বিদেহ নন্দিনী~১৮ || ডঃমালিনী || মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস || Basudeb Das
(আঠারো)
ঘরে এতগুলি অতিথি রয়েছে। তাই পরের দিন আমি কেউ উঠার আগেই ওঠে গেলাম। স্বামী আমার চেয়েও আগে উঠেছে । তিনি স্নান করে হোম,যজ্ঞ সবকিছু সম্পন্ন করে ভাইদের ওঠার অপেক্ষায় রইলেন। ইতিমধ্যে লক্ষ্ণণ, ভরত, শত্রুঘ্ন স্নান করে জপ তপ করে দাদার কাছে এসে পৌঁছাল। আমিও যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে স্বামীর কাছে এলাম। কিছুক্ষণ পরে তিন বধুকে সঙ্গে নিয়ে তিনজন শাশুড়ি এসে বসলেন। তারপর ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ,জবালি,সুমন্ত্র এবং অন্য মন্ত্রীরাও একজন একজন করে এসে নিজের নিজের জায়গা দখল করলেন। স্বামী সকলকে সম্ভাষণ জানানোর পরে দেবর ভরত সবাইকে সুপ্রভাত জানিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন-‘প্রয়াত মহারাজ দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র দাদা রামচন্দ্র, আমার কুচক্রান্তকারী মাতার পাকচক্রে পড়ে পিতৃদেবকে রাজ্য আমাকে দিতে হল। তবে সেই রাজ্য চালানো আমার পক্ষে অসম্ভব। গাধা যেমন ঘোড়ার মতো দ্রুত গতি সম্পন্ন হতে পারে না,সাধারণ চড়াই যেমন গরুড় পাখির মতো উড়তে পারে না ঠিক তেমনই আমিও এই গুরুভার বহন করতে পারব না। তাছাড়া কাল আপনার রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা শোনার পরে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে আমি হাজার চেষ্টা করলেও এই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হব। তাই দাদা,আপনার চরণ ধরে কাকুতি করে আমি রাজ্য আপনাকে অর্পণ করছি। আপনি প্রজা এবং রাজ্যকে রক্ষা করতে পারবেন।’ কথাগুলি বলে ভরত কাঁদতে লাগল।
স্বামী ভরতকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলল-‘ ভাই ভরত,তুমি অযথা শোক কর না,স্বর্গগামী হওয়া, পিতৃদেব নির্ধারিত করে দেওয়া কর্তব্য তুমি এবং আমি দুজনেরই পালন করা উচিত। আমি বনবাস খেটে পিতার বাক্য পালন করব আর তুমি অযোধ্যা রাজ্য শাসন করে তিনি নির্দিষ্ট করে যাওয়া কার্য পালন করবে। পিতার যাতে পরলোকগত আত্মার সদ্গতি হয় তার জন্য তার বাক্য রক্ষা করা আমাদের দুজনেরই বর্তমান মূল কর্তব্য। দাদার কথা শুনে ভরতের শোক কমল না। সে পুনরায় কাতর স্বরে বলল-‘ দাদা আপনার মতো একজন পুরুষকে আমার পাপীয়সী মা মোহে অন্ধ হয়ে পিতৃদেবের মাধ্যমে যে কার্য করালেন তার জন্য তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু আমি সেটাও করতে পারিনি। পিতাও জ্ঞানহীন একজন স্ত্রীর কথা শুনে ভুল করল। অবশ্য এখন সেই কথা আলোচনা করা উচিত নয়। এখন সেই সমস্ত কিছু থেকে আপনিই রক্ষা করতে পারেন। বড়মা কৌশল্যা এবং ছোটমা সুমিত্রার মুখে আপনি হাসি এনে দিতে পারেন। সবার দ্বারা নিন্দিত হয়ে থাকা কৈকেয়ীর অপবাদও আপনাকেই মোচন করতে হবে। বর্তমানে অযোধ্যা কালো মেঘের দেশ যেন হয়ে আছে। অন্ধকারে ডুবে যেতে চাওয়া অযোধ্যাকে আপনি উদ্ধার না করলে আর কেউ নেই। আমি জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনা সমস্ত কিছুতেই আপনার থেকে হীন । আপনার কাছ থেকে দূরে থেকে আমি নিজেই জীবন ধারণ করতে পারব না। তাই রাজ্য চালাব কীভাবে? এখানে আমরা সদলবলে আসার মূল উদ্দেশ্য হল আপনার অভিষেক। অভিষেকের সমস্ত দ্রব্য আমি সঙ্গে এনেছি। মন্দাকিনী নদীর তীরে অভিষেক অনুষ্ঠিত করে আপনাকে সদলবলে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলেই এখানে এসেছি। এভাবে বলে স্বামীর পায়ে মাথা রেখে ভরত কাকুতি করতে লাগল।–‘হে পুরুষ শ্রেষ্ঠ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দয়া করে আমার মায়ের কলঙ্ক মোচন করে পিতৃদেবকেও নিন্দা থেকে রক্ষা করুন। আপনি সবার প্রতি সদয় হন। না হলে আমিও আপনার সঙ্গে বনবাসী হব। ভরতের কথা শুনে সবার চোখে জল দেখা দিল। তবে দাদা রামের দৃঢ়তা বিন্দুমাত্র কমল না। তিনি ভরতকে বললেন-‘ স্নেহের ভাই, তোমার মুখে এই কথাই শোভা পায়। কিন্তু কি জান? এরকম ঘটনা না ঘটলেও প্রকৃত পক্ষে তোমারই যুবরাজ হওয়া উচিত। কেননা আমাদের পিতৃদেব মাতা কৈকেয়ীকে বিয়ে করার সময় তোমার দাদুকে কৈকেয়ীর সন্তানই ভবিষ্যতে অযোধ্যার রাজা হবে বলে কথা দিয়েছিলেন। সে সমস্ত কথা তুমি আমি জানতাম না। মাতা কৈকেয়ী ও মিথ্যা কথার ওপর ভরসা করে বর চাননি। সেই বর দুটো তার প্রাপ্য ছিল। সে কথাও আমরা জানতাম না। তুমিও হয়তো জান না। সেই জন্য প্রথমেই বলি শোনো-‘দেবাসুর বধের যুদ্ধে আমাদের পিতা দেবতাদের হয়ে যুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধে আমাদের পিতা অসুরের বাণে খুব খারাপ ভাবে আহত হয়েছিলেন। তখন মাতা কৈকেয়ী তাকে শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলেছিল। তার শুশ্রষায় সন্তুষ্ট হয়ে পিতৃদেব মাতা কৈকেয়ীকে দুটো বর দিতে চাইলেন। মাতা কৈকেয়ী তখনই বর দুটো না নিয়ে এখন নিতে চাইলেন। তাই এতে খারাপ পাওয়ার মতো বা মাতা কৈকেয়ীকে দোষ দেওয়ার মতো কিছু নেই। তাই তুমি শত্রুঘ্ন এবং অন্য সকলের সঙ্গে ফিরে গিয়ে রাজ্য শাসন করে প্রজাপালন কর । আমিও লক্ষ্ণণ সীতার সঙ্গে চৌদ্দ বছর বনবাসে কাটিয়ে অযোধ্যায় ফিরে যাব। আমরা চার ভাই নিজের নিজের কর্তব্য সমাধান করে পিতার সত্য রক্ষা করব।
স্বামীর কথা শুনে অযোধ্যার মূল ব্রাহ্মণ পুরোহিত জাবালি বললেন-‘রামচন্দ্র যেভাবে কথাগুলি বলছেন যেন মৃত রাজা দশরথ এবং তার মধ্যে এক সম্পর্ক এখনও চলছে বলে আমার মনে হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আত্মা জীব বলে কোনো বস্তু নেই। মৃত্যুর পরে দেহ যেভাবে বিনষ্ট হয়, তেমনই মানুষ ভাবা আত্মা বা জীবও বিনষ্ট হয়। মৃত্যুর পরে কোনো মানুষের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার বা দেবার থাকে না। তেমনই স্বর্গলোক নরকলোক বলেও কোনো একটি আলাদা জায়গা নেই। একটিমাত্র লোক। তা হল মর্ত্যলোক। আমরা দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে পিন্ডদান করি প্রকৃতপক্ষে তার কোনো অর্থ নেই। আমরা মানুষরা নির্বোধ বলেই মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা পিণ্ডদান করি। সেই পিণ্ড মৃতরা পায় বলে ভাবি। প্রকৃতপক্ষে পায় না। শরীরটা বিনষ্ট হয়ে যাবার পরে মৃতরা অন্ন কীভাবে খাবে?
পন্ডিত জবালির কথা শুনে স্বামীর মুখ লাল হয়ে উঠল। তিনি কিছু একটা বলতে চাইতেই জবালি পুনরায় বলেছিল-‘ এই পৃথিবীতে নিজের বলে কোনো জিনিস নেই।কেউ কারও বন্ধু নয়। পিতৃ-মাতৃ বা আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর পরে দুঃখে ম্রিয়মান হয়ে মৃতের প্রতি বেশি আসক্তি দেখানোকে ভক্তি বলেনা। সেই সব দুর্বল চিত্তের মানুষের উন্মত্ততা। প্রকৃতপক্ষে পিতা জীব সৃষ্টির এক নিমিত্ত মাত্র। মাতার গর্ভে থাকা ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণুর সঙ্গে পিতার শুক্রাণু মিলিত হয়ে জীবের সৃষ্টি করে। এটা জীবের উৎপত্তির একটি পদ্ধতি। তাই রামচন্দ্র পিতা পিতা বলে যা বলছেন তা সম্পূর্ণ অমূলক। তাই হে রাম, তুমি ভরতের কথা মেনে অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে প্রজা শাসন কর। সমগ্ৰ কোশলবাসী তোমার শাসনের অধীনে জীবন কাটানোর জন্য আশায় পথ চেয়ে রয়েছে।’
স্বামীর রাগ হয়েছিল যদিও ধীর-স্থিরভাবে অতিশয় তীক্ষ্ণ শব্দ প্রয়োগ করে পন্ডিত জবালিকে তিরস্কার করলেন-‘বিপ্র জবালির কথাগুলি শুনে মানা উচিত বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের কথা ভ্রষ্টাচারী,হীন বুদ্ধি, বেদত্যাগী,পাপকর্মে লিপ্ত মানুষেরাই উচ্চারণ করে। আচার-ব্যবহারেই যেহেতু একজন মানুষের পরিচয় তাই কথাবার্তা থেকেই বুঝা যায় কে উত্তম,কে অধম, কে উচ্চ,কে নিচ,কে পবিত্র,কে অপবিত্র। অধর্মী লোক সাপের মতো। তাই জবালির কথা শুনে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত হইনি এবং সত্য পথ থেকে সরে আসব না। বরং ফলমূল খেয়ে পিতার আত্মার সদগতির জন্য সমস্ত কর্ম নিয়মমতো সম্পন্ন করে বনবাসে ব্রত পালন করব।’ কথাটা বলে স্বামী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন।
তারপর একইভাবে তীক্ষ্ণ শব্দ ব্যবহার করে পুনরায় বললেন-‘ হে দ্বিজবর,সত্য, ধর্ম,পরাক্রম,দয়া, সুবচন, দেবতা, ব্রাহ্মণ- অতিথি পূজা ইত্যাদিকে সাধুসন্ত লোক উত্তম মার্গ বলে থাকে। কিন্তু আপনি যা ব্যক্ত করলেন, তা অধম এবং বেদ বিরুদ্ধ বক্তব্য। আপনি জনসমাজে ধর্মবিরোধী কথা প্রচার করা একজন লোক। আপনার মতো পাষণ্ড মতির একজন পুরুষকে মহারাজ দশরথ কীভাবে ধর্মযাজক পদে নিযুক্ত করেছিলেন সে কথা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি। আপনার মতো একজন নাস্তিক নমস্য পুরুষ হতে পারেন না । তাই আপনার সঙ্গে কথা বলাও পাপ কাজের মতো।’
সমবেত প্রত্যেকেই বুঝতে পারলেন যে রামচন্দ্রের রাগ হয়েছে। ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ দেখলেন যে কথা বিষম। তাই সমস্ত কথার সমাপ্তি টানার জন্য তিনি বললেন-‘হে রাম, প্রকৃতপক্ষে জবালি নাস্তিক প্রকৃতির লোক নয়। তোমাকে যেনতেন প্রকারে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নেবার জন্য তিনি এসব কথা বলেছেন।’ ব্রাহ্মণ জবালিও আর কথা না বাড়িয়ে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের কথায় সায় দিলেন।
স্বামী জবালিকে এভাবে বলায় আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। কারণ জবালির কথাগুলি আমি বড় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে ছিলাম। একজন রাজপুত্রকে সাধারণ একজন ব্রাহ্মণ এভাবে স্পষ্ট কথা বলতে আমি কখনও দেখিনি বা শুনিনি। অযোধ্যায় সবসময় দেখেছি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রাজাকে এবং রাজা ব্রাহ্মণদের প্রশংসা করে । অযোধ্যায় ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় ছাড়া বাকি নিচকুলের লোকদের কিছুটা হীন চোখেই দেখা হয়েছিল, এমনকি তারা বেদ অধ্যয়ন করলে দেশে দুর্ভিক্ষ,নানা রোগ হবে বলে ও প্রচার করা হয়েছিল।তাই এরকম একটি রাজ্যে ব্রাহ্মণ হলেও জবালির মতো ধর্মীয় বিষয়কে বিশ্লেষণ করে দেখার মতো মানুষের স্থান নেই।তাই জবালি স্পষ্টভাবে যে কথা ব্যক্ত করলেন তার পরিণাম যে অতি দুঃখের হবে,সেকথা আমি তখনই বুঝতে পে্রেছিলাম। তাই বনবাস শেষ করে অযোধ্যায় ফিরে যাবার পরে আমি জবালির খবর নিয়েছিলাম, তখন জানতে পেরেছিলাম যে তিনি পত্নী হিন্দ্রালিনীকে সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যা ছেড়ে নির্জন বনে বাস করার জন্য চলে গিয়েছিলেন।
সেদিন ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠও স্বামী রামকে রাজপদ গ্রহণ করার জন্য অনেক বুঝিয়েছিলেন। বিখ্যাত ইক্ষাকু বংশের জ্যেষ্ঠপুত্র যে সিংহাসনে বসাটা একটা প্রথায় পরিণত হয়ে আসছে সে কথা বলতে গিয়েই ব্রহ্মর্ষি সৃষ্টির শুরু থেকে আমাদের বংশের ইতিহাস বর্ণনা করলেন। একদিক থেকে প্রত্যেকের কথা বলে তিনি দাদু,প্রপিতামহদের কথা বলেছিলেন-‘ তোমাদের প্রপিতামহ নাভাগ ধর্মাত্মা নহুষের পুত্র। ধার্মিক নাভাগার পুত্র হল তোমাদের দাদু অজ। দাদু অজের পুত্র হল তোমার পিতা দশরথ । এই বিখ্যাত বংশের জ্যেষ্ঠ জনই রাজা হয়ে আসছে। যদিও কৈকেয়ীর পুত্র ভরতকে রাজা করতে হবে বলে মহারাজকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিল। তুমিও সত্য পথে থেকে বনবাসে এলে, এখনকার কথাটা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পড়েছে। ভরতকে কিছু না জানিয়েই পুরো ঘটনাটা ঘটেছে। সে অসহায় হয়ে পড়েছে, কলঙ্কের ভয়ে তোমার চরণ ধরে ভিক্ষা চাইছে। ভরতকে তুমি কীভাবে বিমুখ করবে? আশ্রয় এবং সাহায্য যে চায় তাকে সহায়তা করাটা তোমার নীতির মধ্যে পড়ে না কি? তাই তুমি এই বিখ্যাত বংশের কুল ধর্ম উলংঘন না করে রাজপদ গ্রহণ কর। আমি যেহেতু তোমার পিতারও গুরু ,তোমারও গুরু, আমার কথা শুনে রাজপদ গ্রহণ করলে তোমার কোনো অপবাদ থাকবে না। কিন্তু আমার স্বামী তার সিদ্ধান্তে অচল অটল হয়ে রইলেন। আমি তার মনের দৃঢ়তা দেখে খুশি হয়েছিলাম যদিও মানুষটার অন্তর পাথরে তৈরি বলে মনে হয়েছিল।
এদিকে ভরতের অন্তর ক্ষোভে ভরে পড়েছিল। দাদাকে এত কাকুতি-মিনতি করে, চোখের জলে দাদার চরণ ধুইয়ে করা মিনতি, কুল গুরু বশিষ্ঠের বাণী, সমবেত প্রত্যেকের উপদেশ অমান্য করা দেখে স্পষ্ট কন্ঠে সুমন্ত্রকে বললেন-‘ মন্ত্রী সুমন্ত্র আমার জন্য কুশ বনের শয্যা তৈরি করুন। দাদা যেহেতু তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না আমিও এই পর্ণকুটিরের সামনে অনশন আরম্ভ করব।’ ভরতের কথা শুনে প্রত্যেকেই ভয় পেল। কিন্তু দাদা রামচন্দ্র যুক্তিপূর্ণ কথা বলে তার এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করালেন। তারপরে ভরত দাদার পরিবর্তে তিনি চৌদ্দ বছর বনবাস যাপন করার প্রস্তাব দিলেন। -‘ যদি দাদাকে পিতৃবাক্য পালন করতেই হয় তাহলে দাদার পরিবর্তে আামি চৌদ্দ বছর বনবাস যাপন করব।’ ভরতের কথা শুনে স্বামীর কিছুক্ষণের জন্য কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার পরে তিনি ভরতকে এভাবে বোঝালেন-‘ দেখ ভাই, এ সমস্ত ব্যাপারে বদলা-বদলি চলে না। পিতা আমাদের মধ্যে নেই বলেই আমি সক্ষম হয়ে থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে বনবাস কাটাতে দেওয়াটা ধর্ম বিরোধী কথা। এখন আমরা চারভাই মিলেমিশে পিতৃবাক্য পালন করাটা উচিত। আমি চৌদ্দ বছর সম্পূর্ণ হলেই অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে তোমার কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করে রাজ্যশাসন করব। এখন তুমি শ্ত্রুঘ্নের সঙ্গে পিতার বাক্য পালন কর গিয়ে। লক্ষ্ণণ আমার সঙ্গে থাকতে চাইছে যখন থাকুক।’
ভরত বুঝতে পারল এটাই দাদার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তাই সে হাতজোড় করে বলল-‘ আচ্ছা দাদা, আপনার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু আপনার খড়মজোড়া আমাকে দিতে হবে। রাজ সিংহাসনে স্থাপিত হবে সেই পাদুকাজোড়া। আমি সেই সিংহাসনের নিচে বসে আজ যে বেশে রয়েছি সেই বেশে থেকেই রাজ্য শাসন করব। আমার দেহে রাজ আভরণ থাকবে না। থাকবে বল্কল বসন এবং মাথায় জটা ভার। যেখানে দাদা রামচন্দ্র নেই,সেই অযোধ্যায় থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই আমি থাকব অযোধ্যার পাশেই অস্থায়ী রাজধানী নন্দীগ্রামে।’
কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে ভরত চোখের জলে ভেসে পুনরায় বলল-‘ হে দাদা শ্রীরামচন্দ্র, আমার দোষ নেবেন না। আমি আপনার ভ্রাতা। তাই আমার একটি প্রতিজ্ঞা আছে। আমি সেই প্রতিজ্ঞা স্পষ্ট করে ব্যক্ত করতে চাই। আপনার আজ্ঞানুসারে আগামী চৌদ্দ বছর আপনার রাজ্য চালাব। চৌদ্দ বছর পূর্ণ হয়ে যাবার পরের দিন যদি আপনি আপনার রাজ্য সমঝে না নেন, সেদিনই আমি জলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করব। আমার এই প্রতিজ্ঞার কোনোরকম নড়চড় হবে না।’ ভরতের কথা শুনে প্রত্যেকেই চোখের জল ফেলতে লাগল।স্বামীও চোখের জলে ভেসে ভরত শত্রুঘ্নকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে দুজনের মাথার ঘ্রাণ নিয়ে বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন-‘ তোমার কথাই হবে ভরত, তার পরে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সেই দৃশ্য সহ্য করা সবার পক্ষে কঠিন ছিল।
তার পরেই এল বিদায় পর্ব।ভরত চোখের জলে দুগাল ভাসিয়ে এক এক করে আমাদের তিনজনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া দৃশ্য আরও হৃদয়বিদারক ছিল। আমার দুই চরণ চোখের জলে ভিজিয়ে কোনোমতে সে বলল-‘ মাতা, দাদা যেন আপনাকে জনমে জনমে জীবনসঙ্গী হিসেবে পায়। তারপরে ভরত স্বামীর খরমজোড়া একটা সুসজ্জিত হাতির পিঠে ভক্তি সহকারে উঠিয়ে দিলেন। বোধহয় স্বামীর অভিষেক সম্পন্ন করে সেই হাতিতে নিয়ে যাবে বলে সাজিয়ে-গুছিয়ে এনেছিল।
ভরতের ভাতৃ প্রেম দেখে আমার আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলেছিলাম-‘ হে অন্তর্যামী, এই বিশাল এবং নিষ্কলুষ হৃদয় বালককে রক্ষা কর। সে যাতে সুচারুরূপে রাজ্য শাসন করতে পারে তার জন্য তার পথের সহায় হও।’
শাশুড়ি কৌশল্যা আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে একটি শিশুকে আদর করার মতোই চুম্বনে ভাসিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ দিলেন যাতে এই সংকটের সময় আমি স্বামী এবং দেবরের সঙ্গে সুকলমে পার করতে পারি। শাশুড়ি সুমিত্রা এবং কৈকেয়ীও অন্তর উজার করে আশীর্বাদ দিয়ে বিদায় নিলেন। আমরা তাদের চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে ছিলাম। সেই সময় আমার মনে একটা কথা বড় বেশি করে মনে পড়ছিল। সেটা হচ্ছে স্বামীর এই নিষ্কলুষ ভরতের প্রতি যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল সেই ভুলগুলো ভাঙল কি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন