বিদেহ নন্দিনী~ ২৪
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(চব্বিশ)
লক্ষ্ণণ চলে যাওয়ার পরে আমি মানুষটা অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। স্বামীর চিন্তায় ব্যাকুল তো ছিলামই তারমধ্যে লক্ষ্ণণকে যেভাবে আঘাত দিলাম সে কথা ভাবতেও বড় দুঃখ হল। কুটিরের ভেতরে থাকতে আমার ইচ্ছা করছিল না। যত সময় পার হয়ে যাচ্ছিল ততই আমি ছটফট করছিলাম। তাই আমি উঠোনে বেরিয়ে এসেছিলাম।
হঠাৎ একজন সন্ন্যাসী এসে উপস্থিত হলেন। তার পরনে গেরুয়া বসন। নতুন কেনা কাপড়ের মতো উজ্জ্বল এবং পরিষ্কার। মাথায় টিকি, হাতে লাঠি এবং কমন্ডুল। ব্রাহ্মণের উপস্থিতিতে আমার ভালো লাগছিল। নাহলে মনটা বিষাদে ঘিরে ধরেছিল। অন্তত তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারব। স্বামী এবং দেবর চলে না আসা পর্যন্ত তাকে বসতে বলতে পারব। আমি দ্রুত সন্ন্যাসীকে বসার আসন পেতে দিয়ে ফলমূল এগিয়ে দিয়েছিলাম। সন্ন্যাসী অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গের সৌন্দর্য কবিতার মাধ্যমে বর্ণনা করতে লাগলেন। প্রশংসা করার সময় কিছু শব্দ আমার কানে বেজে ছিল। যদিও ভোগবিলাস ত্যাগী তপস্বী একজন রূপ বর্ণনা করা কোনো অভিপ্রায় থাকতে পারেনা বলেই বিশ্বাস করেছিলাম। সন্ন্যাসী বলেছিলেন -'হে সুন্দরী, তুমি সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। তোমার মুখ চোখ পা সমস্তই পদ্ম ফুলের পাপড়ির মতো। তোমার দেহ যেন পদ্ম ফুলে ভরা এক পুষ্করিণী। তোমার দাঁত ছোট ছোট ফুলের কলির মতো। চোখদুটি বিশাল এবং নির্মল। উরু দুটি হাতির শুঁড়ের মতো মাংসল, স্তন যুগল গোল, পরিপুষ্ট, পরস্পরকে স্পর্শ করে থাকা ধরনের। যেন দুটি সুস্পষ্ট তাল ফল। তোমার কোমর ক্ষীণ। হে সুন্দরী, তুমি আমার মন প্রাণ হরণ করে নিয়েছ। দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ, কিন্নর এই সবার মধ্যে তোমার মতো সুন্দরী নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
তারপরে সন্ন্যাসী পঞ্চবটি বন বসবাসের উপযোগী জায়গা নয় বলে কথাটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য বলেছিল-‘এটা মায়াবী রাক্ষসের জায়গা। এখানে কেবল বন্য পশু পাখিরাই থাকে। তোমার মতো একজন সুন্দরী এই বনে কেন আছ আমি বুঝতে পারছিনা।’
আমি তখন আমার পরিচয় এবং বনবাসে থাকার কারণ সংক্ষেপে বর্ণনা করে স্বামী এবং দেবরের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। আমার কথা শেষ হওয়ার পরে সন্ন্যাসী তার যে পরিচয় তুলে ধরে ছিল তা শুনে আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়েছিলাম। উনি বললেন, সীতা, আমি তোমার বিষয়ে সমস্ত শুনেছি। আমার নাম রাবণ।তিন লোকে আমাকে সবাই সমীহ করে চলে। আমি তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। এবং তোমাকে পত্মী হিসেবে পেতে আশা করি। সমুদ্র ঘিরে থাকা লঙ্কা হল আমার রাজ্য। ঐশ্বর্য ধনসম্পত্তি সুখ ভোগ করে তুমি আমার সঙ্গে যেভাবে জীবন কাটাতে পারবে এমনকি স্বর্গেও তুমি সে সুখ পাবেনা। প্রতিদিনই তোমাকে পাঁচ হাজার পরিচারিকা শুশ্রূষা করবে। তুমি আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ কর। রাজ্য থেকে বিতাড়িত ভিখারি রামচন্দ্রের সঙ্গে বনে সংসার করাটা তোমার মুর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়।'
সন্ন্যাসীরূপী রাবণের কথা শুনে দাঁত কড়মড় করে বলেছিলাম-‘ কুলাঙ্গার রাক্ষস, তোর এত সাহস? তুই রামচন্দ্রকে চোখে দেখিস নি। শোন, সিংহ আর শিয়ালের মধ্যে যে ব্যবধান, গভীর সাগর আর ছোট নদীর মধ্যে যে পার্থক্য তোর আৰ রামচন্দ্ৰের মধ্যে ঠিক ততটুকু পার্থক্য। আমার কথা শুনে রাবণ উপহাসের হাসি হেসে তার প্রকৃত রূপ ধারণ করল। তারপরে রাবণ তার শরীরটা বিরাট আকারের ধারণ করে আমাকে এক হাতে খপ করে ধরে লুকিয়ে রাখা রথে তুলে আকাশ মার্গে উড়ে যেতে লাগল। আমি চিৎকার চেঁচামেচি, টানা হেঁচরা করতে লাগলাম। আমি চিৎকার করে করে নদী, গোদাবরী, গাছ লতা তরু তৃণ পশুপাখি সবাইকে অনুরোধ করলাম স্বামী রামচন্দ্রকে এই খবর দেবার জন্য। আমার ক্রন্দনে জটায়ু পাখি রথ অবরোধ করে দাঁড়াল। উপায় বিহীন রাবণ রথ মাটিতে নামাতে বাধ্য হল। জটায়ু রাবনকে পরস্ত্রী হরণ করার মতো মহাপাপে লিপ্ত হতে নিষেধ করলেন-‘ মহাপাতকী রাবণ, আমি বেঁচে থাকতে আমার বন্ধুর পুত্রবধূকে হরণ করতে পারবিনা। তুই যে কাজ করতে চলেছিস তা তোকে সবংশে ধ্বংস করবে।রামচন্দ্রের দৃষ্টিতে তুই ভস্মীভূত হবি। তাই সীতাকে ছেড়ে দে । ’ জটায়ুর উপদেশ শুনে রাবণ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠল। সে তর্জন গর্জন করে জটায়ুকে তিরস্কার করল। শেষে দুজনের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হল। রাবণ যুদ্ধ করে থাকার সময় আমি যাতে নাড়াচাড়া করতে না পারি সেইজন্য খামচে ধরে ছিল। জটায়ু নখের দ্বারা রাবণের দেহ ক্ষত-বিক্ষত করে তুলল। অলংকার সাজ-পোশাক সমস্ত কিছু জটায়ু খসিয়ে ফেলল। রাবণের ধেনু এবং রথ টুকরো টুকরো করে ফেলল। বুঝতে পারলাম ভগবানের কৃপায় আজ এই পাখিই আমাকে রক্ষা করবে। অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে বৃদ্ধ জটায়ু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য থমকে যেতেই রাবণ আমাকে জড়িয়ে ধরে তার মায়াবী শক্তিতে আকাশের উদ্দেশ্যে উড়ে গেল। জটায়ু দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে, পাখা দিয়ে রাবণের চোখে মুখে আঘাত করল এবং নখ ,দাঁত দিয়ে রাবণের পিঠ রক্তাক্ত করে ফেলল। উপায় বিহীন হয়ে রাবণ মাটিতে নেমে এল এবং আমাকে ছেড়ে দিল। তখনই দৌড়ে জটায়ুর কাছে চলে গেলাম। ঠিক তখনই নিষ্ঠুর রাবণ কোমরের খাপ থেকে তরবারি বের করে প্রথমে জটায়ুর ডানা দুটো কেটে ফেলল,তারপরে পা দুটি। আমি গগনভেদী চিৎকার করে জটায়ুকে জড়িয়ে ধরলাম। রাবণ আমার বাঁ হাত ধরে টেনে এনে তার পিঠে উঠিয়ে উড়ে গেলেন। আমি হতবুদ্ধি হয়ে কেবল কাঁদতে লাগলাম। কী করলে এই পাষণ্ডের কবল থেকে উদ্ধার পাব ভেবে পেলাম না। শেষে আমার চাদরের একাংশ ছিড়ে নিয়ে অলংকার সমূহের একটি পুঁটুলি বাধলাঁম। পর্বতের উপরে কয়েকটি বাঁদরকে বসে থাকতে দেখে ওদের মাঝখানে যেন পুঁটলিটা পড়ে সেভাবে ছুড়ে দিলাম । উদ্দেশ্য এই বানর গুলি যেন কোনো প্রকারে স্বামীর কাছে খবর পৌঁছে দিতে পারে। আকাশপথে এভাবে যেতে যেতে একটা সময় আমি রাবণের পিঠে অচেতন হয়ে পড়েছিলাম। সেই পাষণ্ড জানতেও পারেনি । ভেবেছিল আমি তার কথায় রাজি হয়ে যাব । কারণ জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পরে যখন আমি আবার চিৎকার চেঁচামেচি এবং হাত-পা ছুঁড়ছিলাম তখন রাবণ বলেছিল প্রিয়া কেন এরকম আচরণ করছ শান্ত হও তুমি আমার কাছে দৈহিক মানসিক আর্থিক সমস্ত সুখে ডুবে থাকবে।তুমি হবে আমার রাজরানি। কিছুক্ষণ পরে আমাকে নিয়ে লঙ্কাপুরী পৌঁছে গেল। রাবণ আমাকে সোজা অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন রাক্ষসীকে নির্দেশ দিল –‘ এই মানুষটা আমার রানি হবে। তোরা একটি ভালো কাপড়-চোপড় পরিয়ে, অলঙ্কারাদি দিয়ে সাজিয়ে রাখবি। ও যা চায় তাই দিবি। আমার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কোনো স্ত্রী বা পুরুষকে ওর সঙ্গে দেখা করতে দিবি না।মানুষটাকে অপ্রিয় কথা বলে দুঃখ দিবি না বা ক্রোধিত করবিনা। তারপর রাবণ আমাকে শুনিয়ে বলল –‘আমি এখন আসছি। আবার পরে আসব।’
আমি কাপড় চোপড় বা অলংকার পরা তো দূরের কথা এমনকি মাথা তুলে কারোর দিকে তাকালাম না। দুইহাতে মুখ ঢেকে চোখ বুজে বসে রইলাম। স্বামীর কথা মনে করে দুঃখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। লক্ষ্ণণের কথা না শোনার প্রতিফল আমি পেলাম । লক্ষ্ণণকে কটু কথা শোনানোর জন্য ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ কবে পাব সে কথা ভেবে অবিরাম আমার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল।
সারারাত আমি ভয়ে কাঁপতে থাকলাম। কে জানে রাবণ হয়তো বলাৎকার করার মানসে অন্তঃপুরে আসবে। পরের দিন সকালে রাবণ এল। এসেই আমাকে প্রেম নিবেদন করে বলতে লাগল-‘ হে পরম-সুন্দরী সীতা, আমি এমন উন্মাদ হয়ে পড়েছি যে আমার ভার্যাদের কাছে যেতে ইচ্ছা করে না। তোমার শরীর উপভোগ করতে চাইলে আমি এখনই করতে পারি কিন্তু আমি জোর জুলুম করতে চাইছি না। তোমার মন আমার দিকে আকৃষ্ট করতে চাইছি। তাহলে উপভোগের স্বাদই আলাদা হবে। তাই আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছি। আমার প্রাণেশ্বরী তুমি আমাকে পতি হিসেবে গ্রহণ কর। আমার রাজ্য ধনসম্পত্তি সমস্ত তোমাকে অর্পণ করছি। তুমি মিথ্যা বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো দীন দরিদ্র একজনের জন্য কেন কান্নাকাটি করছ বুঝতে পারছি না। প্রকৃতপক্ষে আমিই তোমার স্বামী হওয়ার যোগ্য।সমুদ্রের মধ্যে অবস্থিত এই লঙ্কায় এসে রাম তোমাকে কিছুতেই উদ্ধার করতে পারবে না। তাই তুমি সেই ভিখারির কথা ভেবে তোমার জীবন যৌবন নষ্ট কর না। আমাকে পতিরূপে বরণ করলে তোমার পাপ হবে বলে ভেব না, তোমার এবং আমার মধ্যে যদি স্নেহের ভাব জন্মায়।’
রাবণের কথা শুনে আমার দুই কান গরম হয়ে উঠেছিল। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ছিল। ভাবলাম নীরব থাকলে যে আমাকে দুর্বল বলে ভাববে এবং আমার মনের বিষয়ে কিছু জানতে পারবে না। তাই রাবণের দিকে পেছন ফিরে আমি স্পষ্ট কন্ঠে বললাম-‘ শোনো, আমি একজন পতিব্রতা নারী। আমার মনের বিরুদ্ধে তুই আমার গায়ে হাত দিতে পারিস না। যে মুহূর্তে পতিব্রতা নারীর গায়ে হাত দিবি তোর মাথা খসে পড়বে। আর শোন তোকে দেবতারা বধ করতে না পারে কিন্তু আমার স্বামী রাম তোকে অবহেলায় তোকে বধ করবে। আমার স্বামী ভিখারি বা দরিদ্র নয়। বিখ্যাত কোশল রাজ্যের রাজকুমার পিতা দশরথের প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য কিছুদিনের জন্য বনবাসী হতে হয়েছে। আর ও একটি কথা তুই জেনে রাখবি তোর আর আমার মিলন কোনোদিনই সম্ভব না। আমি হলাম পদ্মফুলে ভরপুর সরোবরে রাজহংসের সঙ্গে খেলা করা রাজহংসী আর তুই হলি পানকৌরি। কথাটা বলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম।তারপর পুনরায় বললাম-‘ তুই হয়তো আমাকে মেরে ফেলতে পারিস। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ আমার জীবনের জন্য কোনো মোহ নেই।’ পরের বাক্যগুলি বলার সময় আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমি নীরব হয়ে রইলাম।
আমার কথা শুনে রাবণ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল। তারপর তর্জন গর্জন করে বলল-‘ সীতা, আমি তোমাকে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য এক বছর সময় দিলাম। যদি এই বারো মাসের মধ্যে তোমার মনের কোনো পরিবর্তন না হয়, তাহলে একদিন আমার সকালের জলখাবারের জন্য তোমার দেহ টুকরো টুকরো করা হবে। তারপরে রাবণ রাক্ষসীদের কাছে ডেকে নিয়ে আমার সম্পর্কে কীসব নির্দেশ দিলেন। রাবণ বেরিয়ে যাবার সময় আমাকে শুনিয়ে রাক্ষসীদের বলে গেল -'তোরা সীতার অহংকার চূর্ণ করবি। এইমুহূর্ত থেকে তাকে অশোক বনে রাখবি।'
স্বর্ণ মণিমুক্তা খচিত রাবণের রাজপ্রাসাদের দিকে তাকালে যদিও চোখ জুড়িয়ে যায় আমার জন্য তা হয়ে পড়েছিল নরককুণ্ড। আমার সেখানে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমাকে শাস্তি হিসেবে অন্তপুর থেকে নিয়ে অশোকবনে রাখায় আমি কিছুটা রেহাই পেয়েছিলাম। রাবণের অশোকবন ও ছিল অতি মনোরম স্থান। আমার কাছে এই বনও হয়ে পড়েছিল নরক কুণ্ড। তবু মুক্ত আকাশের নিচে গাছ বনের মধ্যে নিজের কথা চিন্তা করার মতো একটা পরিবেশ পেয়েছিলাম। তা বলে মুক্তমনে বিচরণ করতে দেওয়া হত না। কড়া পাহাড়ার মধ্যে আমাকে রাখা হয়েছিল। রাক্ষসীরা আমাকে ঘিরে ধরে ক্রমাগত বাক্যবাণে প্রহার করত।একজন রাক্ষসী আমাকে চোখের জল বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছিল-'তোর এত শোক করে কাঁদার আবশ্যক কি? তোর রূপ দেখে লঙ্কেশ্বর পাগল হয়েছে। তুই রাজার রানি হয়ে থাকিস না কেন? এই রাক্ষসীর কথা শেষ না হতেই অন্য একজন বলেছিল -' তুই কান্নাকাটি করলেও লঙ্কেশ্বর তোকে যেখান থেকে এনেছিল সেখানে রেখে আসবে না। রাজা তোর মনের পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে। অন্য মেয়েদের ধরে এনে দিনরাত ভোগ করে ফেলে রাখে বুঝেছিস। আমাদের লঙ্কেশ্বরের বড় প্রতাপ, নিজের স্ত্রী, পরের স্ত্রী বলে কোনো বিচার নেই। যার প্রতি মন যায় তাকেই নিজের করে নেয়।ঠিক তখনই অন্য একজন বলে উঠেছিল-' একে রাজা অনেক কষ্ট করে বহুদূর থেকে এনেছে। সেই জন্যই মন পাওয়ার অপেক্ষা করছে। না হলে আমাদের রাজা অপেক্ষা করার মতো লোক নয়। ওদের মধ্যে ত্রিজটা নামে আধ বয়সী রাক্ষসী ছিল সে এসে আমার কাছ থেকে সমস্ত রাক্ষসীকে তাড়িয়ে দিল-' মানুষটিকে জুলুম করছিস কেন? রাজা বলেছিল না ওকে জোর জুলুম না করার জন্য। তোদের পাহারা দেওয়ার কাজ তোরা পাহারা দে। কী এত কথা বলছিস। ও জানে রাজাকে কখন ভালোবাসতে হবে।'
তারপরে ত্রিজটা আমাকে কোমল স্বরে বলল-' তুই কান্নাকাটি করে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে এভাবে থাকিস না। তোর স্বামী এখান থেকে উদ্ধার করে নিতে পারবে না। তাই রাজার কথা মেনে নে। তখন দেখবি তোর সুখই সুখ।'
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ত্রিজটা জিজ্ঞেস করল-' তোর স্বামী দেখতে খুব সুন্দর নাকি রে? রাজার বোন শূপর্ণখা তোর স্বামীর প্রেমে পড়েছে। তাই দাদাকে দিয়ে তোকে হরণ করিয়েছে। 'আমি কোনো উত্তর না দেওয়ায় রাক্ষসী ত্রিজটা পুনরায় বলল তোরা মানুষগুলি বড় খারাপ । তোর স্বামী আশা পূরণ করেনি তা নাহয় মেনে নিলাম। তাবলে একজন বিধবা মহিলার নাক কান কেটে শাস্তি দিতে হবে নাকি? আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম শূপর্ণখা বিধবা নাকি ? ত্রিজটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-' দাদা রাবণই ওকে বিধবা করেছে। রাবণ না জেনে নিজের বোন শূপর্ণখার স্বামী বিদ্যুজিতকে কেটে দু'টুকরো করেছে। বাড়ি ফিরে এসে বিধবা বোনকে জনস্থানে আপন মনে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা রাজা রাবণই ঠিক করে দিয়েছিল। হঠাৎ তোর মানুষটাকে দেখে শূপর্ণখা তাকে বিয়ে করবে ভেবেছিল। কিন্তু তুই সঙ্গে থাকার জন্য তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল না।তাই শূপর্ণখার তোর উপরে এত রাগ। প্রথমে সে কান্নাকাটি করে খর নামে দাদার কাছে তোর স্বামীর বিরুদ্ধে লাগিয়েছিল। কিন্তু তোর মানুষটা তার খর দূষণ নামে দুটি ভাইকেই হত্যা করায় শূপর্ণখা সোজা এসে লঙ্কায় উপস্থিত হল। এসেই দাদা রাবণকে দুঃখের খবরটা জানাল। অবশ্য তার আগেই রাজা জনস্থান থেকে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা একজনের কাছ থেকে ভাইদের মৃত্যুর খবর পেয়েছিল। বোন শূপর্ণখার কাছ থেকে পাওয়া নিজের পছন্দমত খবর রাজাকে ভাইদের দুঃখ ভুলিয়ে দিল। বোন যতই তোর রূপ ব্যাখ্যা করে দ্রুত তোকে হরণ করে আনার জন্য রাজা কে উৎসাহিত করতে লাগল, রাজা আর অপেক্ষা করতে পারল না। শূপর্ণখা দাদাকে বুদ্ধি দিল যুদ্ধ করে রামকে পরাস্ত করার আশা ছেড়ে দাও। তার পরিবর্তে সীতাকে পালিয়ে নিয়ে আস। এরকম করলে রাম দুঃখেই মরে যাবে। তাই লঙ্কেশ্বর সোজা মামা মারীচের কাছে উপস্থিত হল। মারীচ এর আগে মায়ার সাহায্যে অনেকের প্রাণবধ করেছে। পরে তার কি হয়েছিল জানি না তপস্বী হয়ে বসবাস করছিল। লঙ্কেশ্বর তোকে পালিয়ে নিয়ে আসার জন্য মারীচের সাহায্য চাইল। মারীচ স্বর্ণমৃগ হয়ে তোদের ভুলিয়ে জালে ফেলল। এখন তোর স্বামী তোকে কে হরণ করে নিল, কোথায় নিল, নাকি রাক্ষস খেয়ে ফেলেছে কিছুই জানতে পারবেনা। আর পারলেও এই সাগর পাড়ে এসে তোকে উদ্ধার করতে পারবেনা।
এই রাক্ষসীর মনে কিছুটা দয়া মায়া আছে বলে মনে হল তাই তাকে আমি বললাম-‘ তোমাকে কী বলে সম্বোধন করব জানিনা। তবুও তোমাকে বলছি, আমার স্বামী আমার খোঁজে এখানে এসে উপস্থিত হবেই। এই কথা আমি এমনিতেই বলছিনা। একজন পতিব্রতা নারীর মন থেকে উঠে আসা কথা। তাই স্বামী আসার আগে পর্যন্ত তুমি আমাকে রাজার কাছ থেকে রক্ষা কর।’
আমি কথাটা বলেছি মাত্র রাক্ষসীর শরীর শিউরে উঠল। সে চোখ বড় বড় করে বলল-'কী বললি ? তোকে রাজার কাছ থেকে রক্ষা করতে হবে? তোকে সাহায্য করতে আমি পারব না ।' এ কথা বলে সে আমার কাছ থেকে চট করে চলে গেল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন