কিছু বই কিছু কথা ৷ অলোক বিশ্বাস ৷ রিদমিক এবং রিদমিক্স ৷ সৌমিত্র রায়
রিদমিক এবং রিদমিক্স : সৌমিত্র রায়
আলোচক : অলোক বিশ্বাস
নিপাট আনন্দের অনুভূতি থেকে উৎসারিত কবি সৌমিত্র রায়ের কবিতার বই 'রিদমিক এবং রিদমিক্স'। বইটি ছন্দের বা রিদমের নির্মল গন্ধমাখা অনুভূতিতে পূর্ণ। 'রিদমিক্স' শব্দটি বহুবিধ ঝংকারের তান ইঙ্গিত করে। লয়যুক্ত করেছেন কবি, কবিতাগুলোতে, যা কখনো দ্রুত, কখনো ধীর। গদ্যের চলনেও লয় সম্পর্কিত হয়েছে। ছড়া আর কবিতার মিশ্রণে, জীবনপথে চলার নানা রূপায়িত সম্পর্কের খুঁটিনাটির ইন্টারলকিং, আনন্দের অনুভূতির সঙ্গে প্রযুক্তিগত মেধা ও যোগসাধনার মনোযোগের মিশ্রণে ক্যালাইডোস্কোপিক রূপ ধারণ করেছে গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো। অপার, অসীম আনন্দের অনুভূতির পরিণত স্রোত আছড়ে পড়ছে সমস্ত কবিতায়। উন্মুক্ত হৃদয় আর সরল চোখে যাকিছু এসে মেশে সে-সবকে কাটাছেঁড়া না কোরে কবি বিন্যাসিত করেছেন কাব্যে। সর্বদা ধ্বনিসমতা বজায় রেখেছেন। পাঠকের ওপর কিছু ইম্পোজ করেননি। কবির অভিজ্ঞতা যেন পাঠকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রবাহিত হতে থাকে আনন্দে। জগৎকে কবি দেখেন আনন্দময়। জগতের বেদনাও আনন্দের সংমিশ্রণে জল হয়ে যায়। যদিও বেদনার নিজস্ব ব্যাপ্তি, বেদনা থেকে উৎসারিত মানবসত্তার বিচ্ছিন্নতা কবির দৃষ্টি থেকে সরে যায়নি। মানুষে মানুষে সামঞ্জস্য থেকে যে সুখানুভূতি সৃষ্ট হয়, কবি, সরল মনে ঢুকে পড়েছেন তার মধ্যে। কখনো সারল্যের মধ্যে এসে যায় যুক্তিহীন খোলা মনের আবোল তাবোল--- "নালায় এ কি মৌন মিছিল, জ্যাম জুড়েছে প্লাস্টিকে/হঠাৎ জলের মৃত্যু হলে, জীবন ভেবো লাশটিকে!" (জীবন ভেবো লাশটিকে, পৃষ্ঠা-৪৭)। সিরিয়াস বিষয়কে অনেক সময় সিরিয়াস কোরে লেখার পরিবর্তে যদি তার মধ্যে হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রুপের মিশেল ঘটানো যায়, কবি যদি ঘটমান বাস্তবের নিজস্ব আয়রনিকাল রূপগুলোকেই লিখে যান অক্ষরে অক্ষরে, বিরল আনন্দের প্রবাহ চলতে থাকে কবিতায়। একটি কবিতায় মাত্র ২ টি পংক্তিতে কাব্যিক সত্তার অনেক পরিচয় লেখা আছে--- "একাধিক 'আমি'-রই মুখোমুখি হই;/বহু বর্ণ আমাতেই পাতিয়েছি সই"(আমাতেই বন্ধুত্ব করি, পৃষ্ঠা ৪৮)। গত দুই তিন দশকে প্রযুক্তিবিদ্যার অনেক আলোবাতাস প্রবেশ করেছে সমস্ত কর্মযজ্ঞে, পেশা ও অপেশার দরজায়। এমন কোনো ক্ষেত্র আর নেই যেখানে প্রযুক্তির প্রভাব পড়েনি। কাব্য জীবনের প্রথম থেকেই সৌমিত্র রায় প্রকাশ মাধ্যমের সঙ্গে প্রযুক্তিকে নিবিড়ভাবে ব্যবহার কোরে আসছেন। তাঁর যাবতীয় সম্পাদনার মধ্যে প্রযুক্তির সাম্প্রতিকতমের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নিজস্ব লেখার প্রকরণেও প্রযুক্তির সুফলকে কাজে লাগিয়েছেন নির্বিঘ্নে। লেখালেখির বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান কোথায় রয়েছে সেটাও জানিয়েছেন গ্রন্থের প্রথম কবিতায়--- "যা দেখি, তাই লিখি/লিখতে লিখতে শিখি/ফুরায় নাকি লেখার বিষয়?/তাই তো লিখি, যা মনে হয়।/আমার লেখার বিষয় নিয়ে/সাজানো দশ দিকই।।"(পৃষ্ঠা-৯)। কবিতাটির ফর্মে যতিচিহ্ন বাক্যের পাশে না দিয়ে, দিয়েছেন চরণের স্পেসে। এরকমটি করেছেন অন্যান্য কিছু কবিতার মধ্যে, অর্থাৎ যতিচিহ্ন স্তবকের মাঝখানে প্রয়োগ কোরে ভাবনার ধাবমানতার স্বরূপকে নির্দিষ্টতা দেওয়া। শব্দের পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন বন্ধনী চিহ্নসহ আরো কিছু চিহ্ন, শব্দের রেশ বা গতিকে নিরূপিত করতে। আনন্দই কবিতার প্রধান উৎসভূমি। কবিতার বিভিন্ন স্থানে নাটকের সূত্রধরের মতো 'আনন্দ' শব্দটির অবস্থান লক্ষ্য করেছি। এর সঙ্গে অন্যান্য কুশীলবের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে কাব্যযোগ, শান্তি, ভার্চুয়াল, স্পিরিচুয়াল শব্দগুলো। আনন্দকে তিনি কবিতায় বন্দনা করেছেন বারবার। কোথাও কবিতার শুরু হচ্ছে এবং সমাপ্তি ঘটছে 'আনন্দ' শব্দ সহযোগে। জীবনের চলার পথে অচেনা লোকের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে যে সহজ ভাষায় কথপোকথন চলতে থাকে, সেই প্যারোলকে ব্যবহার করেছেন তিনি কবিতায়। 'ওইখানে যাই' কবিতাটিতে এই শৈলি ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। বলা যায়, কবির দ্বিতীয় সত্তার সঙ্গে কবি কথপোকথন চালাচ্ছেন চলতে চলতে--- "চড়লে ট্রেনে নতুন নতুন/মশলামুড়ি/খাচ্ছো খাও!/চোখ রাখো ওই জানলাটাতে/চশমা মুছে/ঠিক তাকাও!/সামনে দেখো আলুর ক্ষেত,/সর্ষে বাড়ি,/খাট্টামিঠা রোদ পড়েছে আড়াআড়ি,/ওই যে দূরে বাঁশবাগান/খড়ের গাদা, ধানের হাঁড়ি, গোবরনাতায় সাফ উঠান,/ওইখানে যাই--- ভাবছো না?/ওই উঠোনেই হাত-পা মেলে/পান্তা পেয়াঁজ খাচ্ছো না?" কবিতার সঙ্গে ছড়ার রিদম সংযোজনে, ছড়ার সহজলভ্য হাস্য-লাস্যকে ব্যবহার কোরে নতুন এক নির্মিতি প্রকাশিত হয়েছে সৌমিত্র রায়ের 'রিদমিক এবং রিদমিক্স' বইটিতে। কবির জন্য অবিরাম আনন্দরূপ পথের সন্ধান কামনা করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন