কিছু বই কিছু কথা ২৮৭ । অলোক বিশ্বাস
পরমচেতনার ম্যানিফেস্টো : অরুণ দাস
আলোচক : অলোক বিশ্বাস
------------------------------ -------
বর্ণময় পৃথিবীর বস্তুজগৎকে স্পর্শ করতে করতে একজন শিল্পীকবি ব্রহ্মের উপস্থিতি অনুভব করেন। ব্রহ্ম হলো পরম চেতনা, যাকে আর এক নামে বলি মহাচেতনা। লেখক অরুণ দাসের চেতনা-বিস্তার সংক্রান্ত আলোকিত ভাবনার গ্রন্থ 'পরমচেতনার ম্যানিফেস্টো', সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মেদিনীপুরের অমিত্রাক্ষর প্রকাশনী থেকে। মাত্র বত্রিশ পৃষ্ঠার বই হলেও একজন কবির অন্তর্জগতের নানারূপের সন্ধানে অবিরাম যাত্রার কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রচ্ছন্নহীনভাবে লিখিত হয়েছে অরুণ দাসের কলমে। এই গ্রন্থ পাঠে একজন কবির কবিসত্তা অর্জনের নতুন পথ চিহ্নিত হতে পারে এবং যেকোনো কবি পারমাণবিক চিন্তার অনেক সূত্র পেয়ে যেতে পারেন এই বইটি পাঠের পর। বইটিতে কবিতা লেখার প্রক্রিয়ার সবিস্তার কোনো বর্ণনা নেই। আছে কেবল একজন কবির মানসভূমি নির্মাণের সক্রিয় পটভূমি বা দার্শনিক সত্তার ভিত্তি। লেখক অরুণ দাস স্পষ্ট জানিয়েছেন, এই বস্তুবিশ্বের সকলই আমাদের চেতনার অন্তর্গত। অর্থাৎ যখন আমরা আমাদের চেতনার আলোকে বস্তু বিশ্বের সকল পদার্থকে দেখি বা স্পর্শ করি, তখন সেইসব বস্তুর অবস্থার রূপ বদল ঘটে যায়। বইটিকে যেহেতু লেখক ম্যানিফেস্টো হিসেবে নির্মাণ করেছেন, ফলত পুনঃপুনঃ উল্লিখিত হয়েছে বস্তুজগতের সঙ্গে একজন কবির মানসিক সম্পর্ক, একজন কবির মানস জগতের ভিত্তিভূমি এবং একের পর এক সূত্রের সাহায্যে পরম চেতনার প্রকাশ ও পরম চেতনায় পৌঁছনোর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন লেখক।
#
অরুণ দাস লিখছেন--- ১. আমাদের বহুরূপী বাহ্যিক জগতের মতো একটি বর্ণময় অন্তর্জগত আছে। ২. কবি অনুভব করবেন ত্রিমূর্তি, ত্রিকালদর্শী পরমচেতনার সূক্ষ্ম ধ্বনিকে। আর এখান থেকেই সূচনা হবে জেড প্রজন্মের কবিতা যুগ। ৩. পরম চেতনায় শব্দের সংযোগ কবিতার যান্ত্রিক কাঠিন্যকে প্রকাশ করে না। এর সাহায্যে মন্ত্রের মধ্যেকার পরমাত্মিক জগতকে অনুধাবন করা যায়। ছোঁয়া যায় বর্ণের মধ্যেকার ব্রহ্ম ও ব্রহ্মাণ্ডকে। ৪. পরম কারণকে খুঁজে, তার সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধির যথার্থ প্রয়োগেই গড়ে উঠবে পরমচেতনার কবিতা। ৫. পরমচেতনার কবি ছুঁতে চান সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম সত্তাকে। আবেগ-চেতন-অবচেতন ও অচেতনের পরম নিয়ন্তা সর্বময় পরমাত্মাকে তাঁরা ছুঁতে পারেন। ফলে, কোনো কিছুর বর্জন নয়, বরং সুষ্ঠু সংমিশ্রণেই পারমার্থিক জগতের উপলব্ধিকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে কবিরা প্রয়োগ ঘটান তাঁদের কবিতায়।
#
নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গটিও অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ধরেছেন লেখক। বইটি অনেকগুলো ছোট ছোট নামকরণহীন দর্শনচিন্তা সমৃদ্ধ গদ্যের সংকলন। গদ্যগুলোতে লেখক চেতনা, অবচেতনা, পরমচেতনার পাশাপাশি বাহ্যিকজগত এবং কবিদের অনুভূতির প্রসঙ্গে চলে এসেছেন। স্পষ্টভাবেই বলেছেন, 'বস্তু বা দৃশ্যের বহুরূপ আমাদের মনেরই সৃষ্টি। আমাদের অনুভূতি কোনো ইন্দ্রিয় বা কারণ সাপেক্ষ নয়। অনুভূতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও অনন্তস্বরূপ'(পৃষ্ঠা- ১৬)। আমরা দেখেছি, বিভিন্ন কবি বহুবার সীমা অতিক্রমের বলেছেন। বলেছেন, পরমচেতনায় কিভাবে বস্তুকে দ্বিতীয় তৃতীয় সত্তায় অর্জন করা যায়। পরম চেতনায় বস্তু পৌঁছে গেলে সেটি সীমাঅতিক্রমকারী নতুন রূপ পেতে থাকে। এভাবে মেটামরফোসিস ঘটে কবির চেতনায় বা চেতনার আধারে নিয়ে আসা বাহ্যিক দৃশ্যজগতের বস্তুগুলোর। বাহ্যিক অবস্থার সম্মুখে দাঁড়িয়ে একজন কবির অবস্থানটি সুন্দর কোরে চিত্রায়িত করেছেন লেখক। লিখেছেন--- 'পরমচেতনায় কবি অনুভব করেন চিৎ-শক্তি, জড় ও চেতন সবকিছুর উৎস। চিৎ-শক্তি ছাড়া জড়শক্তি অস্তিত্বহীন। জড়জগৎ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু চিন্ময় জগৎ নিত্য। সুতরাং পরমচেতনার মধ্য দিয়ে জড়বস্তু ও জীবনকে উপলব্ধি করলে তার যথার্থ রূপকে ছোঁয়া যায়। পরমচেতনায় ব্যক্তি-বস্তু, সবকিছুই নিত্য, শাশ্বত ও চিন্ময়'(পৃষ্ঠা-২১)। বইয়ের শেষে ষোলটি চিন্তাসূত্র নিয়োজন করেছেন কোনো ইম্পোজিশনের মনোভাব ছাড়াই। পুরো বিষয়টি লেখক ছেড়ে দিয়েছেন স্বাধীন চেতনাযুক্ত একজন কবির ইচ্ছার ওপর। পরমচেতনার স্তরে কিভাবে কবিতার সামগ্রিক সত্তা বদলায় সেটিকে মেধাযুক্ত আবেগের সঙ্গে অভিব্যক্ত করেছেন লেখক অরুণ দাস তাঁর 'পরমচেতনার ম্যানিফেস্টো' গ্রন্থে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন