বৃহস্পতিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২১

বিদেহ নন্দিনী || ডঃমালিনী || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস

 বিদেহ নন্দিনী

ডঃমালিনী 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস 



(পাঁচ)

 

অযোধ্যা মহানগরীতে পা রেখেই আমি নিজের মনে ‘অযোধ্যা’ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করেছিলাম। অযোধ্যা অর্থাৎ যাকে যুদ্ধের দ্বারা বশ করা যায় না। এরকমই একটি রাজ্যে বধূ হিসেবে প্রথম পা রেখেই উপলব্ধি করেছিলাম শ্বশুর দশরথের দূরদর্শিতা এবং পূর্বপুরুষদের পরিকল্পনা। অযোধ্যায় পা রেখেই কোশল রাজ্যের সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি, শান্তি-ঐক্য, শক্তি কর্মদক্ষতা,নিপুণতার আভাস পেয়েছিলাম। সমগ্র কোশল রাজ্যের চার সীমা সব সময় শক্তিশালী সেনাবাহিনী দ্বারা পাহারা দেওয়া হচ্ছিল। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের চারপাশে এভাবে পরিখা খনন করা হয়েছিল যে সেই সমস্ত অতিক্রম করে বাইরের শত্রু রাজ্যে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। শ্বশুর দশরথ রাজ্যটাকে যেভাবে সুরক্ষিত করে সাজিয়ে ছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

 আমাকে বরন করে নেওয়ার জন্য নগরটাকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। চারজন রাজকুমার একই জায়গায় বিয়ে করে কনে নিয়ে ফিরেছে এই খবরে রাজ্য বাসীরা আনন্দে মাতাল হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া অনেকদিন পরে তাঁদের আদরের রাম এবং লক্ষ্ণণ একেবারে বধূ নিয়ে ফিরে এসেছে। এই খবরও অযোধ্যাবাসীদের অনেককে আনন্দে মাতাল করে তুলেছিল।অযোধ্যাবাসীদের অনেকেই সজল চোখে  স্বামীকে জড়িয়ে ধরছিল। তাঁরা তাঁর চরণ স্পর্শ করে সেই আঙ্গুলগুলি  মাথা কপাল এবং বুকে বুলিয়ে নিয়েছিল। অনেক যুবক-যুবতি এবং ছেলেমেয়েরা তাকে স্পর্শ করে দেখছিল। আমি তার জনপ্রিয়তা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।

 ঠিক সেভাবেই রামচন্দ্রের পত্নী বলে আমাকে বিভিন্নজন প্রণাম জানিয়ে এই ধরনের মন্তব্য করছিল-‘অযোধ্যায় সাক্ষাৎ লক্ষ্মী দেবীর আগমন ঘটেছে।’

 রাজ প্রাসাদের মূল প্রবেশদ্বারে চারজন নতুন বধূকে তিনজন শাশুড়ি বরণ করে নিলেন। প্রত্যেকেই আমাদের দুগাল চুমুতে ভরিয়ে দিলেন। কাপড়ের আঁচলে ধরে বড় শাশুড়ি কৌশল্যা প্রথমে আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোনার বড় পিঁড়িতে বসাল। তারপরে বাকি তিন বধূকেও  আমার পাশে নির্দিষ্ট করে রাখা আসনে বসতে দিল। আমাদের দেখার জন্য আত্মীয়-স্বজন সঙ্গী-সাথীরা ঘিরে ধরল। ছোট শাশুড়ি কৈকেয়ী আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আমার পিতা পাঠানো উপহার গুলি ছোট শাশুড়ির সাহায্যে যাকে যাকে দেওয়ার প্রয়োজন সেই ভাবে ভাগ করে দিয়ে গেলাম। তাছাড়া কাকে সম্মান দেখাতে হবে, কাকে প্রণাম জানাতে হবে, তাও শাশুড়ি কৈকেয়ী ঠিক করে দিলেন। আমাদের বরণ করে নেওয়া এবং সম্ভাষণ জানানো পর্ব শেষ হওয়ার পরে প্রতিটি নির্দিষ্ট করে রাখা রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হল।

 সেদিন তিনজন শাশুড়ির মেলামেশা দেখে আমার বড় ভালো লাগল। একে অপরের গুণ এভাবে বর্ণনা করছিল যেন তারা তিনজন গলায় গলায় বান্ধবী,সতীন নয়।

আমি প্রতিজন শাশুড়ির পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করছিলাম। প্রতিটি নারীই ছিলেন বিদূষী মহিলা। বিশেষ করে ছোট শাশুড়ি কৈকেয়ী।তার যেমন রূপ তেমনই আচার ব্যবহার।  কাজকর্মে দক্ষ।এমনকি অস্ত্রচালনা, রথ চালানোর কাজেও। বয়সও বাকি দুজনের তুলনায় কম। তাঁরা চার পুত্রের কোনজন কার মা সেটা অনুমান করা আমার পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল। 

তবে এক বছরের মধ্যেই আমি স্বামীগৃহে অন্দরমহলের প্রায় সমস্ত কথাই জানতে পেরেছিলাম। কিছু কথা দেখে অনুমান করেছিলাম আর কিছু জানতে পেরেছিলাম মেজ শাশুড়ি সুমিত্রার কাছ থেকে। আমার বড় শাশুড়ি কৌশল্যা যদিও রাজা দশরথের বড় রানি ছিলেন তবু যেন তিনি ভেতরে ভেতরে সুখী নন এরকম একটি অনুমান করেছিলাম। আমার অনুমান  সত্যি বলে ধরে নিয়েছিলাম  যেদিন আমি জানতে পেরেছিলাম যে আমার শ্বশুরের অর্থাৎ রাজা দশরথের তিনশো পঞ্চাশ জন স্ত্রী। যখন একজন স্বামীর তিনশো পঞ্চাশ জন স্ত্রী থাকে তখনই অনুমান করতে পারি যে পারিবারিক জীবনে কোনো নারী সুখী হতে পারে না। বড় শাশুড়ি কৌশল্যা অন্তর্দাহ করতে থাকা অনেক কথা আমি বনবাসে যাওয়ার আগের মুহূর্তে তিনি বিলাপ করে বলা কথাগুলি থেকে জানতে পেরেছিলাম।

শ্বশুর অর্থাৎ রাজা দশরথ তিনশো পঞ্চাশ জন স্ত্রীকে সুখে শান্তিতে রাখতে চেয়েছিলেন। প্রত্যেক জনের মধ্যে তিনি আমার বড় শাশুড়ি কৌশল্যা, মেজ শাশুড়ি সুমিত্রা এবং ছোট শাশুড়ি কৈকেয়ীকে মুখ্য স্থান দিয়েছিলেন। তিনি যদিও এই তিনজনকে সমান চোখে দেখেন বলে মন্তব্য করেছিলেন তবুও তার ছোট শাশুড়ির প্রতি অন্তরের টান কিছুটা বেশি বলে আমি প্রায়ই অনুভব করতাম। অবশ্য রাণী কৈকেয়ী এরকম একজন মহিলা, যাকে প্রথম দেখায় মানুষ ভালো না বেসে থাকতে পারেনা। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি মানুষকে ভালোবাসতে জানেন। আমার শ্বশুর এবং শাশুড়ি কৈকেয়ীকে একসঙ্গে থাকলে যদিও বাবা মেয়ের মতো দেখায় তবু তিনি কোনোদিন বৃদ্ধ পতি বলে দশরথকে অবজ্ঞা করেননি বা কখনো কোনো কথায় অতিরিক্ত সুযোগ নেননি। রাজা রাজসভায় যাওয়ার সময় ছোট শাশুড়ি প্রতিদিন তাকে রাজপথ পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। ঠিক সে ভাবে ফিরে আসার সময় এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। শ্বশুর ভালোবেসে পথের মধ্যে ছোট শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরতে আমি কয়েকদিন প্রত্যক্ষ করেছিলাম। বোধহয় তাই শ্বশুর ছোটরাণীর প্রাসাদটাকে অত্যন্ত সুন্দর করে সাজিয়ে ছিলেন।প্রাসাদের আসবাবগুলি একেবারেই  অত্যাধুনিক ছিল। প্রাসাদের ভেতরে উদ্যান এবং পুষ্করিণী। বিভিন্ন রঙের জল,গোলাপ এবং পদ্মফুলে পুষ্করিণীর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছিল। বারো মাস উদ্যানের ফুল মন মোহিত করে তুলত। উদ্যানের মাঝে ময়ূর পেখম ধরে তার সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছিল।

 রাজা মাসের বেশিরভাগ দিন ছোট শাশুড়ির ঘরে  ঘুমোতে ভালোবাসতেন। এই কথার জন্য বড় শাশুড়ি কৌশল্যা বা সুমিত্রা কোনোরকম অসন্তোষ প্রকাশ করতেন না।

শ্বশুর দশরথ যদিও চারজন পুত্রকে সমান ভালোবাসতেন, তবু স্বামী রামচন্দ্রের  প্রতি তার বেশি অনুরাগ ছিল। ঠিক সেভাবে চারজন বধূর মধ্যে আমাকে অধিক ভালোবাসতেন বলে মনে হতো।

অযোধ্যা নগরের একজন মূল ব্যক্তি ছিলেন ঋষি বশিষ্ঠ যাকে রাজা থেকে শুরু করে প্রত্যেকেই গুরু বলে মানতো। অযোধ্যা নগরে পদার্পণ করার তৃতীয় দিন আমি, তিনজন শাশুড়ি, স্বামী, তিনজন দেবর এবং জায়েদের সঙ্গে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে গিয়েছিলাম।ঋষি আমাকে  সূর্য বংশের বিখ্যাত রাজা মনু কীভাবে এই রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেকথা ছাড়াও সাংসারিক জীবনের অনেক সারগর্ভ, জ্ঞানগর্ভ কথা বলেছিলেন। সেদিন ঋষির কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম কীভাবে শ্বশুর দশরথ যজ্ঞ সম্পাদন করে তার পুত্রদের সন্তানরূপে লাভ করেছিলেন। যজ্ঞের অগ্নিশিখার মধ্যে হাতে স্বর্ণপাত্র নিয়ে কীভাবে সূর্যের মতো মহিমামণ্ডিত মূর্তি আবির্ভূত হয়ে পিতা শ্বশুরের হাতে পায়েসের পাত্র দিয়েছিলেন সে কথা শুনে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। তিনি এতই গভীরভাবে বর্ণনা করছিলেন যে আমি স্বচক্ষে সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম বলে মনে হচ্ছিল। ঋষির কাছ থেকে স্বামী রামচন্দ্রের জন্ম বৃত্তান্ত শুনে আমি আমার জীবনের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছিলাম।

 এভাবেই স্বামী এবং শাশুড়িরা আমাকে অযোধ্যার গণ্যমান্য সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। হাসি-ঠাট্টা,সুখ আনন্দের মধ্য দিয়ে আমাদের বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত হয়েছিল।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...