বিদেহ নন্দিনী~ ৪১
(৪১)
প্রকাশ্য জনসভায় অপমানিত হওয়ার পরে আমি একটা দুঃস্বপ্নের মতোই তা ভুলতে চেষ্টা করলাম। অবশ্য স্বামী রামচন্দ্র আমার মন থেকে দুঃখ-শোক দূর করে আমাকে প্রফুল্ল রাখার জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করছিলেন। আমিও অন্তরের দুঃখ অন্তরের মধ্যেই লুকিয়ে রেখে স্বামীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলাম। সেই রাতে আমরা সবাই বিভীষণের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। ইতিমধ্যে আমাদের বনবাসের চৌদ্দ বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র চার দিন বাকি ছিল। স্বামী আমাকে অযোধ্যা ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। লক্ষ্মণ লংকা নগরের সৌন্দর্য, কারুকার্য, পরিকল্পনা করে নির্মাণ করা ঘর দুয়ার , অট্টালিকা আর পথঘাট দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি দাদাকে বললেন, দাদা সত্যি কথা বলতে গেলে আমার অযোধ্যা ফিরে না গিয়ে এখানেই থাকতে ইচ্ছে করছে। লক্ষ্ণণের কথায় দাদা কিছুটা আহত হলেন বলে মনে হল। তার মুখের থেকে তখনই দুটি বাক্য বেরিয়ে এল-‘ লক্ষ্ণণ এই স্বর্ণ লঙ্কার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। জননী জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী। স্বামীর এই বাক্য দুইটি আমার অন্তর স্পর্শ করে গেল। স্বামী আমাকে ভরতের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন-‘ আমরা সময়মতো পৌঁছে না গেলে ভরত অঘটন ঘটাবে। তাই আজকেই আমাদের যাত্রা করতে হবে। এদিকে লংকা থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত হেঁটে গেলে চারদিনেও পৌঁছাতে পারব না। তাই বিভীষণ তাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা কুবেরের পুষ্পক রথে যাবার প্রস্তাব দিলেন। সেই পুষ্পক রথ রাবণ কুবেরকে যুদ্ধে হারিয়ে কেড়ে নিয়েছিল। রাঘব বিভীষণের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে পুষ্পক রথ আহ্বান করার সম্মতি প্রদান করলেন। নিমেষের মধ্যে পুষ্পক রথ এসে হাজির হল। এই দিব্যরথ দেখতে অনেকটা একখণ্ড মেঘের মতো। আরোহীর ইচ্ছামতো এটা আপনা থেকেই চলে।
আমাদের অযোধ্যায় ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে দেখে বিভীষণ, বাঁদর, হনুমান এবং সুগ্রীবের মন্ত্রীবর্গও বেরিয়ে এল। আমরা প্রত্যেকেই মনের আনন্দে পুষ্পক রথে বসলাম। সরমা,ত্রিজটা চোখের জলে ভেসে আমাকে বিদায় দিল। স্বামী আমাকে এবং লক্ষ্ণণকে পাশে বসালেন। তিনি রথের উপর থেকে লঙ্কা নগরের সৌন্দর্য উপভোগ করে লক্ষ্ণণকে বললেন-‘ ভাই লক্ষ্ণণ, রাবণ যতই অত্যাচারী হোক না কেন তার রাজ্য এবং প্রজাদের প্রতি থাকা অনুরাগ প্রশংসনীয়। সুনির্মিত নগর, সমগ্র রাজ্যে নির্মল পানীয় জলের ব্যবস্থা, সুন্দর পরিকল্পনায় নির্মাণ করা ঘর দুয়ার, পথঘাট ইত্যাদি তার প্রতিটি দিকে দক্ষতার কথাই প্রমাণ করে। তারপরে স্বামী আমাকে আকাশ থেকে নিচের দৃশ্য গুলি দেখিয়ে বলে যেতে লাগলেন –‘জানকী, ঐ যে ত্রিকুট পর্বত।সমতলের ওই জায়গাটা ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। ওই যে ঢিপিটা দেখছ, সেখানেই আমি দুরাত্মা রাবণকে বধ করেছিলাম। ওই যে বড় রথের চাকাটা পড়ে আছে, সেখানে কুম্ভকর্ণকে বধ করা হয়েছিল। মায়া সীতাকে বধ করে আমাদের মন ভেঙ্গে দেবার জন্য পুজো সম্পন্ন করতে যাওয়া ইন্দ্রজিৎকে ওই গাছের কাছে লক্ষ্ণণ বধ করেছিল।’
তারপরে স্বামী সাগরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন-‘ এই যে বৃহৎ সেতু দেখছ,তা মহাবীর নলের তত্ত্বাবধানে বাঁধা সেতু ।’
সমুদ্রে সেতুবন্ধনের মতো বিস্ময়কর কাজ কীভাবে করতে পারল সে বিষয়ে আমি জানতে চাওয়ায় রাঘব বললেন-' বৈদেহী, হনুমান তোমার খবর দেবার পরে আমি এই কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম যে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সাগর কীভাবে পার হব। ধর্মাত্মা বিভীষণ আমাকে সমুদ্র দেবতার উপাসনা করার জন্য উপদেশ দিয়েছিল । তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে আমাদের বিখ্যাত পূর্বপুরুষ ইক্ষাকু বংশের রাজা সগর সমুদ্রের সৃষ্টি করেছিল। তিনি আমাদের প্রার্থনা নিশ্চয় শুনবেন। আমি সমুদ্রের তীরে সম্পূর্ণ তিনদিন তিনরাত কুশাসনে বসে সমুদ্র দেবতাকে ধ্যান করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হল না। সাগর অশান্ত হয়ে থাকল এমনকি এক একটি ঢেউ আমার কুশাসনকে ভিজিয়ে দিল। আমার সমগ্র দেবতাদের উপরে ভীষণ ক্রোধ জন্মেছিল। তাই হাতে তীর-ধনুক নিয়ে ভাবলাম এই বাণে সমুদ্রের দর্প চূর্ণ করে সমুদ্রের জল শুকিয়ে ফেলব। সাগরের সমস্ত জীব নাশ করব।আমার সৈন্যবাহিনী পায়ে হেঁটে সাগরের নিচ দিয়ে যেতে পারবে। আমার ক্রোধ দেখে সমুদ্রের জীব গুলি আর্তনাদ করতে লাগল। সাগরের জলে বাষ্পীভবন শুরু হল। হঠাৎ সমুদ্রের মাঝখান থেকে সাগর দেবতা বেরিয়ে এসে বললেন-' রঘুনন্দন, তুমি নিশ্চয় জান পঞ্চভূত অর্থাৎ পৃথিবী, আকাশ, জলবায়ু, আগুন, এবং বাতাস সব সময় নিজের স্বাভাবিক রীতি অনুসারে চলে। তার ব্যতিক্রম হয় না। আমি সাগর। আমার নিজের স্বাভাবিক ধর্ম আছে। আমি স্থির হয়ে লঙ্কায় যেতে দিতে পারি না । তাই রাঘব, তুমি জীবজগতে বিশৃংখলার সৃষ্টি কর না। সাগরে সেতু বেঁধে তুমি অনায়াসে সমুদ্র পার হতে পারবে। তোমার সৈন্যবাহিনীতে নল নামে বীর রয়েছে সে প্রকৃতই বিশ্বকর্মার পুত্র। নল পিতার সমতুল্য । সমুদ্র দেবতা এভাবে বেশ কিছু উপদেশ দিয়ে যুদ্ধজয়ের কামনা করে অন্তর্হিত হলেন ।
কথাটা বলে স্বামী কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করলেন। তারপর পুনরায় বললেন-' বুঝেছ জানকী,একশো যোজন দীর্ঘ এই পথটি দশ যোজন প্ৰস্থ হিসেবে নিয়ে নীল বাঁদর এবং ভালুক সেনার সাহায্যে নির্মাণ করে ফেলল । বিশাল শিলাখণ্ড ছাড়া ও সমস্ত ধরনের গাছ পেতে দিল সেই পথে।
তারপর স্বামী একটুকরো অপূর্ব জায়গা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন-' ওই যে গাছ বনে পরিপূর্ণ হয়ে থাকা নগরটা দেখতে পাচ্ছ সেটাই কিষ্কিন্ধানগর। পাশে সেই প্রস্রবনগিরি। তারই একটি গুহায় বর্ষাটা পার করেছি। ওই যে পাথরটা দেখছ, আমি তার উপরে বসে তোমার কথা ভেবে ম্রিয়মান হয়ে ছিলাম।'
এদিকে কিষ্কিন্ধা নগরের নাম শুনে আমার একবার মহারানী তারাকে দেখার ইচ্ছা হল। হনুমানের মুখে তারা সম্পর্কে এত কিছু শুনেছি যে একবার তাকে দেখার আগ্রহ জন্মাল । তাছাড়া আমার স্বামী যেহেতু বালীকে অন্যায় ভাবে বধ করেছে, তাই তারার সঙ্গে দেখা করে যাওয়া আমার নৈতিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করছি। তাই আমার ইচ্ছার কথা স্বামীকে ব্যক্ত করায় তিনি সানন্দে আমার প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করলেন। বানর রাজা সুগ্ৰীব ও আমার ইচ্ছায় অতিশয় আনন্দিত হলেন। আমরা সকলেই কিষ্কিন্ধায় নামলাম।
মহারানী তারা আলাদাভাবে সকলকে সম্ভাষণ জানালেন । সুগ্রীবের পত্নী রুমা সহ প্রতিটি মহিলাই আমাদের খুব আদর যত্ন করলেন। রুমা সারারাত আমাদের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দিলেন। আমার বিরহে রাঘব কীভাবে কাটিয়েছিল সেই বিষয়েও বললেন। পুনরায় অযোধ্যা থেকে কিষ্কিন্ধায় আসার সময় সেদিনই স্বামী অঙ্গদকে যুবরাজ বলে ঘোষণা করলেন।
পরের দিন আমরা সকালে পুনরায় যাত্রা আরম্ভ করলাম। আমাদের সঙ্গে রুমা এবং আরও কয়েকজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। স্বামী আমাকে আগেরবারের মতোই পাশে বসিয়ে জায়গো গুলি দেখিয়ে যেতে লাগলেন-' বৈদেহী,ওই যে পর্বতটা দেখছ, সেটাই ঋষ্যমুক পর্বত। সেখানেই মিত্র সুগ্রীবের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল।' পম্পা সরোবরের কাছে পৌঁছাতেই স্বামী আমাকে সরোবরের সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করতে দিয়ে বললেন-' বৈদেহী পম্পা সরোবরের সৌন্দর্য মানুষের ক্ষুধা তৃষ্ণা হরণ করে। এই সরোবরের পারে আমি তোমার বিরহে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ফেলেছিলাম। এখানেই আমি ধর্মপরায়ণ শর্বরীর দর্শন লাভ করেছিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে স্বামী পুনরায় আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন -'জানকী , চিনতে পারছ কি ওই জায়গাটায় আমাদের আশ্রম ছিল। ওই যে আমাদের পর্ণকুটির। গোদাবরী নদী। এখান থেকেই দুরাত্মা তোমাকে হরণ করেছিল। এটা মহর্ষি অগ্যস্ত মুনির আশ্রম। আমরা ঋষিকে দর্শন করার কথা মনে আছে কি? ওই দিকে তাকিয়ে দেখ, অত্রি মুনির আশ্রম বলে চিনতে পারছ কি ?সেখানে মাতা অনুসূয়া তোমাকে স্নেহে আদরে আপ্লুত করে তুলেছিল। অলংকার এবং সাজপোশাকে তোমাকে সাজিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে ছিল, বৈদেহী তোমার মনে আছে কি?
কিছুটা দূরে যাবার পরে স্বামী পুনরায় বললেন -'জানকী এই পর্বতটা কি চিনতে পারছ? গিরিরাজ চিত্রকূট। এখানে ভরত এসেছিল আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। ওই যে যমুনা নদীর তীরে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম।এখানে আমরা এক রাত কাটিয়ে ছিলাম। আজও আমরা এখানে এক রাত কাটাব। মুনির কাছ থেকেই রাজ্যের সমস্ত সংবাদ নেব।ভরতের আমাদের প্রতি যদি আগের স্নেহ অটুট আছে বলে জানতে পারি তাহলে অযোধ্যায় প্রবেশ করব, না হলে ফিরে যাব। ক্ষীণ ধারার মতো যা বয়ে যেতে দেখছ সেটাই গঙ্গা নদী। তার তীরে নিষাদ রাজ গুহর শৃঙ্গবেরপুর। গাছটার নিচে আমরা রাত কাটিয়ে ছিলাম মনে পড়ছে। এরপরে আমরা পাব সরযূ নদী। তার তীরে আমাদের রাজ্য অযোধ্যা। তবে আমরা এখন ঋষির আশ্রমের একটু আগে গিয়ে নামব। '
আমরা আশ্রম থেকে বেশ কিছুটা দূরে রথ থেকে নেমে আশ্রমের অভিমুখে হাঁটতে লাগলাম। ঋষি ভরদ্বাজকে যাওয়ার সময় যে চেহারায় দেখে ছিলাম এখন চৌদ্দ বছর পরেও সেই একই চেহারা দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমরা ঋষিকে প্রণাম জানালাম। মুনি ভরদ্বাজ চৌদ্দ বছর বনবাস সম্পূর্ণ করা সাধারণ কাজ নয় বলে আমাদের আশীর্বাদ দেওয়ার সঙ্গে একটা বর দিতে চাইলেন।স্বামী হাতজোড় করে বললেন-' প্রভু আপনি যদি বড় দিতে চাইছেন, তাহলে এই বর দিন যাতে অযোধ্যায় যাওয়ার পথে বিপরীত আবহাওয়াতেও গাছগুলি সুস্বাদু ফলে ভরে ওঠে। মৌচাক গুলি যেন অনবরত রসে ভরপুর হয়ে থাকে।'
ঋষি তথাস্তু বলে আশীর্বাদ করলেন।
আমরা মুনির কাছ থেকে অযোধ্যার সমস্ত খবর পেলাম।বিশেষ করে ভরত কঠোর ব্রতের মধ্য দিয়ে কীভাবে সুচারুরূপে রাজ্য শাসন করছে সেকথা মুনি বড় আনন্দের সঙ্গে বললেন। ভরতের ভ্রাতৃ ভক্তির কথা বিভীষণ, হনুমান, এবং সুগ্রীবের মন্ত্রী প্রত্যেকেই গল্প শোনার মত স্বামীর কাছ থেকে শুনল। স্বামী ঋষির কাছ থেকে সমস্ত কিছু শুনে আশ্রম থেকেই নিষাদ রাজ গুহ এবং ভরতকে বার্তা পাঠালেন যে বর্তমানে আমরা রাজ্যের সীমানায় রয়েছি। সকালে অযোধ্যায় প্রবেশ করব। সেই রাতে আমরা সকলেই ভরদ্বাজ মুনির আতিথ্য গ্রহণ করলাম। পরের দিন সকালে মুনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রথে উঠলাম। অযোধ্যার অভিমুখে । স্বামী বাঁদর বীরদের মনুষ্য রূপ ধারণ করে রথে ওঠার নির্দেশ দেন।
রাঘব আমাকে রথের উপর থেকে সরযূ নদী দেখিয়ে বললেন -'জানকী,আমরা এখন অযোধ্যার মধ্যে প্রবেশ করব। তাই মাতৃভূমিকে প্রণাম জানাও। আমরা প্রত্যেকেই রথের উপর থেকে অযোধ্যা নগরকে প্রণাম জানিয়ে রাজ্যের সৌন্দর্য নয়নভরে দেখলাম ।এমনিতেই অযোধ্যা সুন্দর এবং সমৃদ্ধশালী, তারমধ্যে এখন আমরা আসব বলে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে । যেদিকেই তাকাই সেদিকেই জাঁকজমক।
স্বামীর নির্দেশে পুষ্পক রথ মাটি স্পর্শ করল। ভরত এগিয়ে এসে আমাদের রথের ভেতরে সম্ভাষণ জানাল। দাদা রামচন্দ্রের চরণে মাথা রেখে তিনি চোখের জলে ভাসলেন। স্বামী ভরতকে রথের মধ্যেই জড়িয়ে ধরে নিজের কোলে বসিয়ে নিলেন।তারপর মানুষের রূপে আসা বীরদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য নতুন করে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল।কুলু গুরু বশিষ্ঠ সহ, রাজ্যের শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, পন্ডিত ,মন্ত্রী ,তিনজন মাতা ,দুই ভাই, তিনজন জা, বিখ্যাত শিল্পী, শ্রেষ্ঠ বৈদ্য, শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী ,প্রত্যেকেই এগিয়ে এসে পুষ্প মালা আর মিষ্টির ভাঁড় সহ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। অভ্যর্থনার কাজ শেষ হওয়ার পরে সুসজ্জিত চতুরঙ্গ সেনা, গায়ক বাদক, বিভিন্ন নর্তকীর দল, আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেল। ভরত দাদাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য খড়ম মাথায় করে নিয়ে এসেছিল। তারপরে হাঁটু গেড়ে খরম জোড়া স্বামীর পায়ে পরিয়ে দিয়ে বলেছিল -'হে নরশ্রেষ্ঠ ভ্রাতা রাম, এই খড়মজোড়া তোমার চরণে পুনরায় পরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে এই বিশাল রাজ্য, রাজপাট সমগ্র দেশবাসীর সামনে আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম। ধনবল,সৈন্য বল সহ সমস্ত সম্পদ আপনি যাবার সময় থেকে দশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি আপনার দায়িত্ব পালন করে এখন কার্যভার আপনাকে অর্পণ করতে পেরে অত্যন্ত সুখী হয়েছি।'
আমরা ভরত শত্রুঘ্নকে রথে উঠিয়ে প্রথমেই গেলাম ভরতের আশ্রম নন্দীগ্রামে। মহাত্যাগী ভরত কী কঠোর ব্রতের মধ্য দিয়ে চৌদ্দ বছর সম্পন্ন করলেন তা স্বচক্ষে দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। আমাদের সঙ্গে আসা বীর অতিথিবৃন্দ ভরতের ভ্রাতৃভক্তি এবং দেশপ্রেম দেখে কেঁদে ফেলল। কিছুক্ষণ নন্দীগ্রামে থেকে আমরা পুনরায় অযোধ্যায় ফিরে এলাম।
আমাদের সঙ্গে আসা অতিথিদের পৃথক পৃথকভাবে থাকার ব্যবস্থা করার জন্য শত্রুঘ্ন মান্ডবী এবং শ্রুতকীর্তি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। উর্মিলা যদিও সব সময় মান্ডবী এবং শ্রুতকীর্তির সঙ্গে ছিল, তার যেন কোনো কিছুতেই উৎসাহ, আগ্রহ, আন্তরিকতা নেই বলে মনে হচ্ছিল। আমাকে অভ্যর্থনা ইত্যাদি সমস্ত কাজ যন্ত্রের মতো করে যাচ্ছিল। উর্মিলাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল যেন সে ভালোবাসা, স্নেহ, অনুভূতি থাকা কোনো জীব নয়। একটি জীবিত পদার্থ মাত্র। ভরত বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সমস্ত শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত, মন্ত্রীদের এবং বন্ধুবর্গ কে একত্রিত করে দাদা রামচন্দ্র কে বিনতি জানালেন-' হে পূজনীয় শ্রেষ্ঠ ভ্রাতা রামচন্দ্র, আমি আগেও বলেছিলাম এবং এখন ও বলছি এই বিশাল রাজ্য সামলানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই আমি গুরু, পন্ডিত, মন্ত্রী, মাতা,ভ্রাতা, মিত্র সবার সামনে পুনর্বার বলছি আপনার অভিষেক আগামীকাল সম্পন্ন করতে হবে। তাই আপনার মুখে তথাস্তু শুনতে চাইছি।
রাঘব সম্মতি প্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে সবাই জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। আমাদের দেখতে আসা অগণন মানুষের মধ্যে আনন্দধ্বনি সমগ্র অযোধ্যা নগরকে মুখরিত করে তুলল। পুনরায় মানুষ গুলির মধ্যে ব্যস্ততা আরম্ভ হল। দাদা ভাই তিনজনের জটার ভার খসিয়ে স্নান করার কার্য দেখার জন্য অনেক লোক সমবেত হল।
এদিকে বাঁদর বীর সেনাদের মধ্যে আনন্দের আর সীমা ছিল না। তাঁদের প্রভুর অভিষেক। ভরত অভিষেকের জন্য বিভিন্ন ঘাটের জল আনতে তাদের দায়িত্ব দিল। কুলগুরু বশিষ্ঠ স্বামীর সঙ্গে আমাকেও মন্ত্র পাঠ করালেন।মহিলাদের হাসি ফুর্তির মধ্যে আমাকে স্নান করিয়ে মহারানীর সাজ পোশাক পরিয়ে স্বামীর কাছে বসালেন। পরম আনন্দের মধ্য দিয়ে অভিষেক কার্য সম্পন্ন হল । ছিন্নভিন্ন হওয়া পরিবারটা পুনরায় একতার বন্ধনে বাঁধা পড়ায় আমার আনন্দের আর সীমা রইল না।
একটি রাজ্য থেকে রাজা দীর্ঘদিনের জন্য দূরে থাকাটা মঙ্গল জনক নয় । তাই আমাদের সঙ্গে আসা অতিথিবৃন্দকে কিছুদিন আনন্দ আহ্লাদের মধ্যে রেখে স্বামী নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন।সবাইকে পুনরায় দেখা হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বামী নিজেও রাজকার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চারপাশ থেকে কোশল রাজ্যকে উন্নতির শিখরে অবতীর্ণ করানোর সংকল্প নিয়ে রাঘব রাজ্যশাসনে মনোনিবেশ করলেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন