বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২১

বিদেহ নন্দিনী~ ৩২ ।। ডঃমালিনী ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস ।।Bideha Nandini-32

 

বিদেহ নন্দিনী~ ৩২

ডঃমালিনী 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস 

(৩২)


(৩২)

হনুমানের দ্বারা  সংঘটিত হওয়া ঘটনাগুলির পরের কথা। একদিন বিকেলে বিভীষণের পত্নী সরমা এসে উপস্থিত হল। সরমাকে আসতে দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। কারণ হনুমান কাণ্ডের পর থেকে সরমা, কলা আমার কাছে আসেনি। এমনকি আমাকে পাহারা দেওয়া রাক্ষসীরাও খুব একটা কাছে আসতে সাহস করেনা। অবশ্য একদিন ত্রিজটা  কিছুক্ষণের জন্য এসেছিল। অনেকদিন পরে সরমাকে দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছিল, আমি সরমার চেহারা দেখে অবাক হয়েছিলাম। চোখ জোড়া লাল, তখন ও ছল ছল করছে। মুখ মলিন, সাজ-পোশাকের পারিপাট্য ছিলনা। অন্যান্য সময়ে সরমা প্রথমে আমাকে সম্ভাষণ জানায়। কিন্তু সেদিন মুখ দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ না করে সোজা আমার কাছে এসে বসল। তারপর আমার বা হাতে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। এই ধরনের অস্বাভাবিক কাণ্ডে আমি খুবই অবাক হলাম। মনে ভয় হল কে জানে আমাদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তার আদানপ্রদান হয়তো রাবণ জানতে পেরে গেছে। তাই আমার কোনো বিপদ হবে বলে আশঙ্কা করে সরমা  কাঁদছে। কে জানে হয়তো রাবণ মা-মেয়ে দু'জনকেই অশোকবনে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছে। আমি ডান হাতটা তার পিঠে বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সর্বগুণী সরমা আপনি এরকম করছেন কেন? এভাবে হৃদয় ভাঙ্গা কান্নায় কেন ভেঙে পড়ছেন? এই পৃথিবীতে এমন কে আছে যে আপনার অন্তরে দুঃখ দিতে পারে ?সরমা কান্না সম্বরণ করে নিয়ে বলল-' জানকী আমার স্বামী বিভীষণ তার চারজন অনুচরের সঙ্গে আজ লঙ্কা ত‍্যাগ করে চলে গেছে তোমার পতি রামচন্দ্রের কাছে। কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি স্তব্ধ হয়ে রয়েছি দেখে সরমা বলল -'তুমি হয়তো জান না তোমার স্বামী রাম, লক্ষ্মণ, কিস্কিন্ধার রাজা সুগ্রীব, হনুমান, বীর অঙ্গদ,নীল,নল আদি বীর সাগরের তীরে সমবেত হয়েছে লঙ্কা আক্রমণ করার জন্য। গুপ্তচরের কাছ থেকে এই খবর পাওয়ার পরেই আমার পতি বিভীষণ দাদা রাবণকে অনেক উপদেশ দিয়ে বলেছিল-' এখন ও সময় আছে ,রামের সঙ্গে মিত্রতা কর। আপনার বাকি মন্ত্রীরা যে সমস্ত মন রাখা কথা বলছে তাতে মোহিত না হয়ে  রামের সঙ্গে যুদ্ধ করা থেকে বিরত হন ।রামচন্দ্র আপনি ভাবার মতো সাধারণ পুরুষ নন।

এরকম একজন মহান পুরুষের পত্নীকে হরণ করে আপনি বড় অপরাধ করেছেন। সেই অপরাধের জন্য আপনার স্বর্ণালঙ্কা ধ্বংস হতে চলেছে। যদি ভেবে থাকেন, খর দূষণকে বধ করার জন্য সীতাকে হরণ করেছেন, তাহলে আপনার পক্ষে সেটা ভুল হয়েছে। কারন খর দূষণকে বধ করার জন্য রামচন্দ্র জনস্থানে যায়নি। তারাই সৈন‍্য সামন্ত নিয়ে রামচন্দ্রকে আক্রমণ করার জন্য এসেছিল। তাই রামচন্দ্র আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছে। তাই হে রাজন, রামের সঙ্গে শত্রুতার ভাব ত্যাগ করে মিত্রতা স্থাপন করুন। তাহলে আমাদের প্রত্যেকেরই কল্যাণ হবে। কিন্তু আমার পতির সহজ কথা শুনে রাবণের ক্রোধ হল। এমনকি রাবণ পুত্র ইন্দ্রজিৎ কাকাকে  অনেক তিরস্কার করলেন-' কাকা, তুমি বিখ্যাত পৌলস্ত বংশে জন্ম লাভ করে কেন এই ধরনের কথা বলছ আমি বুঝতে পারছি না। বিখ্যাত রাক্ষস বংশে জন্মগ্রহণ করে রাম লক্ষণ নামের দুজন সাধারণ মানুষকে ভয় করাটা শুধু লজ্জাজনক কথাই নয় এমনকি অপমানজনকও।স্নেহের কাকা, তুমি ভুলে গিয়েছ কি আমি ইন্দ্রকে বন্দি করে লঙ্কায় নিয়ে এসেছিলাম।ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতকে দাঁতে ধরে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে টেনে নামিয়ে ছিলাম। সমস্ত দেবতা  আমার ভয়ে কম্পমান। সমস্ত কিছু জেনে শুনে তুমি কেন রামচন্দ্রকে ভয় করার মতো কথা বলছ? ছেলের কাছ থেকে উৎসাহজনক কথা শুনে রাবণ বিভীষণকে সভাসদদের সামনে তিরস্কার করলেন-' ভাই বিভীষণ, বিষাক্ত সাপের সঙ্গে বাস করা যায় কিন্তু বাইরে মিত্রতা দেখিয়ে অন্তরে শত্রুতা ভাব নিয়ে থাকা দাদা ভাইয়ের একসঙ্গে থাকা বড় বিপদজনক কথা। আমি আজকে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি, তুমি আমার বড় শত্রু। ত্রিজগতে আমার সম্মান, দমনকারী রূপ,যশ, সম্পদ, ঐশ্বর্য তোমার সহ্য হচ্ছে না।আমাকে পরাজিত করার জন্য তুমি শত্রুপক্ষকে  সাহায্য করবে।জাতি ভাইয়ের থেকে হতে পারা বিপদ সবচেয়ে ভয়ানক।  পদ্ম ফুলের পাপড়িতে  জলবিন্দু যেভাবে স্থায়ী হতে পারে না তেমনই তোমার মতো ভাইয়ের অন্তরেও আমার প্রতি স্নেহ স্থায়ী হতে পারে না। তুমি আজ যে কথা বললে আমার তোমাকে কারাদণ্ড দেওয়া উচিত ছিল।'

দাদার মুখে এই ধরনের কঠিন বচন শুনে পতি বিভীষণ দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে বললেন-' মহারাজ রাবণ, আমি আপনার এবং দেশের মঙ্গলের জন্য বলা কথা বলি বলে আপনার খারাপ লাগল। আমাকে আপনি যেহেতু শত্রু বলে ভেবেছেন তাই আমি চলে যাচ্ছি। আপনি মিত্রদের সঙ্গে লঙ্কাপুরী রক্ষা করতে থাকুন। একথা বলে পতি বিভীষণ আমার থেকেও বিদায় নিয়ে তার চারজন অনুচরসহ রামচন্দ্রের শিবিরের অভিমুখে চলে গেলেন। কথাটা বলে সরমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি সরমার মনের অবস্থার কথা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। যদিও কী বলে সান্ত্বনা দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবুও স্বামীর বিষয়ে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলাম, হে ধর্মপ্রাণ সরমা আপনার শোক নিবারণ করার আমার শব্দের অভাব ঘটেছে। তাই আপনি নিজগুনে শোক সম্বরণ করুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ধর্মাত্মা বিভীষণ কখন ও বিপদে পড়বে না। কারন আমার স্বামী রামচন্দ্রের অন্তর কোমল মহাসাগরের মতোই বিশাল, নির্মল। সব সময় সৎ পথে পরিচালিত চিন্তা সুস্থির এবং উচ্চ মার্গের। শরণাগতকে তিনি সর্বদা আশ্রয় দেন। স্বামী সহজ সরল মানুষকে চিনতে পারেন। তাই ধর্ম পুরুষ বিভীষণকে তিনি অন্তরে নিশ্চয়ই ঠাঁই দেবেন। তাই হে মাতা আমি আপনাকে পুনর্বার বলছি, যে পুণ্যাত্মা বিভীষণের কোনো অপকার হবে না। দুজন দুজনের উপকারে আসবে।তাই আপনি মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর করুন। মন শক্ত করে সহজ পথে থেকে আপনার দৈনন্দিন কর্তব্য করে যান। আপনি এভাবে  কান্নাকাটি করলে কলাদের কে বোঝাবে? তাই হে নিষ্কলুষ সরমা, ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে আপনি ধৈর্য ধরুন।'

এভাবে কিছুক্ষণ বুঝিয়ে বলার পরে সরমা চোখের জল মুছে আমার থেকে বিদায় নিয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথে চলে গেল। এমনিতেই আমার অন্তর অনবরত কাঁদতে থাকে। তারমধ্যে নির্মল চরিত্রের মানুষগুলির দুঃখ দেখলে শোকে আমার হৃদয় যেন ভেঙ্গে যাবে বলে মনে হয়। তাই সেদিন অশোক গাছের নিচে বসে অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সরমার সঙ্গে আমার এটাই শেষ দেখা। এখন থেকে হয়তো সরমার চলাফেরা সীমিত করার জন্য রাবণ বাধ্য করবে। অবশ্য দুঃখের মধ্যে স্বামী রামচন্দ্রের লঙ্কা  আক্রমণের প্রস্তুতি চালানোর খবর শুনে বেঁচে থাকার জন্য কিছুটা প্রেরণা পেয়েছিলাম। খবরগুলি সঠিকভাবে জানার জন্য আমার হনুমানের মতো একজন সংবাদদাতার প্রয়োজন ছিল। তবে এই রাক্ষসপুরীতে  কোথায় পাব হনুমানের মতো গুণী, জ্ঞানী প্রাণী। কথাটা ভাবতে ভাবতেই ত্রিজটা এসে হাজির হল।ত্রিজটা  আমার কাছে বসে চুলটা আঁচড়ে  দিয়ে আদর করে বলল-' জনক নন্দিনী আমি তোকে বলেছিলাম না তোর দুঃখের দিন শেষ হয়ে আসছে বলে?'

আমি সাধারন ভাবে বললাম-' তুমি তো সবসময় আমাকে সুখে ডুবিয়ে রাখতে চাও। আজ কী ধরনের সুখের কথা বলতে চাইছ একটু খুলে বলবে? 

ত্রিজটা উদাস মনে বলল-' মা, এখন তোর ভালো দিন আসা মানে রাক্ষসপুরীর দুর্দশা। কিন্তু উপায় নেই, লঙ্কেশ্বর কারও কথা শুনে না যখন সবাইকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। 

আমি ত্রিজটার ডান হাতের উপরে আমার একটা হাত রেখে বললাম এভাবে কেন বলছ? সৎ লোককে কেউ  মারতে পারেনা। 

ত্রিজটা আমার কথায় খুব বেশি গুরুত্ব  না দিয়ে বলল-'তুই হয়তো জানিস না? দশরথ নন্দন, ভাই লক্ষ্মণ কিস্কিন্ধার রাজা সুগ্রীব সৈন্য সামন্ত নিয়ে   সাগরপাড়ে ছাউনি পেতেছে। লঙ্কা আক্রমণের উদ্দেশ্যে। তবু আমাদের রাজার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ।ভাই বিভীষণ এবং কয়েকজন সভাসদ ছাড়া বাকি প্রত্যেকেই রাজাকে উত্তেজিত করে চলেছে। বিভীষণকে রাজা এভাবে তিরস্কার করল যে তিনি রাজ্য ছেড়ে রামচন্দ্রের শরণাগত হতে বাধ্য হলেন। কথাটা বলে ত্রিজটা কিছুক্ষন অপেক্ষা করল। তারপর পুনরায় বলল -'যদিও আমাদের রাজাকে চট করে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তবুও সভাসদরা এভাবে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রাজাকে উত্তেজিত করা ঠিক নয় । তারা ভাবছে রাজা রাবণ দেবতা, অসুর,  গন্ধর্ব, যক্ষ, দানব সবাইকে যখন বশ করেছে তাহলে মানুষকে জয় করা তো কোনো বড় কথা নয়। তারমধ্যে সংখ্যায় মাত্র দুজন। বাকি সৈন্যরা বাঁদর, ভালুক। তবে  ওরা বুঝতে পারেনি যে এবার ব্যাপারটা আলাদা। রাবণ ব্ৰহ্মার কাছ থেকে বর পেয়েছিল যে দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ,নাগ আদি তাকে পরাজিত করতে পারবে না।  মানবকে নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী বলে মানুষের কথা গণনার মধ্যেই আনেনি।  তাই মানুষ, বাঁদর, ভালুক ইত্যাদির দ্বারা  তিনি যেন অবধ‍্য না হন এইরকম বর কামনা করেন নি। তাছাড়া রাম হলেন সাক্ষাৎ বিষ্ণু এবং ভাই লক্ষ্মণ তারই অংশ। আমি ত্রিজটার মুখে এত বড় কথা শুনে আশ্চর্য হয়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম ত্রিজটা বলা কথা গুলি তার  নিজের বিশ্লেষণ না রাক্ষস পুরীতে  দুই একজন জ্ঞানীর  মধ্যে আলোচিত কথাবার্তা। যাই হোক না কেন একজন রাক্ষসী এত অধ‍্যয়নপুষ্ট ব্যক্তির মতো কথা বলতে পারাটা আমাকে বিস্মিত করল।

  আমি ত্রিজটার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম তিনি মানসিক দ্বন্দে ভুগছেন। একদিকে দেশপ্রেম, অন্যদিকে ন‍্যায়। তাই ত্রিজটাকে আশ্বাস দেবার জন্য বললাম-' হে জ্ঞানী সুহৃদ, তোমাকে আমি স্পষ্ট করে একটা কথা এখনই বলে রাখি, আমার স্বামী রামচন্দ্র অতি বিবেচক পুরুষ।তিনি ধর্মাত্মা, পুণ্যাত্মা ,বৃদ্ধ ,বালক কারও অপকার হতে দেবে না। তাই তুমি নিশ্চিন্ত থাক।তোমাদের লংকা, লংকাই থাকবে। মাত্র স্বামী রামচন্দ্র পাপী, অত্যাচারী সবাইকে বধ করে একটি সুন্দর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...