বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২১

বিদেহ নন্দিনী~ ৩৩ ।। ডঃমালিনী ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস , Bideha Nandini- 33

বিদেহ নন্দিনী~ ৩৩

ডঃমালিনী 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস 

(তেত্রিশ)
  এই কয়েকদিন আমার মনে মাত্র একটাই চিন্তা। রাম এবং তার সৈন্য বাহিনী মহাসমুদ্র কীভাবে পার হবে? হনুমান এবং কিস্কিন্ধার রাজা সুগ্রীবের জন্য চিন্তা নেই। কিন্তু বাকিরা ? আমাকে পাহারা দেওয়া রাক্ষসদের কথাবার্তা থেকে কিছুই বুঝতে পারছিনা। রামচন্দ্রের বাহিনী সাগর পার হতে পেরেছে কিনা, নাকি এখন ও ওপারে। এদিকে ত্রিজটা কিছুদিন ধরে আমার খবরা খবর নিতে আসছে না। আমি বড় দুশ্চিন্তায় ভুগছিলাম ।মনের মধ্যে কথাগুলি আলোচনা করার সময় একদিন বিভীষণের কন্যা কলা এসে উপস্থিত হল। তার মুখমন্ডল নিরানন্দ। কলা ফ‍্যাকাশে হাসি হেসে   আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল-' সীতাদেবী, আপনি এখন ও জানতে না পারা একটা সংবাদ দিতে এসেছি। 
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।
কলা বলতে আরম্ভ করল। জ্যাঠা রাজা রাবণের একজন গুপ্তচর সংবাদ এনেছে যে  আপনার স্বামী রামচন্দ্র,ভ্রাতা  লক্ষ্মণ এবং বড় বড় বাঁদর বীরের  সঙ্গে সাগর পার হয়ে এসে লঙ্কার সীমানায় ছাউনি পেতেছে। কলার বহুমূল্য কথা গুলি শুনে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। কলা পুনরায় বলল-''জ্যাঠা রাজা রাবণ শুক নামের একজন রাক্ষসকে শত্রু পক্ষের শক্তির পরিমাণ জেনে আসার জন্য পাঠিয়েছিল। তাকে এর সঙ্গে এটাও  দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যাতে যেভাবেই হোক কিস্কিন্ধার রাজা সুগ্রীবকে কিস্কিন্ধায় ফেরৎ  পাঠিয়ে দিতে পারে। শুক টিয়া পাখির রূপ ধরে রামের ছাউনিতে গিয়েছিল। যদিও বাঁদর সেনারা তাকে রাক্ষস বলে বুঝতে পেরে কিল-লাথি মেরে তার অবস্থা কাহিল করে তুলেছিল। আপনার স্বামী নাকি শুককে প্রাণে না মেরে বন্দি করার আদেশ দিয়েছিল। শুককে বেশকিছুদিন রামচন্দ্রের ছাউনিতে বন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিল। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি  সম্পূর্ণ করে এখন শুককে  ছেড়ে দিয়েছে রাজা রাবণকে যুদ্ধের সংবাদ দেওয়ার জন্য। সেই শুক শত্রুপক্ষের বল বিক্রম দেখে শুনে রাজাকে একটা কথাই বলেছে যে রামচন্দ্রের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ অসম্ভব। তাই সীতাদেবীকে সসম্মানে ফিরিয়ে দেওয়াই ভালো হবে। কিন্তু জ্যাঠা আর কোথায় ভালো কথা শুনবে। শুকের মুখে শত্রু পক্ষের শক্তির কথা শুনে আজ তিনি নড়েচড়ে বসেন। কারণ শুক কেবল গুপ্তচরই নয়, একজন বড় বীরও । তাই রাবন বীর, সেনাপতি সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছে। কথাটা কলা দ্রুত বলে গেল ।
কলার কাছ থেকে খবরটা পাওয়ার পরে আমার মনে কিছুটা আশার আলো জ্বলে উঠল। সেদিন প্রথমবারের জন্য আমার রাক্ষস পুরীতে কিছুটা ঘুমের ভাব এসেছিল। পরেরদিন সকালে আমি আলুথালু মনে ত্রিজটা, সরমা এবং কলার  জন্য পথ চেয়ে বসে ছিলাম। কে জানে হয়তো ভালো খবর আসবে। তবে আমার আশায় ঠান্ডা জল ঢেলে মুখে উপহাসের হাসি নিয়ে রাবণ এসে উপস্থিত হল। এসেই বলতে শুরু করল-' সীতা, রামকে কেউ বধ করতে পারবেনা বলে বড় গর্ব করছিলে না। রামচন্দ্রের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবেনা বলে অহংকার করেছিলে কিন্তু তোমার পতি রাম নিহত হয়েছে। সাগর পারের ছাউনিতে রাত্রিবেলা শুয়ে থাকার সময় আমার সৈন্যবাহিনী গিয়ে রামের শিবির লন্ডভন্ড করে ফেলার সঙ্গে তার শিরচ্ছেদ করেছে। তোমার দেবর লক্ষ্মণ, লঙ্কায় উৎপাত করে যাওয়া বাঁদর হনুমান, সুগ্রীব ,নীল,অঙ্গদ,নল সমস্ত বীর নিহত হয়েছে। তুমি দেখলে রাবণের  পরাক্রম ?এখন তুমি আমার কাছে আত্মসমর্পণ করার বাইরে আর কোনো রাস্তা নেই। তাই এখন আমাকে পতি হিসেবে গ্রহণ করে লঙ্কার মহারানী হয়ে জীবন উপভোগ কর। রাবণের কথা শুনে আমি বজ্রাহত  হয়ে গেলাম ।রাবণ পুনরায় বলতে শুরু করল -'কী হল বিশ্বাস হচ্ছে না? এই বলে দশানন একজনকে ডেকে আদেশ দিল -'মুহুর্তের মধ্যে রামের শির এখানে নিয়ে আয়। জানকী নিজ চোখে একবার দেখে নিক।'
কয়েক মুহুর্ত পরেই একজন অনুচর তার এক হাতে স্বামী রামের কাটা শির অন্যহাতে রামের সেই বৃহৎ ধেনু নিয়ে হাজির হল। আমি স্বামীর মুখ  স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তারপরে একটা বিকট চিৎকার করে মাটিতে ঢলে পড়লাম।
  যখন আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল তখন বিভীষণের পত্নী সরমাকে আমার কাছে দেখতে পেলাম ।আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। সরমা আমার চোখের জল মুছে দিল। তারপর সান্ত্বনা দিয়ে বলল-' বৈদেহী,তুমি শোকে ভেঙ্গে পড়ার কোনো কারণ নেই । রামচন্দ্রের মৃত্যু হয়নি। তুমি যা দেখলে তা রাক্ষসের মায়া মাত্র । তুমি যাতে লঙ্কেশ্বরের কাছে আত্মসমর্পন কর তার জন্য পাপীষ্ঠ এই চেষ্টা চালিয়েছে। আমাদের লঙ্কা নগরে বিদ্যুৎজিহ্ব নামে একজন রাক্ষস মায়া বিদ্যায় বড় দক্ষ। তাকে অবিকল রামের মতো একটা মাথা এবং ধনু মায়া বিদ্যার সাহায্যে তৈরি করে দিতে বলতে আমি নিজের কানে শুনে ছিলাম। যদি রামকে বধ করেছে তাহলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি কেন? আর রাবণ তোমাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যেত না। অন্য সময় তোমার কাছে অনেকক্ষণ ধরে প্রেম নিবেদন করে থাকে।আজ তার সময় নেই। যুদ্ধের প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। তাই হে কৌশল বধূ, ভেঙে না পড়ে মন শক্ত কর।তুমি একটু মন দিয়ে শোনো ,লঙ্কার পথে-ঘাটে রাক্ষস সেনার যুদ্ধের প্রস্তুতি শব্দ শুনতে পাবে ।যদি রাম এবং সমস্ত বীর নিহত হত তাহলে যুদ্ধযাত্রা কার জন্য?'
সরমা আমাকে আশ্বাস দিয়ে পুনরায় বলল-' তুমি মনের দুঃখে কোনো অঘটন ঘটাবে বলে আমি দ্রুত তোমাকে কথাগুলো বলতে এলাম। রাবণ যদি জানতে পারে যে আমি তোমার কাছে এসেছি তাহলে আমাকে জীবন্ত রাখবে না। অবশ্য আমি তার মতো পাপিষ্ট একটাকে ভয় করি না। কথাটা বলে সরমা  চলে গেল। আমি ও স্বামী রামচন্দ্রের চরণ চিন্তা করে সুদিনের জন্য পথ চেয়ে রইলাম। সেদিন বিকেলে ত্রিজটা  প্রায় দৌড়ে এল। ত্রিজটার চেহারা দেখেই আমার বুক কাঁপতে লাগল। ত্রিজটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে একনাগাড়ে বলতে লাগল, রাঘব ঘরনী মুহূর্তের মধ্যে যে বড় ঘটনা ঘটল তা দেখে শুনে পেটের মধ্যে আমার হাত-পা ঢুকে যাচ্ছে।শত্রুপক্ষের বীর এসে রাবণের সঙ্গে রঙ চরায় মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে । কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে ত্রিজটাকে জিজ্ঞাসা করলাম –‘কে সেই বীর? আমাকে একটু খুলে বলুন?’
হনুমানের মতোই একজন বাঁদর। নিজেকে কিষ্কিন্ধার রাজা এবং রামচন্দ্রের সেনাপতি সুগ্রীব বলে পরিচয় দিয়েছিল। তারপর ত্রিজটা ইস ইস করে বলল-‘ আমি বলেছিলাম না আমার স্বপ্নের কথা? কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে দেখেছ? রাজাকে একটা সাধারণ বাঁদর দিন দুপুরে চাকর-বাকরের সামনে এভাবে খড়কুটোর মতো প্রহার করল। তারপর ত্রিজটা  ঘটনাটা নিজের চোখে দেখার মতো করে বর্ণনা করে গেল। লঙ্কেশ্বর রঙচরায় বসে শত্রুপক্ষের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিরীক্ষণ করছিল। রংচরা  রাবণের আকাশচুম্বী অট্টালিকার একেবারে শীর্ষে। সেখান থেকে চারপাশটা অনেক দূর পর্যন্ত একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়। বোধহয় রামচন্দ্রের বাহিনী পর্বতের উপরে উঠে লঙ্কা নিরীক্ষণ করছিল। রাবনের দুই পাশে পরিচারিকা সুন্দর পাখা দিয়ে হাওয়া করছিল। মাথায় ছিল রাজমুকুট এবং বিজয় ছত্র। বোধহয়  শত্রুপক্ষ দেখেই চিনতে পারল যে ইনি হলেন রাজা রাবণ। রামচন্দ্রের সেনাপতি সুগ্রীব রাবণকে দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।সুবেল পর্বত থেকে এক লাফে রাবণের রংচরায় এসে পৌঁছাল। তারপর রাজাকে সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করার মতো ঘুসি, লাথি, চর মেরে গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলল। মাথার মুকুট খসিয়ে রাজাকে মাটিতে ছিটকে ফেলল। তারপর সুগ্রীব তর্জন গর্জন করে বলল –‘পাপিষ্ঠ,আমি রামচন্দ্রের মিত্রও,ভৃত্যও। তুই প্রভু রামচন্দ্রকে যত দুঃখ দিয়েছিস ,তোকে আমি আজ এমনিতে ছেড়ে দেব না।আমার হাতে আজ তোর প্রাণ যাবে।’ 
হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে রাবণ কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তিনি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলেন না। পরের মুহূর্তে রাবণ নিজেকে সামলে নিলেন। তখন দুজনের মধ্যে মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হল।দুজনেই সমান শক্তিশালী।তাই চর,ঘুসি,লাথি,কিল সমান তালে চলতে লাগল। দশানন বুঝতে  পারল যে মল্ল যুদ্ধে বশ করা যাবে না। তাই তিনি মায়া যুদ্ধ করতে যেতেই সুগ্রীব পুনরায় এক লাফে সুবেক পর্বতে পৌঁছে গেল।
ত্রিজটার কাছ থেকে কথাগুলি শুনে আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম।মনে মনে ভেবেছিলাম স্বামী রামচন্দ্রের সেনাপতি যদি এই ধরনের চঞ্চল মনের হয় তাহলে বিপদ হবে। হনুমানের মতো সুগ্রীব শক্তিশালী মহাবীর সাহসী হলেও বাঁদর বাঁদরই। তাদের চরিত্রে মাঝেমধ্যে বাঁদরের নিজস্ব প্রকৃতি প্রকট হয়ে ওঠে। তাই সুগ্রীবকে মুখ্য করে সমস্ত বানর সেনাকে স্থিরচিত্ত প্রদান করার জন্য আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানালাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...