেও মনে হয় না,তাহলে টেবিলের ওপর গীতাটা এত সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছে কেন?এর রহস্য আমি বুঝতে পারলাম না।পড়তে বেশ ভালো লাগবে বলেই মনে হচ্ছে।কিন্তু সারা রাত গীতা পড়ার পরে নিষ্কাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘বিশেষ কিছু বুঝতে পারলাম না’বলে পরের দিন বাবাকে বইটা ফিরিয়ে দিলাম।
মাত্র চারদিন বাকি আছে-তারপরে বাড়ি থেকে দূরে একটা নতুন শহরে পা রাখব।পাঁচ বছরের জন্য নতুন কলেজটাই হবে আমার নতুন ঘর।একটা ঘরই যে এত আপন হয়ে উঠল,আরও বেশি আপন হয়ে উঠার মতো অন্তরে দেখছি তিল ধারণের ঠাঁই নেই।আঃ পুনরায় একটা নির্ণায়ক মুহূর্ত।অনেক প্রশ্নই আমার অভ্যন্তরে উদ্দাম নৃ্ত্য শুরু করে দিল।
‘বাবা,নীৎসের একটা বই দাও।‘
‘দার্শনিক হতে চাইছিস? দাঁড়া তোকে আজ’বলে বাবাকে কৃত্রিম ক্রোধে মারার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে খিলখিল করে হাসতে হাসতে আমিও কোন ধুবড়ি পৌছে গেলাম।
সন্ধেবেলা দেখি বাবার মুখটা যেন বাতাবী লেবু-হয়তো আমার বিদায় নেবার দিনটা ঘনিয়ে আসছে বলেই।ব্যক্তিগত ভাবগুলির সমাধান নিজেই করা উচিত,কেননা বুদ্ধ বলে যাওয়া ধরণে আমিও ভাবি-‘পেইন ইজ সারটেইন,বাট সাফারিং ইজ এ চয়েস’।
এইভেবে নিজে আশ্বস্ত হয়ে ‘দাস স্পেক জরথুস্ত্র’ নামের বইটা হাতে তুলে নিলাম।
‘তীব্র ক্রোধে নয়,মানুষের মৃত্যু ঘটানো যায় কেবল হাসির দ্বারা।এসো আমরা মাধ্যাকর্ষণের মূল আত্মাটিকে হত্যা করে ফেলি!’-নীৎসের এই কথাগুলি অন্তরটাকে কেমন যেন হালকা করে দিল।হ্যাঁ,বিশৃঙ্খলতা নিশ্চল হয়ে পড়েছে শৃঙ্খল গ্রহণের জন্য।বইটাকে একেবারে বুকের কাছটাতে নিয়ে আমি ভাবলাম –মা-বাবার কাছ থেকে দূরে প্রথমবারের জন্য কোথায় থাকতে যাব।
বাবা যে এত আবেগপ্রবণ।আবেগবিহ্বল হয়ে বাবা একথা অবজ্ঞা করছে যে এই পৃথিবীতে দায়িত্বশীল ছেলেমেয়ের কোনো পিতা-মাতা শোকগ্রস্ত হতে পারে না।কেন না তাঁদের জীবনকালের অন্ত পর্যন্ত যে সন্তানের অস্তিত্বও প্রায় নিশ্চিত।কিন্তু সন্তানকে জীবনের কিছুটা সময় মা-বাবার সঙ্গে এবং বাকি কিছু সময় নিঃসঙ্গ ভাবে কাটাতে হবে।আর যদি তাদের কাছে একমাত্র সন্ত্রাসের কারণ মৃত্যু,তাহলে সান্ত্বনার বিষয় হল –যে জন্ম নেয় তাঁরও মৃত্যু অনিবার্য-হয়তো একজন আগে,একজন পরে।
প্রকৃ্তির এক মন্ত্রমুগ্ধকর প্রপঞ্চ হল জন্ম-মৃত্যুর বৃত্ত।এর মধ্যেই আমাদের ছোটো ছোটো অর্থের খোঁজে সুখী হতে হবে।জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে সৃজনশীলতা।অন্যের কথা না জানলেও আমার প্রশ্নের এটাই কেবল উত্তর।সুখও যেন অন্য একটি প্রপঞ্চ,জীবনের ইঁদুর দৌড়ের কেবল একটি উপজাত দ্রব্য। সুখের যদি মূল্য আছে,দুঃখও তেমনই সমান মূল্যবান।প্রকৃ্তির ইন্দ্রজালকে উপহাস করা বোঝাবে না কি,যদি তুমি সমস্ত অধিকৃ্ত জিনিসের লেজে একটি মূল্য ঝুলিয়ে দাও?
উয়া।বই পড়া তো আমার কাছে কখনও বিরক্তিকর নয়।এটা একটি ইউরেকা মুহূর্ত।এমনিতেই জ্ঞানকে ক্ষমতা বলে না।এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুম এসে একটা অন্য জগতে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।
‘এই দুষ্টু।তোরতো যাবার সময় হয়ে এল।চল ‘মিশন মঙ্গল’টা দেখে আসি-কৃ্ত্রিম ক্রোধ প্রকাশ করে বাবা আমাকে জাগিয়ে দিল।
‘মইনার জন্য কিছু বাজার করতে হবে,আমিও তোমাদের সঙ্গে বের হচ্ছি’-রান্নাঘর থেকে মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
ইস কী যে কণ্ঠস্বর!
হঠাৎ আমার মনে হল মায়ের কণ্ঠস্বরের ঔদ্ধত্যের আড়ালে হাহাকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।প্রচণ্ড জোরে চেপে রাখা কারুণ্য যেন মায়ের অভ্যন্তরে ভিত ভেঙ্গে ফেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আমি দাঁতের ডাক্তার হওয়ার জন্য অনেক দূরে যেতে চলেছি।কারও কারও চর্ব্যের অনুভূতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য,কারও মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্য বা কারও ফোকলা মুখে একটা দন্ত্য পরিবেশ রচনা করার জন্য সমাজ আমার খোঁজ করবে।জীবনের এটা প্রান্তীয় দিক নাকি এটাই খুচরো জীবন?
খুচরো জীবনের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য মা,বাবা এবং আমি এইবার ছোটো গাড়িটার অভ্যন্তরে ঢুকে গেলাম।
-------
লেখক পরিচিতি-অসমের গুয়াহাটি নিবাসী অর্হণা পূর্বা শইকীয়ার জন্ম ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯। বর্তমানে মোরাদাবাদের (উত্তর প্রদেশ) কোঠিয়াল ডেন্টাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।২০১৭ সনে কটন কলেজে পড়াকালীন শ্রেষ্ঠ গল্পকার বলে নির্বাচিত হন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন