বিদেহ নন্দিনী~ ২৭
ডঃমালিনী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস
(২৭)
হনুমানের ধ্বংসাত্মক কার্য অব্যাহত রইল। রাবণ দ্রুত আশি হাজার সৈন্য হনুমানকে আক্রমণ করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। তবে হনুমান ওদের তীর বা শূলকে ভ্রুক্ষেপ করল না । প্রাচীরের উপর থেকে প্রকাণ্ড একটা লোহা একটানে বের করে নিয়ে রাক্ষস সেনাদের একনাগাড়ে নিধন করতে লাগল। তারপর হনুমান তর্জন গর্জন করে বলতে লাগল -'তোরা সবাই শুনেনে আমি শ্রীরামচন্দ্রের দূত এবং কিষ্কিন্ধা নৃপতি সুগ্রীবের মন্ত্রী। আমার নাম হনুমান। আমি আমার প্রভু রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতাকে দর্শন করে প্রণাম জানিয়ে এসেছি। এখন দেখতে চাইছি তোদের শক্তি কতটা। আমার উদ্দেশ্য এতটুকুই। হনুমানের তর্জন গর্জন শুনে আমার গলা শুকিয়ে এল। হাত পা কাঁপতে লাগল। বুকের ধপধপানি বেড়ে গেল। হনুমানের উপরে রাগ হল।মনে মনে ভাবলাম 'জ্ঞানী,গুণী, শক্তিমান এবং বুদ্ধিমান হলেও বাঁদর, বাঁদরই । আমি রাগে মনের ভেতর বিড়বিড় করলাম- 'স্বামী হনুমানকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিল। এই ধরনের কান্ড করার জন্য নিশ্চিত পাঠায়নি। হনুমানের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল আমার বার্তা রামচন্দ্রকে এবং তারবার্তা আমাকে দেওয়া। আজ যদি আমার কোনো অঘটন ঘটে তার জন্য হনুমানকেই দায়ী হতে হবে।কথাটা ভেবে থাকতেই হনুমান রাক্ষসদের কুল দেবতার মন্দির চৈত্যপ্রসাদ ভেঙ্গে ধুলিসাৎ করল। মন্দিরটা ভেঙ্গে ফেলায় রাক্ষসেরা খুব ভয় পেয়ে গেল। রাক্ষস কুলের বিশ্বাসের মন্দিরটা ধ্বংস করায় আমারও খুব দুঃখ হল। হনুমান আর কী ধ্বংস করে তা নিরীক্ষণ করার জন্য আমাকে পাহারা দেওয়া রাক্ষসদের সঙ্গে অশোক বনের একটা ঢিপিতে উঠে দাঁড়ালাম।
এবার হনুমানকে আক্রমণ করার জন্য রাবণ বীর জাম্বূমালীকে পাঠাল। জাম্বূমালী হনুমানের শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করল। হঠাৎ হনুমান পাক মেরে একটা প্রকাণ্ড খুঁটি উপড়ে নিয়ে জাম্বূমালীর মাথায় আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে জাম্বূমালীর প্রাণ বেরিয়ে গেল। তারপর রাবণ এক এক করে কয়েকটি দুধর্ষ যোদ্ধার দল পাঠাল হনুমানকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকটি দলই হয় মৃত্যুকে বরণ করে নিল অথবা পালিয়ে গেল। দুধর্ষ যোদ্ধার পরাজয় দেখে রাবণ পুত্র অক্ষকুমারকে হনুমানকে বধ করার জন্য পাঠালেন। বলতে শুনেছিলাম রাবণের পুত্র অক্ষকুমার নাকি ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্তের মতোই মহাবীর। অক্ষকুমার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ গতিতে বাণ চালিয়ে হনুমানের দেহ রক্তাক্ত করে তুলল। আমি বুঝতে পারলাম এবার হনুমানের রক্ষা নেই যেকোনো মুহূর্তে অক্ষকুমারের শর হনুমানের বক্ষ ভেদ করবে। আমি মনে মনে ভগবানের আরাধনা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ হনুমান অক্ষকুমারের রথের কাছে এসে হাত দিয়ে রথের আটটা ঘোড়া চেপে ধরল। তারপর বীর অক্ষকুমারের দুই পা খামচে ধরে উপরে সহস্র পাক ঘুরিয়ে মাটিতে নিক্ষেপ করল। অক্ষকুমারের হাড়গোড় ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে গেল এবং জীবনের সমাপ্তি ঘটল।
রাবণের দুর্বুদ্ধির জন্যই বীর পুত্র অক্ষকুমারের জীবনের অবসান ঘটল। পুত্রকে হারিয়ে রাবণ দুঃখ পেয়েছিল কিনা জানিনা কারণ তিনি মুহূর্তের মধ্যে অন্য এক পুত্র রাক্ষস কূলের সর্ব শ্রেষ্ঠ বীর ইন্দ্রজিৎকে হনুমানকে বধ করার উদ্দেশ্যে পাঠালেন। অনেকক্ষণ হনুমান ইন্দ্রজিৎ এর বাণ ব্যর্থ করে দিল। ইন্দ্রজিৎ বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে হনুমানকে বধ করা সম্ভব নয়। তাই ইন্দ্রজিৎ একটা বাণকে মন্ত্রের দ্বারা ব্রহ্মপাশ বাণে রূপান্তরিত করে হনুমানের দিকে নিক্ষেপ করল। সঙ্গে সঙ্গে সেই বাণ হনুমানের বিশাল দেহটাকে বেঁধে ফেলল।
হনুমানকে বন্দি হতে দেখে আমি স্থির থাকতে পারলাম না ।আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমার হাত পা পাথরের মতো ঠান্ডা হয়ে এল। আমার আর হনুমানের মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ভগবানকে মনের মধ্যে স্তুতি করে স্বামীকে স্মরণ করেছিলাম। কিছুটা প্রকৃতিস্থ হওয়ার পরে মনটাকে এভাবে সবল করেছিলাম যে জন্ম নিলে মৃত্যুবরণ করতে হবেই। তাই জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সত্যের প্রতীক হয়ে মৃত্যুকে আপন করে নেব। কথা চিন্তা করে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ ত্রিজটা এসে উপস্থিত হল। এসেই বলতে শুরু করল-' সীতা, রামচন্দ্রের দূত বাঁদরটা বিশাল বড় বীর এবং জ্ঞানী ।রাজাকে নম্রভাবে যে সমস্ত কথা বলল তাতে অনেক সভাসদ খুশি হয়েছে।
ত্রিজটার কথা শুনে আমি বেশ স্বস্তি পেলাম। সাহস করে এবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-' হে আমার বিপদের বান্ধবী,অনুগ্রহ করে আমাকে বলবে কি বর্তমানে হনুমান কেমন আছে? সে সুস্থ তো? হনুমান কী্যয় এমন বলেছিল যাতে সভাসদরা খুশি হয়েছে, আমার তা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।আমার কথা শুনে ত্রিজটা অবাক হয়ে বলল, 'ভালো কথা বলেছিস। এতগুলি শরের আঘাতের পরও বাঁদরটা কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ রয়েছে । সে নকি ভান করেছিল। রাজার সামনে সমস্ত কথা নির্ভীকভাবে স্বীকার করে বলেছিল -'মহাপাপী লঙ্কেশ্বর ,আমি শ্রীরামচন্দ্রের দূত।আপনাকে একবার সাক্ষাৎ করে যাবার জন্যই অশোক বন ছিন্নভিন্ন করলাম। না হলে তো আপনাকে সাক্ষাৎ করার কোনো উপায় ছিল না ।আপনার বীররা আমাকে আক্রমন করায় আমি আত্মরক্ষার জন্যই যুদ্ধ করেছিলাম। মেঘনাদ বলে খ্যাত আপনার রাজ্যের শ্রেষ্ঠ বীর ইন্দ্রজিৎ আমাকে ব্রহ্ম পাশের দ্বারা বন্দি করেছে ।কিন্তু ব্রহ্মপাশের দ্বারা আমাকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। সেটা আমাকে ব্রহ্মার দান ।আমি মাত্র একমুহূর্তের জন্য বাঁধা পড়েছিলাম ,আপনার দর্শনের আশায় আমি নির্জীব ভাবে পড়ে থাকার ভান করেছিলাম । এখন আপনার দর্শন পেয়েছি যখন কয়েকটি কথা বলে চলে যাব ।আপনি রামচন্দ্রের ভার্যা সীতাদেবীকে হরণ করে এনে বন্দি করে রেখেছেন। এটা অতি গুরুতর অপরাধ ।মূর্খ না হলে কেউ রামের সঙ্গে শত্রুতা করে না। তাই আমি আপনাকে বলছি আপনি ভালোয় ভালোয় সীতা দেবীকে রামের হাতে অর্পণ করে আপনার এবং রাজ্যের মঙ্গলের কাজ করুন। না হলে আপনার পতন অনিবার্য ।কথাটা বলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল । তারপর পুনরায় বলল -'বাঁদর হলেও সহজ কথাই বলেছিল ।তবে হনুমানের কথা শুনে আমাদের রাজা ক্রোধে জ্বলে উঠেন। এমনকি হনুমানকে মৃত্যুর আদেশ দিয়েছিল। তবে রাজার ভাই বিভীষণ বললেন -'দূত সদাই অবধ্য। কোনো শাস্ত্রেই দূতকে বধ করার কথা লেখা নেই। শেষ পর্যন্ত রাজা ভাইয়ের কথা মেনে নিল। শাস্তি হিসেবে বাঁদরটার লেজে আগুন লাগিয়ে রাজপথে ছেড়ে দেবার কথা বলল।'
ত্রিজটা আমাকে হনুমানের সংবাদগুলি দিয়ে থাকার সময় আমি রাজভবনের উপরে অগ্নিশিখা দেখতে পেলাম। সুবিধা মতো একটা জায়গা থেকে সেদিকে তাকালাম। নিমেষের মধ্যে সেই আগুন অন্যান্য প্রাসাদে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে সেই আগুন মন্ত্রী প্রহস্ত, ইন্দ্রজিৎ কুম্ভকর্ণের বাস ভবন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রী,বীর, মহাবীরের বাড়ি দপ দপ করে জ্বলে উঠল। রাক্ষসদের মধ্যে সন্ত্রাস চিৎকার চ়েঁচামেচি কোলাহলের সৃষ্টি হল।
ঠিক তখনই এককর্ণা নামের একজন রাক্ষসী দৌড়ে এসে ত্রিজটাকে বলল-' এই সর্বনাশী মানুষটাকে লঙ্কেশ্বর কেন রাজ্যে এনেছিল বলতে পারিনা। তার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকা বাঁদরটা সমগ্র রাজমহলগুলি ছারখার করেছে। সেই দুর্দান্ত বাঁদরের গায়ে কোনো যাদু মন্ত্র আছে।’
ত্রিজটা মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল-' এই দাঁড়া কী বকবক করছিস।রাজা লেজে আগুন লাগিয়ে রাজপথে ঘোরানোর আদেশ দিয়েছিল। এতগুলি বীর এবং পাহারা থাকতে হনুমান রাজমহল গুলিতে আগুন লাগাতে পারল কীভাবে?' এককর্ণাও মুখ ঝামটা দিয়ে বলল-' সেই জন্যই তো বলছি এই বাঁদর জাদু বাঁদর। তার লেজ কাপড় দিয়ে মোড়ানোর সময় সে যতই দেহটাকে দীর্ঘ করে যাচ্ছিল,যারা কাপড় দিয়ে দেহটাকে মুড়ে দিচ্ছিল তারা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তেল ঢেলে লেজে আগুন লাগিয়ে তাকে রাজপথে ঘোরানোর সময় হঠাৎ বাঁদরটা লাফ মেরে রাজভবনের উপর উঠে একদিক থেকে আগুন দিয়ে গেছে। আমি ভয়ে দৌড়ে এখানে এসে পৌঁছেছি। এভাবে কথা বলার সময় আমি রাবণের সাত মহলের মহালটা দপ দপ করে জ্বলে উঠতে দেখলাম।
ত্রিজটা এবং এককর্ণা রাবণের সাত মহলের রাজমহলটার দিকে তাকিয়ে বিলাপ করতে লাগল। তখনই হনুমান আমার কাছে এসে উপস্থিত হল। সঙ্গে সঙ্গে এককর্ণা দৌড়ে পালিয়ে গেল। ত্রিজটাও কিছুই না বলে সেই জায়গা থেকে সরে পড়ল। আমি কৃত্রিম ক্রোধে হনুমানকে বললাম-' হে বীর তুমি আমাকে কতটা চিন্তা দিয়েছ তা বুঝতে পার?’
হনুমান হাতজোড় করে বলল-'হে দেবী জানতে পারলাম বলেইতো পুনরায় এখানে এসেছি। আমার দোষ ক্ষমা করবেন। আসলে কী জানেন রামচন্দ্রের দূত হলেও বাঁদরের প্রকৃতি কোথায় যাবে ?তাই কিছুটা বাঁদরামি করে আমার শক্তির কিছুটা আভাস দিয়ে এলাম ।হঠাৎ আপনার কোনো বিপদ হয়েছে বলে আশংকা করে আবার দেখতে এলাম ।আমি হনুমানের সর্বশরীরের দিকে দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞাসা করলাম -'তোমার শরীরে কোথাও পোড়া বা অস্ত্রের আঘাত লেগেছে নাকি? হনুমান আনন্দের সঙ্গে বলল -' কোথা থেকে লাগবে? আপনার প্রার্থনা ভগবান শুনেছেন। তাতে অগ্নিদেব আমার পিতা বায়ু দেবের বন্ধু নয় কি? আমি বড় কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম -'তোমার লেজের সেই প্রকাণ্ড আগুন কীভাবে নেভালে? হনুমান হেসে বলল -'রাক্ষসের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে বিরক্ত লাগায় আমার দেহটাকে ছোট করে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গেই লেজে বেঁধে দেওয়া কাপড়ের পুটলিটা নিজে থেকেই খসে পড়ল। অবশিষ্ট আগুনটা সাগরের জলে চুবিয়ে নেভালাম।আমি আর কথা না বাড়িয়ে স্নেহের সঙ্গে বললাম-' বাছা তুমি আমার কাছে থাকলে আমি কোনো কিছুতেই ভয় করব না। তাই তোমাকে দুদিন থেকে যেতে বলতে ইচ্ছা করছে কিন্তু তোমার প্রভু রাঘব চিন্তা করবে। তার চিন্তা দুঃখ ,কষ্ট ,আমি সহ্য করতে পারব না ।আমার কথা শুনে হনুমান বলল -' হে মাতা ,আমি আজই গিয়ে প্রভু রামকে আপনার কথা বলব ।তাই আর দেরি না করে বিদায় চাইছি ।একথা বলে হনুমান আমাকে প্রণাম জানিয়ে প্রস্থান করল। সে যাতে নিরাপদে স্বামী রামচন্দ্রের কাছে পৌঁছে যায় তার জন্য আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানালাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন